বেলীফুল পর্ব-৬

0
1242

বেলীফুল
পর্ব-৬

রইসুদ্দিন প্রতিদিনের মতো সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে বাসার প্রতিটা জানালার পর্দা ভালো করে টেনে দিলেন। তার ঘরের ফার্নিচারের মতো জানালার পর্দাগুলোও কালো রঙের। বারান্দার দরজা তিনি খোলেন কালেভদ্রে। পূবের জানালার পর্দা ভেদ করে বসার ঘরে খানিকটা যে আলো আসে তাও তার পছন্দ নয়৷ তিনি নাস্তা করেন নিজের শোবার ঘরের খাটে বসে। নাস্তা হিসেবে তিনি খান পাউরুটি। একটা পাউরুটির চারকোণা ছেটে তার ওপর পুরু করে মাখন মসৃণভাবে মেখে নিয়ে সেটাকে আরেকটা পাউরুটি দিয়ে চাপা দিয়ে খান। সাথে থাকে ঘন দুধের চা। দুধটা গরুর দুধ নয়, মহিষের দুধ, যেটা তার জন্য স্পেশাল অর্ডার দিয়ে আনা হয়। প্রায়ান্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। বিড়ালের মতো দিন দিন যেন তার চোখের জ্যোতি বেড়ে রাতে দেখার ক্ষমতা চলে আসছে। আঁধারেও দিব্যি সব করে ফেলেন। খাওয়া শেষে তিনি বসেন রকিং চেয়ারে। দোল খেতে খেতে এক..দুই..তিন গুনতে শুরু করেন৷ প্রতিদিন ঠিক চল্লিশ পর্যন্ত গোনার পরেই তার ছেলে ফোন করে৷ তিনি ধরেন৷ তাদের কথাও হয় এলোমেলো। একেকদিন একেক কথা। রইসুদ্দিন জানেন একমাত্র তার ছেলে তাকে খানিকটা বুঝতে পারে বা বোঝার চেষ্টা করে। তবে তিনি চান না ছেলে তার সাথে এই অসুস্থ পরিবেশে থাকুক। তার ইচ্ছে ছেলে যেন আর দশটা মানুষের সাথে মিশে চলতে পারে, খুব ভালো একটা মেয়ের সাথে যেন ছেলের বিয়ে হয়, বিয়ের পর ফুটফুটে ছেলেমেয়ে হয়।

আজ ফোনটা এলো তিনি পয়তাল্লিশ গোনার পর।

“হ্যালো।”

“বাবা জানো কী হয়েছে?”

“কী?”

“আমার কোয়ার্টারের ছাদের পাশে ছোট্ট একটা চিলেকোঠার মতো আছে। তাতে বাসা বেঁধেছে অনেকগুলো চড়ুই পাখি।”

“চড়ুই সবার বাড়িতেই সুযোগ পেলে বাসা বানায়। এতে এত খুশি হওয়ার কী আছে?”

“পুরোটা শোনো আগে। তোমাকে বলেছিলাম আমার কোয়ার্টারের ডানে একটা পুকুর আছে। সেটার পাশে লম্বা তালগাছ।”

“হুম।”

“তাতে আবার কয়েকটা বাবুই পাখির বাসা।”

“বাহ।”

“আমি সকালে উঠে দেখি চড়ুই আর বাবুই দুই পক্ষই সমানে চেঁচামেচি করে যাচ্ছে।”

“তো?”

“উফ বাবা তুমি ছোটবেলায় কবিতাটা শিখিয়েছিলে, বাবুই পাখিরে ডাকিয়া কহে চড়াই…”

“হ্যাঁ। পাখিরা কি সেই কবিতা বলছিল?”

“পাখিরা কেন কবিতা বলবে? আমিই বলছিলাম। পাখিরা শুনল না। তবে আমার মনে হয় ওরা এই বিষয়েই ঝগড়া করছিল।”

“ধুর বোকা।”

সাজিদ হাসতে হাসতে বলল, “তায়িফ চাচাও আমাকে বোকা বলেছে আজ।”

“কেন?”

“আমি শোল মাছ চিনি না দেখে। উনি মাছ কুটছিল, আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করেছি এটা কী মাছ তেলাপিয়া?”

রইসুদ্দিনের হাসি পেল। কিন্তু হাসলেন না তিনি। ছেলেটা তাকে হাসানোর কত চেষ্টা করে, তিনি সাড়া দেন না। মাঝে মাঝে মনে হয় তার মতো পাগল এত ভালো ছেলের বাবা হওয়া যোগ্য না৷ তিনি ফোন রেখে দিলেন। কথাবার্তা অর্ধেক হতে না হতেই তিনি ফোন রেখে দেন। ছেলের আগে অনেক মন খারাপ হতো, এখন হয় কি না কে জানে!

সাজিদ ফোনের দিকে হতাশ চোখে চাইল। বাবাকে বলার জন্য সে অনেক কথা জমিয়ে রাখে যেগুলো বলার সুযোগ তিনি দেন না। পরদিন একই বিষয়ে কথা বলতেও ভালো লাগে না। সাজিদ সেই কথাগুলো একটা ডায়েরিতে লিখে রাখে। ইচ্ছে আছে একদিন বাবাকে সে ডায়েরিটা উপহার দেবে। বাবা খুব আগ্রহ নিয়ে পড়লেও মুখ গোমড়া করে বলবেন, “এসব কেউ লেখে? হাদারাম কোথাকার!”

সাজিদ লিখল, “তায়িফ চাচাকে একটা কাগজি লেবুর গাছ আনতে বলেছিলাম কিছুদিন আগে। আমার এক কলিগের কোয়ার্টার বিল্ডিং এর সামনে এরকম একটা গাছ লাগানো। এত লেবু হয়েছে যে গাছ ঝুকে পড়েছে। পাশ দিয়ে গেলেই দারুণ সুবাসে বুক ভরে যায়। তা তায়িফ চাচা লেবুর গাছ না এনে এনেছেন একগাদা লেবু। সেই লেবু দিয়ে ফ্রিজের ড্রয়ের ভর্তি হয়ে গেছে। আসলে তার মনে হয়েছিল আমার লেবু খেতে ইচ্ছে হয়েছে। এখন গাছ লাগালে লেবু হতে দেরি হবে, তাই লেবু কিনে আনাই ভালো। এই লোকের মাথায় হয়তো ছিট আছে। কিন্তু আমাকে বড় ভালোবাসেন। বাবার জায়গা নিতে চান হয়তো। আমিও তাকে বাবার মতোই ভালোবাসি।

ইদানীং তিনি খুব বলেন, ‘বিয়ে করে ফোলো ছোটবাবা।’ কিন্তু কাকে বিয়ে করব? কাউকে সেরকম মনে ধরে না। চেহারাটা সুন্দর বলে হয়তো অনেক মেয়ে পাব বিয়ের জন্য, কিন্তু সত্যি মনের মতো কাউকে কি পাব? তারচেয়ে বড় প্রশ্ন আমার মনের মতো মেয়েটা আসলে কেমন? আমি নিজেও জানি না।”

ডায়েরি লেখা শেষে সে মোবাইল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকল। আজ ছুটির দিন, ক্লাস নেবার তাড়া নেই। কয়েকটা পরীক্ষার খাতা জমে আছে, সেসব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটা মেসেজ এসেছে, ‘রুদিতা তুলন’ নামের আইডি থেকে। গত কয়েকদিন ধরেই মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। কী ভেবে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছিল যে সাজিদ! এখন নিজের ওপরেই রাগ লাগছে! মেয়েটা লিখেছে, “আপনি কথা বলেন না কেন? এতগুলো মেসেজ দিলাম!”

সাজিদ একবার ভাবল ব্লক করে দেবে। কিন্তু আবার কেন যেন ইচ্ছে করল না। উল্টো উত্তর দিল, “আমি হাই হ্যালোর উত্তর দেই না। কোনো দরকার থাকলে বলুন।”

“দরকার তো আছেই! সেজন্যই মেসেজ দেয়া!”

“বলুন কী দরকার।”

লিখে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল সাজিদ। মেয়েটা মেসেজ সীন করেছে, কিন্তু উত্তর দেয়নি। আরও অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও উত্তর এলো না। মেসেঞ্জারের সবুজ আলোটা নিভে গেছে। আজব তো!

****
তুলন ভীষণ মেজাজ খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে মায়ের সামনে। এতদিন পর তার বহুকালের পছন্দের মানুষটা তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে। কিন্তু তার কাছে মোবাইল নেই। সে সুযোগ পাওয়া মাত্র চলে যায় ইলার কাছে৷ ইলার ফোন দিয়ে নিজের ফেসবুকে লগইন করে মেসেজ করে সাজিদকে। কয়েকদিন টানা মেসেজ দেয়ার পর আজ সে উত্তর দিয়েছিল, কিন্তু যেই না কথা বাড়াতে যাবে, ওমনি ডাক পড়ল। এখন বাড়িতে রাজ্যের কাজ পড়েছে, তাকেও সেই কাজে হাত লাগাতে হবে। দুই ভাবি মুখ টিপে হাসছে। তুলন ঠিক করল আজ সে একটা কাজও করবে না। অনেকগুলো রসুনের কোয়া দেয়া হয়েছিল তাকে খোসা ছাড়াতে। সে একটা রসুন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ কাজ করার ভান করে আস্তে আস্তে চোখ উল্টে গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। সবাই ছোটাছুটি করে তাকে তুলল। চোখমুখে পানি দিল। কিন্তু যে ইচ্ছে করে জ্ঞান হারিয়েছে তার জ্ঞান কি আর ফেরানো যায়?

অতঃপর ডাক্তার ডাকা হলো। ফার্মেসির ডাক্তার প্রেশার মেপে বললেন, “প্রেশার লো। বিশ্রাম নিতে দিন উনাকে। আর দুধ ডিম বেশি করে খাওয়ান।”

ব্যাস! আর কে কাজ করে! সোফায় আধশোয়া হয়ে ভালোমন্দ খেতে খেতে টিভিতে সিনেমা দেখতে বসে গেল সে। আটাশতম বারের মতো দেখল, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

  • *পরীক্ষার জন্য পর্ব দিতে দেরি হয়ে গেল। সেজন্য দুঃখিত। পরবর্তী পর্বগুলো নিয়মিত আসবে ইনশাআল্লাহ।*

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here