ভালোবাসি তাই পর্ব-২৯

0
2066

#ভালোবাসি তাই
part:29
Writer:Afifa Jannat Maysha

🍁

অবাকের রেশ কাটিয়ে রাহুল ভাইয়াকে প্রশ্ন করলাম

– আপনার চোখে পানি যে? খুশি হননি বুঝি? আপনার তো খুশি হওয়ার কথা।

রাহুল ভাইয়া টলমলে চোখেই মুচকি হাঁসলেন। এবারো অবাক হলাম আমি। তবে সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে চোখমুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। উনি চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললেন

– হুম খুশি হওয়ার কথা। আমি যা চেয়েছিলাম তাই তো হয়েছে কিংবা তবুও খুশি হতে পারছি না আমি। কোথাও একটা কষ্ট হচ্ছে আমার।

– কষ্ট হচ্ছে? আপনি নিজে আমার এ অবস্থার জন্য দ্বায়ী। এখন নিজেই বলছেন কষ্ট হচ্ছে?

-………………….

– হ্যাঁ এবার বলুনতো বিনা দোষে আমার সাথে এতটা জঘন্য কাজ কেনো করলেন আপনি?

আমার কথায় আবারো হাঁসলেন রাহুল ভাইয়া। উনার এতো হাঁসি পাচ্ছে কেনো সেটাই বুঝতে পারছিনা আমি। উনি ঠোঁটে হালকা হাঁসি ঝুলিয়ে রেখেই বললেন

– সত্যি সত্যিই কি তুমি নির্দোষ?

– মানে?

– মানে টা বুঝতে পারছো না?

– বুঝতে পারলে জিজ্ঞেস করতাম না নিশ্চই?

– আচ্ছা একটু দাঁড়াও তাহলেই বুঝতে পারবে।

রাহুল ভাইয়া তার ফোনটা বের করলেন। কতক্ষণ পরেই ফোনের স্ক্রিনটা আমার সামনে ধরলেন। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে ভাসছে একটা ছেলের মুখ। যেটা দেখে অবাক হয়ে গেলাম আমি।

-এটা তো রোহান।

– হ্যাঁ রোহান। আমার ছোট ভাই।

– ও আপনার ভাই?

– হ্যাঁ আমার ভাই। এখনো তুমি বলবে তুমি নির্দোষ?

– হ্যাঁ বলবো আমি নির্দোষ। কারণ আমি ভুল কিছুই করিনি।

– কে বলেছে করোনি। ও ভালোবাসতো তোমায়। তাই প্রপোজ করেছিলো। কিন্তু তুমি কি করেছো ? মেলায় সবার সামনে অপমান করেছো। আরে ওর ভালোবাসা গ্রহণ না-ই করতে পারো তাই বলে অপমান করতে পারো না।

রাহুল ভাইয়ার কথায় অবাক হচ্ছি আমি। উনি না বুঝেই কত কথা বলে চলেছেন। উনার কথা শুনেই বুঝতে পারছি যে উনি আসল ঘটনাটাই জানেন না। আমি বলে উঠলাম

– আপনি এসব কিভাবে জানেন ভাইয়া?

– তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি হাস্যকর কথা বলছো? ও আমার ভাই হয়। সেদিন বাসায় এসে লজ্জায় অপমানে কেঁদেছিলো রোহান। একটা ছেলে খুব ছোট কোনো বিষয় নিয়ে কাঁদে না এটা বিশ্বাস করো নিশ্চই? ওর কাছে জানতে চাইলে ও সবটা বলেছিলো আমায়।

– ওহ আপনার ভাইয়ের কথা বিশ্বাস করে আপনি একটা মেয়ের সারাটা জীবন নষ্ট করে দিলেন? একবারো যাচাই করে দেখলেন না আসল সত্যিটা কি?

– মানে?

– মানে জানতে চান? তাহলে শুনুন, রোহান আমাদের ক্লাসমেট ছিলো আর আমরা এক কলেজেই পড়তাম সেটা জানেন নিশ্চই?

– হ্যাঁ

– আমরা জাস্ট ক্লাসমেট ছিলাম। ওর সাথে কথা বলতাম না কখনো। ইভেন সারা বাদে অন্য কারো সাথেই কথা বলতাম না আমি। কিন্তু একদিন হুট করেই ও প্রপোজ করে বসে আমায়। আমি প্রথমে অবাক হলেও পরে মুচকি হেঁসে বলে দিয়েছিলাম আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। সেদিন ও কিছু না বলে মুখ কালো করে চলে গেছিলো। আমি ভেবেছিলাম ও বুঝতে পেরেছে। কিন্তু আমার ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে এরপর থেকে রোজই আমায় ডিস্টার্ব করা শুরু করে রোহান। প্রথম দিকে ভালো করে বললেও পরে রেগে যেতাম আর আমার পিছনে পরে থাকতে নিষেধ করতাম। কিন্তু ও আমার কথা মানলে তো। এভাবেই কলেজ লাইফের একদম শেষ প্রান্তে চলে আসি আমরা। সেদিন ছিলো ২৮ শে মার্চ। কলেজের সামনে মেলা বসেছিলো। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। কারণ আর তিনদিন পর ছিলো আমাদের পরীক্ষা। কিন্তু সারা জেদ ধরে সে মেলায় যাবে। পড়তে পড়তে নাকি বোর হয়ে গেছে সে। তাই মেলায় গিয়ে মনটাকে একটু ফ্রেশ করে নিতে চায়। তো, তার জেদের কাছে হার মেনে নিয়ে পাড়ি জমালাম মেলার উদ্দেশ্যে। সেদিন রোহানও ছিলো মেলায়। এতোদিন যা-ই করুক না কেনো। সেদিন সব সীমা পাড় করে ফেলেছিলো সে। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই কোমড়ে কারো স্পর্শ পাই আমি। সাথে সাথেই চরম মাত্রায় রেগে যাই । কাজটা কে করেছে সেটা না দেখেই থাপ্পড় মেরে বসি। অবশ্য দেখলেও এটাই করতাম। মেলার ভীড়ে এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ায় সবার নজরে পরে সেটা। তাই সবাই মিলে অপমান করে রোহানকে। সেদিনই ছিলো ওর সাথে আমার শেষ দেখা। এই এক বছরে আর দেখিনি ওকে। তারপর পরীক্ষা, ভারসিটির ভর্তি কোচিং এসব কিছুর ব্যাস্ততায় ভুলেই যাই রোহান নামক কাউকে।

একদমে সবটা বলার পর রাহুল ভাইয়ার দিকে তাকালাম আমি। উনার গাল বেয়ে গরিয়ে চলেছে পানি। এবার পাশ থেকে পুলিশ অফিসার বলে উঠলেন

– সো, মিস্টার রাহুল। এবার আপনি এসব কিভাবে করলেন তার ডিটেইলস বলুন।

– ভারসিটির নবীন বরণ অনুষ্ঠানে মাইশাকে দেখি আমি। প্রথম দেখাতেই ওকে চিনে যাই। পরে জানতে পারি ও হচ্ছে সায়নের কাজিন। তারপর ওর সাথে পরিচয় হয়। ওর আচার ব্যবহারে অবাক হয়ে যেতাম। ওকে দেখে কখনো মনে হয়নি অকারণে কারো সাথে এতটা খারাপ কিছু করতে পারে।কিন্তু নিজের ভাইয়ের কথাও অবিশ্বাস করতে পারতাম না। তারপর রাস্তায় ধাক্কা দেওয়া, লাইব্রেরিতে কাঁচের বোতল ছুড়া, কক্সবাজারের হোটেলে মুখ চেপে ধরা সব আমি করেছিলাম। তবে ওকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে নয়। শুধুমাত্র ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম। রাস্তায় সারাকে দেখেই ধাক্কা দিয়েছিলাম আর লাইব্রেরিতেও এমনভাবে বোতল ছুড়েছিলাম যাতে ওর কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু মাইশা তো মাইশাই। এতোকিছুর পরেও নিশ্চিত হয়ে চলাফেরা করতো সে। তারপর ঠিক করি বিয়ে করে সারাজীবন ইচ্ছেমতো অত্যাচার করা যাবে ওর উপর।

এটুকু বলেই থামলেন রাহুল ভাইয়া। আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনে চলেছি সব। বুঝে উঠতে পারছি না কি করা উচিৎ আমার। সায়ন ভাইয়ার দিকে চোখ যেতেই উনার ভিজে উঠা লাল চোখ দেখতে পেলাম আমি। আবারো বলতে লাগলেন রাহুল ভাইয়া

– সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিলো কিন্তু গায়ে হলুদের দিনই সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হলো আমায়। সেদিন সায়নকে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় মাইশাকে দেখে ফেলি আমি। জানিনা কেনো সেদিন না চাইতেও সায়নের প্রতি হিংসা হয় আমার। মনে হচ্ছিলো আমার কলিজাটা ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম মাইশার প্রতি দুর্বল আমি। এই দুর্বলতা সামান্য নয়। খুব বেশিই দুর্বল হয়ে গেছিলাম ওর উপর। কিন্তু আমার তো দুর্বল হওয়া চলতো না। তাহলে আমি যা চাইতাম তা হতো না। তাই সিদ্ধান্ত নিই এমন কিছু করবো যাতে কেউ কোনোদিন ওর দিকে তাকাতেও না পারে। তাতে আমার কাজটাও হয়ে যাবে আর মাইশা অন্য কারো হতে পারবে না। কারণ ওকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না আমি। তারপরেই…………

এবার আর চুপ থাকতে পারলাম না। চিৎকার করে বললাম

– তারপর এতো নিকৃষ্ট একটা কাজ করে বসলেন। বুঝতে পারছেন? আপনার একটা ভুল সিদ্ধান্তে আমার পুরো ভবিষ্যতটাই নষ্ট হয়ে গেছে। সমাজের কাছে একটা বোঝায় পরিণত হয়ে গেছি আমি। এখন তো জানতে পারলেন আমার কোনো দোষ ছিলো না। এবার বলুন পারবেন আমায় আগের মতো করে দিতে? পারবেন আমার বাঁ চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে? বলুন পারবেন ?

হঠাৎ করেই অদ্ভুত কাজ করে বসলেন রাহুল ভাইয়া। আমার কাছে এসে হাত ধরে বলে উঠলেন

– আমি জানি খুব বড় দোষ করে ফেলেছি আমি। এর ক্ষমা হয়না। কিন্তু আমি যখন তোমার ক্ষতি করেছি তখন আমিই এই ক্ষতিপূরণ করতে চাই।

– মানে?

– তোমায় বিয়ে করে একটা সুন্দর ভবিষ্যত দিতে চাই তোমায়। দয়া করে আমায় একটা সুযোগ দাও মাইশা। তোমার এই অবস্থা সহ্য করতে পারছি না আমি।

আমি রাহুল ভাইয়াকে কিছু বলতে যাবো তার আগেই সায়ন ভাইয়া আমার হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন রাহুল ভাইয়ার থেকে। উনি শক্ত গলায় বললেন

-এতক্ষন ধরে তোর সব কথা শুনেছি। কিছু বলিনি। ট্রাস্ট মী, একঘন্টা আগে পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম মাইশা ভুল। কোনো ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে হয়তো। কিন্তু এখন তো সবটাই পরিষ্কার। আচ্ছা রাহুল? তোকে নিজের ভাইয়ের থেকে বেশি কিছু ভাবতাম আমি। সবসময় তো বলতি তোর এমন কোনো কথা নেই যেটা আমরা জানি না। তাহলে এই কথাটা কেনো জানলাম না। বল? বিশ্বাস কর তোর জায়গায় অন্য কেউ থাকলে জাস্ট খুন করে ফেলতাম। কিন্তু তুই যে আমার কি সেটা তুই নিজেও জানিস। তাই বলছি এবার চুপ কর। নাহলে আর কতক্ষন নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারবো সেটা জানি না আমি।

রাহুল ভাইয়া অস্পষ্ট গলায় বললেন

– সায়ন, আমায় ভুল বুঝিস না দোস্ত। আমি সত্যিই মাইশাকে বিয়ে করতে চাই।

– তোর দয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মাইশাকে নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে। এর জন্য আমি আছি। হ্যাঁ ওকে ভালোবাসি আমি।

সায়ন ভাইয়ার কথায় চমকে গেলেন রাহুল ভাইয়া।

– তুই?

– হ্যাঁ আমি।

রাহুল ভাইয়া টলমলে চোখে তাকিয়ে বললেন

– হুম, মাইশা তোর মতো কাউকেই ডিজার্ব করে। আমার মতো কাউকে না। কিছুই বলার নেই আমার। নিজের দোষে নিজের ভালোবাসাকে হারাতে হলো আমায়। আমি সত্যি অনুতপ্ত।

এবার আমি বলে উঠলাম

– এটা কোনো হিন্দি সিরিয়াল নয় ভাইয়া। যে আপনি অনুতপ্ত হলেই আপনাকে ক্ষমা করে দেবো আমি। সরি, এতোটা মহৎ আমি নই। আপনাকে তো শাস্তি পেতেই হবে। আমি নিজে আপনার সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাবস্থা করবো। আমার মতো আপনার ভবিষ্যতটাও নষ্ট করে দেবো আমি।

– আমি নিজেকে ধণ্য মনে করবো। তুমি যে শাস্তি দেবে দাও। আমার কোনো আপত্তি নেই।

এবার সায়ন ভাইয়া জড়িয়ে ধরলেন রাহুল ভাইয়াকে। রাহুল ভাইয়াও জড়িয়ে নিলেন উনাকে।

– কেনো এতো বড় একটা অপরাধ করলি তুই? আমি যে তোর এই অবস্থা দেখতে পারবো না। আবার মাইশার অপরাধীকেও শাস্তি না দিয়ে শান্তি পাবো না। এবার তুইই বল কি করবো আমি?

– আমার জন্য তুই কষ্ট পাস না দোস্ত। ফাহাদ আর সাদবকেও বলিস আমার জন্য যেনো কষ্ট না পায়। আমার দোষের শাস্তি আমিই পাবো।

– এতো সহজ? পারবো তোকে কষ্ট পেতে দেখতে?

– পারতে তো হবেই।

চলবে……….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here