বেলীফুল পর্ব-৩২

0
1020

#বেলীফুল
পর্ব- ৩২

কথাটা যখন শুনল, মৌরির মনে হলো তার হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। আবার যখন হৃৎপিণ্ড সচল হলো, সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বাবার সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে গেল। পুরো শরীরে মনে হচ্ছে রক্ত চলাচল অতি দ্রুত হয়ে উঠেছে। কেমন যেন কাঁপুনি লেগে যাচ্ছে। বাগান থেকে দমকা হাওয়ার সাথে আসা মিষ্টি ফুলের সুবাস অস্থির করে তুলছে তাকে। বাবা কি সত্যি কথা বলছেন? ওই দেবদূতের মতো আশ্চর্য মানুষটা তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে? এটা কি সত্যি?

অনেকটা সময় মৌরি স্তব্ধ হয়ে বসে রইল শুধু কথাটা বিশ্বাস করার জন্য। যে কথাটা সে নিজের কাছেও এতদিন স্বীকার করতে লজ্জা পেত, সেটাই কথাটাই ছায়ার রূপে প্রকট হয়ে উঠেছে তার সামনে। বলে উঠছে, মৌরি তুমি ভালোবাসো ওই মানুষটাকে। ঠিক যেদিন সে তোমার হয়ে লড়েছিল সেদিন থেকেই। তোমার জীবনে অনেক কাদাপানি লেগে যাওয়ার পরেও, অনেক বড় আঘাত লাগার পরেও তোমার যত্ন করে গড়া কোমল মনটা নষ্ট হয়ে যায়নি। সেটা যার জন্য তুলে রেখেছিলে তাকেই দিতে পেরেছ। আর সেই মানুষটাই তোমাকে চাইছে। তুমি কি সৌভাগ্যবতী মৌরি!

অনেক সময় পার হলো। সিরাজউদ্দীন সাহেব অধৈর্য হয়ে উঠলেন, তবু মেয়েকে আর কিছু বলতে পারলেন না। মৌরি রাজি না হলে তিনি খুবই কষ্ট পাবেন। কিন্তু মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। তিনি পায়চারি করতে থাকলেন ক্রমাগত।

রাতে খাওয়ার সময় বাবা মেয়ের দেখা হলো। মৌরি হাতমুখ ধুয়ে নিজেকে সামলে অনেকটা ধাতস্থ হয়ে এসেছে। টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে প্রস্তাব কে দিয়েছে বাবা?”

“সাজিদের বাবা।”

“আর উনি রাজি?”

“রাজি না হলে কি আর তার বাবা আমাকে ওকথা বলত?”

“আমাকে তো কিছু বলল না।”

“হয়তো মনে হয়েছে বড়দের মাধ্যমে কথা হোক। খুবই ভদ্র আর সমঝদার ছেলে। এমন ছেলে এখন পাওয়া যায় ক’টা!”

মৌরি আর কিছু না বলে খাওয়া শেষ করল। বুঝল বাবা বারবার আঁড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছেন। অপেক্ষায় আছেন তার সিদ্ধান্ত শোনার জন্য। বাবাকে আর অপেক্ষা করানো ঠিক হবে না। মৌরি বরাবরই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে জানে। তার কাছে কোনো বিষয় নিয়ে বেশি ভাবাভাবি অযৌক্তিক মনে হয়। নিজের কাছে সে পরিষ্কার। সাজিদকে তার ভালো লাগে। এটা নিয়ে আরও বছরখানেক ভাবলেও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে না। তাই খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় বলল, “তাদের ‘হ্যাঁ’ বলে দিও। আমার আপত্তি নেই।”

***

বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। কোয়েলরা খুব বেশিদিন থাকবে না। তার ওপর কানন আর ইলার কাজকর্ম দেখে অভিভাবকরা ঠিক করেছে বিয়ে শিগগির দিয়ে ফেলাই ভালো। কোয়েলসহ কাননের আরও কিছু আত্মীয় ইলাদের বাসায় একদিন বিয়ের এলেন দিন তারিখ ঠিক করতে। ইলার পুরো পরিবারটাকেই কোয়েলের বেশ পছন্দ হলো। বিশেষ করে ইলার মাকে।

ধীরে ধীরে কেনাকাটা করে ফেলছে তারা। প্রতিদিনই শপিংমলে যেতে হচ্ছে। একটা বিয়েতে এত জিনিস লাগে কে জানত! কোয়েল প্রায়ই একেবারে হাঁপিয়ে যায়। বলে, এই গরমে আমি আর পারব না! যদিও তারপরের দিন সেই সবার আগে তৈরি হয় মার্কেটে যেতে।

কাননের চাকরিটা ভালো। নিজের তেমন খরচ ছিল না তার, তাই ক’বছরে যথেষ্ট টাকা জমেছে। খরচ করছে তাই হাত খুলে।

দুই ভাইবোন আংটি কিনতে গেল একদিন। স্বর্নের ভারী একটা আংটি পছন্দ হলো কোয়েলের। সুক্ষ্ম কারুকাজ করা তাতে। কানন কিন্তু পছন্দ করতে পারল না সেটা। ইলার গায়ের রঙ একটু তামাটে। আংটিটা দেখতে ভালো হলেও ইলার সরু লম্বাটে আঙুলে ঠিক ভালো লাগবে না। কানন বলল, “এটা না আপা, ওই আংটিটা দেখো!”

কোয়েল দেখল পাথর বসানো অল্প কাজ করা আংটি। সুন্দর, তবে বিয়ের জন্য চলে না। বলল, “ওটা পছন্দ হলো কেন?”

“ইলার হাতে এটা মানাবে না।”

কোয়েল হেসে বলল, “সরাসরি বলিস না কেন বউকে হীরের আংটি দিতে চাস?”

“এই না..ওটা কি হীরের নাকি?”

“না, কিন্তু চাইছিলি তো হীরে কিনতে।”

“না আমি চাইছিলাম…”

“বুঝেছি। চল ডায়মন্ডের দোকানে যাই। বিয়েতে এত সিম্পল আংটি দিলে পাত্রীপক্ষ কী ভাববে? তবে পাথরটা হীরে হলে আর কথা থাকবে না। বুঝিস না তো কিছু। গাধা একটা!”

পাশেই হীরের গয়নার দোকান ছিলো। দেখা গেল সেখানে তিরিশ পার্সেন্ট ছাড় দিচ্ছে। ঢুকে গেল তারা। সারি সারি আংটির মাঝে একটা আংটি কাননের চোখে লেগে গেল। চারপাশে ছোট ছোট পাথরের বৃত্তের ভেতর একটু বড় একটা পাথর। অন্যগুলোর থেকে পার্থক্য হলো হীরের রঙটা একটু হলদেটে। বেশি সুন্দর। দামও বেশি। কিন্তু কাননের আর কোনোটাই ভালো লাগল না। অগত্যা সেটাই কেনা হলো।

দোকানি বললেন, “আপনাদের আগে আরেকজন কাস্টোমার এসে এই আংটিটাই পছন্দ করেছিলেন। শেষে দামে না মেলায় নিলেন না। আসলে আপনাদের কপালে ছিল জিনিসটা।”

কাননদের আগে আসা কাস্টোমারটি ছিল সাজিদ। মৌরির জন্য আংটি কিনতে এসেছিল সে। কিন্তু কেন যেন বারবার ইলার কথা মাথায় আসছিল। আংটি কিনতে এসেও ইলার হাত মনে পড়ে যাচ্ছিল। মৌরির হাত কেমন কে জানে! খেয়াল করে দেখা হয়নি৷ আংটির সাইজ জেনে নিয়েছে শুধু।

হীরের দোকানেই প্রথম এসেছিল সে। ইলার কথা ভেবেই সেই আংটিটা পছন্দ করেছিল। দাম বেশি বলে কিনল না। দোকান থেকে বের হয়েই মনে হলো, আংটিটা সে মৌরির জন্য কিনবে, ইলার জন্য না।

মৌরিকে মেসেজ করল, “নিজের হাতের একটা ছবি দিন তো।”

মৌরি একটু পরেই হাতের ছবি পাঠালো। সুন্দর সুগঠিত ফর্সা আঙুল। যে কোনো আংটি পরলেই দারুণ লাগবে। সাজিদ স্বর্নের দোকান থেকে সুক্ষ্ম কাজ করা ভারী দেখে একটা আংটি কিনে ফেলল।

***

তুলন এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। ইলাদের ফ্ল্যাটে প্রায়ই আসে। বিয়ের কাজকর্মে হাত লাগায়। আর সময় পেলেই আফসোস করে বলে, “বিয়ে হওয়ার কথা ছিল আমার, হচ্ছে তোর!”

ইলা ইদানীং কথাবার্তা কম বলে। তার সবকিছুতেই কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। তুলনের কথার জবাবে সে কিছুই বলে না।

এনগেজমেন্টের দিন সকালে ইলাকে নিয়ে পার্লারে গেল তুলন। এর আগেও ক’দিন পার্লারের চক্কর কাটতে হয়েছে ইলার। বলা যায় বাধ্য হয়ে কোয়েলের জোরাজুরিতে। অবশ্য তাতে লাভ হয়েছে, ইলার রূপ খুলে গেছে বলা যায়। ওর চুলগুলো আগেই সিল্কি ছিল, সেটা রিবন্ডিং করে এখন একেবারে চকচকে দেখায়। স্টেপ কাট দেয়ার কারনে সেগুলো থরে থরে সাজানো থাকে, ভীষণ সুন্দর দেখতে লাগে। হাত-পা মেনিকিউর পেডিকিউর করে সুন্দর হয়ে উঠেছে। আজ গোল্ড ফেশিয়াল করে যখন উঠল, আয়নার দিকে তাকিয়ে ইলার মনে হলো সে আসলে দেখতে সুন্দরই। এতদিন যত্নের অভাবে ভূতকন্যার মতো দেখতে লাগত।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here