ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ১৫ .

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৫
.
আমি কাঁপাকাঁপা হাতে রুমালটা নিয়ে নিলাম তারপর মুখ, ঘাড়, গলা মুছে গভীরভাবে কয়েকটা শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক করে ওনার দিকে রুমালটা এগিয়ে দিলাম। উনি রুমাল টা নিয়ে বললেন,

— ” ফাইন নাও?”

আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে। চুপচাপ সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলাম। আদ্রিয়ান ও কিছু আর জিজ্ঞেস করলেন না। সারারাস্তা আর চোখ খুলিনি আমি চোখ বন্ধ করেই রেখেছিলাম। গাড়ি থামতেই চোখ খুলে তাকালাম আমি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আদ্রিয়ান আমার সিটবেল্ট খুলে দিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন তারপর দরজাটা খুলে আমার হাত ধরে নিচে নামালেন। তারপর দুজনে একসাথেই ভেতরে ঢুকলাম। সবার সাথে কথা বলে রুমে চলে গেলাম। সেদিন সারারাত আমরা দুজন একে ওপরের সাথে কোনো কথা বলিনি। আসলে দুজনের মনটাই খুব খারাপ ছিলো। নূর আপুর এরকম অবস্থা দেখে, তারওপর ইশরাক ভাইয়ার সব স্মৃতি। সব মিলিয়ে আজ খুব বেশিই কষ্ট হচ্ছিলো। আদ্রিয়ান আজ আর আমার ওপর হাত রেখে ঘুমান নি অন্যদিকে ঘুরে শুয়েছিলেন। আমিও কিছু মনে করিনি। কারণ আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিলাম ওনার একটু স্পেস দরকার। তাই আমিও ওনাকে কোনোভাবে বিরক্ত করিনি।

_________________

আজ শুক্রবার। পার্টিতে যেতে হবে। শাড়ি পরে যেতে হবে। একটু আগে আদ্রিয়ান রেড একটা জরজেটের শাড়ি এনে দিয়েছে পড়তে। আপি আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়ে নিজেও শাড়ি পরেনিলো। আপির শাড়িটা নীল। দুজনেই খুভ হালকা সেজেছি। আমরা রেডি হয়ে বেড়িয়ে দেখি ইফাজ ভাইয়া আপির সাথে ম্যাচিং করে নীল সুট পরেছে, কিন্তু আমার খবিশ বরটা পরেছে কালো। হুহ। যদিও ঠিকই ঠিকই আছে লাল পরলে কেমন কার্টুন কার্টুন লাগতো। দুই ভাইকেই ভীষণ হ্যান্ডসাম লাগছে।যদিও এরা ওলওয়েজ হ্যান্ডসাম। কিন্তু নিজের বর বলে বলছিনা আমার বরটা কিন্তু এক্কেবারে বেস্ট। জাবিনও রেডি হয়ে চলে এসছে এর মধ্যে ও একটা বেবি পিংক লং গাউন পরেছে। এরপর পাঁচজনেই রওনা দিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম পার্টিতে। খুব জাকজমক পরিবেশ, চারপাশে লাইটিং করে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে। খুব ভালো লাগলো আমার। গাড়ি থেকে নেমে পাঁচজনেই ধীরপায়ে ভেতরে এগোতে শুরু করলাম। ভেতরে যেতেই ওনারা আমাদের সুন্দরভাবে ওয়েলকাম করে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমরাও চুপচাপ ওনাদের কথামতো চলে গেলাম ওনার সাথে। আঙ্কেল খুব ভালো একজন মানুষ সেটা কেনো জানিনা কয়েক সেকেন্ড দেখেই বুঝতে পারলাম আমি। ওনার ওয়াইফকেও দেখে ভালোই মনে হলো। আমরা চারজনেই একজায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। আদ্রিয়ান ফোন দেখছেন। আমি হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছি। আপি আর ইফাজ ভাইয়া কী বিষয়ে যেনো কথা বলছে। আর জাবিনও নিজের ভাইয়ের মতোই ফোনে ডুবে আছে।হঠাৎ করেই আদিব ভাইয়াকে দেখতে পেলাম। আদিব ভাইয়াও এখানে ইনভাইটেড। আদিব ভাইয়া আমাদের কাছে এসে বললেন,

— ” কী ব্যাপার হ্যাঁ? পুরো জোড়ায় জোড়ায় হাজির না কী?”

জাবিন ফোন থেকে চোখ তুলে ভ্রু কুচকে বলল,

— ” অদ্ভুত? তুমি আমার জোড়া কোথায় পেলে ভাইয়া?”

আপি হেসে বলল,

— ” এখন নেই তাতে কী হয়েছে? দেখবে কখনো একদিন হুট করে এন্ট্রি নেবে তোমার হিরো।”

জাবিন আবার ফোনে চোখ দিয়ে বলল,

— ” দিল্লি এখনো অনেক দূর।”

আদ্রিয়ান ফোন থেকে চোখ তুলে জাবিনের দিকে তাকিয়ে মেকি হেসে বলল,

— ” একদমি না। এখন প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে উড়ে চলে যাওয়া যায়। এইচ এস সি টা দে। ঘাড় ধরে বিদায় করবো বাড়ি থেকে।”

জাবিন মুখ ফুলিয়ে ইফাজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে অভিযোগের সুরে বলল,

— ” দেখনা দাভাই ভাইয়া কীসব ফালতু বকছে?”

ইফাজ ভাইয়া একটু রেগে যাওয়ার ভান করে আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” ঠিকই তো আদ্রিয়ান। এটা কেমন কথা হলো? এইচ এস সির পর বিদায় করবি মানে কী? তুই বুঝতে পারছিস না? ও এখনি যেতে চাইছে?”

বলেই শব্দ করে হেসে দিলো আদ্রিয়ানও হেসে দিল। হাসতে হাসতে দুই ভাই ই হাইফাইভ করল। জাবিন বিরক্ত হয়ে হাত ভাজ করে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি আর আপি মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছি। বেশ অনেকটা সময় আড্ডা দেওয়ার পর আদ্রিয়ান আর আদিব ভাইয়া কোথাও একটা গেলো। কেউ একজন ডাকতে আপি আর ইফাজ ভাইয়াও একসাথে গেলো একটু কথা বলতে। আমি আর জাবিন কথা বলতে বলতেই ওর এক ফ্রেন্ডের ফোন এলো। এখানে শোরগোল আছে তাই ও কথা বলতে একটু দূরে সরে গেলো। আমি বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানে। দূর ছাই! ভাল্লাগেনা। সবাই নিজের কাজে বিজি হয়ে গেলো আর আমি এখানে একা একা বোর হচ্ছি। এদিক ওদিক হাটছি কিন্তু মনে হচ্ছে কেউ আমার খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আড়াল থেকে নজর রাখছে আমার ওপর। গায়ে কেমন কাঁটা দিচ্ছে। কেনো হচ্ছে এমন? হঠাৎ আমার পেছন থেকে মাথায় কেউ টোকা মারতেই তাকিয়ে দেখলাম একজন মুচকি হেসে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে যখন এসছিলাম তখন দেখেছি। সম্ভব ওই আঙ্কেলের ছেলে। তখনও কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে আর এখনও? কী চায় কী উনি? উনি মুখে মুচকি হাসি রেখেই বললেন,

— ” হাই? একা একা বোর হচ্ছো বুঝি?”

কী লোকরে বাবা প্রথম দেখাতেই তুমি বলে দিলো? আমি মুখে সৌজন্যমূলক হাসি ফুটিয়ে বললাম,

— ” না আসলে ফ্যামিলি ম্যামবাররা একটু ব্যাস্ত তাই..”

— ” ওহ তুমি মানিক আঙ্কেলের বাড়ি থেকে এসছো নিশ্চয়ই?”

— ” জ্বী।”

— ” খুব সুন্দর লাগছে কিন্তু তোমাকে দেখতে।”

আমি এবার বেশ অস্বস্তিতে পরলাম। লোকটা কী শুরু করেছে কী। একটু ইতস্তত করে বললাম,

— ” ধন্যবাদ।”

উনি হাত বাড়িয়ে বললেন,

— ” বাই দা ওয়ে চলো ডান্স করা যাক?”

আমি একটু অস্বস্তিতে পরে গেলাম। এতো পেছনেই পরে গেছে। কোনোরকমে হাসার চেষ্টা করে বললাম,

— ” সরি আই কান্ট ডান্ট।”

উনি আমার হাত ধরে বললেন,

— ” আরে কোনো ব্যাপারনা আমি শিখিয়ে দেবো চলো?”

আমার এবার বেশ রাগ হলো। চেনা নেই জানা নেই হুট করে এসে এভাবে হাত ধরবে কেনো? এখন কোনো ভদ্রতা দেখাতে ইচ্ছে করছেনা তবুও এখানে গেস্ট হয়ে এসছি তাই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,

— ” হাত ছাড়ুন আমি ডান্স করবোনা।”

তখনই কেউ আমার হাত ধরলো তাকিয়ে দেখি আদ্রিয়ান। ওর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বেশ রেগে আছে। চোখ মুখে সেই তীব্র রাগটা স্পষ্ট। ওই ছেলেটাও একটু অবাক হয়ে দেখছে। আদ্রিয়ান একটানে হাতটা ওনার থেকে ছাড়িয়ে নিলেন যার ফলে হাতে বেশ ব্যাথা পেলাম। কিন্তু উনি আমার হাতটা ছাড়েননি শক্ত করে ধরে আছেন। আদ্রিয়ান ওই ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” তোমাকে আঙ্কেল ডাকছিলেন।”

ছেলেটা অবাক হয়ে একবার আমার দিকে একবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। ছেলেটা চলে যেতেই আদ্রিয়ান আমার হাত টান দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,

— ” কী কথা বলছিলে ওর সাথে?”

আমি বেশ ভয় পেয়ে গেছি ওনার চোখ মুখ দেখে। এতোটা রেগে কেনো গেলেন উনি? আমি কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম,

— ” ন্ না আসলে উনি নিজেই এসছিলেন কথা বলার জন্যে।”

আদ্রিয়ান হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

— ” ও তারজন্যে হাত ধরে কথা বলতে হবে তাইনা?”

— ” আমি ধ্ ধরিনি উনি নিজে..”

কথাটা শেষ করার আগেই উনি ধমকের সূরে বললেন,

— “ধরতে দিলে কেনো?”

আমি কেঁপে উঠলাম ওনার ধমকে। তখনি সবাইকে ডাকতে শুরু করলো কাপল ডান্সের জন্যে। আপি আর ইফাজ ভাইয়াও এসছে। আদ্রিয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বললেন,

— ” খুব শখ না ডান্স করার? চলো তোমার এই শখটা আমি নিজেই পূরণ করে দিচ্ছি।”

বলে আমায় কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টেনে নিয়ে গেলেন। সবাই সবাই জোড়ায় জোড়ায় নাচ করছে। মিউজিক শুরু হতেই একটানে নিজের কাছে নিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলেন উনি। আমি একটু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কোমর খুব শক্ত করেই ধরেছে যার ফলে ব্যাথাও পাচ্ছি। উনি নাচের মধ্যে যেখানে স্পর্শ করছেন খুব রাফভাবে করছেন খুব বেশি ব্যাথা না পেলেও মোটামুটি ব্যাথা লাগছে আমার। মনে হচ্ছে নাচের প্রতিটা স্টেপে আমার ওপর থেকে নিজের রাগ মেটাচ্ছেন উনি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেটা কমে এলো ওনার স্পর্শগুলো ধীরে ধীরে কোমল হতে শুরু করলো। আমি এক দৃষ্টিতে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। এখন কেনো জানিনা সম্মোহীত হয়ে পরছি। হঠাৎ করেই আমার চোখ গিয়ে পড়ল একটু দূরের গাছটার দিকে আর গাছটার পেছনে যা দেখলাম তাতে আমার পিলে চমকে উঠলো, ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওদিকে, ধীরে ধীরে হাত পা জমে যেতে শুরু করলো। হয়তো হঠাৎ আমার এভাবে শক্ত যাওয়া আদ্রিয়ান বুঝতে পারলেন। তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে বললেন,

— ” অনি? হোয়াট হ্যাপেন্ড? কী হয়েছে?”

আমার শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি আমি। আপি, ইফাজ ভাইয়া, জাবিন আদিব ভাইয়াও দৌড়ে এলেন। সবাই জিজ্ঞেস করছে আমার কী হয়েছে? কিন্তু আমি কোনো কথা বলতে পারছিনা শুধু জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই দূরের ঐ গাছটার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছুই দেখতে পেলেননা এখন আমিও দেখতে পাচ্ছিনা। ধীরে ধীরে সব ঝাপসা হয়ে এলো আমার কাছে। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি আদ্রিয়ান আমার গাল ধরে ঝাঁকিয়ে কিছু একটা বলছেন কিন্তু কী বলছেন সেটা শুনতে পাচ্ছিনা। একপর্যায়ে সবটাই অন্ধকার হয়ে গেলো আমার কাছে।

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here