#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#sohani_Simu
২১.
মাঝরাত্রি না হতেই অন্তর ঘুম ভেঙ্গে গেল।অন্তর মনে হচ্ছে সে ঘুমায়নি।এতক্ষণ চোখ বন্ধ করে ছিল।কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানেনা।হয়তো সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ভাঙলো অথবা দীর্ঘ সময় ঘুমালো।বিছানায় বসে থেকেই অন্ত খোলা দরজার দিকে তাকালো।বারান্দায় বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে।সেই আলোতে ঘরের অন্ধকার কিঞ্চিৎ দূর হয়েছে।মাথার উপর মৃদু স্পিডে ফ্যান ঘুরছে।পাশের ঘর থেকে কিলকিল খিলখিল হাসির আওয়াজ আসছে।অন্ত ধড়মড় করে বিছানা থেকে নামলো।নষ্ট করার মতো সময় এখন তার নেই।আবছা আলোতে দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হতেই বারান্দার এক কোণায় নির্ভীককে ফোনে কথা বলতে দেখেই দাঁড়িয়ে গেল।ধীরে ধীরে হেঁটে নির্ভীকের পেছনে দাঁড়িয়ে টিশার্ট টানতেই নির্ভীক ভ্রু কুচকে পেছনে তাকালো।অন্তকে দেখে কুচকানো ভ্রু স্বাভাবিক করে ফোনে বলল,
‘ওকে ভাইয়া আ’উইল কল ইউ লেটার।’
কল কেঁটে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে বলল,
‘ঘুম ভেঙে গিয়েছে?’
অন্ত বারান্দার দেয়ালে খোঁজা-খুঁজি করে সুইচ বোর্ডের কাছে যেয়ে বারান্দার আলো নিভিয়ে দিল।বাইরে খটখটে জ্যোৎস্না তাই অন্ধকারেও সব দেখা যাচ্ছে।অন্ত রেলিং এ হেলান দিয়ে মেঝেতে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।নির্ভীক চিন্তিত হয়ে অন্তর পাশে বসে বলল,
‘এনি প্রবলেম?’
অন্ত নির্ভীকের এক বাহুতে মাথা হেলিয়ে দিয়ে মলিন কন্ঠে বলল,
‘নির্ভীক ভাইয়া?’
‘হুম?’
অন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে থাকলো।নির্ভীক অন্তর গালে কপালে হাত দিয়ে বলল,
‘জ্বর এসেছে তোমার।রুমে চলো।’
অন্ত মাথা তুলে নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীকের এক হাত নিজের দুইহাতের মধ্যে নিয়ে বলল,
‘আপনি প্রমিস করেছিলেন এই পৃথিবীর বিনিময়েও আমাকে কখনও ছেড়ে যাবেননা।ইউ প্রমিস মি না?’
নির্ভীক মুচকি হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘ইয়াহ,মনে আছে তোমার?’
অন্ত নিঃশব্দে কান্না করছে।কান্না আটকানোর চেষ্টা করে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
‘আরাফ ভাইয়া জোর করে নিয়ে যাবে আমাকে।’
নির্ভীক অন্তকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কেউ নিয়ে যেতে পারবেনা,ডোন্ট ক্রাই।’
অন্ত নির্ভীকের বুকে মাথা রেখে নাক টেনে বলল,
‘আরাফ ভাইয়া যা বলবে ভাইয়া তাই শুনবে।’
নির্ভীক অন্তর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ডোন্ট ওরি, ভাইয়া কিছু শুনবেনা।’
অন্ত চোখবন্ধ করে বলল,
‘আমরা কি বিয়ে করে নিয়েছি?’
নির্ভীক চমকে গেল।এতক্ষণে বুঝতে পারলো অন্তর সবকিছু মনে পরে গেছে।দুইহাতে অন্তর গাল ধরে খুশি হয়ে অন্তর দিকে তাকিয়ে থাকলো।অন্ত নির্ভীকের হাতের উপর হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বলল,
‘কেমন যেন হচ্ছে।কি বলছি কিছু বুঝতে পারছিনা,হেল্প মি নির্ভীক ভাইয়া,প্লিজ হেল্প মি।’
কথা বলতে বলতে অন্ত নেতিয়ে পরছে।নির্ভীক ব্যস্ত হয়ে অন্তকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিল।পাশের ঘর থেকে প্রান্ত আর ইচ্ছেমতিকে ডেকে নিল।অন্ত সারারাত বিরবির করে পুরোনো কথা বলেছে।নির্ভীক রাযীনের সাথে কথা বলে চিন্তামুক্ত হয়ে অন্তর পাশে বসে থাকলো।
—
জানালা দিয়ে সকালের সোনাঝরা রোদ চোখে পরতেই অন্তর ঘুম ভেঙ্গে গেল।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে পুরো ঘরে চোখ বুলালো।ঘরে আর কাউকে দেখতে না পেয়ে বিছানা থেকে নেমে ফ্যানের সুইচ অফ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।উঠোনের কুয়ো তলায় সবাই দাঁড়িয়ে থেকে হৈ-চৈ করছে আর বিশাল বিশাল রুই-কাতলা মাছ দেখছে।সাফির মা আর কয়েকটা মহিলা গোল হয়ে বসে মাছ কাটছেন।একটু দূরেই ডালিম গাছের পাশে দাঁড়িয়ে নির্ভীক কানে ফোন ধরে কারও সাথে কথা বলছে আর প্রান্ত কিয়য়ামের সাথে কুয়োর উপর বসে হেসে হেসে কথা বলছে।ইচ্ছেমতি সাফির মায়ের পাশে বসে মাছে হাত দিয়ে দুই হাত মাখামাখি করে ফেলেছে।অন্ত নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
ফ্রেশ হয়ে অন্ত নিচে এসে আইরিন আর তামান্নার মাঝখানে চেয়ারে বসলো।সাফির মা অন্তকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে বললেন,
‘তুমি উঠেছো?চলো তোমাকে খেতে দিই।আসার পর থেকে কিছু খাওনি।সবাই সকালের নাস্তা করে ফেলেছে।’
অন্ত মুচকি হেসে বলল,
‘ব্যস্ত হবেন না অ্যান্টি আমি তুলে নিয়ে খাবো।’
ইচ্ছেমতি ভ্রু কুচকে বলল,
‘তোর খাবার রুমের মধ্যে টেবিলের উপর রাখা আছে।তাড়াতাড়ি খেয়ে আয় যা।আমরা ঘুরতে যাবো এখন।’
অন্ত বার বার নির্ভীকের দিকে তাকাচ্ছে।নির্ভীক উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে, একবারও অন্তর দিকে তাকাচ্ছে না জন্য মুখ ফুলিয়ে আইরিনকে নিয়ে ঘরে চলে আসলো।অন্ত টেবিলের উপর থেকে ভাতের প্লেট নিয়ে খেতে লাগলো আর আইরিন ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বলল,
‘বিকেলে আমি এই শাড়িটা পরবো।অ্যান্টি আমাদের সবাইকে একটা করে শাড়ি পরতে দিয়েছে।আমরাতো এক কাপড়ে চলে এসেছি।বিকেলে স্কুলের ফাংশনে সবাই শাড়ি পরবো।পাশের বাসার একটা আপু আছে উনার ব্লাউজ আর পেটিকোট নিয়ে এসেছি তোর সাইজের ও একটা ব্লাউজ এনেছি,শাফির তেরো বছরের কাজিনের ব্লাউজ।’
শেষের কথাটা হাসতে হাসতে বলে আইরিন অন্তর দিকে তাকালো।অন্ত মুচকি হেসে বলল,
‘আমার শাড়ি কোনটা?’
আইরিন সোফার উপর থেকে কালো রঙের একটা শাড়ি নিয়ে অন্তর কাছে যেতে যেতে বলল,
‘এই তো এই কালো জামদানীটা।এটা আমি নিতে চেয়েছিলাম কিন্তু সবাই বলল তোকেই বেশি মানাবে এটাতে।’
অন্ত খেতে খেতে বলল,
‘তুই নিলে নে।’
‘আরে না আমি তো পরে এই সবুজটা চয়েস করলাম।আচ্ছা তাড়াতাড়ি খা আমরা আজকে সাফিদের পুকুরে গোসল দিব।’
অন্ত ভীত চোখে তাকিয়ে বলল,
‘ আমি সাঁতার জানিনা।’
আইরিন উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,
‘কে আবার জানে।আমিও জানিনা।সাফি আর রিপন জানে।নির্ভীক ভাইয়া আর প্রান্ত ভাইয়াও নাকি জানেন।যারা সাঁতার জানে তারা পানিতে নামবে আর যারা জানেনা তারা সিঁড়িতে বসে মগ দিয়ে গোসল করবে।সকালে আমরা পুকুর দেখে এসেছি।বিশাল বড় আর মাছ আছে প্রচুর,শানবাঁধানো ঘাট আছে।’
অন্ত খেতে খেতে বলল,
‘আমরা বাসায় যাবো কখন?’
আইরিন শাড়ি ভাজ করতে করতে বলল,
‘নির্ভীক ভাইয়া তোকে সকালেই নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন অ্যাঙ্কেল-অ্যান্টি জোর করছিলেন তাই গেলেন না।অ্যাঙ্কেল অ্যান্টি বলছেন সাফির সাথে আরও কিছুদিন থাকতে।বাবা তো ফোন করে এমনিতেই বকছে আর থাকা ঠিক হবেনা।’
অন্ত খাওয়া থামিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ আমরাও অনেক লোক এসেছি।উনারা বিরক্ত হচ্ছেন হয়তো।’
আইরিন আবার আয়নার সামনে যেয়ে মাথায় চিড়ুনি করতে করতে বলল,
‘না না উনারা আমাদের জন্য বিরক্ত হননি।ওই এমপিরা আসবে তাদের জন্য বিরক্ত হচ্ছেন।কুঁড়ি জন লোক আসবে এমপির সাথে তাও নাকি গুন্ডা মস্তান টাইপের।রাতে এখানে খাওয়া-দাওয়া করবে।কি কি খাবে হাংলার মতো সেটার আবার লিস্ট পাঠিয়েছে।অ্যাঙ্কেল আমাদের বলেছেন ওই লোকগুলো আসলে আমরা যেন ঘর থেকে বের না হই।লোকগুলো খেয়েই চলে যাবে।’
অন্ত খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে আইরিনের কাছে যেয়ে নিজের চুল সুন্দর করে চিড়ুনি করে নিল।সারারাত জামাটা পরে থাকায় কেমন কুচকে গিয়েছে তাই বলল,
‘চল এখনই গোসল করে শাড়ি পরি।’
আইরিন বলল,
‘এখন নয়,এগারোটায়।চল বাহিরে গিয়ে দেখি ওরা কি করছে।’
অন্ত ঠোঁট উল্টে বাহিরে আসলো।কুয়োর পাড়ে কয়েকটা লাল নীল প্লাস্টিকের চেয়ার ফেলা আছে সেখানে গিয়ে বসলো।নির্ভীককে এখনও ফোনে কথা বলতে দেখে ভ্রু কুচকালো।মনে মনে ভাবলো নিশ্চয় প্রিয়তা নামের সেই গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে।ইচ্ছেমতি হাত ধুয়ে অন্তর কাছে এসে বসে বলল,
‘রাতে ছাদে আমরা রান্না করব।রাজহাঁসের মাংস দিয়ে।’
অন্ত ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘তুই করবি রান্না?গতবার বৈশাখে ইলিশ মাছ ভাজতে যেয়ে হাতে গরম তেল ছিটকে কি হয়েছিল মনে নেই?’
ইচ্ছেমতি মুচকি হেসে বলল,
‘না মানে অ্যান্টি রান্না করবে আর আমরা হেল্প করব।’
রিপন বসা থেকে দাঁড়িয়ে সাফিকে বলল,
‘চল না একটু ঘুরে আসি।’
সাফি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আম্মু?এখন যাবো আমরা?’
সাফির মা মাছ কাঁটতে কাঁটতে বললেন,
‘যাও।বাগানের দিকে রোদ কম আছে ওদিকে যাও।’
সবাই উঠে দাঁড়ালো।অন্ত এখনও বসে আছে আর নির্ভীককে দেখছে।নির্ভীক একবারও অন্তর দিকে তাকালোনা জন্য অন্ত মুখ ফুলিয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেল।নির্ভীকও সবাইকে যেতে দেখে ফোনে কথা বলতে বলতে সবার পিছু নিল।প্রান্ত আর কিয়াম একটা সফটওয়্যার নিয়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল।বিশাল একটা আম বাগানে এসে থামলো সবাই।এতদূর হেঁটে এসে অন্ত ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর বসলো।সাফি আর রিপন একটা ছোট আম গাছে উঠে আম পাড়তে লাগলো আর বাকিরা গাছতলায় আম কুড়োতে লাগলো।অন্ত প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘প্রান্ত ভাইয়া?আপনার ঘড়িতে কয়টা বাজে?’
‘এগারোটা পঁচিশ।’
অন্ত ভেবে পাচ্ছে না আর কি বলবে।আসলে সে প্রান্তর কাছে জানতে চায় নির্ভীক কার সাথে এত কথা বলছে কিন্তু প্রান্তকে বলতে পারছেনা।প্রান্ত এসে অন্তর পাশে ঘাসের উপর বসলো।অন্ত মুচকি হেসে বলল,
‘এক্সাম শেষ?’
প্রান্ত ভ্রু কুচকে বলল,
‘কিসের এক্সাম?’
‘কেন আপনাদের মাস্টার্স ফাইনাল।’
প্রান্ত ভ্রু স্বাভাবিক করে মৃদু হেসে বলল,
‘সেই কবে শেষ হয়েছে আর আজ বলছো?’
অন্ত কিছু বলার আগেই নির্ভীক এসে অন্তর অন্যপাশে বসে বলল,
‘কি বলছো?’
অন্ত মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো।প্রান্ত মৃদু হেসে বলল,
‘আমাদের এক্সামের কথা শুনছে।শেষ হয়েছে কিনা।’
নির্ভীক অন্তর একহাত টেনে নিয়ে বলল,
‘এক্সাম তো শেষ।এখন জব নিতে হবে।ঢাকাতে কয়েকটা কোম্পানি ডাকছে।কি করবো বলো তো?’
অন্ত নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রেগে বলল,
‘কথা বলবো না আপনার সাথে।’
নির্ভীক ভ্রু কুচকে বলল,
‘কেন?’
অন্ত থম থমে মুখ করে বলল,
‘এমনি।’
নির্ভীক কৌতূহলি হয়ে বলল,
‘না এমনি নয়,বল কেন?’
অন্ত কিছু নাবলে উঠে ইচ্ছেমতির কাছে গেল।নির্ভীক প্রান্তকে বলল,
‘আজকেই চলে যেতে হবে।ওর মেডিসিন চলে এসেছে কিন্তু এক বাইকে চারজন যাবো কি করে?’
প্রান্ত পা মেলে দিয়ে বলল,
‘তুই ওকে নিয়ে যা আমরা নাহয় কাল যাব।’
নির্ভীক ভ্রু কুচকে বলল,
‘ইচ্ছেমতিকে রেখে যাওয়া ঠিক হবেনা।বিকেলে স্কুলে একটু ঘুরিয়ে নিয়েই চলে যাব।তুই সন্ধ্যার আগেই ইচ্ছেমতিকে নিয়ে বাইকে চলে যাস, গিটারটা সাথে নিস।আমরা কোনো ভাবে চলে যাব।মেইনরোড পর্যন্ত অটো বা রিক্সা পেলেই হবে।’
প্রান্ত ইচ্ছেমতির দিকে তাকালো।ইচ্ছেমতি দুইহাতে দুটো আম নিয়েছে।আরও আম নেওয়ার জন্য সাফি সাফি আরদুটো আম দে করে চেঁচাচ্ছে।প্রান্ত মুচকি হেসে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ওকে।’
নির্ভীক অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘পিচ্চিটা আমার সাথে যাবে তো?রাগ করছে কেন আমার উপর?’
প্রান্ত মুচকি হেসে বলল,
‘চুমু দেওয়া কম হয়েছে সেজন্য।’
নির্ভীক প্রান্তর দিকে চোখ গরম করে তাকালো।প্রান্ত পাত্তা না দিয়ে আম খাওয়ার জন্য উঠে গেল।নির্ভীক ঘাসের উপর সটান হয়ে শুয়ে বুকের উপর ফোন নিয়ে টিপতে লাগলো।সেটা দেখে অন্ত আরও ফুলে উঠলো।কিসের এত ফোন নিয়ে পরে থাকা আর কার সাথে এত কথা বলছে সেটায় অন্তর পছন্দ হচ্ছেনা।
দুপুরের খাওয়া শেষ করে মেয়েরা সাজগোছ করছে।আইরিন,তামান্না,সূচি আর ইচ্ছেমতি একে অপরের সহায়তায় সুন্দর করে শাড়ি পরে এখন মুখে হালকা সাজ দিচ্ছে।এদিকে অন্ত নির্ভীকের উপর রাগ করে ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পরেছে।সবাই পুকুরে গোসল করেছে নির্ভীক অন্তকে পুকুরে যেতে দেইনি।তাও অন্ত জোর করে যেতে চেয়েছিল নির্ভীক তখন রেগে গিয়ে অন্তকে বকেছে তারপর থেকে অন্ত আর কারও সাথে কথা বলেনি।বাথরুমে গোসল করে লাল ব্লাউজ আর কালো পেটিকোট পরে চুপ করে শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছে।ইচ্ছেমতি অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ওকে ডাকতে হবে নাহলে কাল সকালের আগে উঠবেনা।আমরা সবাই রেডি ও আবার কখন রেডি হবে।’
বলেই ইচ্ছেমতি অন্তকে ধীরে ধীরে ডাকতে লাগলো।অন্ত অন্যপাশ ফিরে শুয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
‘যাব না কোথাও,ঘুমোতে দে।’
ইচ্ছেমতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার ডাকতে লাগলো।এবার অন্তর ঘুম ভেঙ্গে গেল তাই উঠে বসে খিটমিটে মেজাজ নিয়ে বলল,
‘বললাম তো যাবোনা,কেন বিরক্ত করছিস?’
ইচ্ছেমতি ফোন হাতে নিয়ে বলল,
‘ওকে ওকে ঘুমা।এত হাইপার হতে হবেনা।আমরা চলে যাচ্ছি।বাসায় কিন্তু অ্যান্টি ছাড়া কেউ থাকবেনা।’
অন্ত কিছু না বলে থমথমে মুখ করে বিছানা থেকে নেমে কালো শাড়ি ইচ্ছেমতির দিকে ছুড়ে মেরে বলল,
‘পড়িয়ে দে।’
তামান্না আর ইচ্ছেমতি মিলে অন্তকে শাড়ি পড়িয়ে দিল।অন্ত আয়নার সামনে গিয়ে চুলগুলো বাকি সবার মতো খোলায় রাখলো।ব্যাগে একটা লাল লিপস্টিক ছিল সেটা ঠোঁটে লাগিয়ে বলল,
‘সবাইকে ক্ষ্যাত মার্কা লাগছে দেখতে।শাড়ির সাথে কোন জুয়েলারি নেই,একটা টিপও নেই।আমি এভাবে কোথাও যাবোনা।ড্রেস মনে হয় শুকিয়ে গেছে ওটায় পরবো।’
বলেই অন্ত গটগট করে হেঁটে ছাদে চলে আসলো।প্রান্ত,রিপন,আদনান আর কিয়াম চিলেকোঠার ঘরে লুঙ্গি পরে নিজেদের প্যান্ট শুকানোর জন্য ওয়েট করছে আর নির্ভীক বুদ্ধি করে লুঙ্গি পরে গোসল করেছিল জন্য এখন তাকে লুঙ্গির প্যারা সামলাতে হচ্ছেনা,প্যান্ট পরে আরামছে ঘুরাফিরা করছে।নির্ভীক চিলেকোঠার ঘর থেকে বের হয়ে ভ্রু কুচকে সামনে তাকাতেই অন্তকে দেখে মাথা ঘুরে গেল।প্রথম বারের মতো অন্তকে শাড়ি পরতে দেখে নির্ভীকের কোথাও কিছু হচ্ছে।একটা শুকনো ঢোক গিলে অন্তর দিকে এগিয়ে গেল।অন্ত নির্ভীককে খেয়াল না করে নিজের জামা কাপড় নিয়ে চলে আসছিল তখনই পেছন থেকে হাতে টান অনুভব করে।কিছু বুঝে উঠার আগেই নির্ভীক অন্তকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘এই পিচ্চি আমাকে পাগল বানিয়ে কোথায় যাচ্ছো?’
অন্ত প্রথমে ভ্রু কুচকালো তারপর ভয় পেয়ে নিজের পেটের উপর রাখা নির্ভীকের হাতের উপর হাত রাখলো। মনের মধ্যে ভাল লাগা ছুঁয়ে গেলেও রাগী কন্ঠে বলল,
‘আপনি?ছাড়ুন।’
নির্ভীক অন্তর চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘নেভার,আজ কিছুতেই তোমাকে ছাড়ছিনা।পানিশমেন্ট হবে তোমার।’
অন্ত চোখবন্ধ করে বলল,
‘কিসের পানিশমেন্ট!’
নির্ভীক অন্তকে ছাদের দরজার সাথে দাঁড় করিয়ে অন্তর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল।ধীরে ধীরে অন্তর গলার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে নরম কন্ঠে বলল,
‘তুমি যেই ভুলগুলো করছো সেগুলো মারাত্মক।শাড়ি কেন পরেছো?শাড়িতে তোমাকে অপরুপা লাগছে।এই খোলা চুলের মিষ্টি স্মেল পাগল করে দিচ্ছে আমাকে।লাল টুকটুকে ঠোঁটটা খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।’
শেষের কথাটা নির্ভীক অন্তর মুখের সামনে মুখ রেখে বলল।অন্ত চোখ বন্ধ করে ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে।নির্ভীক ডান হাত অন্তর বাম গালে রেখে বুড়ো আঙুল দিয়ে অন্তর ঠোঁটের লিপস্টিক তোলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছেনা জন্য ভ্রু কুচকে বলল,
‘হোয়াট দ্যা….কি এগুলো?উঠছে না কেন?’
অন্ত নির্ভীকের দিকে তাকালো।সাথে সাথেই লজ্জায় চোখ নিচু করে লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
‘এভাবে উঠেনা।ওয়াটার প্রুফ লিপস্টিক।’
নির্ভীক মুচকি হেসে অন্তর ঠোঁটের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘কিসিং প্রুফও কি?’
নির্ভীকের কথা শুনে লজ্জায় অন্তর গাল লাল হয়ে গিয়েছে।নির্ভীকের বুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে এক দৌঁড়।নির্ভীক ঘাড়ে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
‘আস্তে যাও নাহলে পরে যাবা।’
অন্ত যত দ্রুত সম্ভব নিচে আসলো।ঘরে ঢুকে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে লজ্জায় লাল নীল হতে লাগলো।কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে শাড়ি চেন্জ করে সাদা রঙের কুর্তি আর নীল রঙের জিন্স পরে নিল।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নীল স্কার্ফ ঠিক করে গায়ে জড়িয়ে মুচকি হেসে সবাইকে বলল,
‘আ’ম রেডি।’
আইরিন,তামান্না,সূচি আর ইচ্ছেমতি এতক্ষণ হা করে অন্তর কার্যকলাপ দেখলো।ইচ্ছেমতি ভ্রু কুচকে বলল,
‘এত কষ্ট করে শাড়ি পরিয়ে দিলাম আর তুই দুসেকেন্ডে খুলে ফেললি?’
অন্ত ভাব নিয়ে বলল,
‘হুম ফেলেছি।তোদের ইচ্ছে হলে তোরাও খুলে হাওয়ায় উড়িয়ে দে।’
বলেই ব্যাগ আর ফোন নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। বাকিরা শাড়ি না খুলে অন্তর সাথে নিচে চলে গেল।জামের গাছতলায় দাঁড়িয়ে অন্ত সবার সাথে কথা বলছিল হঠাৎ নিজের ফোন খুলে সিম নিয়ে নষ্ট করে ফেলল।অস্থির হয়ে কিছুক্ষণ পায়চারী করে শানবাঁধানো গাছের গুড়িতে বসলো।ব্যাগ থেকে পাতলা একটা নোট বের করে রেগে পাতাগুলো ছিড়তে লাগলো।ব্যাপারটা কেউ খেয়াল না করলেও নির্ভীক ছাদ থেকে সবটা দেখলো। বিরবির করে বলল,
‘হোয়াটস রং উইথ হার?’
—
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই দুটো ছেলে আরাফের কাছে এগিয়ে গেল।আরাফ হাতের কোর্ট আর ট্রলি তাদের ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘এখন ওরা কোথায় আছে?রাজশাহীর টিকিট করেছো?’
কালো শার্ট পরা একটা ছেলে মাথা নিচু করে বলল,
‘সরি স্যার দুঘন্টা ওয়েট করতে হবে।আকাশের অবস্থা ভাল নয়।ঝড়-বৃষ্টি হবে।টিকিট বুক করা আছে।’
আরাফ চোখমুখ শক্ত করে বলল,
‘বাসায় চলো।’
কন্টিনিউয়াসলি কলিং বেজেই চলেছে।বাসায় কেউ নেই দেখে নিপা ভয়ে ভয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।দরজার সামনে আরাফকে দেখেই অবাক হয়ে বলল,
‘আপনি?’
আরাফ কিছু না বলে হন হন করে ভেতরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।ছেলে দুটো লাগেজ নিয়ে ভেতরে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসলো।নিপা দ্রুত উপরে গিয়ে আরাফের ঘরের দরজায় দাঁড়ালো।আরাফ বিছানায় বসে জুতো খুলতে খুলতে নিপাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘এখনো এই বাসায় পরে আছিস?’
নিপা গুটি গুটি পায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে বলল,
‘হ্যাঁ এখনও পরে আছি।আমার তো অন্য কোথাও পরে থাকার কথা নয়।’
আরাফ ভ্রু কুচকে নিপার মলিন মুখের দিকে তাকালো।রাগী কন্ঠে বলল,
‘অন্তকে নিয়ে আসার আগে চলে যাবি এখান থেকে আর ডিভোর্স পেপার আমি রাতের মধ্যে পাঠিয়ে দিব।’
নিপা তাচ্ছিল্য হেসে আলমারি থেকে ডিভোর্স পেপার আরাফের মুখে ছুড়ে দিয়ে বলল,
‘নিন সাইন করুন আমি অনেক আগেই সাইন করে রেখেছি।’
আরাফ অবাক হয়ে পেপার হাতে নিল।চোখমুখ শক্ত করে টেবিল থেকে কলম নিয়ে সাইন করে ছুড়ে ফেলল।নিপার কলিজা ফেটে যাচ্ছে তাও শক্ত কন্ঠে বলল,
‘আপনি চাচিকে বলেছিলেন না জোর করে ভালোবাসা হয়না?ঠিকই বলেছেন।আপনি হাজার জোর করলেও অন্তর ভালোবাসা পাবেন না।’
আরাফ নিপার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
‘অভিশাপ দিচ্ছিস?কেন পাবো না?আমার অপরাধ?কি করেছি আমি?তোকে তো আগেই বলেছি আমাকে বিয়ে করলে এইরকম কিছুই হবে।’
নিপা মাথা নিচু করে বলল,
‘অন্ত আপনাকে ভালোবাসেনা।’
আরাফ চোখ ছোট ছোট করে বলল,
‘তাই বলে আমিও ওকে ভালোবাসবোনা?’
নিপা কাঁপা গলায় বলল,
‘অবশ্যই বাসবেন।’
আরাফ বিছানায় বসে বলল,
‘গেটলস্ট।’
নিপা মাথা নিচু করে বলল,
‘নেভার।’
‘হুয়াই?’
‘আপনি যেমন অন্তকে ভালোবাসেন আমিও তেমন আপনাকে ভালোবাসি।আপনি যদি অন্তকে ছাড়তে না পারেন মেরে কুচি কুচি করে ফেললেও আমি আপনাকে ছাড়বোনা।আপনার ভালোবাসার থেকে আমার ভালোবাসা কোনো অংশেই কম না।আপনি যদি ভালোবেসে অন্তকে কাছে টানতে পারেন তাহলে আমিও আপনাকে কাছে টানবো।আপনি সারাজীবন আমাকে অবহেলা করবেন আমি সারাজীবন সেই অবহেলাকেই ভালোবাসবো।’
বলেই নিপা ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।আরাফ নিপার কথা শুনলোইনা ভাল করে।শুনলে হয়তো একটু হলেও নিপার ভালোবাসাটা বুঝতে পারতো।আরাফ বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আ’ম কামিং জানপাখি।’
চলবে……………
(ঈদ করতে দাদুর বাসায় যাচ্ছি ফিরে এসে নেক্সট পার্টগুলো দিব।ভাল থাকবেন সবাই।সবাইকে অগ্রিম ঈদ মোবারক।)