#বেলীফুল
পর্ব-৭
ছুটির দিন। কানন বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠল। শরীরটা অলস লাগছে ভীষণ। কয়েকদিন অফিসে খাটুনি গেছে একচোট। শুধু রাতটা বাড়িতে এসে নাকেমুখে দুটো গুঁজে ঘুম! আজ ছুটি পেয়ে সবার প্রথমে মনে পড়ল ইলার কথা। অবশ্য মনে পড়াটা আশ্চর্য নয়। মেয়েটা কয়েকদিন এমনভাবে পেছনে পড়ে ছিল যে অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল একরকম। তাছাড়া ইলা ছাড়া তার জীবনে আর বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয় বলতে তো তেমন কেউ নেই।
ভাবতে ভাবতেই ইলা হাজির। আজ ওকে দেখে একটুও খারাপ লাগল না৷ বরং ভালো লাগল। ইলা শাড়ি পরেছে। আগে ওকে শাড়িতে দেখা হয়নি। কাননের মনে হলো মেয়েটা বেশ সুন্দর। চোহারায় কত মায়া! কাজল একটু লেপ্টে গেছে, সেজন্যই আরও ভালো লাগছে।
ইলা শুরুতেই বলল, “আপনি আজকে শেভ করেন নাই কেন?”
কানন অন্য সময় একই কথা শুনলে ভীষণ বিরক্ত হতো, আজ হলো না। বলল, “ছুটির দিনে শেভ করে কী করব?”
“একেবারে হালকা দাড়ি রেখে দিলে এক ভালো, না রাখলে প্রতিদিন শেভ করবেন, নয়তো নোংরা দেখায়। এখন উঠুন, ভালো করে গোসল করে আসুন, নামাজ পড়তে যাবেন না?”
কানন বাধ্য ছেলের মতো উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। ইলা বেশ অবাক হলেও ব্যাপারটা ভালো লাগল তার। সেদিন কানন তাকে অপমানজনক বইটা দেয়ার পর রাগ করে অনেকদিন কথা বলেনি। আজ থাকতে না পেরে চলে এসেছে৷ এখন তো মনে হচ্ছে এই হনুমানটাও তাকে মিস করেছে। মিস না করলেও অন্তত এটা ধরে নিয়েছে যে সে পিছু ছাড়বে না। যাক, ভালোই হলো!
ইলা দ্রুত হাতে ঘরটা গুছিয়ে ফেলল। আজ তার মা-বাবা বাসায়৷ সে তুলনের কাছে যাবে বলে বের হয়েছে। নিচে নামতে নামতে যখন মা দরজাটা বন্ধ করেছে, টুপ করে ঢুকে পড়েছে কাননের ফ্ল্যাটে।
এলোমেলো ঘরটা ঠিক করে সে ঢুকল রান্নাঘরে। বাজার বলতে তেমন কিছু নেই। শুধু ডিম আছে। সে ডিম সেদ্ধ আর চাল ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিল। তাদের বাসায় আজ মুরগি রান্না হচ্ছে। এক ফাঁকে কিছুটা দিয়ে গেলেই হবে কাননকে।
কানন গোসল সেরে বের হয়ে সুন্দর একটা ইস্ত্রি করা পাঞ্জাবি পরল। জানত ইলা ঘর গুছিয়ে রাখবে। পরিষ্কার পরিবেশে আরও ভালো লাগল তার। তারপর ইলাকে খুঁজতে খুঁজতে পেল রান্নাঘরে। খাবারের ঘ্রাণে তখন ম ম করছে জায়গাটা। ইলাকে কী সুন্দর লাগছে! শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে রান্না করছে। চুলের হাত খোঁপা খুলে যায় যায় অবস্থা। কাননকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইলা বলল, “কিছু বলবেন?”
“না। নামাজ পড়তে যাব। তুমি থাকবে?”
“কীভাবে থাকব? এটা কি আমার বাসা? মা বাবা খুঁজতে বের হবে এখুনি। রান্না হয়ে গেলে তারপর যান। সময় আছে এখনো।”
“ওহ।” কানন ভেবেছিল ইলা বুঝি তার সাথেই খাবে।
ইলা রান্না শেষে রান্নাঘরটা চট করে গুছিয়ে ফেলল। তারপর সাবধানে বেরিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে বেল চাপল। কানন তখন দরজায় তালা দিয়ে নিচে নামছে। ইলার মা দরজা খুলে কাননকে যেতে দেখেতুল বলল, “ছেলেটার সাথে কথা হয়েছে কখনো?”
ইলার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “না।”
“ও। ভালো ছেলে৷ কিছু লাগলে বলিস ওকে। আমার সাথে দু’দিন কথা হলো, খুব মনখোলা। ওকে আজ তরকারি দিয়ে আসিস।”
ইলা খুশি হলো, আবার অবাকও হলো। মায়ের সাথে কাননের কথা হলো কবে? আর এই হনুমানটা আবার দিলখোলা হলো কখন?
★
তুলনকে আজ দেখতে আসবে। তাকে এক সপ্তাহ ধরে রূপচর্চা করাচ্ছে দুই ভাবি। পারলে মুখের চামড়া ঘষে তুলে ফেলে! ঘরোয়া মসুর ডাল লাগানো থেকে শুরু করে আড়ং এর উপটান কিছুই বাদ যায়নি। তুলন সহ্য করেছে চুপচাপ। সে এমনিতেই সুন্দর৷ এতকিছু করে কী লাভ হচ্ছে তার জানা নেই। আজ তাকে সাজাতে বসেছে ভাবিরা। ছোট ভাবি মেকআপের কারিশমা দেখাতে গিয়ে চোখদুটোতে আইশ্যাডো প্যালেট উল্টে দেয় পারলে। এত ভারী হয়েছে চোখের পাতা যে তু্লতেও কষ্ট হচ্ছে। বড় ভাবি আবার তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। জর্জেটের শাড়ি মনে হচ্ছে খুলে যাবে যখন তখন। তুলন সব চুপচাপ সহ্য করল।
ছেলেপক্ষ এলো দুপুরের কিছু পরে। দুই ভাবি তুলনকে নতুন বউ এর মতো করে দু’দিকে ধরে নিয়ে গেল সেখানে। তুলনের হাতে চায়ের ট্রে।
ছেলেকে দেখে তুলনের হাসি পেয়ে গেল। সে মুখ ফুলিয়ে বহুকষ্টে হাসি চেপে রাখল। ছেলের বয়স বোধহয় ত্রিশের একটু ওপর। ফুলহাতা সাদা শার্ট পরেছে, গলার বোতামটা পর্যন্ত আটা৷ একেবারে সোজা হয়ে বসে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে মার্কেটে সাজিয়ে রাখা মেনিকুইন। এই ছেলে নাকি ইঞ্জিনিয়ার। চশমার ফাঁক দিয়ে তুলনকে দেখছে। দৃষ্টিও রোবোটিক।
ছেলের মা অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন। তার বোধহয় তুলনের ভয়াবহ মেকআপ দেখে ঠিক হজম হচ্ছিল না। বলেই ফেললেন, “তুমি কি সাজতে পছন্দ করো?”
তুলন বলল, “জি।”
ছেলের মা হেসে বললেন, “আমরা কিন্তু পর্দাশীন বউ চাই।”
তুলন কিছুই বলল না। ওর মা বলল, “করবে করবে। আমার মেয়ে একেবারে মোমের মতো। গলিয়ে যেমন পাত্রে ঢালবেন তেমন করেই তৈরি হবে।”
তুলন মনে মনে বলল, “মোম গলালে একটুখানি বকি থাকে মা। বাকিটা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। এই ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইলে আমি এমনিতেই উড়ে যাব, গলাতেও হবে না।”
নিজেরা কথা শেষে তুলনকে ছেলের সাথে কথা বলতে দেয়া হলো একটা ঘরে। পর্দা অবশ্য তোলা। ছেলে কেশে গলা সাফ করে নিয়ে বলল, “আপনি কি টাই বাঁধতে পারেন?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু