ভালোবাসি তাই পর্ব-৫

0
2048

#ভালোবাসি তাই
part :5
Writer : Afifa Jannat Maysha

🍁
🍁🍁

সকাল সাতটার কাছাকাছি। রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। রাতে আর ঘুমানো হয়ে উঠে নি আমার। চোখদুটো হালকা জ্বলছে। কাল রাতের পর আর সায়ন ভাইয়ার সামনে পড়তে চাই নি। তাই এই সকালবেলাতেই চলে এসেছি উনাদের বাসা থেকে। কাউকে অবশ্য বলে আসিনি। খালামনি জানতে পারলে এতো সকালে কখনোই আমাকে আসতে দিতো না। খুব ভোরে খালামনিকে তার নিজের ঘরে নামাজ পড়তে দেখেছিলাম। পরে আর দেখা হয় নি। বাসার মেইন গেটটাও খোলা ছিলো। হয়তো আঙ্কেল মসজিদে যাওয়ার সময় খুলে ছিলেন পরে আর বন্ধ করা হয়ে উঠে নি।

ভাবছি এখনই কোনো গাড়িতে উঠবো না। যতক্ষণ পর্যন্ত ক্লান্ত না হয়ে যাই ততক্ষন পর্যন্ত হাঁটতেই থাকবো। এই ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ত সকালটা এভাবে অনুভব করার সুযোগ হয়ে উঠে নি কখনো। রাস্তায় যানবাহনের আনাগোনা দেখে বোঝার উপায় নেই এখন সকাল না দুপুর। মনে হচ্ছে কে কার আগে ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে সবাই। জীবীকার তাগিদে যে হাজারো মানুষ রোজ চোখের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ছুটে চলে কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে তার এক বিরাট বড় উদাহরণ এই সকাল। চারদিকে ইট -পাথরের দেয়ালের কৃত্রিমতা ভেদ করে বিশুদ্ধ বাতাসটাও যেনো প্রবাহিত হতে চাইছে না এই শহরে। কারো মাঝে একটু বিশুদ্ধ শ্বাস নেওয়ার প্রবণতাও লক্ষ্য করছি না আমি। সবাই যে যার কাজে ব্যাস্ত, আশেপাশের কোনোকিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের নেই। আর পাঁচটা দিনের মতো আজকের দিনটাও যদি আমার কাছে স্বাভাবিক হতো তাহলে হয়তো আমিও ভাবতাম না এসব। কিন্তু আজ আশেপাশের পরিবেশটাকে নিয়ে ভাবার ইচ্ছেটা নিজের মাঝে প্রবলভাবে অনুভব করছি।

খালামনির বাসা থেকে আমাদের বাসার প্রায় এক ঘন্টার মতো দুরত্ব। আমি ঠিক কতক্ষন ধরে হাঁটছি তা খেয়াল নেই আমার। হাতঘড়িটায় সময়টা দেখার ইচ্ছেও করছে না। আজ তো আমার কোনো তাড়া নেই, তাই আজ সময়জ্ঞানহীনভাবেই হাঁটতে থাকবো।

হঠাৎ করেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে কেউ আমার পেছন পেছন আসছে। কিন্তু পিছনে ফিরে সন্দেহ করার মতো কাউকেই দেখছি না আমি। তবুও মনে হচ্ছে কেউ একজন আড়াল থেকে খুব সুক্ষ্যভাবে লক্ষ্য করে চলেছে আমায়।

কিন্তু কে এমন করবে? আমার পিছু নিয়ে কার কি লাভ? একবার ভাবছি হয়তো মনের ভুল। আরেকবার ভাবছি সত্যিই কি মনের ভুল? এতোটা ভুল করছি আমি? হ্যাঁ, মনের ভুলই হবে হয়তো। সব চিন্তাভাবনা ফেলে রেখে আবারো হাঁটতে লাগলাম আমি।

পাশ দিয়ে যাওয়া একটা লোকের সাথে ধাক্কা লেগে হাত থেকে পার্সটা পরে গেলো নিচে। আমি সেটা তুলতে গেলেই অস্বাভাবিক কিছু ঘটলো আমার সাথে। আচমকাই কেউ একজন ধাক্কা দিলো আমায়। আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যাচ্ছিলাম তখনই আবার কেউ আমায় ধরে ফেললো।

গাড়িগুলো শনশন শব্দ করে ছুটে চলেছে রাস্তায়। কি ভয়ানক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। কোনোভাবে যদি পড়ে যেতাম, বাঁচার কোনো আশাই থাকতো না আমার। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। হার্ট এতো জোরে বিট করছে যে মনে হচ্ছে সে বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য বিদ্রোহ শুরু করেছে।

নিজেকে স্বাভাবিক রেখে সামনে তাকালাম আমি। উদ্দেশ্য কে আমাকে বাঁচিয়ে দিলো তাকে দেখা। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সারা। চোখের আকার দেখে মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছে সে। কিন্তু তার রাগের কারণটাই বুঝতে পারছি না আমি।

– সারা, তুই এখানে?

– কেনো, আমার জায়গায় আজরাঈল থাকলে খুশি হতি নাকি?

– কিসব বলছিস ? আজরাঈল কেনো থাকতে যাবে?

-আমি কি বলছি তুই বুঝতে পারছিস না?

– তুই বুঝিয়ে বললে না বুঝবো ।

– সুইসাইড করতে কেনো গেছিলি?

– কি? পাগল হয়ে গেছিস তুই? আমি সুইসাইড করতে যাবো কোন আনন্দে?

-মানুষ আনন্দে নয় দুঃখে সুইসাইড করে।

– আমার এমন কোনো দুঃখ নেই যে মরে যেতে চাইবো।

– তাহলে কি গাড়িটা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য তার নিচে পড়তে চাইছিলি?

– তুই ভুল বুঝছিস আমাকে। ট্রাস্ট মি, আমি ইচ্ছে করে পড়ি নি। কেউ ধাক্কা মেরেছে আমাকে।

আমার কথায় চুপ করে গেলো সারা। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর বলে উঠলো

– কিন্তু তোকে ধাক্কা মারতে যাবে কে?

– সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমি। আমার পার্সটা নিচে পরে গেলো, আমি সেটা তুলতে গেলাম আর তখনই কেউ ধাক্কা মারলো। তাই কে ছিলো তাকে দেখতে পারি নি।

-পার্সটা পড়লো কি করে?

– পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় একটা লোকের গায়ের সাথে লেগে পরে গেছিলো।

– তাহলে হয়তো তুই পার্স তুলার সময় আবার অন্য কারো সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যাচ্ছিলি। আই মিন, পুরো ঘটনাটাই অনিচ্ছাকৃত। নাহলে তোকে ধাক্কা মেরে কার কি লাভ?

সারার কথা শুনে আমারো তাই মনে হচ্ছে। সত্যিই তো আমাকে কেউ কেনো ধাক্কা মারতে যাবে? সারার কথাই হয়তো ঠিক। এতো লোকের ভীরে কারো সাথে ধাক্কা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অনিচ্ছাকৃত হলেও কতো বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিলো। সারা না থাকলে হয়তো এতক্ষণ রাস্তায় পড়ে থাকতো আমার নিঃপ্রাণ দেহ।

– আচ্ছা তুই এতো সকালে এখানে কি করছিলি? তুই না সায়ন ভাইয়াদের বাসায় গেছিলি?

– হ্যাঁ, ওখান থেকেই বাসায় যাচ্ছিলাম।

– তাই বলে এতো সকালে? আরেকটু পরে বের হতি।

– এমনি ভালো লাগছিলো না। তাই চলে যাচ্ছিলাম।

– কি হয়েছে বলতো?

– কি হবে?

– কিছু তো হয়েছে। নাহলে যে তুই সায়ন ভাইয়াদের বাসায় গেলে আসতেই চাস না সেই তুই বলছিস ভালো লাগছে না। ব্যাপার কি বলতো?

– কোনো ব্যাপার নেই। সবসময় পরিস্থিতি এক থাকে না।

– হুম বুঝলাম। কি হয়েছে বলতে হবে না। চল আমাদের বাসায় যাই।

– তোদের বাসায় কেনো যাবো? আমি এখন আমাদের বাসায় যাবো।

– তো যা না। যাওয়ার পরে আন্টি যখন জিজ্ঞেস করবে এতো সকালে কেনো চলে এলি তখন কি উত্তর দিবি? বলবি যে সায়ন ভাইয়ার সাথে কোনো কারণে ঝামেলা করে চলে এসেছিস?

সত্যিই তো একথাটা আগে আমার মাথায় আসে নি। বাসার সবাই জানে আমি খালামনির বাসায় যাওয়ার জন্য পাগল। এখন সেই বাসা থেকেই এতো সকালে চলে এসেছি দেখলে সবাই ভাববে কিছু হয়েছে। তার থেকে বরং সারার সাথে ওদের বাসায় চলে গেলে ভালো হবে। আরেকটু পরে নাহয় বাসায় চলে যাবো।

– কিরে ভাবনা শেষ হলো?

– হুম।

– যাচ্ছিস তো?

– হ্যাঁ, চল।

🍁
🍁🍁

সারাদের বাসার সবাই বাসাতেই আছে। সকালবেলায়ই ওদের বাসায় কেমন উৎসব উৎসব ভাব। সারার বড় আপু বেড়াতে এসেছে বলে এতো আয়োজন। ভাবছি আমার আপুও যদি বিয়ের পরে বাসায় আসে তখন কি আমাদের বাসায়ও এমন আনন্দ হবে? হবে হয়তো। কিন্তু কথা হচ্ছে আমি মন থেকে আনন্দ করতে পারবো কি না। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই সারার সাথে তার ঘরে চলে এলাম। তখনই দৌড়ে এলো কিউট গুলুমুলু একটা ছোট ছেলে। তাদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম এটা সারার আপুর ছেলে।

– সালা, তোমায় হাতা থেস?

– হ্যাঁ, বাবা আমার হাটা শেষ।

– আমায় দন্য তক্কেত এনেতো?

– এই রে একদম ভুলে গেছি। কালকে এনে দেবো ঠিকাছে?

সারার কথায় মুখটা কালো হয়ে বাচ্চাটার। আমার পার্সে কয়েকটা চকলেট ছিলো। বাসা থেকে আসার সময় ভাইয়া দিয়েছিলো কিন্তু খাওয়ার সুযোগ হয় নি। আমি চকলেটগুলো তার দিকে বারিয়ে দিয়ে বললাম

– এই নাও বাবু, চকলেটস।

বাচ্চাটা একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার সারার দিকে তাকাচ্ছে। হয়তো অপরিচিত কারোর থেকে কিছু নেওয়ার নিষেধাজ্ঞা জারি আছে তার উপরে। ওর অবস্থা দেখে আমার ছোটবেলার কথা মনে পরে যাচ্ছে। আগে যখন স্কুলে যেতাম মা বারবার করে বলতো ” মাইশা, অপরিচিত কেউ কোনোকিছু খেতে দিলে খাবে না। তার সাথে যেতে বললেও যাবে না “।
তখন আমি শুধু মাথা নাড়তাম যার অর্থ হ্যাঁ, যাবো না। কিন্তু মনে মনে ভাবতাম অবশ্যই খাবো। কেউ আমাকে টাকা ছাড়া চকলেট দিলে আমি কেনো নেবো না? অবশ্যই নেবো। কিন্তু আফসোস, আজ পর্যন্ত এমন অপরিচিত কোনো ব্যক্তির আগমন ঘটে নি। এটা সত্যি সত্যিই অনেক কষ্টের কথা।

– সালা, আমি কি এই আন্তির তক্কেত নিবো?

– হ্যাঁ, বাবা নাও।

– তুমি অনেক বায়ো আন্তি।

ওর কথায় মুচকি হাঁসলাম আমি। তার সামনে হাটু মুরে বসে জিজ্ঞেস করলাম

– তোমার নাম কি বাবু?

– মুয়াম্মত।

– মোহাম্মদ?

– হ্যাঁ।

– অনেক সুন্দর নাম। কে রেখেছে এই নামটা?

– সালা।

– সালা রেখেছে?

– সালা না তো, সালা।

সারা বললো
– তুমি এখন যাও বাবা। আমরা পরে খেলা করবো।

– থিকাতে। আততায়াইকুম আন্তি।

– ওয়ালাইকুম আসসালাম।

মোহাম্মদ চলে যেতেই সারাকে বললাম
– তোর আপুর ছেলে তো দেখি হেব্বি টেলেন্টেড।

– কেনো? এখানে টেলেন্টের কি দেখলি?

– আরে তোকে খালামনি থাকে সোজা শালা বানিয়ে দিলো। এটা কি কম বড় টেলেন্ট?

– ওর এই কথাগুলোর জন্যই তো ওকে এতোটা ভালোবাসি আমি। জানিস মাইশা, মোহাম্মদের জন্মের আগে আমার খুব রাগ হতো। কারণ আমার মনে হতো ওর জন্মের পর আপু আমাকে আর আগের মতন ভালোবাসবে না। হিংসা হতো খুব। কিন্তু ও আমাদের মধ্যে আসার পর আমার ধারণা পুরো পাল্টে গেছে। প্রবাদ আছে না, ” মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি ” আমার ক্ষেত্রে এখন তাই হচ্ছে। ও তো আমার আপুরই অংশ। তাই ওকে ভালোবাসা মানে আপুকে ভালোবাসা। ওদের দুজনকেই আমি খুব ভালোবাসি। আচ্ছা তুই বস আমি একটু আসছি।

সারা চলে গেলে জানালার পাশটায় এসে দাঁড়ালাম আমি। জানালার বাইরে অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবছি

” আমি নিশ্চয়ই অনেক সার্থপর? নাহলে নিজের আপুর আনন্দে খুশি হতে পারবো কিনা তা নিয়েও দ্বিধায় ভুগছি কেনো? আমিও তো আমার আপুকে খুব ভালোবাসি। সারা তার আপুকে যতটা ভালোবাসে তার থেকেও ভালোবাসি। সায়ন ভাইয়ার জন্য আমি নিজের বোনের সাথে দুরত্ব কেনো বারাবো? আমিও আমার আপুর সাথে এভাবেই থাকবো। ওর সাথে অনেক আনন্দ করবো। আচ্ছা, খুব কি ক্ষতি হতো যদি আমি সায়ন ভাইয়াকে ভালো না বাসতাম? বেসেছি তো কি হয়েছে? তার জন্য আপুর সাথে আমার সম্পর্ক কখনোই খারাপ হতে দিবো না, কখনোই না। ”

চলবে……..

[কালকে অনেকেই বলেছেন যে আমি গল্প দেরিতে কেনো দেই? এতে গল্প পড়ার আগ্রহ হারিয়ে যায়।গল্প লেখাটা আমার একটা সখ। আমি সখের বসেই গল্পটা লিখছি। কিন্তু আমার তো আরো অনেক কাজ থাকে তাই না? সব কাজ ছেড়ে দিয়ে শুধু গল্প নিয়ে পরে থাকলেতো চলবেনা। আমি যখন সময় পাই তখন লিখতে বসি। তবুও আমি গল্পটা নিয়মিত দেওয়ার চেষ্টা করবো। তারপরেও যদি গল্প দিতে দেরি হয় আশা করি আপনারা আমার সমস্যাটা বুঝবেন। ধন্যবাদ। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here