বেলীফুল পর্ব-৪

0
1316

#বেলীফুল
পর্ব-৪

কানন হাঁটছিল ঢিমেতালে। রিকশা থেকে গা বাঁচিয়ে, পথের ধুলাবালি মিশ্রিত আবর্জনা একধারে রেখে হেঁটে চলেছিল বেখেয়ালে। চারধারে কোলাহলের মাঝে জীবনের গন্ধ পাওয়া যায় যেটা কাননের কী ভালো লাগে! অফিস ফেরত লোকেদের দোকানে দাঁড়িয়ে দরদাম করে বাড়ির জন্য কিছু নেয়ার তাগিদ কিংবা কোনো বাচ্চার কান্না অথবা চায়ের দোকানের রাজনৈতিক আলাপ সালাপ। তবু কেন বাঁচতে ইচ্ছে হয় না তার? এই পৃথিবীতে তার বাঁচার কোনো কারণ নেই বলেই? তাই বা থাকবে না কেন? সবার তো আছে!

একটা নতুন দোকানে রং করা হয়েছে। রং এর গন্ধ তার এত ভালো লাগে যে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়ল। একটু পরেই পেছন থেকে কারো ডাক শুনে ফিরে তাকাল সে। চারপাশে দোকানের আলো অন্ধকার কমিয়ে দিয়েছে। তবু আবছা চারপাশ। আলোছায়ার মাঝে নারীমূর্তিটি বেশ রহস্যময় বলে মনে হলো কাননের। মানুষটিকে চিনতে অবশ্য দেরি হলো না, ইলা। ইলাকে আজকে সুন্দর লাগছে। এমনিতে বাচ্চা মেয়ে মনে হলেও আজ মনে হচ্ছে পরিণত এক নারী।

ইলা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “দৌড়ে এসেছি।”

“কোন দুঃখে?”

“আপনার সাথে ঘুরব।”

“এই রাতে? লোকে দেখলে আর মান সম্মান কিছু থাকবে?”

“কোন লোক আমাদের চেনে? এই শহরে কে কী করছে অন্য কেউ চেয়েও দেখে না। নিন না আমাকে সাথে…”

কানন প্রাণপণে চাইছিল এই আপদ থেকে দূরে থাকতে, কিন্তু এখন কী মনে করে বলল, “চলুন। কিন্তু ডিসটার্ব করলে রাস্তায় ফেলে চলে যাব।”

“আচ্ছা। আমি তখন বাসায় চলে যাব।”

“উফ! চলুন।”

“আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন?”

“জাহান্নামের চৌরাস্তা খুঁজছি।”

“খুঁজে পেলে?”

“চলে যাব।”

ইলার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। এই লোক খালি মরার কথা বলে। সমস্যা কী?

কাননের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ইলার খুব ইচ্ছে হলো ওর হাত ধরতে। কিন্তু বলার বা করার সাহস পেল না। নিজেকে মাঝে মাঝে একেবারে নির্লজ্জ মনে হয় কিন্তু দূরে থাকতে পারে না।

রাতের বেলাতেও পার্কে মানুষজন আছে। বোধহয় গরমে বের হয়ে এসেছে তারাও। লেকের পাশে মোটামুটি নির্জন জায়গায় আধভাঙ্গা সিমেন্টের বেঞ্চে বসল তারা।

কাননই প্রথমে কথা বলল, “আপনার মা বাবা বাসায় নেই?”

“না। আরেকটু পর আসবে।”

“যদি জানতে পারে কোনো ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি করছেন তাহলে কী হবে?”

“ঘোরাঘুরিই তো করছি, প্রেম করছি না।”

কানন খুবই বিরক্ত হয়ে বলল, “আপনি কি এত বড় মেয়ে হয়েও বুঝতে পারেন না, সব ছেলে কি সাধু? যদি আপনার ক্ষতি করে দেই? তাও আবার এসেছেন পার্কে, রাতের অন্ধকারে।”

ইলা হেসে বলল, “আপনি ভালো মানুষ সেটা জেনেই এসেছি।”

কানন জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করল না যে সে ভালো মানুষ এটা ইলা কেমন করে জানল। উল্টে বলল, “আপনি জানেন আমি একটা খুব ভালো চাকরি করতাম আগে সেটা চলে গেছে কেন?”

ইলা চোখ গোল করে তাকাল কাননের দিকে। “কবে যেন বলেছিলেন আপনার জীবনবৃত্তান্ত? ও হ্যাঁ স্বপ্নে! কিন্তু ভুলে গেছি আমি।”

কানন ঠাট্টা কানে না তুলে বলল, “আমি কোম্পানির টাকা চুরি করেছিলান৷ একটু একটু করে এক বছরে আঠারো লক্ষ টাকা চুরি।”

ইলা হতভম্ব হয়ে গেল। বলে ফেলল, “যা! মিথ্যে কথা!”

“সত্যি! এখন বলুন আমি ভালো মানুষ?”

“হ্যাঁ।”

“কীভাবে?”

“আপনি চুরি করেননি। আর যদি করেও থাকেন তাহলে সেটা খুব জরুরি কারণ ছাড়া না।”

“এত বিশ্বাস কোথা থেকে পেলেন?”

“আমার দাদী সবসময় বলত মানুষ দেখে ভালোমন্দ বোঝা যায়। আমার দাদা ছিল গ্রামের মেম্বার। তার কাছে দুনিয়ার লোকজন আসত। দাদী আড়াল থেকে তাদের দেখাত আর বলত আমাকে। যে খারাপ কাজ করেছে তার ভাবভঙ্গি থাকে চোরের মতো, এরা সরাসরি চোখের দিকে তাকায় না। যারা বদ লোক তারা হয় শয়তানের প্রতিচ্ছবি, এদের হম্বিতম্বি দেখার মতো! কিছু আছে অতিরিক্ত মিষ্টি করে কথা বলে। এরা আরও খারাপ। আপনাকে এক হাঁটে বেঁচে আরেক হাঁট থেকে কিনে আনবে বুঝতেও পারবেন না। আর যারা ভালো লোক তারা উদাস স্বভাবের হয়। সাতে পাঁচে থাকে না, জটিল চিন্তাভাবনা নিয়ে ঘোরে না। যেমন আপনি। আরও অনেক রকম সকম আছে। অরেকদিন সময় করে বলব।”

“তোমার দাদী কি গ্রামে থাকে?”

“না। মারা গেছেন অনেকদিন আগে। দাদা দাদী দুজনেই। এসব পরে বলব। আগে আপনার কাহিনী শেষ করেন।”

“কোন কাহিনী?”

“ওইযে চুরির দোষ দিল তারপর?

“তারপর চাকরি চলে গেল।”

“তারপর?”

কানন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমাকে জেলে দিতে চেয়েছিল। তবে তার আগে আমার বাবা অফিসে টাকাগুলো দিয়ে দেয়। তাই আর কেস করেনি তারা। কিন্তু আমি করেছিলাম৷”

“কেন?”

“চুরি করিনি বলে। অবশ্য প্রমাণ আমার বিপক্ষে ছিল।”

ইলা প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “এইত্ত! ঠিক ধরেছিলাম আমি।”

“কিন্তু তারপর এলাকায় জানাজানি হয়ে যায় ব্যাপারটা। আমার বাবা এমনিতেই অপমানে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন, তারপর সবাই জেনে যাওয়াতে আরও ভেঙে পড়েছিলেন। সেই থেকে অসুস্থ হয়ে গেলেন, আর এক রাতে হার্ট অ্যাটাকে মরেই গেলেন।”

ইলা চুপটি করে কিছুক্ষণ থেকে বলল, “তিনি কি বিশ্বাস করতেন না আপনাকে?”

“জানি না। সেই অপরাধবোধই আমাকে শেষ করে দিচ্ছে!”

“কিন্তু আপনি তো অপরাধ করেননি।”

“না করলেও মা বাবা আমার কারণেই মারা গেছে সেটা অস্বীকার করা যাবে?”

“মা ও?”

“হ্যাঁ। বাবার এক সপ্তাহ পরে। শুধু আমাকে রেখে গেছে মরতে।”

“কেসের ফলাফল কী হয়েছিল?”

“আমি জিতেছিলাম। আসল অপরাধী ধরা পড়েছিল। কিন্তু ততদিনে আমার সব শেষ।”

“আর এজন্য আত্মহত্যা করতে চান?”

“আমি আসলে বাঁচতে চাই না। প্রতিটা দিন বোঝার মতো মনে হয়।”

ইলা কিছু বলতে চেয়েও বলল না৷ বুঝতে পারছে, এই দীর্ঘদিনের অবসাদ অল্প কিছু সান্ত্বনার বাক্যে এক বিন্দু কমবে না। লোকটার পাশে থেকে তাকে বোঝাতে হবে জীবনটা সৃষ্টিকর্তা মরার জন্য দেয়নি। তার প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনে কারণ থাকে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here