ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ১৪

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৪
.
আদ্রিয়ান আমার কাধে হাত রাখতেই ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। নিজেকে সামলে চোখের জলটা মুছে নিলাম। উনি চোখের ইশারায় আমাকে স্বাভাবিক হতে বললেন। আমি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিলাম। উনি দরজায় হালকা নক করে বললেন,

— ” আসবো?”

নূর আপু হালকা চমকে উঠলেন। একধ্যানে কিছু একটা ভাবছিল তাই হয়তো। দরজায় তাকিয়ে আমাদের কে দেখে উনি নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের কোণ মুছে ফ্রেমটা টি-টেবিলের ওপর ছবির ফ্রেমটা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক ঠোঁটে একটু হাসি ঝুলিয়ে বললেন,

— ” আরে তোমরা? এসো ভেতরে এসো?”

আদ্রিয়ান এবার আমার হাতটা ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। নূর আপু এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন আমিও আলতো করে ওনার পিঠে হাত রাখলাম। বেশ অনেকটা সময় আমায় জড়িয়ে ধরে ছিলেন। তারপর আমাকে ছেড়ে মুচকি হেসে বললেন,

— ” কেমন আছো?”

আমি একটা মলিন হাসি দিয়ে মাথা নাড়ালাম। পাল্টা উনি কেমন আছেন প্রশ্নটা করার সাহস করে উঠতে পারলাম না। উনি আদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,

— ” তোমায় কবে থেকে বলছি ওকে নিয়ে আসতে কিন্তু তুমিতো শুনছিলেই না। অবশেষে আজ আনলে।”

— ” আনলাম তো।”

— ” হ্যাঁ ধন্য করেছ আমায়।”

আদ্রিয়ান একটু হেসে বলল,

— ” আঙ্কেল আন্টি কোথায়? দেখছিনা যে?”

— ” ওনারা তো একটু গ্রামের বাড়ি গেছেন। কাল চলে আসবেন। তোমরা বসো আমি সার্ভেন্ট কে বলে কিছু আনাচ্ছি”

আদ্রিয়ান বেডে বসে বলল,

— ” আমাদের নিয়ে ব্যস্ত হতে হবেনা। কিচ্ছু খাবোনা আমরা।”

— ” কী বলছো বলোতো? মেয়েটাকে নিয়ে এসছো কিছু না খাইয়ে ছেড়ে দেবো?”

আমি মুচকি হেসে নূর আপুকে ধরে বসিয়ে দিয়ে আমিও বসে বললাম,

— ” এমনভাবে ট্রিট করছো যেনো আমি মেহমান? নিজের লোকেদের সাথে এতো ফর্মালিটি করতে নেই। আমি তো তোমার ছোট বোন তাইনা?”

নূর আপু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

— ” দেখেছো আদ্রিয়ান কেমন মিষ্টি করে কথা বলতে পারে? ”

আদ্রিয়ান আমার দিকে একপলক তাকিয়ে একটু হাসলো কিন্তু কিছু বললনা। নূর আপু বললেন,

— ” জানো ইফাজ ভাইয়ার বিয়ের সময় যখন তোমাদের দুজনের ঝগড়া খুনশুটিগুলো দেখতাম। তখনই মনে হয়েছিল একদম মেইড ফর ইচ আদার। মনে মনে চাইছিলাম যে তোমাদের একটা জুটি হোক। আমার ইচ্ছেটা পূরণ হলো। জানো তোমাদের বিয়ের খবরটা শুনে কতো খুশি হয়েছিলাম আমি? আর এই আদ্রিয়ান তো আমায় ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। বিয়ের পরের দিন সকালে ফোন করেছিলাম আসলে আমার শরীরটা ভালো ছিলোটা আর মা হঠাৎ করেই ওর জন্যে কান্নাকাটি শুরু করেছিল। আমিও কেঁদে দিয়েছিলাম। মাকে সামলাতে না পেরেই ওকে ফোন করেছিলাম ডক্টর যেনো বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু উনি নিজেই আসতে চাইলো আমি যখন বললাম নতুন বউ রেখে এসোনা ও বলে কী না তোমাকে বউ বলে মানেনা? এটা কোনো কথা হলো বলো? তারপর নিজে এসে মা কে হসপিটালে নিয়ে গেছে। ঐ দিন হসপিটালেই ছিল মা স্যালাইন দিয়ে সুস্থ হয়েছে। সারাক্ষণ আদ্রিয়ান ওখানেই ছিলো।”

আমি একটু অবাক হয়েই তাকালাম আদ্রিয়ানের দিকে। উনি নিজের মতো ফোন দেখছেন। তারমানে সেইদিন এইজন্যই বাইরে ছিলেন উনি। আর কীসব ভাবছিলাম আর বলছিলাম। নূর আপু আবার বললেন,

— ” তবে এখন আমি হ্যাপি যে ও তোর সাথে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ‘তুই’ করে বললাম বলে রাগ করিস না কিন্তু আমি তোকে তুই করেই বলব। আর তুই আমাকে আপনি আপনি না করে আপু বলেই ডাকবি।”

আমি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আপুর দিকে। কত ভালো মেয়েটা। নিজের বুকের মধ্যে পাহাড় সমান দুঃখ চেপে রেখে কতো সহজেই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে কথা বলছে আমার সাথে। আচ্ছা? ভালো মানুষগুলোর সাথেই সবসময় এমন কেনো হয়? তাদের সাথেই কেনো এতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে? আমি নিজেকে সামলে নিয়ে একটু হেসে বললাম,

— ” হুমম। সেটা ঠিক আছে কিন্তু একটা শর্ত আছে।”

আপি একটু ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কী শর্ত?”

— ” আজ থেকে নিজের যত্ন নিতে হবে, ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে, সময়মতো ঘুমোতে হবে। কারণ তুমি একা নও। একজন লিটল চ্যাম্প ও আছে তোমার ভেতরে তার কথাও ভাবতে হবে তাইনা? ভুলে যেওনা ও কিন্তু ইশরাক ভাইয়ার অংশ। যে মানুষটা তোমাকে এতো ভালোবাসতো তার অংশকে তুমি কষ্ট দিতে পারোনা। এতেতো ইশরাক ভাইয়াও কষ্ট পাবে তাইনা?”

নূর আপু এবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়ে বলল,

— ” কেনো চলে গেলো এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে? কী দোষ ছিলো আমার? বলনা? জানিস ও সমসময় বলতো যে আমার প্রেগনেন্সির পুরোটা সময় আমার সব কাজ নিজের হাতে করবে আমাকে কিচ্ছু করতে দেবেনা। ও বলেছিলো ভবিষ্যতে বেবি যখন কিক করবে তখন ও নাকি আমার পেটে মাথা রেখে বাচ্চার উপস্থিতি অনুভব করবে। বেইবি হওয়ার পর বাচ্চার সব কাজ নিজে করবে। ও বলেছিল কখনও আমার হাত ছাড়বেনা কিন্তু ও ওর কথা রাখেনি চলে গেছে আমাকে ছেড়ে চিরকালের মতো চলে গেছে।”

আমাকে জড়িয়ে ধরেই শব্দ করে কাঁদছে। আমিও কেঁদে দিয়েছি। আমি আপুর পিঠে হাত রেখে করুণ চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালাম। আদ্রিয়ান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছলছলে চোখে ইশরাক ভাইয়ার ছবির দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম ইশরাক ভাইয়ার ছবিটার দিকে। এখনো ঐদিনটার কথা মনে পরছে কী পাগলামোটাই না করেছিলেন ভাইয়া সেদিন-

আমরা সবাই আপির বিয়েতে কীভাবে কী শপিং করবো তার প্লানিং করছি। তখন ইশরাক ভাইয়া এসে হাজির হলেন। এসে সোফায় বসে উৎসাহিত কন্ঠে বললেন,

— ” আচ্ছা আদ্রিয়ান বলতো বেবির জন্যে কী কেনা যায়?”

আমরা সবাই বেশ অবাক হয়ে তাকালাম। এখানে তো বিয়ের শপিং এর আলোচনা হচ্ছে উনি বেবি কোথায় পেলেন? আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

— ” কার বেবি? কীসের বেবি?”

ইশরাক ভাইয়া এমন একটা মুখভঙ্গি করলেন যেনো আকাশ থেকে টুপ করে নিচে পরেছেন সবে। অবাক হয়েই বলল,

— ” আরে এরমধ্যে ভুলে গেলি? আমি বাবা হতে চলেছি ইয়ার? কালকেই ট্রিট দিলাম আজকেই ভুলে গেলি?”

আমরা সবাই অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একসাথে শব্দ করে হেসে দিলাম। আদিব ভাইয়া হাসি থামিয়ে বললেন,

— ” আরে ভাই নূর সবেমাত্র একমাসের প্রেগনেন্ট তুই এখনই ওর জন্যে কি কিনবি ভাবছিস?”

ইশরাক ভাইয়া মুখ ফুলিয়ে বললেন,

— ” অবশ্যই। আমার বাচ্চা আমি ভাববোনা। ওকে একদম যত্ন করে বড় করব আমি। সবকিছু দেবো। ওর কোচি কোচি হাত ধরে হাটা শেখাবো মানে আমিতো ভাবতেই পারছিনা আমার বাচ্চা আমাকে আদো আদো কন্ঠে বাবা বলে ডাকবে।”

আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে ওনার কথা শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম ওনার সন্তান কতো লাকি হবে যে ওনার মতো একজন বাবা পাবে। আদ্রিয়ান একটু পিঞ্চ করে বলল,

— ” হ্যাঁ হ্যাঁ সেইতো দুনিয়াতে একমাত্র তোরই বেবি আসতে চলেছে, বাকি সবাই তো আকাশ থেকে চুপ করে পরেছে।”

ইশরাক ভাইয়াও হেসে বলল,

— ” এখন বুঝবিনা। যেদিন নিজে বাবা হবি সেদিন ঠিক বুঝবি।”

আদ্রিয়ান হেসে দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল ইশরাক ভাইয়াকে ভাইয়ার টাইট করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল ওনাকে।

সেই হাস্যজ্জ্বল মুখটার কথা মনে পড়লেই বুকের মধ্যে ভার হয়ে ওঠে। বড্ড কষ্ট হয় শ্বাস নিতে। কদিনের পরিচয়ে আমারই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে নূর আপু আর আদ্রিয়ান এর মানসিক পরিস্থিতিতো আমি কল্পনাও করতে পারছিনা। একজনের ভালোবাসা সন্তানের বাবা, আরেকজনের প্রাণের চেয়েও প্রিয় বন্ধু। ওনাদের দুজনের কষ্টের পরিমাপ করাটাও যে আমার কাছে অসম্ভব।

আমি নিজেকে সামলে নূর আপুকে ছাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বললাম,

— ” প্রমিস করো আমাকে?”

আপু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে একটা মলিন হাসি দিয়ে আমার হাতের ওপর হাত রেখে বলল,

— ” প্রমিস।”

হঠাৎ আদ্রিয়ান মুখ ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলল,

— ” বাহ। এতোদিন আমি বলছিলাম হচ্ছিল না। যেই ও বলল ঠিক মেনে নিলে তো? মানে আমার কোনো ভ্যালুই নেই? চমৎকার! শুধু আমিই সবাইকে নিজের ভাবি। আমাকে কেউ নিজের ভাবেই না।”

কথাগুলো একদম একটা বাচ্চা যেভাবে অভিযোগ করে ঠিক সেভাবেই বলছিলো। আমি আর নূর আপু একে ওপরের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলাম। নূর চোখ মুছে আপু বলল,

— ” আমার বোনের কথা আমি শুনেছি তোমার তাতে কী গো?”

আদ্রিয়ান মেকি হেসে বলল,

— ” হ্যাঁ সেই। আমার বাবা মায়ের কাছে ওই ওনাদের মেয়ে, আমার ভাই বোনের কাছেও ওই বোন, তোমার কাছেও ও বোন। গোটা রাজত্যই ওর, ওই রাণী আর আমিতো শুধু রাজ্যের বেতনহীন সেনাপতি মাত্র। পুরোটাই অপশনাল।”

নূর আপু আর আমি দুজনেই খিলখিলিয়ে হেসে দিলাম ওনার কথা শুনে। কিছুক্ষণ কথা বলে আপুকে স্বাভাবিক করে তারপর ওখান চলে এলাম আমরা।

উনি ড্রাইভ করছেন আর আমি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। দুজনেই নিরব। আজ ইশরাক ভাইয়ার স্মৃতিগুলো চারা দিয়ে উঠছে। হয়তো আদ্রিয়ানের মধ্যেও ঝড় চলছে। মানুষটা অদ্ভুত। মনের মধ্যে অনেক কষ্ট, চিন্তা, কথা চেপে রেখে স্বাভাবিক থাকতে জানেন। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন,

— ” থ্যাংকস।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,

— ” থ্যাংকস কেন?”

— ” নূরকে এভাবে সামলানোর জন্যে।”

আমি মুচকি হেসে বললাম,

— ” উনি আমরাও বোনের মতো ভালোবাসি ওনাকে ভীষণ। তাই যেটা করেছি নিজের মন থেকে নিজের জন্যেই করেছি। থ্যাংকস এর প্রয়োজন নেই।”

উনি একটু হাসলেন কিন্তু কিছু বললেন না। আমি নিজেই বললাম,

— ” আচ্ছা নূর আপুও কী আপনাদের সাথে ইউ কে তে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তো?”

— ” না। ও আমার ইন্টার কলেজ ফ্রেন্ড। সেকশন আলাদা ছিলো আমাদের। ও আর্চ এ ছিলো।”

— ” আপনারা ইউ কে তে কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন?”

— ” কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি।”

আমি সাথে সাথে চমকে উঠলাম। শরীর হালকা ঘামতে শুরু করলো আমার। আমি দুই হাত কচলে যাচ্ছি আর নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছি। উনি পকেট থেকে রুমাল বেড় করে আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। উনি তো আমার দিকে তাকানও নি তাহলে বুঝলেন কীকরে যে আমি ঘামছি? উনি আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন,

— ” ঘামটা মুছে ডিপ ব্রেথ নাও স্বাভাবিক লাগবে।”

#চলবে…

( রি-চেইক হয়নি। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here