ভালোবাসার চেয়েও বেশি 💞পর্ব- ৮১

0
6195

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৮১

★ আদিত্য নূরের বাসার সামনে এসে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত যেয়ে দরজায় বেল বাজালো। একটু পরে নূরের বাবা এসে দরজা খুলে দিতেই আদিত্য তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো।
……নূর কোথায়?

নূরের বাবা বললো।
….তুমি ভেতরে আস বাবা। নূর ওর রুমে আছে। আসার পর থেকেই দরজা আটকে বসে আছে। অনেক ডাকলাম কিন্তু খুলছেই না।

আদিত্য আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে নূরের রুমের দিকে দৌড়াল। নূরের বাবা ভাবলো ওদের একা ছেড়ে দেওয়াই ঠিক হবে। তাই সে আর ওদের কাছে গেলোনা।

আদিত্য নূরের রুমের দরজায় এসে জোরে জোরে চাপড় মেরে বলে উঠলো।
….প্রাণপাখী, দরজা খোল প্লিজ। দেখ আমি চলে এসেছি। একবার দরজা খোল প্লিজ। আমি সব ঠিক করে দেব।

নূর বেডের ওপর বসে বসে কাঁদছে। আদিত্যের কথা শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু ও কোনো উত্তর দিচ্ছে না। দুই কানে হাত চেপে ধরে কাঁদতে লাগলো। যাতে আদিত্যের আওয়াজ না আসে।
এদিকে নূরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আদিত্য আরও ভয় পেয়ে গেল। আদিত্য আরও জোরে জোরে থাবড়াতে থাবড়াতে বললো ।
….প্রাণপাখী, প্লিজ দরজা খোল। আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ কিছু বলো। দেখ তুমি দরজা না খুললে, আমি কিন্তু দরজা ভেঙে ফেলবো? শেষ বারের মতো বলছি দরজা খোল। ঠিক আছে খুলবে নাতো? তাহলে আমি এখন দরজাই ভাঙবো।
কথাটা বলে আদিত্য নিজের গায়ের জোর দিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলো। হঠাৎ আদিত্য হাতে একটু ব্যাথা পেয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করে উঠলো।
….আহহ,,

নূর এতক্ষণ কঠোর হয়ে বসে থাকলেও, আদিত্যের ব্যাথা পাওয়ার আওয়াজ শুনে আর থাকতে পারলোনা। নূর ঘাবড়ে গিয়ে ছুটে যেয়ে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই আদিত্য কোনো কিছু না বলে দ্রুত গতিতে যেয়ে দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে নূরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। নূর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পিছিয়ে যেতে লাগলো, আর আদিত্য ঠোঁট চেপে ধরেই নূরের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে লাগলো। নূর পেছাতে পেছাতে একসময় কাবার্ডের সাথে ঠেকে গেল। আদিত্য এবার নূরের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দুই হাত দিয়ে নূরের গালে হাত বোলাতে বোলাতে আদুরে গলায় বললো।
…..আই এ্যাম সরি প্রাণপাখী, আই এ্যাম সরি। আমি জানি আমি রাগের মাথায় তোমার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলেছি। কি করবো, তুমি ওমন একটা কথা বলে ফেলেছিলে তাই আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে। আর তুমি কিভাবে কাওকে কিছু না বলে এখানে চলে এলে? জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম?

নূরের ইচ্ছে করছে এখুনি ওর আদিত্যকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে।আর বলতে যে,আমি ওর ওপর একটুও রাগ করিনি। কিন্তু সেরকম কিছুই বললো না ও। মাথা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো।
….কেন এখন কি আমি তোমাদের পারমিশন ছাড়া কোথাও যেতেও পারবো না?

নূরের কথা শুনে আদিত্য প্রচুর অবাক হলো। নূর এর আগে কখনো ওর সাথে এভাবে কথা বলেনি। আদিত্য জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
….না না নূর তুমি ভুল বুঝছ। আমি সেটা বলিনি। আমিতো শুধু বলছি যে,আমাকে জানিয়ে আসলে আর আমার টেনশন হয় না।

….সব কথা সবসময় তোমাকে জানিয়ে করতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই। আমার ইচ্ছে হয় নি তাই জানায়নি।

….এভাবে কেন কথা বলছ প্রাণপাখী? বুঝতে পেরেছি, তুমি এখোনো আমার ওপর রেগে আছ তাইনা? সরি না কলিজাটা? এবারতো আমাকে মাফ করে দাও? তাকাও আমার দিকে? প্লিজ চলোনা বাড়ি ফিরে যাই?

আদিত্যের এমন মায়াবী ডাকে নূরের ভেতরটা ভেঙে গুরিয়ে পড়ছে। তবুও নিজেকে অনেক কষ্টে শক্ত রেখে কড়া গলায় বললো।
….আমি যাবোনা। এখানেই থাকবো।

নূরের কথায় আদিত্যের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। আদিত্য জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বললো।
….যাবেনা মানে? ও আচ্ছা, তুমি আজ রাত এখানেই থাকতে চাচ্ছ? ইটস ওঁকে, তাহলে আমরা আজরাত এখানেই থাকবো। সকাল হলে নাহয় চলে যাবো।

…..না, সকালেও যাবোনা। আমি কিছুদিন এখানেই থাকবো।

….ওকে ওকে, তুমি চাইলে তাই হবে। আমরা কিছুদিন এখানেই থাকবো। আর আমিও একটু শশুর বাড়ির মজা নেব কেমন?

নূর কাঠ কাঠ গলায় বললো।
….তুমি হয়তো ব্যাপার টা বুঝতে পারোনি। আমি বলেছি আমি কিছুদিন এখানে থাকবো মানে, শুধু আমি থাকবো। তুমি না। আমি একাই থাকতে চাই।

নূরের কথায় এবার আদিত্যের ভয় লাগছে। আদিত্য কম্পিত গলায় বললো।
….এ একা মানে? কি বলছ এসব প্রাণপাখী? আমি তোমাকে ছাড়া একা কিভাবে থাকবো? তোমাকে ছাড়া তো আমি এক সেকেন্ডও থাকতে পারবো না। আর তুমি আমাকে ছাড়া একা থাকতে পারবে?

নূর নিজেকে শক্ত করে চোখ বন্ধ করে বললো।
….কেন পারবো না? আমি একটু সংসারের ঝামেলা ছাড়া নিজের মতো স্বাধীন ভাবে থাকতে চাই। যেখানে কোনো বন্ধনের বেড়াজাল না থাকবে না। আমি এসবে অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছি। তাই কিছুদিন একা থাকতে চাই।

নূরের কথায় আদিত্য পুরো স্তব্ধ হয়ে গেল। আজকের নূরকে আদিত্যের কাছে অপরিচিত লাগছে। আদিত্যের মনে হচ্ছে এটা ওর প্রাণপাখী না,এটা অন্য কেউ। যাকে ও চেনেনা, কারণ ওর প্রাণপাখী কখনো ওর সাথে এভাবে কথা বলতে পারতো না। আদিত্য ছলছল চোখে তাকিয়ে বললো।
….আ আমি তোমার কাছে বেড়াজাল? আমার সাথে থাকাটা তোমার ঝামেলা মনে হয়? কেন এমন করছ প্রানপাখী? কিসের শাস্তি দিচ্ছ আমাকে? প্লিজ এমন করোনা। আমার কাছ থেকে দূরে যেওনা। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না প্রাণপাখী। প্লিজ আমাকে এতবড় শাস্তি দিওনা।

নূরের ভেতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ও এখনো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা শুধু ওই জানে। তবুও নূর নিজেকে শক্ত করে আবারও বলে উঠলো।
….. কেন? কেন থাকতে পারবে না? নাকি বউ কাছে না থাকলে দৈহিক জ্বালা মেটাতে পারবে না, সেই আপসোস হচ্ছে? কেন তুমিইতো বললে, তোমার বলার সাথে সাথে হাজার টা মেয়ে তোমার বেডে চলে আসবে। তাহলে তাদের দিয়েই তোমার দৈহিক চাহিদা মেটাও।আমার কি দরকার?

এতক্ষণ সবকথা সহ্য করতে পারলেও, এবারের নূরের কথা শুনে আদিত্য আর সহ্য করতে পারলোনা। রাগে ওর চোখমুখ লাল হয়ে গেল। আদিত্য রাগে নূরের মাথার পাশে কাবার্ডে একটা ঘুষি মেরে চোয়াল শক্ত করে রাগী কন্ঠে বললো।
….নূরররর,, এনাফ ইস এনাফ নাও। দিস টাইম ইউ ক্রস ইউর লিমিট। হাউ ডেয়ার ইউ টু সে দ্যাট? তুমি একা থাতে চাওনা? ঠিক আছে থাক তুমি যতদিন খুশী ততদিন একা একা।
কথাটা বলে আদিত্য রাগে ওখান থেকে চলে যেতে নেয়। দরজা পর্যন্ত এসে আদিত্য হঠাৎ পেছনে ঘুরে দৌড়ে যেয়ে নূরকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে করুন সুরে বললো।
….সরি সরি প্রাণপাখী। আমি আবারও তোমার ওপর রাগ করছিলাম। প্লিজ প্রাণপাখী এমন করোনা। আমাকে দূরে সরিয়ে দিওনা প্লিজ।

নূর দুই হাত শক্ত করে মুঠ করে চোখ বন্ধ করে বলে উঠলো।
….ঠিক আছে, তাহলে তুমি বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাও। তাহলে আর আমি তোমার কাছ থেকে দূরে যাবোনা।

আদিত্য এক ঝটকায় নূরকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
….আচ্ছা তো এতকিছু এই কারণে হচ্ছিল তাইনা? তবে আপনি যত চেষ্টাই করেন না কেন, আপনার এই আশা কখনোই পূরণ হবে না।

….ঠিক আছে, তাহলে আমিও এখন থেকে এখানেই থাকবো। আর তুমি এখানে আসবে না, আর না আমাকে ফোন করবে। নাহলে আমি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাবো।

আদিত্য রাগে কটমট করে বললো।
…ঠিক আছে, তোমার যা খুশী তাই করো। আমিও দেখি কতদিন তুমি আমাকে ছেড়ে থাকতে পারো?
কথাটা বলে আদিত্য হনহন করে বেড়িয়ে গেল।

আদিত্য চলে যেতেই নূর কাঁদতে কাঁদতে কাবার্ডের গা ঘেঁষে নিচে বসে পড়লো। তারপর দুই হাত দিয়ে নিজের দুই গালে চড়াতে চড়াতে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
…..কিভাবে পারলি তুই, কিভাবে পারলি?আমার আদিত্যকে এতো কষ্ট দিতে কিভাবে পারলি তুই? আমার আদিত্য কতো কষ্ট পেল আজ। এর আগে তোর মরণ কেন হলোনা? তোর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। কোনো অধিকার নেই। বারবার আমার সাথেই কেন এমন হয়? কেন এমন হয় আমার সাথে? সুখ কেন আমার কপালে সয়না? কেন?
এসব বলে কাঁদছে আর কাবার্ডের সাথে নিজের মাথা ঠোকাচ্ছে।

আদিত্য বাইরে এসে রাগে গাড়িতে একটা লাথি মারলো। তারপর মাথার চুল টেনে ধরে গাড়ির গা ঘেঁষে নিচে বসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। কাঁদো কাঁদো গলায় বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
….কেন আমার সাথে এমন করছ প্রাণপাখী? কেন বুঝতে পারছ না, আমার তোমাকে ছাড়া আর কিছু চাইনা।কিছু না। প্লিজ ফিরে এস আমার কাছে প্রাণপাখী। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।কিছুতেই না।

নূর আধাঘন্টা পর নিজেকে একটু শান্ত করে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে যেয়ে মুখে পানি ছিটা দিয়ে এলো। তারপর জানালার কাছে যেয়ে পর্দা সরিয়ে মনমরা হয়ে বাইরে তাকালো। হঠাৎ নিচে তাকাতেই দেখলো আদিত্য গাড়ির বনেটের ওপর এক হাঁটু ভাজ করে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, নূরের রুমের দিকে তাকিয়ে আছে। নূর সাথে সাথে মুখে হাত চেপে ধরে নিচে বসে পড়ে আবার কাঁদতে লাগলো। তারমানে আদিত্য চলে যাইনি? ও তখন থেকে ওখানেই রয়েছে? কথাটা ভেবে নূরের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। ওর আদিত্য কতো কষ্ট পাচ্ছে। আমি যে আর পারছিনা, আমার আদিত্য এভাবে কষ্টে দেখতে। কি করবো আমি? নূর উঠে দৌড়ে আদিত্যের কাছে যেতে নেয়। দরজা পর্যন্ত এসে আবার থেমে যায়। না না নূর, তোকে শক্ত থাকতে হবে। এভাবে দূর্বল হয়ে পড়লে চলবে না। আদিত্যের ভালোর জন্য আমাকে এটা করতেই হবে। এখন হয়তো আদিত্যর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু পরে ও ঠিকই খুশী থাকবে।
এসব ভেবে নূর আর গেলনা। আবার জানালার কাছে এসে হালকা করে পর্দা সরিয়ে অশ্রু চোখে আদিত্যকে দেখতে লাগলো।

আদিত্যও তাকিয়ে আছে নূরের রুমের জানালার দিকে। ও তখন রাগ করে চলে আসলেও, এখন আর নূরকে না দেখে থাকতে পারছে না। তাই নূরের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে ওকে দেখার জন্য। নূর যেহেতু মানা করেছে তাই ও আর যাবেনা ভেতরে। তবে এখানে থাকতে তো আর নূর মানা করেনি।তাই এখান থেকেই নূরকে দেখবে।
এভাবেই দুজন দুই জায়গায় কষ্ট পাচ্ছে।এভাবে থাকতে থাকতে একসময় রাত পার হয়ে যায়। দুজন সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়।

আদিত্য ভাবে হয়তো সকাল হলে নূরের রাগ কমে আসবে। আর তখন ও আদিত্যের কাছে ফিরে আসবে। কিন্তু তা আর হয়না। শেষমেশ আদিত্য হতাশ হয়ে ফিরে যায়। আর নূর আদিত্যের যাওয়া দেখে আবার কাঁদতে থাকে।
_____

এইভাবে তিনদিন কেটে গেছে। এই তিনদিনেই আদিত্যর পাগল প্রায় অবস্থা হয়ে গেছে। নূর এই তিনদিনেও ফিরে আসেনি। আদিত্য নূরকে কথা দিয়ে এসেছে,যে ও নূরের কাছে যাবে না। তাই ও নিজে থেকে ওর কাছে যেতে পারছে না।আদিত্যর যেন পৃথিবীটাই থেমে গেছে। না ঠিকমত খায়, না ঘুমায়,আর না কারোর সাথে কোনো কথা বলে। ওদিকে নূরেরও একই অবস্থা। বাসার সবাই আদিত্য আর নূরকে অনেক বার জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ওরা দুজনেই কাউকে কিছু বলেনি। আদিত্য রোজ রাতেই নূরের বাসার সামনে গাড়ি নিয়ে এসে গাড়িতে বসে থাকে। নূরকে এক নজর দেখার আশায়। আর নূর জানালা দিয়ে আদিত্যকে দেখে রাত পার করে। মাঝে মধ্যে নূরের ইচ্ছে হয় আদিত্যের কাছে ছুটে যেয়ে আদিত্যের বুকে লুটিয়ে পরতে। কিন্তু আবার নূর নিজের মনকে বুঝিয়ে শক্ত করে নেয়। নিজেকে শক্ত করে নেয়।
নূরের বাবা অনেক বার আদিত্যকে বাসার ভেতরে আসতে বলেছে। কিন্তু আদিত্য যায়না। ও চায় নূর নিজে থেকে যেদিন ওকে ডাকবে, সেদিনই ও যাবে।

রাত ১০টা
নূর রোজকার মতো জানালার কাছে বসে আছে আদিত্যের অপেক্ষায়। রোজ এই টাইমেই আসে আদিত্য। কিন্তু আজ অনেক্ক্ষণ হয়ে গেল আদিত্য আসছে না। নূর বসে বসে অপেক্ষা করছে। দেখতে দেখতে ১১টা বেজে গেল, তবুও আদিত্য আসছে না। নূর মনে মনে ভাবছে, তাহলে কি আজ আদিত্য আসবে না? কথাটা ভেবে নূরের মন খারাপ হয়ে গেল। তাহলে কি আদিত্য ধীরে ধীরে আমাকে ভুলতে শুরু করে দিয়েছে? আমাকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস করছে? এসব ভেবে নূরের চোখে পানি চলে এলো। নূর চোখের পানি মুছে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো।
….তুই কাঁদছিস কেন নূর? এটাই তুই চেয়েছিলি, আদিত্য যেন তোর মায়া কাটিয়ে ওঠে। তাহলে এখন কাদছিস কেন হুম? এসব আবোল তাবোল বলছে আর চোখের পানি ঝরাচ্ছে নূর। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লো নূর।

পরদিন রাতেও নূর অপেক্ষা করছে। কিন্তু আজও আদিত্য আসছে না। নূরের এবার চিন্তা হতে লাগলো। আদিত্যর আবার কিছু হলো নাতো? না না কি হবে? আমার আদিত্য একদম ঠিক আছে। হ্যাঁ একদম ঠিক আছে।
মনে মনে এসব বললেও , নূরের চিন্তা কমলো না। ওর খুব অস্থির লাগতে শুরু করলো। মনটা ছটফট করছে। নূর উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারী করতে লাগলো। নূর ফোন বের ভাবছে আদিত্যকে একবার ফোন করবো? আবার ভাবলো কোন মুখে ফোন করবো? আমি ওর সাথে যে ব্যবহার করে ওকে তাড়িয়ে দিয়ছি। তারপরে কোন মুখে ওর কাছে ফোন দিবো? এসব ভেবে নূর সারারাত ওভাবেই ছটফট করতে লাগলো।

সকাল বেলা উঠেও নূর শান্তি পাচ্ছে না। আদিত্যের খবর না জানা পর্যন্ত ওর কিছুই ভালো লাগছে না। নূর থাকতে না পেরে তানির নাম্বারে ফোন দিল। তানি ফোন রিসিভ করে বললো।
….হ্যাঁ নূর বল।

নূর আমতা আমতা করে বললো।
…..তা তানি শোন না,আদিত্য কোথায়? ও ঠিক আছে তো?

তানি একটু কড়া গলায় বললো।
….কেন? তা জেনে তুই কি করবি? তোর কি ভাইয়ার চিন্তা আছে?

নূর কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
…এ এভাবে বলছিস কেন?

…তো কিভাবে বলবো? তোর কাছ থেকে আমি এটা আশা করিনি। জানিনা তোদের মাঝে কি হয়েছে? তবে আমি তোকে যতদূর চিনি, তুই নিশ্চয় আবার কোনো কিছু নিয়ে বেশি বুঝে এসব করছিস। কিন্তু যাইহোক না কেন তুই এসব একদম ঠিক করিসনি। তুই জানিস ভাইয়ার কি অবস্থা হয়ে গেছে?

নূর কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো।
…মা মানে কি হয়েছে ওর? বলনা তানি প্লিজ? আমি তোর পায়ে পড়ি।

…এই কয়দিন হলো ভাইয়া একদম ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না।কারো সাথে কথা বলে না। ভাইয়ার মুখের দিকে তাকানো যায় না। আর পরশু দিন থেকে ভাইয়ার প্রচুর জ্বর। অতিরিক্ত জ্বরে কাল ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল।

কথাটা শোনার সাথেই নূরের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল।হাত পা থরথর করে কাঁপতে লাগলো। হাত থেকে ফোনটা ঠাসস করে নিচে পড়ে গেল। ওদিক থেকে তানি হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে।কিন্তু নূরের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। ওর মাথায় শুধু আদিত্যর চিন্তা ঘুরছে।ভয়ে ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।এটা কি করলো ও? ওর জন্য ওর আদিত্যর আজ এই অবস্থা হয়ে গেছে। না না আদিত্যের কিছু হবে না। আমার আদিত্যের কিছু হবে না। নূর আর এক মুহূর্তও বসে না থেকে পাগলের এলোমেলো ভাবে দৌড়াল ওর আদিত্যের কাছে।

বিশ মিনিট পর নূর বাসায় এসে পৌঁছাল। এতটুকু রাস্তা কিভাবে এসেছে তার কোনো হুঁশ নেই ওর। সিএনজি থেকে নেমে দৌড়ে বাসার ভেতর ঢুকলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা দৌড়ে ওর রুমে গেল। নিচ থেকে সবাই ডাকতে নিলে তানি ওদের থামিয়ে দিয়ে বললো।
…যেতে দিন ওকে। নূর চলে এসেছে আর কোনো চিন্তা নেই ভাইয়াকে নিয়ে।

নূর দৌড়ে এসে দরজা খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলো। আদিত্য বিছানায় শুয়ে আছে। শরীরের কি অবস্থা হয়েছে, চেহরাটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আদিত্যের এমন অবস্থা দেখে নূরের কলিজাটা ছিড়ে আসছে। ওর অপরাধ বোধে মর যেতে ইচ্ছে করছে ওর। আজ ওর জন্য আদিত্যের এই অবস্থা হয়েছে। ও কিভাবে মাফ করবে নিজেকে? নূর আর এগুতে পারছে না মুখে হাত চেপে ধরে দেয়ালের সাথে এঁটে যেয়ে কাঁদতে লাগলো।

কারোর কান্নার শব্দে আদিত্য চোখ খুলে তাকালো। সামনে তাকিয়ে নূরকে দেখে আদিত্য এক ঝটকায় উঠে বসলো। ওর নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ও স্বপ্ন দেখছে নাতো? ওর প্রাণপাখী ওর কাছে ফিরে এসেছে? আদিত্য খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে নূরের দিকে করুন মায়া ভরা চোখে তাকালো।
আদিত্যের তাকানো দেখে নূর আরও জোরে কেঁদে উঠলো। আদিত্য দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে ছলছল চোখে তাকিয়ে নূরকে নিজের কাছে আসার আহবান জানাল।

নূর আর থাকতে পারলোনা। দৌড়ে যেয়ে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আদিত্যও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো ওর প্রাণপাখীকে। এইকয়দিন পর যেন ওর দেহে প্রাণ ফিরে পেল। সব অসুস্থতা যেন মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল।
নূর আদিত্যকে ছেড়ে দুই হাতে আদিত্যের মুখটা ধরে পাগলের মতো সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো। তারপর আদিত্যের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে কাঁদতে লাগলো। আদিত্যও নূরের কোমড় শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সুখ অনুভব করতে লাগলো।

একটু পরে নূর আদিত্যের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে, দুই হাতে আদিত্যের মুখটা ধরে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বললো।
….আই এ্যাম সরি, আই এ্যাম সরি। আমি অনেক পঁচা, একদম পঁচা আমি। একটুও ভালো না। আমি তোমাকে সবসময় শুধু কষ্ট দেই। কখনো কোনো খুশী দিতে পারি না। আজ আমার জন্য তোমার এই অবস্থা হয়ে গেছে। আমি খুবই পঁচা। আমি আসলে তোমার যোগ্যই না। তুমি কেন এই পঁচা মেয়েটাকে এতো ভালবাস? আমার মতো পঁচা মেয়েকে একদম ভালোবাসা উচিৎ না তোমার।

আদিত্য অশ্রু চোখে মুচকি হেসে বললো।
….হুঁশশ, একদম আমার প্রাণপাখীকে পঁচা বলবে না। আমার প্রাণপাখী সবার থেকে ভালো। হ্যাঁ মাঝেমধ্যে শুধু একটু বোকামি করে ফেলে। একটু মাথামোটাতো তাই আরকি।

নূর কান্নার মাঝে হেসে উঠে আদিত্যে আবার জড়িয়ে ধরলো। আদিত্য নূরকে জড়িয়ে ধরে আবেগি কন্ঠে বললো।
…..যা খুশী করো প্রানপাখী। বাচ কখনো আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। আমি বাঁচতে পারবো না।

নূর আদিত্যকে ছেড়ে দুই কান ধরে মাথা নিচু করে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো।
….আই এ্যাম সরি। আর কখনো এমন করবো না।প্লিজ মাফ করে দাও আমাকে।

আদিত্য নূরের দুই হাত কান থেকে নামিয়ে হাতের তালুতে চুমু খেয়ে বললো।
….আমার তোমাকে ছাড়া আর কিছু চাই না প্রানপাখী। কিছু না। তুমি আছতো আমি আছি। তুমি নেই তো আমিও নেই।

নূর অশ্রু চোখে মুচকি হেসে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরলো। আদিত্যও মুচকি হেসে নূরকে জড়িয়ে ধরলো। ওর প্রাণপাখী ওর কাছে ফিরে এসেছে। আর কিছু চাইনা ওর।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here