ভালোবাসি তোকে ❤ #লেখিকা: অনিমা কোতয়াল #পর্ব- ১৩

#ভালোবাসি তোকে ❤
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
#পর্ব- ১৩
.
আদ্রিয়ানের চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে কফি বানিয়ে ওনার কাছে কফির মগটা নিয়ে গেলাম। এসে দেখি উনি নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে আছেন। আমি গলাটা হালকা ঝেড়ে বললাম,

— ” আপনার কফি।”

উনি আমার দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিয়ে কফি খেতে শুরু করলেন। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর উনি বললেন,

— ” এক্সামের রেসাল্ট দিয়েছে?”

আমি ইতস্তত করে বললাম,

— ” হুম দিয়েছে।”

— ” মেরিট পজিশন কতো? আর মার্কস কতো এসছে?”

আমি চুপ করে আছি আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ” কী হলো? বলো?”

আমি কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,

— ” মার্কস ফরটি সিক্স। আর পজিশন একশ বারো।”

উনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর অবাক কন্ঠে বললেন,

— ” একশ বারো? মানে কী? এতো কষ্ট করে দিন রাত এক করে পড়াচ্ছি তোমাকে এই পজিশনের জন্যে?”

আজব এতো হাজার স্টুডেন্ট এর মধ্যে একশ বারো তম হয়েছি এতে প্রবলেম টা কোথায় শুনি? বেশ ভালোই তো হয়েছে। সবকিছুতে বেশি বেশি। নিজে সবসময় টপ করতো বলে কী আমাকেও করতে হবে নাকি? উনি একটা শ্বাস ফেলে বললেন,

— ” পজিশন আরও এগোতে হবে অনি নয়তো ডিএমসি তে চান্স হবেনা। অন্যান্য কোচিং সেন্টারে আরও ভালো ভালো স্টুডেন্ট আছে। সো হার্ডওয়ার্ক করতে হবে।’

আমার এবার খুব বিরক্ত লাগছে। আরে ভাই আমার হাজবেন্ট তুই। পড়াস ঠিক আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে একটু রোমান্টিক ও তো হওয়া যায়। এতো চাপ দেওয়ার কী আছে। সবসময় এরকম করে। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে মুখ ফুলিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” আপনি এমন কেনো বলবেন? পুরোটা সময় শুধু বই খাতা নিয়ে বসিয়ে রাখেন। বউ আমি আপনার মাঝে মাঝে তো একটু রোমান্টিকও হতে পারেন। কী হয় একটু ..”

এটুকু বলেই থেমে গেলাম আমি। কারণ এতোক্ষণে হুস এলো যে কী বলছিলাম। এটাই আমার দোষ। যখন বলতে শুরু করি তখন ডানে বায়ে আশেপাশে তাকিয়ে কথা বলিনা, আর কী বলছি সেটা ভেবেও বলিনা। নিজের ওপরেই ভীষণ রাগ হচ্ছে এতো বোকা কেনো আমি? সংকোচ নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি ওনার এক ভীষণ বিখ্যাত স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। মানে দুই ভ্রু কোণাকুণি এঙ্গেলে কীভাবে জেনো বাঁকান উনি। বিখ্যাত বলছি এই কারণে কারণ এরকমভাবে ভ্রু বাঁকাতে আমি উনি ছাড়া একমাত্র সুশান্ত সিং রাজপুত কেই দেখেছিলাম। যদিও উনি এখন আর এই পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আদ্রিয়ানের ভ্রু বাঁকানোর স্টাইলটা একদমই ওনার মতো। উনি কিছুক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে থেকে ল্যাপটপটা বন্ধ করে সাইডে রেখে মুখে হালকা বাঁকা হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকালেন, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে একটু এগোলেই আমি পিছিয়ে গেলাম। উনি বাঁকা হাসি দিয়েই এগোচ্ছেন আমার দিকে। আমি পেছাতে পেছাতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

— ” আপনি এভাবে এগিয়ে আসছেন কেনো?”

— ” তুমি এভাবে পিছিয়ে যাচ্ছো কেনো? আফটার ওল তুমি আমার বউ আমিতো তোমার কাছে যেতেই পারি? অধিকার আছে।”

আমি কী বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওনার এরকম কথার উত্তরে ঠিক কী বলা যায় সেটা জানা নেই আমার। আমি শুধু একটু একটু করে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমি যেদিক দিয়ে পেছাচ্ছি সেদিকে দেয়ালটা কাছে থাকার ফলে খুব বেশি দেরী হলোনা দেয়ালের সাথে লেগে যেতে। আমি দেয়ালের সাথে আটকে যেতেই উনি আমার ডান পাশ দিয়ে দেয়ালের ওপরে হাত রেখে একটু ঝুকে বললেন,

— ” তখন কী যেনো বলছিলে? তুমি আমার বউ। আমি এতো আনরোমান্টিক কেনো? এতো এতো অভিযোগ করলে আর এখন যখন আমি তোমার কাছে এলাম তখন তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো? নট ফেয়ার!”

ওনার এতো কাছে আসাতে তো আমার অবস্থা ভীষন রকমের খারাপ হয়ে আছে। উনি ইচ্ছে করেই আমাকে টিজ করতেই যে এরকমটা করছেন সেটা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছি আমি। উনি আরেক হাতে আমার কপালের চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলেন আমি সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। উনি ওনার চার আঙ্গুল দিয়েই আমার গালে আলতো করেই স্লাইড করে থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরলেন। আমি আমার জামা শক্ত করে ধরে আছি, চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছি, ঠোঁটও যে মৃদু কাঁপছে সেটা ফিল করতে পারছি। এটাও ফিল করতে পারছি যে ওনার নিশ্বাস আমার মুখের ওপর পরছে।

— ” ওহহ শিট! সরি সরি আমি কিছু দেখিনি।”

কারও আওয়াজ পেয়ে চমকে চোখ খুলে তাকালাম আমি, উনিও সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি জাবিন উল্টো ঘুরে চোখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আর আদ্রিয়ান দূজনেই একে ওপরের দিকে তাকালাম। জাবিনের দিকে তাকিয়ে ওকে কিছু বলবো তার আগেই ও বলল,

— ” ভেরি সরি। আসলে দরজা পুরো খোলা ছিলোতো বুঝতে পারিনি। যাই হোক তোমরা কনটিনিউ করো আমি যাচ্ছি।”

এটা বলে জাবিন দৌড়ে যেতে নিলেই আদ্রিয়ান বলল,

— ” ওয়ে ড্রামাবাজ দাঁড়া। কী বলতে এসছিলি বল?”

জাবিন পুরো পজ হওয়ার স্টাইলে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর ওভাবে দাঁড়িয়েই বলল,

— ” আম্মু তোদের ডাকছে। স্নাকস হয়ে গেছে।”

বলে দৌড়ে চলে গেলো। আমি নাক ফুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে তাকালাম ওপার দিকে। শুধু শুধু শুধু খবিশ বলি ওনাকে? ইজ্জতের পুরো ফালুদা দিলো আমার। কিন্তু ওনার মধ্যে কোনো ভাবান্তর নেই জেনো যেটা হয়েছে সেটা তেমন কোনো ব্যাপারই না। হুহ। আমি ওনার দিকে একটা বিরক্তিমাখা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে এলাম ওখান থেকে। নিচে গিয়ে দেখি ইফাজ ভাইয়া, আপি, জাবিন তিনজনই মিটমিটিয়ে হাসছে। বেশ বুঝতে পারলাম জাবিনটা উপরে যা দেখেছে সব বলে দিয়েছে। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে সোফায় বসে পরলাম। জাবিব একটু গলা ঝেড়ে বলল,

— ” কী হলো ভাবী? ভাইয়া এতো তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলো?”

আমি চোখ রাঙিয়ে তাকালাম ওর দিকে। আমাকে ওভাবে তাকাতে দেখে জাবিন চোখ সরিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহাশয় নিচে চলে এলেন। উনি এসেই আমি যেই সিঙ্গেল সোফায় বসেছি সেই সোফারই হ্যান্ডেলের ওপর বসে পরলো। আমি ভ্রু কুচকে একবার ওনার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিলাম। বাবা এসে বসে আমাদের জয়েন করলেন। উনি ইফাজ ভাইয়া আর ওনার সাথে টুকিটাকি কথা বলছেন। একটু পর মামনীরাও স্নাকস নিয়ে চলে এলো। সবাই মিলে গল্প করছি। তখনই বাবা বলল,

— ” ইফাজ, আদ্রিয়ান।”

ওপারা দুজনেই বাবার দিকে তাকালেন। বাবা চায়ের কাপটা টি- টেবিলে রেখে বললেন,

— ” সামনের শুক্রবার একটা পার্টিতে আমার ইনভিটেশন ছিলো। কিন্তু আমাকে আর ভাইয়াকে একটু চট্টগ্রাম যেতে হচ্ছে দুদিনের জন্যে। ঐদিন আমরা থাকবোনা। তাই আমাদের হয়ে পার্টিটা তোমরা দুজন হিয়া আর অনিকে নিয়ে জয়েন করবে। জাবিন যেতে চাইলে যেতে পারে।”

ওনারা দুজনেই সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লেন। আমি শুধু আদ্রিয়ানকে দেখছি। লোকটা হঠাৎ এতো বদলে গেলো কীকরে? ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুতে ওনার এরকম পরিবর্তন অস্বাভাবিক ছিলো। হ্যাঁ এটা ঠিক যে প্রিয় বন্ধু ছিলেন ওনার কিন্তু চারটা মাস কেটে যাওয়ার পরেও সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখাটা যতোটা আস্বাভাবিক আর অদ্ভুত ছিল, তারচেয়েও বেশি অদ্ভুত হচ্ছে ওনার এই মুহূর্তে করা ব্যবহারগুলো। হঠাৎ এভাবে আগের মতো কীকরে হয়ে গেলো? না আর ভাববো না। ওনাকে নিয়ে ভাবতে বসলেই মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে আমার। উনি খুবই জটিল একজন মানুষ। ভীষণ জটিল।

___________________

আজ কোচিং নেই তাই রুমে বসেই বেডে হেলান দিয়ে বই দেখছিলাম। কোথা থেকে উনি এসে বললেন,

— ” অনি একটু তাড়াতাড়ি রেডি হও তো। বেড়োবো।”

আমি একটু অবাক হলাম। আমাকে নিয়ে এখন আবার কোথায় বেড়োবেন উনি? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

— ” এখন কোথায় যাবো?”

— ” গেলেই দেখতে পাবে। একটু তাড়াতাড়ি করো প্লিজ।”

আমি জানি এখন ওনাকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলবেন না তাই আর কোনো কথা বাড়ালামই না। চুপচাপ উঠে গিয়ে রেডি হয়ে নিলাম। দুজনেই বেড়িয়ে পরলাম। গাড়িতে গোটা রাস্তা ওনার সাথে আর কথা হয়নি। গাড়ি থামতেই ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম এটা ইশরাক ভাইয়াদের বাড়ি। আমি একটু অবাক হলাম উনি এখানে কেনো আনলেন আমাকে? উনি আমার সিটবেল্ট খুলে দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আমার হাত ধরেই ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতরে নিয়ে গিয়ে আমার হাত ধরেই সোজা একটা রুমের দরজার সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালেন। দরজার ভেতরে বসে থাকা মানুষটাকে দেখে আমার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো। নূর আপু খাটে হেলান দিয়ে বসে একটা ফ্রেম বুকে জরিয়ে বসে আছে। নিশ্চয়ই এটা ইশরাক ভাইয়ার ছবি। কী হাল করেছে নিজের? সুন্দর ভাসা চোখ দুটো বসে গেছে, মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, এইসময় নাকি মেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো হয় কিন্তু উনি শুকিয়ে গেছেন। এমন মনে হচ্ছে শুধু বাঁচতে হবে তাই বেঁচে আছে। এতো চঞ্চল একটা মেয়েকে এতোটা প্রাণহীন দেখে নিজের চোখের জলকে আটকাতে পারলাম না। আমি ধীর চোখে আদ্রিয়ানের দিকে তাকালাম উনি একদৃষ্টিতে নূর আপুকেই দেখছেন। আচ্ছা সবচেয়ে কাছের মানুষকে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কী এতোটাই গভীর হয়? নিজের স্বামী হারানোর যন্ত্রণা কী মানুষকে এভাবেই শেষ করে দেয়? এভাবে পাথরে পরিণত করে দেয়? ইশরাক ভাইয়ার মৃত্যুটা এক বিশাল বড় রহস্য। এখনও কেউ জানেনা ঠিক কেনো মরতে হলো ওনাকে। যদি কোনোদিন আমি আদ্রিয়ানকে এভাবে হারিয়ে ফেলি? যদি উনিও এইভাবেই আমাকে ছেড়ে চিরকালের মতো চলে যায়? তখন কী করবো আমি? এভাবেই জীবন্ত একটা লাশ হয়ে বেঁচে থাকবো চিরকাল?

#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here