ভালোবাসার রংমশাল পর্ব-৩

0
2844

#ভালোবাসার রংমশাল
#পর্ব-৩
#সিফাতী সাদিকা সিতু

নিঝুম সাম্যর ঘরে ঢুকলো দুপুরে। সকাল থেকেই সে সুপ্তির ঘরে ছিলো। গোসলটা সেড়ে ফেলবে তাড়াতাড়ি তাই এই ঘরে আসলো।সাম্য এখন নেই।ঘরে ঢুকে সে দেখলো সারাঘরের ফ্লোরে তার সমস্ত কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এসব যে সাম্যর কান্ড তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। খুব রাগ হলো নিঝুমের।রাগ নিয়ে সে সবকিছু আবার গুছিয়ে রাখলো।ঘরটা পরিষ্কার করতে গিয়ে দেখলো গত রাতের খাবার টুকু পড়ে আছে। নাজনীন বেগম সাম্যর জন্য রেখে গিয়েছিলেন।এর মানে সাম্য খায়নি!নিঝুম খাবার গুলো রাখতে রান্নাঘরে গেলো।কোহিনূর বেগমকে দেখে একটু ঘাবড়ে গেলো।কোহিনূর নিয়ে নিঝুমের হাতে খাবার গুলো দেখে বুঝলো সাম্য রাতে না খেয়ে ছিলো।
তিনি রাগ সামলাতে না পেরে বললেন,দুদিনও হয়নি বউ হয়েছ এতেই আমার ছেলেকে অভুক্ত রেখেছ, শনি হয়ে ভালো ভর করেছো দেখছি আমার সাম্যর ওপর!
নিঝুম ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো। দ্রুত বেরিয়ে গেলো সে রান্নাঘর থেকে।

সাম্য রাফাতের অফিসে এসে বসে আছে দু’ঘন্টা হতে চললো।এর মাঝে রাফাত হাজার বার চেষ্টা করেছে কথা বলতে কিন্তু সাম্য জবাব দেয়নি।রাফাত শেষে বিরক্ত হয়ে নিজের কাজে মন দিয়েছে।

দুটো বাজলে সাম্য উঠে দাঁড়ালো রাফাতকে বললো,চল লাঞ্চটা সেরে আসি।

রাফাত যেন সাম্যর কথা শুনতে পায়নি এমন ভাব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। সাম্য বুঝলো রাফাত এখন তার ওপর শোধ তুলবে। হেসে বললো,”শালা, আমার ওপর শোধ তুলিস পরে,আগে খেয়ে আসি।প্রচুর ক্ষুধা লাগছে।”
রাফাতের মাঝে কোনো ভাবান্তর হলো না।
সাম্য এবার গম্ভীর হয়ে বললো,যাবি নাকি তোকে কোলে তুলে নিয়ে যাবো?তোর অফিসের কর্মীরা তাদের বসকে এমন ভাবে দেখে নিশ্চয়ই খুব মজা পাবে!
রাফাত বরাবরের মতোই চুপ করে থাকলো।
মনে হচ্ছে কাজে করে দেখাতে হবে বলে সাম্য কয়েক পা এগোতেই রাফাত তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে পরলো।সাম্যর দিকে কটমটে তাকিয়ে বের হয়ে গেলো।সাম্য হেসে রাফাতের পিছু নিলো। দুই বন্ধু খাওয়া শেষে কেবিনে ফিরে আসলো।রাফাত দুকাপ কফি অর্ডার করে সাম্যর দিকে তাকালো।

“আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে গেছে।একবার মনে হচ্ছে বিয়ের সিদ্ধান্তটা নেয়া সঠিক হয়নি।”

কে বলেছে নিঝুমকে বিয়ে করতে?ও যা অন্যায় করেছে তার শাস্তি তুই দেয়ার কে?ও নিজের শাস্তি একদিন পাবেই,দুনিয়ায় না হোক পরকালে পাবে।তোর কি দরকার ছিলো এতসব ঝামেলা তৈরী করার।আমার মানা তো শুনিস নি।এখন মজা বোঝ।

মারুফের কষ্ট টা তুই বুঝতে পারলি না!

মারুফ তোর একার বন্ধু? তোর এতো দরদ উথলে উঠে ক্যান? শালা তো কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করলো!দোষ তো ওরই,রাফাত রেগে বললো।

সাম্য একটা দীর্ঘনিশ্বাস গোপন করে বললো,কাউকে কখনো মন থেকে ভালোবেসেছিস তুই?

মানে,এতে আমার কথা আসলো ক্যান,আমার ভালোবাসার সাথে তোর ঝামেলার কি সম্পর্ক?

“না, সম্পর্ক নেই।যদি থাকতো তাহলে মারুফের কষ্ট টা বুঝতি।ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারিত হওয়ার যন্ত্রণা কতটুকু তা অনুভব করতে পারতি,শান্ত অথচ দৃঢ় গলায় বললো সাম্য।”

রাফাত তাচ্ছিল্য ভাবে হেসে বললো, তুই কবে থেকে এতো আবেগী কথাবার্তা বলা শুরু করছিস?এমন ভাবে বলছিস যেন তুই কাউকে ভালোবেসেছিস?

সাম্য যেন হোঁচট খেলো রাফাতের কথায়।সহজে জবাব বেরোলো না তার।ভাবনায় ভেসে উঠলো বৃষ্টি ভেজা ষোড়শী এক কিশোরীর মুুখ।যা ঝড় তুলেছিলো তার হৃদয়ে।সেই ঝড় ছিলো হৃদয় আন্দোলিত করার ঝড়, তা আজ কালবৈশাখী ঝড়ে পরিণত হয়েছে।
সাম্য রাফাতে অফিস থেকে বেরিয়ে কারখানায় এসেছে।সামির রহমান তাকে ডেকেছেন।বড় বাবা কেন তাকে ডেকেছে কিছুটা সে আচঁ করতে পেরেছে।তবুও মুখে কিছু বলতে পারবে না।বড় বাবাকে সে যথেষ্ট সম্মান করে।সামির তাকের দশ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেছে।দশ মিনিট পার হতে আর মাত্র দুমিনিট বাকি।সাম্য তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে সামির রহমান দশ মিনিট পেরোনোর ত্রিশ সেকেন্ড আগে এসে গেলেন।এবারও সাম্যর মুখে হাসি ফুটলো।সে জানে বড় বাবার সময় জ্ঞান অসাধারণ! সামির রহমানের এই গুনটা সাম্যর খুব পছন্দের। তিনি ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ।

দুপুরে বাসায় খেয়েছ না বাইরে? সামির রহমান নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন ।

রাফাতের অফিসে গিয়েছিলাম,ওর সাথে লাঞ্চ করেছি।

বেশ,তোমার জীবনে এখন দায়িত্ব বেড়েছে, এরপর কি করবে ভেবেছ কিছু?ব্যবসায় আসবে নাকি চাকরি করবে?

এখনো সিদ্ধান্তে আসেনি।তবে একটা কোম্পানিতে সিভি জমা দিয়েছি কয়েকদিন আগে।তেমন কিছু হলে তোমাকে জানাবো।

ঠিক আছে।তোমাকে একটা কথা বলবো বলে ডেকেছি।মন দিয়ে শোনো,এতদিন আমি নিঝুমের অভিভাবক ছিলাম এখন পাশাপাশি তুমিও হয়েছো।আমি চাই নিঝুমের প্রতি তুমি সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করো।গ্রামে নিঝুমেট বাবার কিছু জমা জমি, বসত ভিটা আছে।নিঝুমের চাচারা অনেক ঝামেলা করেছিলো দখল নেয়ার জন্য। আমি মামলা করেছিলাম।এতোদিন ধরে চলেছিলো মামলা।রায় নিঝুমের দিকেই এসেছে।তুমি নিঝুমকে নিয়ে গ্রামে যাবে।ওখানকার থানার সাহায্য নিয়ে তুমি নিঝুমের চাচাদের কাছ থেকে দলিল পত্র গুলো ঠিক মতো বুঝে নিবে।আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।ওই এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলা আছে,এটুকু বলে কথা থামালেন সামির রহমান।

সাম্য সবটা শুনে বললো,বড়বাবা নিঝুমের এসব সম্পত্তি লাগবে কেন,এসবরের তো কোনো প্রয়োজন দেখছি না?

তুমি কি বিষয়টা বুঝতে পারো নি।নিঝুমের সম্পত্তি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত চাহিদা নেই।কিন্তু নিঝুমের বাবার সম্পত্তি ওর ন্যায্য অধিকার। সেই অধিকার পাইয়ে দেয়াটা আমার দায়িত্ব।নিঝুম সেই সম্পত্তি কি করবে সেটার সিদ্ধান্ত ও নিজে নিবে।ও চাইলে এতিমখানায় দান করে দেবে বা চাচা, ফুফুদের দিয়ে দেবে। সেটা ওর ব্যাপার।আপাতত তুমি মূল কাগজ গুলো নিয়ে আসো যত দ্রুত সম্ভব ব্রিক্রি করে নিঝুমের আক্যাউন্টে রেখে দিবো।এরপরই আমার দায়িত্ব শেষ।এ গুরু দায়িত্বটা ঠিক মতো পালন করতে না পারলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।

সাম্যর তার বড়বাবার প্রতি সম্মান আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো।মানুষটার চিন্তা ভাবনা কতটা স্বচ্ছ! নিঝুমকে সে কিছু বলতে পারেনা শুধু বড়বাবার জন্য।যে মেয়েটার জন্য বড়বাবা এতো কিছু করছে সেই মেয়েটার কীর্তি- কলাপ কতটা খারাপ,জঘন্য! সাম্য শীতল স্বরে বললো,”ঠিক আছে। আমি আগামি সপ্তাহে নিঝুমকে নিয়ে যাবো গ্রামে।”

আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে।মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে!নিঝুম বৃষ্টি ভালোবাসে।যখন গ্রামে থাকতো বৃষ্টি হলেই মায়ের সাথে বায়না করতো ভেজার জন্য।মা কখনো অনুমতি দিতো কখনো দিতো না।স্কুল থেকে কতদিন ভিজে ভিজে বাড়িতে ফিরতো তার হিসেব নেই!জোর হাওয়া দিচ্ছে, নিঝুম বারান্দায় মেলে দেয়া কাপড় গুলো চটজলদি তুলে ফেললো।জানালা গুলো বন্ধ করতে যেতেই আরোহী এসে বায়না করলো বৃষ্টিতে ভেজার।আরোহী মেঝো চাচার মেয়ে, নিঝুমের সমবয়সী। একটু পর সুপ্তি এসেও বায়না ধরলো।

নিঝুম অসহায় হয়ে বললো,”আমি একটু আগেই গোসল করছি,মামনি শুনলে খুব বকা দেবে।”

সুপ্তি বললো,মা ঘুমিয়েছে। কেউ কিছু বলবে না।চলো তো।ওরা নিঝুমকে টেনে নিয়ে আসলো ছাঁদে। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো তিনজন।নিঝুমের খুব ভালো লাগছে খোলা আকাশের নিচে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজতে।ছাঁদে শুয়ে পরলো ওরা।বৃষ্টির ফোটা ওদের চোখে,মুখে এসে ছুঁয়ে দিতেই আনন্দে শিহরিত হলো।

নিঝুম বললো,আরোহী একটা গান ধরো না,এমন পরিবেশে গান হলে আরো ভালো লাগবে!

আমরা সবাই মিলে গাইবো চলো!
ওরা তিনজনে গান ধরলো,
“দুঃখটাকে দিলাম ছুটি আসবে না ফিরে, এক পৃথিবী ভালোবাসা রয়েছে ঘিরে।
মনটা যেন আজ পাখির ডানা,হারিয়ে যেতে তাই নেইতো মানা।
চুপিচুপি স্বপ্ন ডাকে হাত বাড়িয়ে, মন চায় মন চায়, যেখানে চোখ যায়, সেখানে যাবো হারিয়ে।

সাম্য বাড়িতে ফিরলো কাকভেজা হয়ে।বৃষ্টি আসায় বেশ ঝামেলায় পরে গেছিলো।ঘরে এসে ওয়াশরুমে ঢুকে গোসল সেড়ে নিলো।বাড়ির সবাই এখন ভাতঘুমে।এই বৃষ্টিময় পরিবেশে এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কার কাছে চাইবে কফি।নিজেই বানিয়ে নিবে ভেবে পা চালালো রান্নাঘরের দিকে। কফি বানিয়ে ফেরার সময় দেখলো,সুপ্তি,আরোহী হাসতে হাসতে নিচে নামছে।সবার শরীর ভেজা এর মানে এরা ছাঁদে বৃষ্টিতে ভিজছিলো এতক্ষণ! নিঝুমের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো তার।ভেজা চুল গুলো লেপ্টে আছে পিঠময়।পুরো মুখে বৃষ্টির পানির ফোঁটা লেগে আছে।সাম্যর মনের ভেতরে যেন সাইক্লোন হলো।সে দ্রুত ঘরে চলে আসলো।কেন এতো মনে পরছে সেদিন গুলোর কথা?

চলবে…।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here