ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২পর্ব:২৫

0
1520

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

২০.(বোনাস)

সকালে সূর্যের তেজ দেখে মনে হয়েছিল সারাদিন কাঠফাটা রোদ হবে কিন্তু দুপুর হতেই সূর্যের তেজ কমে আসলো।মেঘলা আকাশ সাথে মৃদু বাতাস প্রেম করার জন্য নির্ভীকের এর চেয়ে বেশি কিছু দরকার নেই।তার ধারনা তাকে জলন্ত আগুনের উপর বসিয়ে যদি বলা হয় অন্তর সাথে প্রেম কর সে হাসি মুখে প্রেম করতে পারবে আর এখানে তো আগুন নেই তাই আরও ভাল করে প্রেম করবে।

ভার্সিটিতে নিজেদের ডিপার্টমেন্টের বারান্দা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে ইচ্ছেমতি আর অন্ত।এখন ক্লাস আওয়ার তাই বাহিরে কেউ নেই,চারপাশে পিনপতন নীরবতা।দু জোড়া পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল হঠাৎ একজোড়া পা চলা বন্ধ হয়ে গেল।ইচ্ছেমতি ভ্রু কুচকে পেছনে তাকিয়ে দেখে অন্ত নেই কিন্তু একটু দূরে একটা ক্লাসরুমের দেয়ালে প্রান্ত হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ফোন টিপছে।ইচ্ছেমতি বুঝলো প্রান্ত আছে মানে নির্ভীকও আছে তাই অন্তকে নিয়ে আর চিন্তা করলো না।ইচ্ছেমতিকে তাকাতে দেখে প্রান্ত মাথা তুলে ইচ্ছেমতির দিকে তাকালো।ভ্রু নাচিয়ে একটু জোড়েই বলল,

‘হোয়াটস্ আপ সখিনা বিবি?’

ইচ্ছেমতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাথা দুলিয়ে ক্লাসে দৌঁড়।ভার্সিটিতে আসবেনা বলে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল।যাক এসে ভালই হয়েছে এটলিস্ট প্রান্তকে একবার চোখের দেখা দেখতে পেল।তিনদিন পর আজ প্রান্তকে দেখলো।অবশ্য প্রান্ত এই তিনদিন কয়েকশো বার ফোন করে ইচ্ছেমতির সাথে দেখা করতে চেয়েছে তার বাচ্চা কেমন আছে কি করছে এসব জানতে চেয়েছে।এক কথায় ফোন দিয়ে বিরক্ত করে ইচ্ছেমতিকে পুরো তেজপাতা করে ফেলেছে।ইচ্ছেমতি সব সময় চাইতো প্রান্ত তাকে ফোন দিক,একটু খোঁজ খবর নিক কিন্তু এত বেশি ফোন দিক এটা কখনওই চায়নি।প্রান্ত সারারাত ঘন্টায় ঘন্টায় ইচ্ছেমতিকে ফোন দেয়।এটা হলো এক্সেস বিরক্ত করা।কথায় বলে এক্সেস ইজ ভেরী ব্যাড।এক্সেস কিছু করতে গিয়ে প্রান্তর সাথে আবার ব্যাড কিছু না হয়ে যায়।

পরিত্যক্ত ক্লাস রুমের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ত।নির্ভীক অন্তর একহাত ধরে অন্তর সামনে দাঁড়িয়ে একধ্যানে অন্তর দিকে তাকিয়ে আছে।অন্ত চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক দেখছে আর ভাবছে পালাবে কোন পথে।নির্ভীক একহাত অন্তর গালে রেখে নরম কন্ঠে বলল,

‘তোমার মনে হয়না তোমার একটু আমার দিকে তাকানো দরকার?একটু দেখো আমাকে,তাকাও আমার চোখের দিকে।একটু বুঝার চেষ্টা কর।ভালোবাসি আমি তোমাকে, কেন বুঝতে চাও না?’

অন্ত ভ্রু কুচকে নির্ভীকের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ আগে বলুন আপনি কে?’

নির্ভীক ফুস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে অন্তকে ছেড়ে দিয়ে বলল,

‘ওকে ফাইন।আমি নির্ভীক,মুহতাসিম ফুয়াদ নির্ভীক।প্রেমে পড়ার বয়স হওয়ার পর থেকে তোমাকে ভালোবাসি। ছোটবেলা থেকে তোমাকে চিনি।তুমিও ছোটবেলায় চিনতে বড় হয়ে ভুলে গিয়েছো,আর কিছু শুনবে?’

অন্ত মনোযোগ দিয়ে নির্ভীকের কথা শুনলো।আরও কিছু শোনার জন্য মনের মধ্যে খুত খুত করছে কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেনা।নির্ভীক অন্তর গালে হাত দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

‘খুব প্রেম পাচ্ছে।আমার থেকে এত প্রেম নিয়ে কি কর বলো তো তুমি?কোথায় রাখো সেগুলো?’

অন্ত গাল থেকে নির্ভীকের হাত সরিয়ে দিয়ে রাগী কন্ঠে বলল,

‘কে নিতে চাইছে আপনার প্রেম?লুকিয়ে রাখুন না।যত্তসব আজাইরা কথা।’

নির্ভীক একহাতে অন্তর কোমড় জরিয়ে ধরে অন্য হাত অন্তর গালের নিচে রেখে মুচকি হেসে বলল,

‘প্রেম তো লুকিয়ে রাখার জিনিস নয়।রাখতে চাইলেই পারবো কি?তোমার মতো ডাকাত থাকতে নিরাপত্তা কোথায় বল?’

অন্ত নির্ভীকের হাতের উপর হাত রেখে ভ্রু কুচকে বলল,

‘আমি ডাকাত?আপনি তাহলে ডাইনোসর।’

‘নো।ডাকাত নট ইকুয়াল টু ডাইনোসর।পিচ্চি ইকুয়াল টু ডাইনোসর।’

অন্ত ভ্রু কুচকে নির্ভীকের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল।নির্ভীকের কথা শেষ হতেই নির্ভীকের নাক টেনে দিয়ে মুচকি হেসে বলল,

‘আপনি শুধু ডাইনোসর নয় আতংকবাদীও।আরাফ ভাইয়া বলেছে এসব প্রেমের কথা বলে আপনি আমার সাথে মজা করছেন।আমরা আগে ফ্রেন্ড ছিলাম তাইনা?’

নির্ভীক কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ধূর আরাফ ভাইয়াটাও না একটা ছাগল।ভাবলাম তোমার সাথে একটু প্রেম করবো সেটা আর হল না।আগেই তোমার কানে কুমন্ত্র দিয়ে দিল।বাই দ্যা ওয়ে,উই আর ফ্রেন্ডস বাট মোর দ্যান ফ্রেন্ডস।’

অন্ত খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,

‘আরাফ ভাইয়া বলেছে আপনি….।’

হাসির জন্য অন্ত কিছু বলতেই পারছে না।আরাফ কি বলেছে সেসব নিয়ে নির্ভীকের মাথাব্যথা নেই সে মুগ্ধ হয়ে অন্তর হাসি দেখছে।কয়েকমাস অন্ত এমন করে হাসেনি।বেশির ভাগ সময়ই কান্না করেছে।অন্তর কান্না মাখা মুখ দেখে দেখে নির্ভীকের হার্ট অসুস্থ হয়ে পরেছিল আজ এভাবে হাসতে দেখে আবার সুস্থ হয়ে গেল।নির্ভীককে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্ত হাসি থামিয়ে বলল,

‘কি হয়েছে আপ…’

আর কিছু বলার আগেই নির্ভীক অন্তর ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে অন্তর ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল।

সূর্য পুরোপুরি পশ্চিম আকাশে হেলে গিয়েছে।বিকেলের কমলা রঙা রোদ সানন্দে গায়ে মাখিয়ে চারতলার করিডোরে রেলিং এর উপর বসে একটার পর একটা চকলেট খাচ্ছে ইচ্ছেমতি আর তার বন্ধুরা।অন্তর কাছে ব্যাগ ভর্তি চকলেট।সবগুলো নির্ভীক কিনে দিয়েছে।তখন দুপুরে অন্তকে চুমু দেওয়ার পর অন্ত কান্না করছিল।নির্ভীক তিন ঘণ্টার মধ্যে হাজার বার সরি বলেছে।অন্তর সামনে কান ধরে উঠাবসাও করেছে।অন্তকে দোকানের সব চকলেট আর আইসক্রিমও কিনে দিয়েছে কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।অন্ত খুব রেগে গিয়েছে সাথে মন খারাপও করেছে।নির্ভীকও গিলটি ফিল করছে।

অন্তর বন্ধু আইরিন অন্তর ব্যাগ থেকে আরও কয়েকটা চকলেট নিতে নিতে বলল,

‘তুই তো কামাল কার দিয়া ইয়ার।এমন করে প্রতিদিন নির্ভীক ভাইয়ার উপর রেগে যাবি ওকে?তারপর ভাইয়া তোকে চকলেট দিবে আর সেগুলো তুই আমাদের দিবি।’

ইচ্ছেমতি মুখে লেগে থাকা চকলেট মুছতে মুছতে বলল,

‘নির্ভীক ভাইয়াকে একটা ফোন কর।করে বলল এখানে এসে একটা গান শোনাতে।এতগুলো চকলেট সাথে গান।কেমন হবে গাইস?’

সবাই হাত তালি দিল।কিয়াম খেতে খেতে বলল,

‘দারুন হবে।নির্ভীক ভাইয়ার গান আমার খুব ভাল লাগে।’

অন্ত তো কিছুতেই ফোন দিবেনা।সবার জোরাজুরিতে বাধ্য হয়ে ফোন দিল।মেজাজ নিয়ে বলল,

‘শুনুন আপনার সাথে আমি কোন কথা বলতে চাই না।আপনি নাকি গান জানেন।আমার ফ্রেন্ডদের ননস্টপ কয়েকটা গান শোনাবেন।চলে আসুন।’

বলেই অন্ত ফোন কেটে দিল।সাফি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অন্তর ব্যাগ থেকে পকেট ভর্তি চকলেট নিয়ে বলল,

‘ওকে গাইস আমাকে বাসায় যেতে হবে,কাল ফ্রাইডে স্যাটারডেতে দেখা হবে তোদের সাথে।’

রিপন ভ্রু কুচকে বলল,

‘গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিস?কোনো প্রবলেম?’

‘না তেমন কিছু নয়,কাল বাবার স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে।এমপি আসবে,ঝামেলা আছে তাই আমাকে যেতে বলেছে।’

কিয়াম নেচে উঠে বলল,
‘নাচ গান?আমিও যাব।’

রিপনও সাফির কোলে উঠার চেষ্টা করতে করতে বলল,

‘আমিও যাব,আমাকে নিয়ে চল দোস্ত।’

আইরিন আর তামান্না একসাথে বলল,

‘তোরা যাবি আর আমরা দেখবো?নেভার,আমরাও যাবো।’

চলন্ত ট্রাকে উঠে ব্রেক ডান্স আর নাগিন ডান্স দিচ্ছে সবাই।অন্ত ট্রাকের এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে সবার হৈ-চৈ করা দেখছে।অন্ত কিছুতেই এদের সাথে আসতে চায়নি।সবাই অন্তকে জোড় করে সাথে নিয়েছে।ইচ্ছেমতিও অন্তর সাথে আছে।নির্ভীকের পারমিশন পেয়েই ইচ্ছেমতি অন্তকে নিয়ে যাচ্ছে।এদিকে অন্ত কোথায় যাচ্ছে বুঝতে পারছেনা।ভার্সিটি থেকে বের হয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বিভিন্ন ধরনের ফাস্টফুড কিনে মেইনরোডে দাঁড়াতেই সাফির পরিচিত একটা ট্রাক ড্রাইভার সবাইকে ট্রাকে তুলে নিল।তখন থেকে ট্রাক চলছে তো চলছেই থামার কোনো কথা নেই।অন্ত ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশ দেখার চেষ্টা করতেই মাথা ঘুরে উঠলো তাই তাড়াহুড়ো করে আবার বসে পরলো।চলন্ত ট্রাকে সবাই লাফালাফি করছে কিছু হচ্ছেনা আর অন্ত দাঁড়াতেই পারছেনা।ভেবেই অন্ত ঠোঁঠ উল্টে ইচ্ছেমতির দিকে তাকিয়ে থাকলো।ইচ্ছেমতি নিজের ব্যাগ অন্তর গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বন্ধুদের সাথে উরাধুরা নাগিন ডান্স দিচ্ছে।সবাইকে এমন উদ্ভট আচরণ করতে দেখে অন্ত ফিক করে হেসে দিল।

রাজশাহী জেলা শহর হতে ৩০ কি.মি. দূরে তানোর উপজেলার ছায়া ঢাকা ঘুঘু ডাকা সবুজ শ্যামল একটি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব মো: আব্দুর রহমান।তার একমাত্র ছেলে সামিউল আহসান সাফি তার ভার্সিটির একদল বন্ধুদের নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে এসছে।সদ্য ভার্সিটিতে পা রাখা চঞ্চল ছেলে-মেয়ে গুলো এসেই হুটোপুটি শুরু করে দিয়েছে।এত সুন্দর আর নির্জন গ্রাম তারা আগে কখনও দেখেনি।ভার্সিটি থেকে ক্লাস শেষ করে এখানে আসতে তাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।

গ্রামের শেষ প্রান্তে ঘন গাছপালায় ঘেরা হলুূদ রঙের দোতলা বাড়িটি সাফিদের।সবাই বাড়ির সামনে শান বাঁধানো বিশাল জাম গাছের তলায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গিয়েছে জন্য তারা গাছতলায় কাঠখড় সাজিয়ে আগুন লাগিয়ে আলোর ব্যবস্থা করেছে।সবাই যখন হৈচৈ করতে ব্যস্ত তখনই দোতলার বারান্দায় ধীর পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ালো ‘অন্ত’।তার শান্ত মায়াবী চোখ সামনের দিকে স্থির।দোতলার বারান্দা থেকে দূরে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।অন্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘোলাটে আকাশের দিকে তাকালো।আকাশে কয়েকটা তারা দেখা যাচ্ছে,চাঁদ তারার প্রতি অন্তর প্রবল আকর্ষন।দপদপে শুক্র গ্রহের দিকে তাকালে অন্তর মাঝে মাঝেই মনে হয় কেউ একজন আছে যে অন্তর পাশে দাঁড়িয়ে বার বার ওই দপদপে তারাটার দিকে ইশারা করে কিন্তু এটা শুধুমাত্র তার কল্পনা, অন্ত ভেবে পায় না তার কেন এমন মনে হয়।

বারান্দায় বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলছে জন্য নিচ থেকে সহজেই অন্তকে দেখা যাচ্ছে।অন্তকে দেখেই নিচ থেকে ইচ্ছেমতি বলল,
“এই অন্ত,এখানে আয়।দেখ আমরা কত মজা করছি আর তুই ঘরের কোনায় কি করছিস বলতো?”

অন্ত চমকে উঠলো, নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখলো সবাই আগুনের চারদিকে গোল হয়ে বসে আছে।অন্ত চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দোতলার কোনার ঘরটায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।ভাল লাগছেনা,কিছু ভাল লাগছেনা অন্তর।বিছানায় ডান কাত হয়ে শুয়ে ফোনের স্ক্রিনে ভেসে থাকা একটা ছবির দিকে একমনে তাকিয়ে থাকলো সে।তিনমাস ধরে একই ভাবে ছবিটা দেখে আসছে সে।হঠাৎই গিটারের শব্দ পেয়ে ঘোর ভাঙলো অন্তর।ফোন বিছানায় রেখে আশেপাশে বুঝার চেষ্টা করতেই শুনতে পেল হৃদয়স্পর্শ করা সেই পুরুষালি কন্ঠ।

“আমি.. তোমাকে আরও কাছে থেকে,
তুমি আমাকে আরও কাছে থেকে….

আমি.. তোমাকে আরও কাছে থেকে,
তুমি আমাকে আরও কাছে থেকে….

যদি জানতে চাও তবে ভালোবাসা দাও,ভালোবাসা নাও
ভালোবাসা দাও,ভালোবাসা নাও।”

অন্ত চমকে গিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দৌঁড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।কাঁপা কাঁপা হাত দুটো রেলিং এর উপর রেখে নিচে তাকালো।আগুনের চারপাশে বসে আছে তার বন্ধুরা আর শানের উপর গাছের সাথে হেলান দিয়ে কালো প্যান্ট,কালো টিশার্ট পরে কালো গিটার হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ‘নির্ভীক’।আগুনের রক্তিম আভা তার ফর্সা মুখে পরে অনেকটা অগ্নিবর্ণ ধারন করেছে তার মুখ,চক চক করছে ভীষণ পরিচিত তরতরে লম্বা নাক।

চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই নির্ভীক অন্তুর উপস্থিতি বুঝতে পেরে মুচকি হেসে আবার গাইতে শুরু করলো,

“নদী কেন যায় সাগরের ডাকে,চাতক কেন বৃষ্টির আশায় থাকে,যদি বুঝতে চাও….(নিচে থেকে অন্তর দিকে তাকিয়ে)

“আমি তোমার ঐ চোখে চোখ রেখে…
তুমি আমার এই চোখে চোখ রেখে…
আমি তোমার ঐ চোখে চোখ রেখে..
তুমি আমার এই চোখে চোখ রেখে…(অন্তর দিকে তাকিয়ে)

স্বপ্ন দেখে যাও,তবে ভালোবাসা দাও,ভালোবাসা নাও
ভালোবাসা দাও,ভালোবাসা নাও।”

অন্তর ভেতরটা হুহু করে উঠলো,চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো অজস্র জল।এক মুহূর্তও না দাঁড়িয়ে সে দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে কান্না করতে লাগলো।অন্তর মনে বয়ে যাচ্ছে শূন্যতা আর হাহাকারের বন্যা।কেন তার এমন হচ্ছে সে জানে না।মাঝে মাঝেই নির্ভীকের জন্য এরকম অনুভূতি কাজ করে তার মধ্যে।

অন্তকে এভাবে যেতে দেখেই নির্ভীক গিটার ফেলে দৌঁড়ে দোতলায় আসলো,বাকিরাও আসতে লাগলো কিন্তু প্রান্ত আর ইচ্ছেমতি তাদের আসতে নিষেধ করলো।কোনার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে অন্তকে কাঁদতে দেখেই নির্ভীকের ভেতরে ধক করে উঠলো।দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পরলো সে।এই মুহূর্তে অন্তর কান্না ভেজা চোখের দিকে তাকানোর সাহস তার নেই।নির্ভীক করুন চোখে ইচ্ছেমতির দিকে তাকালো।ইচ্ছেমতি মাথা নেড়ে ঘরের ভেতর ঢুকে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে অন্তর একবাহু তে হাত রাখতেই অন্ত উঠে বসে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,
“নির্ভীক ভাইয়া কে?কি চায় আমার কাছে?কেন এমন করে?কে এই নির্ভীক??…..প্লিজ বলো আমাকে।”

ইচ্ছেমতি অন্তর মুখোমুখি বসে শান্ত কন্ঠে বলল,”তুমি নয় তুই।উত্তপ্ত মোমেন্টে তোর দেখি কিছুই মনে থাকেনা।নির্ভীক কে তুই ভাল জানিস,আমি কিছু জানিনা।বিকেলে তুই উনাকে ফোন করে বললি একটা গান শোনাতে আর এখন গান শুনে এমন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিস কেন?পাগল হয়েছিস?”

অন্ত হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নাক টেনে বলল,”উনি কিছুতেই নির্ভীক নয়।কে নির্ভীক?”

ইচ্ছেমতি চোখের গোল ফ্রেমের চশমা ঠেলে দিয়ে চুপ করে থাকলো,সে কি বলবে বুঝতে পারছেনা।অন্তর কেন এমন মনে হচ্ছে সেটাও বুঝতে পারছেনা,হয়তো নির্ভীক কোন কারনে অন্তকে বকেছে।হুম এটাই হবে ভেবে ইচ্ছেমতি মুখ কাঁচুমাচু করে অন্তর দিকে তাকিয়ে থাকলো।এই কয়মাসে চেহারার কি অবস্থা হয়েছে মেয়েটার,ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে মনে হয় না একা একা উঠে দাঁড়াতে পারবে।একদম শুকিয়ে গিয়েছে।কেঁদে কেঁদে চোখ-নাক লাল করে ফেলেছে।তাও কাটা কাটা নাক মুখ জুড়ে বয়ে যাচ্ছে ভয়ঙ্কর স্নিগ্ধতা।এটাই কি সেই স্নিগ্ধতা যার জন্য জ্বলে পুরে ছাই হয়ে যাচ্ছে চারটি জীবন?ইচ্ছেমতি জানেনা এর শেষ পরিণতি কি হবে,জানতে চায়ও না।সে শুধু চায় সবাই ভাল থাকুক,সব ঠিক হয়ে যাক।

ইচ্ছেমতিকে বরাবরের মতো চুপ থাকতে দেখে অন্ত বালিশে মাথা দিয়ে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পরলো।ইচ্ছেমতি হন্ত দন্ত হয়ে অন্তর কাছে এগিয়ে যেয়ে তার একবাহুতে হাত রেখে বলল,”এই জানু এখনই ঘুমাবি নাকি?”

অন্ত চোখ বন্ধ করে বলল,”মাথা ব্যাথা করছে,অসহ্য লাগছে।”

ইচ্ছেমতি দ্রুত উঠে ব্যাগ থেকে মেডিসিন বের করে গ্লাসে পানি ঢেলে অন্তর পাশে যেয়ে বলল,”উঠে পর সোনা মনা তোর মেডিসিন রেডি।”

অন্ত ধীরে ধীরে উঠে মেডিসিন খেয়ে আবার শুয়ে পরলো।চোখ বন্ধ করে বলল,”থ্যাংক ইউ।”

ইচ্ছেমতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্তর শরীরে কাঁথা টেনে দিল।কিছুক্ষণ অন্তর পাশে বসে থেকেই বুঝতে পারলো অন্ত ঘুমিয়ে গিয়েছে তাই সে ধীরে ধীরে হেঁটে ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো।

দরজার পাশে বসে থেকে নির্ভীক অন্তর সব কথায় শুনতে পেয়েছে।তার কিছু ভাল লাগছেনা,সবকিছু শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।নির্ভীক নিজের উপরই চরমভাবে রেগে যাচ্ছে।ইচ্ছেমতি নির্ভীকের সামনে দাঁড়াতেই পাশে থেকে প্রান্ত বলল,”বোনু কি ঘুমিয়ে গিয়েছে?”

ইচ্ছেমতি প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,”মাথা নাকি ব্যাথা করছিল তাই মেডিসিন দিলাম খেয়েই ঘুমিয়ে গেল।কি এক বাজে অভ্যাস হয়েছে!!এত সকাল সকাল ঘুমাবে উঠবে কখন জানেন?রাত তিনটের সময়।তখন আমাকেও টেনে তুলবে।”

ইচ্ছেমতি নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে বলল,”এই নির্ভীক ভাইয়া শুনুন,আপনাদের পাশের বাসার রিংকু আছে না?ওকে ধরে আচ্ছা মতো ধোলায় দিবেন।ও অন্তকে কোনী ভূত আর কন্দকাঁটা ভূতের ভয় দেখিয়েছে।বেচারি অন্ত ভূতের ভয়ে রাতে চোখ বন্ধ করতে পারেনা।বাই দ্যা ওয়ে কন্দকাঁটা ভূত আবার কি জিনিস?”

নির্ভীক উঠে দাঁড়িয়ে চুপচাপ ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।ইচ্ছেমতি আর প্রান্ত একে অপরের দিকে চেয়ে মন খারাপ করে নিচে চলে গেল।

নির্ভীক বিছানার পাশে হাঁটুতে ভর দিয়ে দাঁড়ালো।খুব সাবধানে অন্তর মুখের উপর পরে থাকা চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ালো।কিছুক্ষণ এক ধ্যানে অন্তর দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে অন্তর মুখের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,

“আ’ম লস্ট,আ’ম টোটালি লস্ট ইন ইউ পিচ্চি।”

চলবে……………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here