#ভালোবাসি তাই
part:19
Writer:Afifa Jannat Maysha
🍁
বিকেলবেলা সবার সাথে ড্রয়িংরুমে বসে আছি আমি। সবাই এসে গেছে প্রায়। এতো মানুষের ভীড়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাড়িটা যেনো মাছের বাজারে পরিণত হয়ে গেছে। মেইন রিচুয়াল শুরু হবে সন্ধ্যায়। সারা বাড়ি সাজানো হয়ে গেছে। বাড়ির ভেতরটা দেখে বুঝার উপায় নেই যে এখানে এনগেজমেন্ট হচ্ছে না বিয়ে।
গ্রাম থেকে যেসব আত্মীয় স্বজনরা এসেছে তারা সবাই বকবক করতে করতে কান খেয়ে ফেলছে। কতরকম কৌতুহল তাদের। নানুবাড়ির সবাই সায়ন ভাইয়াদের বাসায় আছে। তাদের সাথেই আসবে। একসাথে ছেলেপক্ষ আর মেয়েপক্ষ হলে যা হয় আরকি। সবাই মিলে সন্ধ্যায় কোন ড্রেস পরবে, কিভাবে সাজবে এমনকি কোন স্টাইলে সেলফি তুলবে তাও ঠিক করে ফেলেছে। আমি চুপচাপ বসে আছি শুধু। যতই নিজেকে ঠিক রাখতে চাইছি না কেনো তা পেরে উঠছি না। মনে হচ্ছে কি যেনো হারিয়ে ফেলছি আমি।
সারাকে দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছি। এই অল্প সময়েই কি সুন্দর আমার সব কাজিনদের সাথে মিশে গেছে । ওর এই গুণটা অনেক ভালো লাগে আমার। মনে হয় সবার সাথে মিশে যাওয়ার এক ম্যাজিকাল পাওয়ার নিয়ে জন্মেছে সে। খুব তারাতাড়ি ভাব করে নেয় সবার সাথে। আমিও সবার সাথে মিশতে পারি। তবে এতো তারাতাড়ি না।
আমার ভাবনায় ছেদ পড়লো যখন শুনতে পেলাম সবাই বলছে সায়ন ভাইয়ারা এসে গেছে। সবার সেকি উচ্ছাস! সায়ন ভাইয়াকে তো আর প্রথম দেখছে না তারা। কিন্তু এবার সবার রিয়েকশন আলাদা। এতোদিন উনাকে এবাড়ির ছেলে হিসেবে দেখতো আর এখন থেকে দেখবে জামাই হিসেবে সেজন্য হয়তো এমন করছে তারা। আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে এখানে। চোখ তুলে দরজার দিকে তাকাতে পারছি না আমি। একঝাঁক শুণ্যতা ঘীরে ধরছে আমায়।
– মাইশা কন্ট্রোল ইউরসেল্ফ। এতক্ষণ ধরে ঠিক থাকতে পারলে এখন পারবি না কেনো?
সারার কথায় অনেকটা স্বাভাবিক হলাম আমি। বেস্টফ্রেন্ড মানেই হয়তো দুর্বলতা কাটিয়ে তোলার আরেক মাধ্যম। কঠিন সময়ে যাকে পাশে পাওয়া যায়। যার একটা কথায়ই হারিয়ে যাওয়া মনোবল খুজে পাওয়া যায়। সারার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করলাম আমি যার অর্থ “হ্যাঁ, আমি পারবো “। আমার উত্তরে এক টুকরো হাঁসি উপহার দিলো সে।
এবার সামনের দিকে তাকালাম আমি। না চাইতেও আবার বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। আজকেও কালো রঙে নিজেকে সাজিয়েছেন সায়ন ভাইয়া। মুখে ঝুলে আছে মৃদু হাঁসি। উনার সাথেই আছেন উনার বন্ধুরা।
আলাদা একটা ঘর বরাদ্দ করা হলো সায়ন ভাইয়াদের জন্য।সন্ধ্যা পর্যন্ত যেখানে উনি আর উনার বন্ধুরা থাকবেন। সমস্যা হলো যখন উনাদের ঐ ঘরে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠলো। আজ সবাই এমন ভাব করছে যেনো সায়ন ভাইয়া কোনো এলিয়েন। উনাদেরকে ঐ ঘরে কে দিয়ে আসবেন সেটা নিয়েই ভাবনাচিন্তার শেষ নেই। বুঝতে পারছি না এমন করার কি আছে। আগে তো সায়ন ভাইয়া একা একাই সারা বাড়িতে ঘুরে বেরাতো। তাহলে আজকে আবার কাউকে সাথে যেতে হবে কেনো? আজব!
– নাজিবা তুই যা সায়নের সাথে।
মায়ের আদেশে মুখ কাচুমাচু করে ফেললো নাজিবা আপু। কুচকে যাওয়া মুখ নিয়েই আমতা আমতা করে বললো
– চাচী প্লিজ আমি যাবো না।
– কেনো?
– আমার কেমন লজ্জা লাগছে।
– আরে পাগল এখানে লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
– জানি না। প্লিজ চাচী ।……. এক কাজ করো মাইশাকে পাঠাও তাহলেই তো হয়।
নাজিবা আপুর কথা শুনে সারার দিকে তাকালাম আমি। সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
– আমি কেনো আপু? তোমরা যাও না।
– একদম না। তুই যাবি। তুইই ঠিক আছিস। তাই না বলো চাচী?
– নাজিবা ঠিকই বলেছে। তুইই ওদের নিয়ে যা।
এবার তো আর কিছু করার নেই আমার। সবার ফাপড়ে পরে গেছি। তাই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সায়ন ভাইয়াদের সাথে উঠে এলাম আমি। সায়ন ভাইয়া আমার পাশেই আছে। কিন্তু আমি তাকাচ্ছিনা উনার দিকে। কি দরকার শুধুশুধু কষ্ট বাড়ানোর?
উনাদের ঘরে রেখেই চলে আসার জন্য পা বারালাম আমি। কিন্তু তখনই শুনতে পেলাম রাহুল ভাইয়ার ডাক।
– হেই মাইশা। কেমন আছো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনারাও ভালোই আছেন নিশ্চয়ই?
– হ্যাঁ, আমরা তো বিনদাস আছি।
– হুমম ভালো। আচ্ছা আমি আসি?
– একটা কথা বলবো তোমায়?
– জ্বী বলুন।
– আমার মাও এসেছে আজকে। তোমার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন।
– আমার সাথে?
– হ্যাঁ, তুমি কি একটু কথা বলবে মার সাথে?
– আচ্ছা চলুন।
– হুমম চলো।
রাহুল ভাইয়ার সাথে আবারও চলে এলাম ড্রয়িংরুমে। ড্রয়িংরুমের এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন মা আর একজন মহিলা। আমায় নিয়ে সেখানেই গেলেন রাহুল ভাইয়া। উনি মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন
– মা এই যে মাইশা।
রাহুল ভাইয়ার কথা শুনে আমার দিকে তাকালেন উনি। আমিও ভালো করে তাকালাম উনার দিকে। অসম্ভব রূপের অধিকারী উনি। এই বয়সেও চেহারার লাবণ্যতা কমে যায়নি। উনি আমার কাছে এসে দাঁড়ালেন।
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। তুমিই মাইশা?
– জ্বি।
– কিরে রাহুল ওতো দেখি যেমন রূপবতী তেমন গুণবতী একটা মেয়ে। এমন মেয়ে আজকাল পাওয়া দুষ্কর।
রাহুল ভাইয়া মাথা চুলকে হাসলেন শুধু কিছু বললেন না। আমার এবার চরম অস্বস্তি হচ্ছে। প্রকাশ্যে নিজের প্রসংশা শুনলে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হয়। যেটা একদমই ভালো লাগে না আমার। উনি এবার মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন
– ভাবী আপনার দুই মেয়েই তো অনেক ভালো। একদম চাঁদের টুকরো যেনো।
আন্টির কথা শুনে মাও হেঁসে দিলেন। মা যে এই কথায় গর্ব বোধ করছে সেটা বুঝতে পারছি আমি। তবে অন্য কেউ যাতে এটা না বুঝতে পারে তাই অন্য কথায় চলে গেলো মা। আমিও তাদের বিদায় জানিয়ে চলে এলাম নিজের ঘরে। সকাল থেকে সবার সাথে আছি। এবার একটু নিজেকে সময় দেওয়ার প্রয়োজন।
🍁
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসছে সবার হাঁসাহাঁসির আওয়াজ। নিজের ঘরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। হাতে মেরুন কালারের একটা গাউন। এনগেজমেন্ট পার্টিয়ে পড়ার জন্য কিনেছিলাম। কিনেছিলাম বললে ভুল হবে আপু কিনিয়ে ছিলো। সব মেয়েরা অন্য একটা ঘরে সাজতে ব্যাস্ত। পার্লারের মহিলারা এসেছে সাজাতে। সবাই সেখানেই সাজছে। আমাকেও জোর করেছিলো। কিন্তু আমি যাইনি। এমনিতেই সাজাসাজি ভালো লাগে না আমার। আর আজকে তো আরো সম্ভব না।
বাহিরেই যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। আচ্ছা, আমি ওখানে না গেলে কি কেউ খুঁজবে আমায়? হয়তো খুঁজবে নয়তো না। এতো মানুষের মাঝে আমায় নিয়ে ভাবার সময় পাবে কেউ?
সে যাই হোক আমায় তো যেতেই হবে। যাকে ভালোবাসি তার জীবনের এতো বড় একটা সময়ে আমি উপস্থিত থাকবো না? অভিয়েসলি থাকবো। নিজের চোখে দেখবো সবটা। এসব ভেবে নিয়েই ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলাম আমি। উদ্দেশ্য গাউনটা পরবো। কিন্তু দরজার আওয়াজে ঘুরে তাকালাম পিছনে।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মা। কিছু একটা বলতে চাইছে মনে হচ্ছে কিন্তু বলতে সংকোচ বোধ করছেন হয়তো। মায়ের এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকায় কেমন সন্দেহ হচ্ছে আমার। তাই আমিই বললাম
– কিছু বলবে মা?
– না মানে একটা কথা বলার ছিলো তোকে।
– তো বলো ।
– কিভাবে যে বলি।
মায়ের এমন কথায় জোরে জোরে হেঁসে দিলাম আমি। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে। আমি কোনোমতে হাঁসি থামিয়ে বললাম
– মা, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি একটা ছেলে। আর আমায় প্রপোজ করতে এসেছো। তাই ঠিকভাবে কথা বলতে পারছো না। হাউ ফানি। তুমি বয়ফ্রেন্ড আর আমি গার্লফ্রেন্ড। বাহ বাহ
– ফাইজলামি বন্ধ না করলে টেনে মারবো এক চড়। ফাজিল মেয়ে।
– তো আমি কি করবো? তোমার হাবভাব দেখে যা মনে হচ্ছে তা-ই তো বললাম। সত্যি কথা বললেই দোষ। যাও আর কথাই বলবো না আমি। এই মুখ অফ। যা বলার তুমি বলো।
– বলছিলাম যে
– কি বলছিলে?
– দেখ, মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস তখন একদিন তো বিয়ে করে অন্যের ঘরে যেতেই হবে। তাইনা?
মায়ের কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। চলছে আপুর বিয়ের কাজ আর কথা হচ্ছে আমার মেয়ে হওয়া নিয়ে? অদ্ভুত! আমি আবুলের মতোই মাথা নারলাম অর্থাৎ হ্যাঁ, যেতে হবে। আমার সায় পেয়ে মা আবার বলতে শুরু করলো
– একটা কথা বলবো। পুরো না শুনে কিছু বলবি না তুই।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
– শোন, রাহুল আছে না সায়নের বন্ধু?
– হ্যাঁ। তো?
– আগে শোন। রাহুলের মা তোর আর রাহুলের বিয়ের কথা বলছে।
– মা? কিসব বলছো তুমি?
– হ্যাঁ, দেখ মাইশা। একদিন না একদিন বিয়ে তো করতেই হবে। সেখানে রাহুল ভালো একটা ছেলে, পরিবার ভালো সবদিক দিয়েই পারফেক্ট। আমরা তো এমন ভালো কারো কাছেই আমাদের মেয়ের বিয়ে দিতে চাইবো। তাই না? আমি তোর উপর জোর খাটাবো না। তোর নিজঃস্ব একটা মতামত আছে। শুধু বলবো, রাহুলের মতো ভালো ছেলে আর নাও পেতে পারি।
মায়ের আর কোনো কথা কানে যাচ্ছে না আমার। মাথাটা যেনো হ্যাং হয়ে গেছে। সবকিছু উলোটপালোট লাগছে। মায়ের দিকে তাকাতেই চোখে পরলো এক উদ্বিগ্ন চেহারা। আচ্ছা, আমি যদি না করে দিই তাহলে কি এই চেহারায় কষ্ট পাওয়ার ছাপ পরে যাবে? হয়তো না। তবে এই মুখটায় খুশি ফুটে উঠবে না। আমার উত্তরটা যদি “হ্যাঁ ” হয় তাহলে হয়তো সুপাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দেওয়ার আনন্দে মায়ের মুখে ভেসে উঠবে অন্যরকম প্রশান্তি। কিন্তু আমি? আমি কি খুশি হবো?মায়ের খুশির থেকে কি আমার নিজের খুশি বেশি? কি করা উচিৎ এখন আমার?
চলবে……….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]