ভালোবাসার উষ্ণতা পর্ব-৩

0
3489

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#৩য়_পর্ব

আবরারের কিছু হয় নি তো!! ঠিক তখনই পাশ থেকে শুনে কিছু কাজের লোক বলাবলি করছে,
– এই নিয়ে চাইর বার এরাম যায় যায় অবস্থা হইছে। বলতে গেলে তো লোকটা মরাই, ছোট ভাইজান খালি খালি এতো চেষ্টা করে।

কথাগুলো কানে আসতেই প্রাপ্তি দৌড়ে কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে,
– উনার কি হয়েছে? উনার শরীর ভালো নেই? কি হয়েছে এই মাত্রই তো বলছিলেন, আবরারের এরকম চার বার হলো। কি হয়েছে?

আচমকা প্রাপ্তির প্রশ্নে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় কাজের লোকগুলো। আমতা আমতা করে “জানি না” বলে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রাপ্তির সামনের থেকে সরে গেলো তারা। প্রাপ্তির বুঝতে বাকি রইলো না, এদের মুখ দিয়ে কথা বার করানো যাবে না। তাই সিদ্ধান্ত নিলো আবরারের ঘরে যেয়েই দেখিবে কি হয়েছে! সময় নষ্ট না করে আবরারের ঘরের দিকে পা বাড়ালো প্রাপ্তি। আবরারের ঘরের বাইরে চিন্তিত মুখে অয়ন হাটাহাটি করছে। মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে, ফর্সা চেহারাটা টেনশনে মলিন হয়ে আছে। অয়ন প্রাপ্তির সাথে এ যাবৎকালে ভালো করে কথা বলে নি। তাই প্রাপ্তি খুব ভয় পায় অয়নকে। তাও বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে উনার?
-……
– ভেতরে এতো ডাক্তার কেনো?
-……
– সরুন, আমি ভেতরে যাব।

প্রাপ্তি অনেকটা জিদের বসেই ভেতরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। অমনি হ্যাচকাটানে পেছনে নিজের সামনে এনে দাঁড় করায় অয়ন তাকে, ডান হাতটা মুড়িয়ে পেছনে আটকে রাখে। ছাড়ানোর চেষ্টা করেও অপারগ প্রাপ্তি। প্রচন্ড জোরে চেপে ধরায় হাতে আংগুলের ছাপটুকু পড়ে যায়। অয়নের চোখ থেকে যেনো আগুন বের হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগে,
– ভাইয়ের এই অবস্থার জন্য দায়ী তুমি, এখন এসেছো ভালো সাজতে না? এতো আদিক্ষেতা পাও কোথায়?
– মানে? আমি কি করেছি?
– ন্যাকামি করবি না? এখানে আসতে বলেছি তোকে? কেনো এসেছিস? লোকমান কাকা! লোকমান কাকা!

অয়নের পাগলামি যেনো বেড়েই চলেছে, প্রাপ্তির হাত ছেড়ে লোকমান কাকাকে ডাকতে থাকে। প্রাপ্তি আর পেরে চেঁচিয়ে উঠে,
– আপনার সমস্যা কি? সে যদি আপনার ভাই হয়ে থাকে আমার ও স্বামী। আমি তার সম্পর্কে জানার অধিকার আছে। মানে কি মগের মুল্লুক! আমি ভেতরে যাবো মানে যাবো। আমাকে আটকানোর চেষ্টা খবরদার করবেন না।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে এক মিনিট দেরি না করেই ভেতরে ঢুকে পড়লো প্রাপ্তি। ভেতরে এতো বড় শক তার জন্য অপেক্ষা করবে এটা তার জানা ছিলো না। ডাক্তাররা আবরারকে সি.পি.আর দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আবরার অচেতন অবস্থাতে পড়ে রয়েছে বিছানায়। প্রাপ্তির অতর্কিতভাবে ঢুকে যাওয়া কিছুতে আটকাতে না পারায়, অয়নও তার পিছু পিছু রুমে ঢুকে। এই দৃশ্যটি প্রাপ্তি ঠিক কিভাবে নিবে বুঝে উঠতে পারছে না অয়ন। প্রাপ্তি ফ্যালফ্যাল করে বেশ কিছুক্ষণ আবরারের দিকে তাকিয়ে ছিলো। একটা সময় পর ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো তার কাছে। এতো তার স্বামীর গলার স্বরটুকু সে শুনেছে। আজ তাকে দেখছে সে। নিজেকে কিছুতেই ধরে রাখতে পারছে না। আসলেই তো অয়ন তো একটা কথাও ভুল বলে নি, সে সত্যি এই তিনমাস এই লোকটার কোনো যত্ন নেয় নি। তার দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। আজ লোকটাকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে নিজের মনেই অনুতাপের পোকাগুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ধীর পায়ে এগিয়ে আবরারের হাতটি ধরে নিচে বসে পড়ে। অশ্রুধারা যেন থামতেই চাইছে না। শুধু মনে একটাই বাক্য চলছিলো,
– আবরারকে ভালো করে দেও আল্লাহ, আমি স্ত্রীর সকল দায়িত্ব পালন করবো ইনশাআল্লাহ।

দৃশ্যটি কারোর মনে ছুরিঘাত করছিলো, সে আর কেউ নয় সে অয়ন। নিজেকে বুঝ দেওয়ার বাক্যটুকু নেই। প্রাপ্তির দিক থেকে সে কোনো ভুল তো করে নি, তবে কেনো মন চাইছে ওকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু তা সে করতে পারবে না। সত্যিটা জানলে হয়তো প্রাপ্তি এক মূহুর্ত এ বাড়িতে থাকবে না। আজ অলৌকিকতার শেষ নেই, মিনিট বিশেক পর আবরার অবস্থা স্ট্যাবল হয়। ধীরে ধীরে রেসপন্স করতে লাগে। অয়ন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। প্রায় দেড় ঘন্টার কষ্ট পেরিয়ে এখন আবরার স্ট্যাবল। শুধু তাই নয়, সে চোখ খুলেছে। তবে কি সে এখনো প্রাপ্তিকে ভালোবাসে? সে কি প্রাপ্তির অস্তিত্বের আভাস পেয়েছিলো??

বিকেল ৪টা,
স্টাডি রুমে বসে আছে অয়ন। সকালের ঘটনা এখনো মাথায় ঘুরছে, আবরার ছয় মাস পর আজ চোখ খুলেছে। এই দিনটার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনতো অয়ন। অথচ আজ যেন কিছুতেই মনকে শান্ত করতে পারছে না। আবরারের অবস্থা ইমপ্রুভ করছে, ডাক্তার বলেছে খুব দ্রুত আবরার ঠিক হয়ে যাবে। খবরটা যতটা খুশির ততটাই ভয়ের। কারণ নিজের মাঝে যে গোপন রহস্য লুকিয়ে রেখেছিলো তা সবার সামনে চলে আসবে। অবশ্য তাতে কারোর কোনো ক্ষতি হবে না। এসব ভাবতে ভাবতেই অতীতে পাতাগুলো সামনে ভেসে উঠলো অয়নের। আজ থেকে ছয় মাস আগে একটা এক্সিডেন্টে কোমায় চলে যায় আবরার। যদিও এক্সিডেন্টটা একটা ষড়যন্ত্র ছিলো, তবে সেদিনে গাড়ি নিয়ে হাইওয়েতে রাস ড্রাইভ করার কারণ ছিলো আবরারের ভগ্ন হৃদয়। দীর্ঘ তিন বছরের ভালোবাসার মানুষটি তাকে ধোকা দিয়েছিলো। অনলাইন ভালোবাসা তাকে ভালোবাসার উপর থেকে বিশ্বাস উঠিয়ে ফেলেছিলো। এক্সিডেন্টের পর সিকদার কোম্পানির প্রেসিডেন্সি বজায় রাখতে বলেছিলো আবরারের কিছু ফিজিক্যাল ড্যামেজ বাদে কিছুই হয় নি। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবে। অয়ন তখন আবরারের ভং ধরে সবার সামনে আসে। আর খোঁজ খবর লাগিয়ে জানতে পারে প্রাপ্তিই সেই মেয়ে যে আবরারকে কষ্ট দিয়েছিলো। প্রথমে বিশ্বাস না করলেও পড়ে ঠিকই বিশ্বাস করে। প্রাপ্তিকে শাস্তি দেওয়াই অয়নের উদ্দেশ্য। তাই আবরার সেজে প্রাপ্তিকে বিয়ে করে সে। কিন্তু এখন তার কাছে সব ধোয়াশা লাগছে। যদিও বিয়েটা তার কাছে কোনো মুল্য নেই, তবুও বুকে চিনচিনে ব্যথাটা রয়েই গেছে। নিজেকে শান্ত করতে না পেরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় অয়ন। রান্নাঘরে আবরারের জন্য সুপ বানাচ্ছিলো প্রাপ্তি। এক মূহুর্তের জন্য মনে হচ্ছিলো দৌড়ে প্রাপ্তিকে জড়িয়ে ধরতে পারলে হয়তো শান্তি লাগতো তার। ধীরে ধীরে প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে…..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here