ভালবেসে_অবশেষে পর্ব: ২

0
934

#ভালবেসে_অবশেষে
#নুশরাত_জেরিন
পর্ব: ২

বিয়ে হলো একপ্রকার ঘোরের মধ্যে। তিনবার কবুল বলে রেজিষ্ট্রি পেপারে সাইন করতেই মিলির জীবন জুরে গেলো অন্য কারো সাথে। অন্য কারো ঘরের বউ, ভাবী, স্ত্রী হিসেবে অদৃশ্য নাম না জানা অনুভূতিরা ঘিরে ধরলো তাকে। তবে অপরপাশের লোকটার মনোভাব কী সেটা জানতে খুব ইচ্ছে হলো মিলির। লোকটা অদৌ সেচ্ছায় বিয়েটা করলো কিনা, তাকে বউ হিসেবে মানবে কি না এসব হাজারো আজগুবি চিন্তা ঘিরে ধরলো তাকে। এই ফাঁকে সে একবার নীরাকে প্রশ্ন করে বসলো,
“আপা, তোর ভাসুরকে ধরে বেধে বিয়েটা দিসনি তো? না মানে আমাকে আবার অত্যাচার-টত্যাচার করবে নাতো?”

নীরা সে কথার উত্তর না দিয়ে মিলির হাত টেনে ধরলো। আজ সকালে হাত ভর্তি মেহেদী পরিয়েছিল মিলিকে। বিয়ে হচ্ছে অথচ মেহেদী পরবে না? মিলি তো পরতেই চাইছিল না নীরাই জোর করলো।
সে বলল, “কী গাঢ় রং হয়েছে রে বোন, সিয়াম ভাই তোকে অনেক ভালবাসবে দেখিস।”

মিলি নিজেও হাতের দিকে তাকালো। আসলেই সুন্দর রং ফুটেছে৷ লতাপাতা আকা ডিজাইনের মাঝে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষন করছে এস অক্ষরটা। মানুষটা কী সত্যিই মিলির জিবনের সাথে জুরে গেলো? মিলির অদ্ভুত লাগলো।
সে আনমনে বলল,
“প্রথম বউটাকে বুঝি কম ভালবাসতো?”

নীরা হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো।
“কম নাকি বেশি ভালবাসতো সেটা জানি না বোন, তবে আরিয়া ভাবী কিন্তু সিয়াম ভাইকে বিন্দু পরিমাণ ভালবাসা তো দুর সম্মানটুকু করতে পারেনি। নয়তো স্বামীর বন্ধুর সাথে পরোকিয়ার মত জঘন্য অন্যায় করে তার হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার মত কাজটা সে করতে পারত না।”

“তুই কী সত্যি জানিস আপা, এর ভেতর তোর ভাসুরের কোনো দোষই ছিল না?”

নীরা হতাশ কন্ঠে বলল,
“সিয়াম ভাইকে তোর এত অপছন্দ কেন বলতো? সেকি তোর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেছে?”

“খারাপ ব্যবহার কোথা থেকে করবে, আমার সাথে তো কখনও কথাই বলেনি। ”

“তবে?”

নীরার প্রশ্নের উত্তরে মিলি কিছুই বলতে পারলো না। আসলেই তো সিয়াম নামক লোকটা তার সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করেনি, কিন্তু ঐযে, সবার সাথে রাগারাগি করে। সেসব তো দুর থেকে শুনেছে মিলি। তাছাড়া কেমন গম্ভীর মুখ করে থাকে৷ একশটা প্রশ্ন করলে একটা উত্তর দেয়। এসব কি একজন মানুষকে অপছন্দ করার জন্য যথেষ্ট নয়?

আকাশের আজ মন ভাল নেই। নিকষ অন্ধকারে প্রকৃতিকে ডুবিয়ে রেখেছে সে। মৃদু বাতাসে মিলির গায়ে কাটা দিচ্ছে। রুমের সাথে লাগোয়া ছোট্ট এই বেলকনিটা তার খুব পছন্দের। ঘন্টার পর ঘন্টা সে এখানে দাড়িয়ে কাটিয়ে দিতে পারে। তবে আজ কেন যেন ভাল লাগছে না। আজ অমাবস্যা না তারপরও চাঁদটা মিইয়ে আছে, হয়তো মেঘ করেছে। তারাদের টিকিটি পর্যন্ত চোখে পরছে না।
মিলির খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর রাতে দুজনে মিলে জোৎস্না বিলাস করবে, একজন অন্যজনের কাধে মাথা ভরসার হাত বুলাবে। কিন্তু সব ইচ্ছে কী পুরন হয়?
সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুমে ঢুকলো। বিছানার ওপর সিয়াম আধশোয়া হয়ে আছে। কপোলে তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। কালো চেক শার্টের ওপরের দুটো বোতাম খোলা। মিলি প্রথমে তার উপস্থিতি বুঝে চমকে উঠলেই পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিলো।
আজ সিয়ামরা এ বাড়িতে থাকবে। মফস্বল থেকে এত রাতে ঢাকায় রওনা দিলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে পরদিন হয়ে যাবে। তাছাড়া আজ ধকলও সবার ওপর দিয়ে কম যায়নি।
মিলি আড়চোখে একবার সিয়ামকে পর্যবেক্ষন করে নিলো।
শ্যামলা গড়নের পেটানো শরীর। আহামরি না হলেও খারাপ না। সুপুরুষ বলা চলে। এমন মানুষকে ছেড়ে কোনো নারী অন্যতে কীভাবে মত্ত হতে পারে? স্বভাবের দোষে? নাকি লোকটারও দোষ আছে।
মিলি আর ভাবতে পারলো না। লোকটা গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“এসেছো? রুমে পানি নেই কেনো? নিয়ে এসো যাও।”

মিলি কিছুক্ষণ চোখ বড় করে থমকে রইলো। সদ্য বিবাহিত বউকে কেউ প্রথমেই এমন ভাবে আদেশ করতে পারে! যেন তিনি মিলির শিক্ষক। ধমকে বলছে যাও…

কথা না বাড়িয়ে ধীর পায়ে পানি নিয়ে সামনে দাড়ালো। লোকটা চোখ বন্ধ করে আছে। ক্লান্ত বোধহয়। মিলির কাজিনরা এতক্ষণ তাকে জালিয়ে মেরেছে। মিলি ঘরে বসেও স্পষ্ট সে আওয়াজ পেয়েছিলো। সে মৃদু গলায় বলল,
“পানি”
গলাটা খানিক কেপে উঠল তার। লোকটার সাথে এই প্রথম কথা। আগে তো সারাক্ষণ লুকিয়ে চুপিয়ে থেকেছে। লোকটা যা ধমক দিতে জানে! এর আগেও এমন দৃশ্য বহুবার দেখেছে মিলি। তাইতো এত ভয় তার!
সিয়াম নিঃশব্দে সোজা হয়ে বসে পুরোটা গ্লাস খালি করে ফেললো। মিলি আবার বলল,
“আরেক গ্লাস এনে দেই।”

সিয়াম জবাব না দিয়ে শুয়ে পড়লো। শার্টটা ঘামে চুপসে আছে। খুলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু একটা মেয়ের সামনে শার্ট খুলে বসে থাকাটা কেমন বিশ্রী দেখায়, যতই মেয়েটা বউ হোক। বউ কথাটা মাথায় আসতেই তার চোয়াল শক্ত হলো।

সে বলল,
“লাইট নেভাও, ঘুমোবো।”

মিলি কাঁপা কাঁপা সরে বলল,
“আমি কোথায় ঘুমোবো?”

সিয়াম জবাব না দিয়ে বিছানার একপাশে সরে গেলো। মিলি বুঝলো লোকটা পাশে তার জন্যই জায়গা করে দিয়েছে। তবে মুখে বললে কী হতো?
সে লাইট নিভিয়ে সুতির একটা শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। বেনারশী পরে আর থাকা যাচ্ছে না, গা চুলকোচ্ছে, কাধের দিকে সেপটিপিন খুলে গেছে বোধহয়, সমানে খোঁচাচ্ছে।
শাড়ি পাল্টে নিঃশব্দে বিছানার একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরলো।
তবে অসস্থি হচ্ছে খুব। কে জানতো এই লোকটার সাথে তাকে বিছানা শেয়ার করতে হবে।
তাছাড়া একই রুমে পাশাপাশি এক পুরুষের সাথে….মিলি অসস্থিতে কাথা টেনে গায়ে দিল, পাছে শাড়ি এলোমেলো হয়ে গেলে? তার শোয়ার তো আবার ঠিক ঠিকানা নেই।

,
মিলির ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে, ফজরেরও আগে।
আবছা অন্ধকারে সে বাইরে বেরিয়ে এলো। সিয়াম এখনও ঘুমাচ্ছে। শেষ রাতে তারও হয়তো শীত লেগেছিল, যার দরুন সেও মিলির কাথার নিচে আশ্রয় নিয়েছিল। মিলি ঘুমের ঘোরে কখন যে তার উপর হাত পা তুলে দিয়েছিল বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙতেই সে পড়িমরি করে উঠে পরেছে। লোকটা এ অবস্থায় দেখলে মিলি লজ্জায় পরে যেত। তাছাড়া আজ এ বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে তাকে। মনটাও খারাপ।
সে ঘুরেঘুরে চারিপাশে দেখতে লাগলো।
আর কিছুক্ষণ, তারপরেই মিলিকে পাড়ি জমাতে হবে অন্য কোনো শহরে, অন্য কারো বাড়ি হবে তার আশ্রয়।
আচ্ছা, ইচ্ছে হলেই হুটহাট এ বাড়িতে আসতে পারবে তো তখন?
ফজরের আজান পরতে সে রুমে এলো। নামাজ পরতে হবে। ওয়াশরুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। বিছানা খালি। তারমানে সিয়াম উঠে গেছে!
মিলি মিনিট দুই অপেক্ষা করতেই সিয়াম বের হলো। অযু করে এসেছে সে।
মিলিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এক্সট্রা জায়নামাজ হবে?”

মিলি চটজলদি জায়নামাজ এনে দিয়ে নিজেও ওয়াশরুমে ঢুকলো।
ওযু করে সিয়ামের পিছে দাড়িয়ে পরলো।
লোকটাকে দেখে এখন মোটেও বিরক্ত লাগছে না মিলির। বরং তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে। কী স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে! নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হলো সে।
নামাজ শেষে সিয়াম বলল,
“আজ বাড়ি যেতে হবে!”

মিলি মৃদু গলায় বলল,
“জ্বি জানি।”

ব্যাস এতটুকুই, আর কথা না বাড়িয়ে সিয়াম রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মিলি মনক্ষুন্ন হলো। সিয়াম আরো কিছু বলতে পারতো তাকে৷ বিয়েটা যেভাবেই হোক, হয়েছে তো। মিলি বিয়ে নামক সম্পর্কটাকে শ্রদ্ধা করে। সে মোটেও ডিভোর্স বা এমন কেনো বিষয় মাথায় আনতে চায় না। সম্মান বাঁচাতে যে বিয়ে দেওয়া হলো সেখানে ডিভোর্সের চিন্তা করাটা সম্মান কমবে বৈ বাড়বে না।
কিন্তু লোকটার এমন নির্লিপ্ত ব্যবহার চলতে থাকলে মিলি নিজে কতটুকু এগুতে পারবে!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here