ভালোবাসি আমি যে তোমায় পর্ব: ৩০

0
2074

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব:৩০

গাড়ির হর্নের তীব্র সাউন্ডে ঘুম ভাঙ্গলে তাকিয়ে দেখি আমরা ঢাকা চলে এসেছি।আমি নির্ভীক ভাইয়ার বাম বাহুতে হেলান দিয়ে আছি।উনি আমার ডান হাত উনার বাম হাতের আঙুলের ভাঁজে নিয়ে নিজের বাম পায়ের ফিমারের উপর রেখেছেন।আমি মাথা তুলে তাকাতেই উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন।প্রান্ত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনিও নির্ভীক ভাইয়ার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছেন।জারিফ ভাইয়া আর অ্যাঙ্কেল ব্যবসায়ীক আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত,ইচ্ছে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি ইচ্ছেকে ডাকদিয়ে নির্ভীক ভাইয়ার উপর দিয়ে ইচ্ছের সিটে ঝুকে ওর কানে কানে বললাম,

আমি:এই হিমু,তোর রুপা অন্য একটা ছেলের কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমোচ্ছে তুই কিছু করবিনা?(ফিসফিস করে)

আমার কথা শুনে ও প্রান্ত ভাইয়ার দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসে আমার কানে কানে কিছু বলবে তখনি নির্ভীক ভাইয়া আমাকে টেনে সিটে বসিয়ে দিয়ে বললেন,

নির্ভীক:কি এত কানাকানি করছো তোমরা বলো তো?(ভ্রু কুচকে)

আমি:কানাকানি করতে দিলেন কোথায়?পুরোটা তো শুনতেই দিলেন না।(ঠোঁট উল্টিয়ে)

নির্ভীক:ইশ!কি কিউট। (আমার গাল টেনে)

আমি বাঁকা চোখে উনার দিকে তাকালাম উনি ইনোসেন্ট মুখ করে সামনে তাকালেন।

কিছুক্ষণ পর আমরা আমাদের বাসায় চলে আসলাম।রাযীন ভাইয়া রাত ৮টার ফ্লাইটে আসবেন তাই আমরা রাতে এয়ারপোর্ট যাবো।কত দিন পর বাসায় আসলাম।এসেই আমি আর ইচ্ছে আপুর পেছনে লেগে গেলাম।আপু তো লজ্জায় লাল হয়ে আছে, হবু বর আসছে বলে কথা।

সারা বিকেল আপুকে জ্বালিয়ে সন্ধ্যায় আমি, ইচ্ছে,আপু,নির্ভীক আর প্রান্ত ভাইয়া ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছি।আমাদের কথপোকথনের মধ্যেই কেউ আমাকে ডাকলো।পেছনে তাকিয়ে আমি চমকে উঠি।কারন আরাফ ভাইয়া ছাদের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।প্রায় সাড়ে তিন বছর পর দেখলাম।প্রায় ৬ফুট উচ্চতা,ফর্সা দেখতে,লম্বাটে মুখ,মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি,সিগারেট খেয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেলেছে,মাথায় সিল্কি চুল।গায়ে কালো কালার ঢিলেঢালা টি শার্ট পরে আছে, টি শার্টে ভূতের মতো একটা ফেস প্রিন্ট করা আছে।

আরাফ ভাইয়াকে দেখে আমি আপুর পেছনে লুকিয়ে পরলাম।আরাফ ভাইয়া আমার দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ধীর পায়ে আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন।

ইচ্ছে:ভাইয়া,তুমি এখানে?(কাছে যেয়ে)

আরাফ:তোদের সাথে মিট করতে আসলাম।(মুচকি হেসে)

আফ্রা:ফুপ্পি এসেছে?

আরাফ:হুম।

বলেই ভাইয়া আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।অন্যরকম তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।যেন কত যুগ পর আমাকে দেখছে।এমন চাহনি দেখে আমার খুব অসস্তি হচ্ছে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

আরাফ:কেমন আছো,অন্ত?(ধরা গলায়)

আমি চুপ করে আছি, কিছু বলছিনা।আরাফ ভাইয়া তার হাত ধীরে আমার গালের কাছে এনে আমার গালে হাত দিবে এমন সময় নির্ভীক ভাইয়া আমাকে সরিয়ে দিলেন।তারপর বললেন,

নির্ভীক:তুমি আমাকে চিনতে পারছো,আরাফ ভাইয়া?(মুচকি হেসে)

আরাফ:চাঁদ,কেমন আছো ভাই?(হ্যান্ড শেক করে)

নির্ভীক:আলহামদুলিল্লাহ,তুমি?

আরাফ:এখন খুব ভাল আছি।(আমার দিকে তাকিয়ে)ও কে?(প্রান্ত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)

প্রান্ত:আমি প্রান্ত,নির্ভীকের বেস্টফ্রেন্ড।(মুচকি হেসে হ্যান্ডশেক করে)

নির্ভীক:ওর আরও পরিচয় আছে ও আমার মামাতো ভাই।(প্রান্ত ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে)

আমি আর ইচ্ছে তো মহা অবাক।এতদিন শুধু জানতাম উনারা বেস্টফ্রেন্ড কিন্তু আজ জানলাম উনারা আত্মীয়। আরাফ ভাইয়া সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলে আবার আমাকে বলল,

আরাফ:কথা বলবানা আমার সাথে?(আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলাম।আরাফ ভাইয়া একটা ছোট নিঃশ্বাস ছেড়ে সবাইকে বলল,

আরাফ:ওকে গাইস,আমি আসছি।তোমরা মজা কর।(মন খারাপ করে)

বলেই দ্রুত হেঁটে চলে গেল।আমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। সবাইকে স্বাভাবিক দেখালেও নির্ভীক ভাইয়াকে অস্বাভাবিক লাগছে কিন্তু কি ধরনের অস্বাভাবিকতা সেটা বুঝতে পারছিনা।
আরও কিছুক্ষণ ছাদে থেকে আমরা নিচে চলে আসলাম। তারপর রেডি হয়ে এয়ারপোর্ট চলে গেলাম।

গেইটের বাহিরে দাঁড়িয়ে সবাই উকি দিচ্ছি।হাঠাৎ একটা লম্বা সুদর্শন ছেলে গেইটের কাছে আসতেই নির্ভীক ভাইয়া দৌড়ে যেয়ে ‘ভাইয়া’ বলে চিৎকার দিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন।রাযীন ভাইয়াও উনাকে ‘ছোটু’ বলে চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।কি সুন্দর দৃশ্য!কিছুক্ষণ দুইভাই জড়াজড়ি করে ছেড়ে দিলেন তারপর রাযীন ভাইয়া আমাদের দিকে এগিয়ে এসে একে একে সবার সাথে কথা বললেন শুধু আপু বাদে।আপুর দিকে তাকিয়ে শুধু মুচকি হাসলেন।দুজনই খুব লজ্জা পাচ্ছে কারন বাবা,অ্যাঙ্কেল,চাচা,ভাইয়া সামনে আছে।

বাসায় এসে লিভিং রুমে সবাই হৈ চৈ করছি।এখন বড় রা কেউ নেই তাই রাযীন ভাইয়া আর আপু সংকোচ ছারায় কথা বলতে পারছে।রাযীন ভাইয়াকে ফোনে যতটা গম্ভীর ভেবেছিলাম উনি মোটেও তেমন নন।উনি খুব হাসি খুশি আর প্রানোবন্ত মানুষ। কি সুন্দর করে সবার সাথে ইয়ারকি ঠাট্টা করছেন।উনি আমাদের জন্য গিফট এনেছেন সেগুলোই বের করে দিচ্ছেন।আপুর জন্যও অনেক গিফট এনেছেন, একটা স্পেশাল গিফটও নাকি আছে সেটা বিয়ের দিন দিবেন।গিফটের পর্ব শেষ করে সবাই গল্প গুজবে মেতে উঠলাম,

রাযীন:তিন মাসের জন্য এসেছি তারপর আবার ফিরে যেতে হবে।(মুখ ভার করে)

নির্ভীক:তোমার যেখানে যাওয়ার যাও কিন্তু বিয়েটা করে যাও,কবে করবে বলো?(সিরিয়াস হয়ে)

রাযীন:কেন ভাই তোর এত তাড়া কিসের?(টেডি স্মাইল দিয়ে)

প্রান্ত:আরে বুঝ না? তুমি বিয়ে না করলে ও বিয়ে করতে পারছে না।(নির্ভীক ভাইয়াকে এক পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে)

উনার বিয়ে করার কথা শুনে নিজের অজান্তেই আমার মুখ মলিন হয়ে গেল।উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রান্ত ভাইয়ার পেটে একটা পান্চ মেরে বললেন,

নির্ভীক:শাট আপ।
প্রান্ত:আউচ!মেরে ফেলবি নাকি?(চোখ বন্ধ করে)

রাযীন:ওকে ছোটু, তুই একদম চিন্তা করিস না আমি বিয়ে না করে কোথাও যাবো না।(মুচকি হেসে আপুর দিকে তাকিয়ে)

প্রান্ত:আহা রে,বিয়ের চিন্তা করে করে বাচ্চা টা শুকিয়ে যাচ্ছে।(এক হাত দিয়ে নির্ভীক ভাইয়ার দুই গাল টিপে ধরে)

নির্ভীক:তোকে তো আমি হত্যা করে ফেলবো। (প্রান্ত ভাইয়ার গলা চেপে ধরে)

রাযীন:আচ্ছা?আমার শালী দুইটা এত শান্ত কেন?শালী হবে সকাল বেলার কাকের মতো,সব সময় কা কা খা খা করতেই থাকবে তা নয় এরা একদম চুপ চাপ বসে আছে।(আমাদের দিকে তাকিয়ে)

আমি:দুলাভাই, দুলাভাই,দুলাভাই…শালী দের পক্ষ থেকে আপনাকে শান্তি প্যাকেজ অফার দেওয়া হয়েছে আর এই অফার খুবই সীমিত সময়ের জন্য সো উপভোগ করুন।(হাত নাড়িয়ে)

রাযীন:বাহ!চমৎকার!(মুচকি হেসে)

ইচ্ছে:আপনি খুশি তো দুলাভাই?দুলাভাই খুশ তো শালীরাও খুশ।(মুচকি হেসে)

আর কোন কথা হওয়ার আগেই ফুপ্পি সবাইকে খেতে ডাকলো।যেহেতু আম্মু নেই তাই ফুপ্পি আমাদের বাসায় এসেছে।বড় রা ডিনার সেরে টুকটাক গল্প করছে। আমরা শুয়ে পরলাম কালই আবার রাজশাহী ফিরে যাবো।আমি আর ইচ্ছে আমার ঘরে শুয়ে আছি হঠাৎ নিচে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনে ধরফরিয়ে লাফিয়ে উঠলাম।দরজা খুলে দুজনই নিচে এসে দেখি এখানে সবাই আছে।আরাফ ভাইয়া রেগে জারিফ ভাইয়ার সাথে কথা বলছে।

আরাফ:তুই আমাকে সুযোগ দিসনি তাই পরিস্থিতি এমন হয়েছে।(রাগি কন্ঠে)

জারিফ:আমি কি সুযোগ দিব হ্যাঁ?ছোটপাখি চায় না তোকে, বুঝেছিস তুই?ও চায় না তোকে।(রেগে)

আরাফ:তোর জন্য চায় না,সব তোর জন্য হয়েছে।(রেগে)

বাবা:আরাফ,এসব কথা কেন উঠছে আবার?(আরাফ ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে)

আরাফ:মামা,আমি যা বলার ক্লিয়ার করে বলে দিয়েছি।তোমরা কি করবে না করবে ভেবে দেখো।(মাথা নিচু করে)

জারিফ:আমার বোনের ব্যাপারে আমি যা বলবো সেটাই হবে।তুই ওকে ভুলে যা।(শান্ত হয়ে)

আরাফ:পারবোনা।(ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)

ফুপ্পি:কেন পাগলামি করছিস, বাবা?(কাঁদতে কাঁদতে)

আরাফ:আম্মু,তুমি ওদের বোঝাও না একটু,ওরা কেন বুঝতে চাইছেনা বলোতো?অন্ত আমার কাছে ভাল থাকবে,আমি ভাল রাখবো ওকে।(ফুপ্পির কাছে যেয়ে উত্তেজিত হয়ে একদমে)

আমি আপুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছি।ভয় করছে।আরাফ ভাইয়া আবার আগের মতো পাগলামি করছে।আরাফ ভাইয়া কবে বুঝবে?আমি কোনদিন তাকে ভালোবাসিনি আর কোনদিন ভালোবাসবোও না।

ফুপ্পি:তুই কেন বুঝিস না?অন্ত তোকে পছন্দ করেনা।তুই ওকে ভালোবাসলেও ও তোকে ভালোবাসেনা।জোড় করে ভালোবাসা হয়না।ওর সুন্দর জীবন তুই নষ্ট করে দিবি?(আরাফ ভাইয়ার গালে হাত দিয়ে)

আরাফ ভাইয়া ফুপ্পির হাত সরিয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো,

আরাফ:কি নেই আমার হ্যাঁ?কি নেই?আমার মতো তোকে কে ভালোবাসতে পারবে?সবটা দিয়ে তোকে ভালোবেসেছি,কি করলে তুই আমাকে মানবি?..কি করলে?(রেগে ধমক দিয়ে)

আমি এইবার কেঁদেই দিয়েছি।জারিফ ভাইয়া এসে আরাফ ভাইয়াকে আমার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে বলল,
জারিফ:তুই ওকে কোনদিনও পাবি না,ওকে যদি সত্যি ভালোবেসে থাকিস তাহলে এসব বন্ধ কর।(একবাহু ঝাকিয়ে রেগে)

আরাফ:কেন পাবো না?কি দোষ করেছি আমি?(হাত ঝাড়া দিয়ে রেগে)

জারিফ:তুই ছোটপাখিকে এসিড ছুড়েছিলি না?সেটা ওর গায়ে লাগুক আর না লাগুক ছুড়েছিস তো?ওর কি দোষ ছিল?কোন দোষ ছিল না।সব দোষ তোর ছিল।খুনি তুই, খুন করেছিস কুহেলীকে।কান খুলে শুনে রাখ,এই জারিফ যতদিন বেঁচে আছে তুই আমার বোনকে পাবিনা,আমাকে যদি মেরেও ফেলিস তাও তুই ওকে পাবিনা।(চোখ মুখ শক্ত করে)

আরাফ ভাইয়া চুপ হয়ে গেল।টপ টপ করে চোখ দিয়ে পানি পরছে।পাথরের মতো শক্ত হয়ে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ ফ্লোরে হাঁটু গেরে বসে বলল,

আরাফ:আমি খুনি নই।কুহেলী কার এক্সিডেন্টে মারা গেছে।আমি তখন অন্তুর স্কুলে ছিলাম।ওর মৃত্যুতে আমার কোন হাত নেই।(চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে)

জারিফ:মৃত্যুর দুমিনিট আগে ও আমাকে ফোন করে বলেছে তুই অন্তকে স্কুলের বারান্দায় আটকিয়ে ধোঁয়া উঠা কাচের পাত্র নিয়ে ওকে ভয় দেখাচ্ছিস।ও আমাকে জানিয়ে ফোন কেটে রাস্তা পার হয়ে তোকে আটকাতেই যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে,

জারিফ:কি দোষ ছিল ওর বল?আমার বোনকে তোর হাত থেকে বাঁচাতে চাওয়া ওর দোষ ছিল?আমার কি দোষ ছিল?কোন অপরাধে নিজের ভালোবাসা হারাতে হল আমাকে,বল?(ধরা গলায়)

সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইচ্ছে আর আপু আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে।কান্নায় আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছে।হেঁচকি তুলে কাঁদছি।জারিফ ভাইয়া এত কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে,ভাইয়ার কষ্ট যে আমি সহ্য করতে পারিনা।সব হয়েছে আরাফ ভাইয়ার জন্য,আরাফ ভাইয়াকে আমি কোনদিনও ক্ষমা করবোনা।

জারিফ ভাইয়া নাক টেনে চোখ মুছে আবার বলতে থাকলো,

জারিফ:তোকে আমরা অনেক ভালোবাসি,পারিনি তোকে শাস্তি দিতে,ক্ষমা করে দিয়েছি।কিন্তু তোর জন্য আমার বোনের যদি কিছু হয় আমি তোকে খুন করে ফেলবো।তুই ভুল করেছিস তুই সাফার করবি কিন্তু ছোটপাখি তো কোন ভুল করেনি ও কেন সাফার করবে?(চোখ মুখ শক্ত করে)

আরাফ:তুই প্রতিশোধ নিচ্ছিস তাইনা?কুহেলীকে পাসনি এখন আমাকেও আমার ভালোবাসা পেতে দিবিনা।(চোখ মুছে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়িয়ে)

জারিফ:কিসের ভালোবাসা?কাকে ভালোবাসিস তুই?ভালোবাসলে তারমুখে এসিড নিক্ষেপ করা যায়?ভালোবাসার মানুষের গলায় সাপ পেঁচিয়ে দিয়ে গোডাউনে আটকে রাখা যায়?ধাক্কা মেরে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেওয়া যায়?কুৃুকুরে ভয় পায় জেনেও কুকুরের সামনে আটকে রাখা যায়?….এখন তুই কি বলবি?এই সব কিছু ভালোবেসে করেছিস?আরে চাই না তোর এসব ভালোবাসা, আমি আমার বোনকে যোগ্য ছেলের হাতে তুলে দিব আর তুই সেটা দাঁড়িয়ে থেকে দেখবি।তোর মতো অযোগ্য ছেলেকে তো জীবন থাকতে দিবনা(রেগে)

আরাফ:মানছি আমি ভুল করেছিলাম কিন্তু যা করেছি নিজের ভালোবাসাকে পাবার জন্য করেছি। তোমাকে এসিড দিলে কেউ তোমাকে বিয়ে করতোনা কিন্তু আমি করতাম।চাইনা আমার এমন ভয়ংকর রুপ, তুমি বিশ্রী হলেও আমার তোমাকেই চাই কারন ভালোবাসি আমি যে তোমায়।(আমার সামনে এসে আমার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে)

জারিফ ভাইয়া আরাফ ভাইয়াকে আমার সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে আপু আর ইচ্ছের কাছ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে নির্ভীক ভাইয়ার সামনে নিয়ে গিয়ে আমার হাত উনার হাতের মধ্যে দিয়ে উনাকে কানে কানে কিছু বলল তারপর জোড়ে জোড়ে বলল,

জারিফ:তোরা এখনই রাজশাহী যাবি,প্রান্ত তুই ওদের সাথে যা।(প্রান্ত ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)তোরা ছোটপাখির ব্যাগ ফোন আর কিছু থাকলে নিয়ে আয়(আপু আর ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে)

ভাইয়ার কথা মত ওরা আমার রুমে চলে গেল।প্রান্ত ভাইয়াও রুমে গেল।আরাফ ভাইয়া ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে,চোখ দিয়ে জল গরিয়ে পরছে।কিন্তু আমি তারজন্য সামান্যতম কষ্ট ফিল করছিনা।আমার ঘৃণা আসছে।

নির্ভীক ভাইয়া আমার হাত শক্ত করে ধরে আছেন।বাবা,অ্যাঙ্কেল আর রাযীন ভাইয়া আমাকে নিয়ে সাবধানে যেতে বললেন।জারিফ ভাইয়া আরাফ ভাইয়ার সামনে যেয়ে বলল,

জারিফ:তোর ভুলের শাস্তি কঠোর এই কঠোর শাস্তি তুই সহ্য করতে পারলেও আমরা পারবোনা।তোর বাবা-মাকে দেখ,তোর জন্য কত কষ্ট পাচ্ছে আর তোর বোন?ওর কথা ভেবেছিস একবারও?মেয়েটা কত চেন্জ হয়ে গেছে।আরে সব বড় ভাইয়েরা ছোট ভাইবোনদের প্রেরণা হয় কিন্তু তোর বোন তোকে ভাই বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায়।দেখ,আমরা এখনও তোকে অনেক ভালোবাসি তাই তোকে শাসন না করে নিজের বোনকেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছি।আমরা চাই তুই ভাল থাক, ছোটপাখি ভাল থাকুক। ওর কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করিসনা,একটু দয়া কর ওর উপর। ও যে অনেক ছোট, আমার ছোট্টপাখি।তুই তো ভালোবাসিস তাহলে কেন ওর ক্ষতি করতে চাইছিস? (এক হাত আরাফ ভাইয়ার কাঁধে রেখে)

ভাইয়ার কথা শেষ হতেই আরাফ ভাইয়া জারিফ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো।কাঁদতে কাঁদতে বলল,
আরাফ:প্লিজ অন্তকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিসনা।আমি তোকে কথা দিচ্ছি আমি ওর কোন ক্ষতি করবোনা। আমি কারও কোন ক্ষতি করবোনা।আমি ওকে স্পর্শও করবোনা শুধু ওকে আমার আশেপাশে থাকতে দে।আমি খারাপ নই,আমি খুনি নই।

জারিফ:হুম তোর সামনে থাকতে দিব।তুই ঠিক হো তারপর।সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন,তুই ট্রাই করনা একটু।আমাকে দেখ আমি পেরেছি তুই পারবিনা কেন?তুই বলতিস না তুই আর আমি এক তাহলে এখন আলাদা কাজ কারবারি কেন করছিস রে ভাই?(স্বান্তনা দিয়ে)
আরাফ:কষ্ট হচ্ছে খুব।(ধরা গলায়)

জারিফ:ঠিক হয়ে যাবে সব।(পিঠে ধীরে ধীরে থাপ্পড় দিয়ে)

জারিফ ভাইয়া আরাফ ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে আর নির্ভীক ভাইয়াকে নিয়ে বাসার বাহিরে চলে আসলো। আমাদের গাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে ড্রাইভার চাচাকে ভাল করে ড্রাইভ করতে বলল।প্রান্ত ভাইয়া এসে সামনের সিটে বসলো।ভাইয়া আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
জারিফ:চাঁদ,আমার ছোটপাখিকে একদম কাঁদতে দিবিনা,দিস ইজ মাই অর্ডার।(মুখে হাসি ঝুলিয়ে)

নির্ভীক:ইয়েস বস।(হেসে)

জারিফ ভাইয়া ড্রাইভারকে গাড়ি চালাতে বলল।গাড়ি চলতে শুরু করলো।মধ্যরাত হওয়ায় রাস্তায় তেমন ভীর নেই।বাসা থেকে অনেক দূর চলে এসেছি আমরা। এখনও আমার হেঁচকি উঠছে কিছুতেই কনট্রোল করতে পারছিনা।কুহেলী আপুর কথা খুব মনে পরছে।সে থাকলে ভাইয়ার এত কষ্ট থাকতোনা।কত ভালোবাসতো আপু আমাদের।আমি ছিলাম তার নয়নের মণি,কুহেলী আপু ভাইয়াকে বলতো…

“জানো জারিফ তোমার ছোটপাখিকে আমি তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসি,তুমি আবার বলনা মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি।”

“জারিফ জানো আমি মাছের কাঁটা বাছা শিখে নিয়েছি তোমার বাড়িতে বউ হয়ে গেলে তোমার ছোটপাখিকে মাছের কাঁটা বেছে খাওয়ানোর দায়িত্ব আমার,পাখিটা মাছ পছন্দ করে কিন্তু কাঁটার ভয়ে খায় না।”

এসব কথা মনে আসলেই নতুন করে কান্নার বেগ বাড়ছে।নির্ভীক ভাইয়া আমার চোখ মুছে দিয়ে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,

নির্ভীক:অনেক অনেক আগের কথা,একটা ছিঁচকাঁদুনী পিচ্চি রাজকুমারী ছিল।সারা দিন রাত শুধু কান্না করতো।কান্না করা তার প্যাশন ছিল।একটু কিছু হলেই কান্না শুরু থামার আর কোন নাম গন্ধ নেই।

এটুকু বলেই উনি আমারর দিকে তাকালেন।তারপর আমাকে নিয়ে জানালার দিকে চেপে বসে জানালার কাচ নামিয়ে দিলেন।আমাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আবার বলতে থাকলেন,

নির্ভীক:পাশের রাজ্যে ছিল এক রাগি রাজকুমার।রাগ তার নাকের ডগায় থাকে সব সময়।একদিন রাজকুমারের জন্মদিন ছিল আশেপাশের সব রাজ্যের সবাইকে ইনভাইট করা হয়েছিল। রাজকুমারীও গিয়েছিল অনুষ্ঠানে,যেয়ে দেখে রাজকুমার রেগে সবকিছু ভাঙচুর করছে কারন তার এসব অনুষ্ঠান পছন্দ নয়,সে কিছুতেই কেক কাঁটবেনা। এসব দেখেই রাজকুমারী কান্না শুরু করেদিল।

প্রান্ত:তারপর কি হলো?(ঘাড় ঘুড়িয়ে পেছনে তাকিয়ে)

নির্ভীক:রাজকুমারের রাজকুমারীর কান্না দেখে তার সব রাগ উড়ে গেল, সে রাজকুমারীর কান্না সহ্যই করতে পারছিলনা তাই সে ভাবতে থাকলো কিভাবে কান্না বন্ধ করা যায়।কিছুক্ষণ ভেবেই কান্না থামানোরএকটা উপায় বের করে ফেলল। রাজকুমার রাজকুমারীকে কোলে নিয়ে বললো,”ইয়াক ছিঃ,তোমার নাক থেকে ঝোল বের হচ্ছে ইশ!কি বাজে গন্ধ।” ব্যস,এটুকুতেই কাজ হয়ে গেল।গন্ধের ভয়ে রাজকুমারী টা কান্না করাই ভুলে গেল।

বলেই উনি আর প্রান্ত ভাইয়া হেসে দিলেন।আমার মোটেও হাসি পায়নি তাই চুপ করে থাকলাম।

প্রান্ত:তুই কি বোনুর নাক থেকে বাজে গন্ধ পাচ্ছিস?তাই এমন গল্প শুনালি?(ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে)

প্রান্ত ভাইয়ার কথা শোনার সাথে সাথে আমি টিস্যু দিয়ে নাক চোখ মুছে ফেললাম।উনি কি সত্যি গন্ধ পেলেন?সেজন্যই জানালা খুলে দিলেন?নির্ভীক ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে প্রান্ত ভাইয়াকে বললেন,

নির্ভীক:মজার ব্যাপার কি জানিস প্রান্ত?আফটার আ লং টাইম,রাজকুমারী টা সেই একই রকম ছিঁচকাঁদুনি আছে রাজকুমারও একই রকম আছে।রাজকুমারী কাঁদলে এখনও তার সহ্য হয়না তাই সে এখনও কান্না থামানোর উপায় বের করতে থাকে। অদ্ভূত ভাবে পেয়েও যায়, উপায় গুলো আবার কাজেও দেয়।

আমি:ওটা পঁচা গল্প রাজকুমারী টাও পঁচা ছিল আর আমার নাক দিয়ে ঝোল বের হয়না, গন্ধও নেই বুঝেছেন?(মুখ ফুলিয়ে)

নির্ভীক:জানিতো,আমার পিচ্চি তো কিউট তাই তার নাক দিয়ে ঝোল ও বের হয়না গন্ধও বের হয়না।(আমার গালে হাত দিয়ে)
উনার হাত সরিয়ে দিয়ে আমি বাহিরে তাকালাম।ল্যাম্পপোস্টের আলোই অন্ধকার রাতটা খুব ভাল লাগছে।আলো না থাকলে অন্ধকার ভাল লাগতো না আবার অন্ধকার না থাকলে এই ল্যাম্পপোস্টের আলোটাও ভাল লাগতোনা।রাস্তা দিয়ে শা শা করে গাড়ি চলছে।আমি জানালায় হেলান দিয়ে বাহিয়ে তাকিয়ে আছি।মৃদু ঠান্ডা বাতাসে আমার চুলগুলো উড়ছে।চোখের পাপড়ি গুলো দুলছে। নির্ভীক ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছেন এটা আমি না দেখলেও ফিল করতে পারছি।থাকুক তাকিয়ে আমি এভাবেই থাকবো।হঠাৎ নির্ভীক ভাইয়া জানালার কাছে এসে মাথা নিচু করে আকাশের দিকে তাকালেন।তারপর বললেন,

নির্ভীক:দপ দপে ওই তারাটা আজ উঠেছে?(খোঁজা খুঁজি করে)

আমি:কোন তারা?(ভ্রু কুচকে)

নির্ভীক:চাঁদের পাশের ওই তারাটা।
আমি:আজ তো চাঁদই উঠেনি।কি করবেন ওটা দিয়ে?

নির্ভীক:তোমাকে দেখাতাম।জানো একদম পিচ্চি তারা তাও তার কি তেজ।কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেই মন হারিয়ে যায়।(মুচকি হেসে)

আমি:আপনি আকাশ ভালোবাসেন তাইনা?(মিষ্টি হেসে)

নির্ভীক:হুম বাসি তবে আকাশবাসিদের বেশি ভালোবাসি।(আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি:আকাশবাসি?(ভ্রু কুচকে)
নির্ভীক:হুম, যারা আকাশে বাস করে-চাঁদ,তারা,সূর্য,গ্রহ,নক্ষত্র,উল্কা,মেঘ ইত্যাদি।(সামনে তাকিয়ে)

আমি:আর কি ভালোবাসেন?(জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে)

নির্ভীক:ভালোবাসতে ভালোবাসি।(আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি:কিভাবে?

নির্ভীক:শিখতে চাও?(ফিসফিস করে)

আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম।উনি আমার পাশ ঘেষে বসে আমার কানে কানে বললেন,

নির্ভীক:বড় হও তারপর শেখাবো।

আমি:ভালোবাসতে ভালোবাসি এটা শিখতে বড় হওয়া লাগে?(উনার চোখের দিকে তাকিয়ে)

নির্ভীক:আর কোন কথা নয়।ঘুমাও, দেখ প্রান্ত ঘুমিয়ে পরেছে।তুমিও ঘুমাও।চোখবন্ধ কর।(আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি:ঘুম আসছেনা।

নির্ভীক:ওকে চলো একটা গেইম খেলি।(দুই হাতের তালু ঘষে)
আমি:কি গেইম?(এক্সাইটেড হয়ে)

নির্ভীক:তুমি জানালার পাশে মাথা লাগিয়ে পাঁচমিনিট চোখবন্ধ করে বাতাসের কথা শুনবা তারপর আমি শুনবো।দুজন কি শুনলাম সেগুলো বলবো, মিলে গেলেই দেখবা কি মজা।(সিরিয়াস ভঙ্গিতে)

আমি:এমন গেইম আছে নাকি?(ভ্রু কুচকে)
নির্ভীক:হুম আছে তো,জাস্ট ট্রাই ইট।(মুচকি হেসে)

আমি:ওকে আপনি ঘড়ি দেখুন পাঁচমিনিট হলে আমাকে ডেকে দিবেন।

বলেই আমি জানালার পাশে হেলান দিয়ে থাকলাম।প্রথম দুমিনিটে খেয়াল করলাম রাতের শীতল বাতাসে আমার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে।আরও দু-এক মিনিট পর আমার মস্তিষ্ক বলছে নির্ভীক ভাইয়াকে বল চোখ আর খুলতে ইচ্ছে করছেনা কিন্তু হৃদয় বলছে এই একদম কথা বলিসনা এভাবেই থাক, খুব শান্তি লাগছে।মন আর মস্তিষ্কের কথা শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি নিজেও জানিনা।

যখন ঘুম ভাঙলো আশেপাশে তাকিয়ে দেখি আমি আমার নিজের রুমে শুয়ে আছি।সকালের মিষ্টি আলোই চারপাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে।

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here