#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১০
© জারিন তামান্না
‘তুই এতটা ছোট মনের কবে হইলি রে সাজি?একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে…তারে নিয়ে তোর এত আপত্তি কিসের? তুই নিজেই তো বাচ্চা কত পছন্দ করিস। স্কুলে কত কত বাচ্চা সামলাস.. আর এখন একটা বাচ্চা মেয়ের জন্য এভাবে…ছিঃ ছিঃ ছিঃ..
_মা তুমি ভুল বুঝতেছো। আমার ইয়ানাকে নিয়ে কোন সমস্যা নাই।সমস্যা ওই মানুষটাকে নিয়ে। সে আমাদের এভাবে ঠকালো আর তোমরা তার সাথেই তোমাদের মেয়ের বিয়ে দিতে একেবারে উঠেপড়ে লাগছো?
_ঠকাইছে মানে? কে কারে ঠকাইলো?মেয়ের দিকে বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন শাহনাজ বানু।
_কেন, যার সাথে মেয়ে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লাগছো সে তো দিব্যি লুকায় গেছে বাচ্চাটার কথা!
_বাচ্চাটার কথা সে ক্যান লুকাবে!সেই প্রথম দিনই তারা বাচ্চাটার কথা আমাদের বলছে। বাচ্চাটা কত্ত আদরের তাদের। প্রথম নাতনি। আদরের তো হবেই। আমার তো থেকেও নেই। -পলাশের মেয়ের কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল শাহনাজ বানুর।
তারপরেই আবার বললো, ‘হ্যাঁ,বাচ্চাটা জামাই বাবাজীর একটু বেশিই ন্যাওটা,তাই বলে তুই এমন করবি? এইটা কি তোর মত মেয়ের করা সাজে??’
মায়ের কথা শুনে পলক এবার অবাক না হয়ে পারলো না। হতভম্ব গলায় প্রশ্ন করলো,
_তোমরা সব আগে থেকেই জানতা,তারপরেও তোমরা এমন একটা মানুষের সাথে বিয়ে দিতে চাইতেছো? এতই বোঝা হয়ে গেছি আমি তোমাদের জন্য?
_আরেএএএ…তোর সমস্যা কি হ্যাঁ? কি যা তা বলতেছিস? এমন ভালো একটা ছেলে যেচে তোরে বিয়ে করতে চাইছে,পরিবারের সবাই রাজি। তাহলে আমরা তোরে বিয়ে দিবই বা না ক্যান!
_অন্যের স্বামীকে আমি ক্যান বিয়ে করবো?
_অন্যের স্বামীকে বিয়ে করবি ক্যান..তার কি ঘরে আরেকটা বউ আছে নাকি!বিয়ের পর তো সে তোর স্বামীই হবে। আর স্বামীর সব কিছু তো তোরই হবে।সেসব আপন করে নেওয়াই তো তোর দায়িত্ব কর্তব্য।
মায়ের এমন নির্দয়তা দেখে পলক আর কিছু বলার মত ভাষা হারিয়ে ফেললো। চুপ করে রইলো।
এতক্ষণ মায়ের সাথে তর্ক চলছিল পলকের।তখন সে রুমে না ঢুকে দরজা থেকেই ফিরে এসেছে। আসার আগে মিলিকে বলে এসেছিল যেন শাহনাজ বানুকে তার ঘরে পাঠিয়ে দেয়। মিলি তাকে কিছু বলবে বা আটকাবে তার আগেই হনহনিয়ে চলে এসেছে নিজের ঘরে। শাহনাজ বানু ঘরে এসে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই সে সটাং জানিয়ে দিল,এই বিয়ে সে করবে না। কারণ,সিফাতের কোলের বাচ্চাটা। ওই বাচ্চা সমেত সে এই সম্পর্কে জড়াবে না। ব্যাস…এই নিয়ে শুরু হয়ে গেল তর্কাতর্কি।
কিন্তু,পলকের এখন অসহ্য লাগছে সব। তারা জেনে বুঝে এক বাচ্চার বাবা হওয়া ছেলের সাথে তাকে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। আর আজ এত সব আয়োজন করার আগে তাকে কেউ কিছু জানালোই না,তার মতামত জিজ্ঞেস করা তো অনেক দূরের কথা। তাই সে দরজায় দাঁড়িয়ে নেওয়া তার বিয়া না করার সিদ্ধান্তেই সে অটল থাকবে বলে মনস্থির করলো।
হঠাৎই তাদের এই রুদ্ধদ্বার কথোপকথনের মাঝেই দরজায় টোকা পড়লো কারও। কেউ একজন অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে।কথা থামিয়ে দিল তারা।ওপাশ থেকে নাজিয়ার গলা পাওয়া গেল।
_সাজি….এই সাজি।দরজা খোল। ভিতরে কি মামীমা আছে? এই সাজি…
নাজিয়ার গলা শুনেই তটস্থ হয়ে গেল পলক। তড়িৎ গতিতে উঠে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই নাজিয়া দেখে পলক যেন ভরসা পেল। নাজু আপাকে বললে নিশ্চয় সে কোন উপায় করে দেবে। বিয়েটা তাকে করতে হবে না। নাজিয়া পলকের এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে তাকে কিছু বলবে তার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিল পলক। নাজিয়া হতভম্ব। আজকের দিনে এভাবে কাঁদছে কেন মেয়েটা? ঘরের ভিতরে চোখ পড়তেই দেখলো শাহনাজ বানু দাঁড়িয়ে আছেন। চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ। আর এখানে পলক এভাবে কাঁদছে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে শাহনাজ বানুর দিকে তাকাতেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। নাজিয়াকে দেখে উনিও যেন এবার ভরসা পেলেন। রাগ বিরক্তি চিন্তা সব কিছু মিলিয়ে তেঁতানো গলায় নাজিয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,
_দেখ না রে নাজু। কি শুরু করছে মেয়েটা। সে নাকি এই বিয়ে করবে না।বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হয়ে যাইতেছে আর উনি বলতেছেন বিয়ে করবেন না। তুই একটু বুঝা তো ওরে। নিজ হাতে নিজের পা’য়ে কুড়াল মারার পায়তারা করতেছে এই হতচ্ছাড়ি।
মামীমার কথা শুনে নাজিয়া আরেকদফায় অবাক হলো। এই তো সব ভালো ছিল। এত ভালো সম্বন্ধ। কিছুদিন আগে নিশাত ফোনে বললো, পলক নাকি নিজেও দেখা করে আসছে ছেলের সাথে। তাহলে তখন তো কিছু বললো না যে বিয়ে করবে না।তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে বিয়ের ডেট ফিক্স করতে আসার পর বিয়ে করবে না বলে মানা করতেছে সে।
এদিকে একনাগাড়ে কেঁদে যাচ্ছে পলক। নাজিয়ার কাঁধের অনেকটাই ভিজে গেছে। এটা বুঝতেই পলকে টেনে তুলে ছাঁড়িয়ে নিল সে। সোজা করে দাঁড় করিয়ে কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
_সমস্যা কি? বিয়ে কেন করবি না তুই?
পলক তখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কান্নারত অবস্থাতেই জবাব দিল,
_ওই বাচ্চাটা…কান্নার দমকে কথা আটকে আসছে তার।
_কোন বাচ্চাটা? ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো নাজিয়া।
_উনার কোলে..মেয়েটা! ওই জন্যই তো বিয়ে করতে চাইছে। নয় তো আমার মত মেয়েকে কেন জেনে শুনে উনার মত একজন যেচে বিয়ে করতে আসবে? আর এরাও দেখো…জেনে..জেনেবুঝে আমাকে উনার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছে।
নাজিয়া ঘটনার কিছুই বুঝলো না। ওদিকে ছেলে পক্ষ তাড়া দিচ্ছে। ছেলের বড় বোন,মামা মেয়েকে দেখবে বলে অপেক্ষা করছে।আগেরবার তারা আসতে পারেননি। অপেক্ষা করছে ওই ছোট্ট বাচ্চাটাও। আর এদিকে এসব…। আর কিছু ভাবতে পারলো না সে। কারণ তাদের কাউকে ও ঘরে না যেতে দেখে রিয়া দিয়া এসেছে খুঁজতে। মিলি, নিশাত আর বাকিরা মেহমানদারি করছে। হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো দু বোন। এখানেও কে আগে আসবে সেই নিয়েও প্রতিযোগিতা তাদের। তাই দিয়া ঘরে ঢুকতেই তার পেছনে হুড়মুড়িয়ে দিয়ার গায়ে এসে পড়লো রিয়া। দিয়া গিয়ে ধাক্কা খেলো দরজার কাছে দাঁড়ানো নাজিয়ার সাথে। ধাক্কা খেয়ে নাজিয়া পেছনে তাকাতেই দেখলো বিচ্ছু দুটো এসেছে। চোখ গরম করে তাকাতেই বিচ্ছু দুটো ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল। বকা শোনা থেকে বাঁচতে দুজনেই একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিল।প্রথমেই দিয়া বললো,
_নাজু আপা,,আমার কোন দোষ নাই।রিয়া ফাজিলটা ধাক্কা দিছে আমাকে আর আমি এসে তোমার সাথে ধাক্কা খাইছি। মানে একবার পেছন থেকে ধাক্কা খেয়ে আবার সামনে গিয়ে ধাক্কা খাইছি। আ..
_না, আপা। দোষ তো ওই শাঁকচুন্নিটারই। দেখো না কেমন দরজার মুখে দাঁড়ায় ছিল।আমি ঢুকতে গিয়ে ধাক্কা লেগে গেছে।
_এই তুই মিথ্যা বলিশ ক্যান…এমনে হুড়মুড়াইয়া কে ঢুকতে বলছিল তোরে?
_এইই…আমি কই..-ব্যাস রিয়া আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই নাজিয়া ধমকে উঠলো ওদের।
_এই, চুপ করবি তোরা? যখন দেখো দুইটাতে চুলাচুলি লাইগাই থাকে। আর ওইখানে মেহমান সব ছাইড়া এইখানে কি করতে আসছিস তোরা?
_আমরা তো তোমাদের খুঁজতে আসছিলাম। নিশু’বু পাঠায়ছে ডাকতে। তারা ওয়েট করতেছে। সাজি’বু কে নিয়ে যাইতে বলছে। দুজনেই একসাথে বললো।
_আচ্ছা,তোরা যা আমরা আসতেছি। নাজিয়া বললো।
_আচ্ছা। বলেই যেমন হুড়মুড়িয়ে এসেছিল ঠিক তেমনই হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল দু বোন।
ওরা বেড়িয়ে যেতেই নাজিয়া পলকের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। বললো,
_তোর যা কাহিনী সব পরে শুনবো। এখন যা,মুখ চোখে পানি দিয়ে আয়। কেঁদে কেটে তো সাজগোজ সব ঘেঁটে দিছিস এক্কেবারে।
_নাজু আপা,আমি এই বিয়ে করবো না। তুমি গিয়ে মানা করে দাও ওদের।
_এই চুপ। যা জলদি, যেটা বললাম কর। বাকি কি করা লাগবে না লাগবে আমরা দেখবো।
নাজিয়ার এমন ধমকে কেঁপে উঠলো পলক। কান্না এতক্ষণ থেমে গেছে তার। নাজিয়ার রাগ সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা আছে তার। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বে সে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
_________________________________
ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে পলক বেশ ভালো রকমে ঝটকা খেলো। তার ঘরের বিছানায় সিফাত বসে আছে। ঘরের দরজাটাও বন্ধ।
আসলে নাজিয়া গিয়ে যখন বললো যে পলকের স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হয়েছিল।তাই রেডি হতেও সময় লাগছে। সিফাত ঠিকই বুঝেছিল পলক এখনো ভুলভাল ভেবেই বসে আছে। তাই এখানে আসতে চাইছে না হয় তো। তারপর নাজিয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই নাজিয়া প্রথমে বলতে ইতস্তত করছিল। পরে যখন সিফাত ভরসা দিল,যে তাকে বলা যায়..নাজিয়াও বলে দিল পলকের বিয়ে করতে না চাওয়ার কথা।তারপর নিশাতের সাহায্য নিয়ে সে পলকের ঘর পর্যন্ত এসেছে।তার সাথে কথা বলবে বলে। নিশাতকে বলেছিল ঘরে আসতে কিন্তু সে বলেছে যে ঘরে যাবে না। দরজার বাইরেই থাকবে। দরজাটাও চাপানো ছিল। কিন্তু খুব বেশি খেয়াল না করায় পলক ভেবেছে যে সিফাত দরজা লাগিয়ে বসে আছে।
বিছানায় বসে ফোনে চোখ রেখে কি যেন ঘাঁটাঘাঁটি করছে সিফাত। বেশ দ্রুত গতিতে তার আঙুল চলছে ফোনের স্ক্রিনে। বিস্মিত পলক অপলক নয়নে দেখছে তাকে। একদম ফর্মাল ড্রেসআপে একজন সুদর্শন ব্যক্তি বসে আছে তার সামনে। আপন মনে কিছু একটা করছে। ক্ষণেক্ষণে তার মুখের ভাব বদলাচ্ছে। বেশ লাগছে.. তাকে দেখতে। এভাবে সিফাতকে দেখতে দেখতেই আপনমনেই মৃদু হাসলো পলক।
এদিকে ঘরে আরও একজনের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_তুমি নাকি বলছো বিয়ে করবানা আমাকে? ভীষণ রকম শান্ত গলায় কথাটা বলেই পলকের দিকে তাকালো সে। তার দৃষ্টিও ভীষণ শান্ত। কিন্তু সেই শান্ত দৃষ্টির আড়ালে ছিল এক চাপা রাগ। যেটা খুব সুনিপুণভাবে সে আড়াল করে রেখেছে।
সিফাতের কথায় ঘোর কাটলো পলকের। ধাতস্থ হতেই ফিরে গেল আগের ফর্মে। সিফাতের প্রতি হওয়া রাগ ক্ষোভ এসে আবার ভর করলো তাকে। সিফাতের প্রশ্নের উত্তর তো সে দিলোই না বরং উল্টা তাকেই প্রশ্ন করলো।
_আপনি এখানে কি করতেছেন? তাও ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে আছেন।মানুষজন কি ভাব্বে?
_মানুষজনের ভাবনার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। বিয়ে করবানা বলছো তুমি?
_হ্যাঁ। ঝাঁঝালো গলায় জবাব দিবে ভেবেও শান্ত গলায় উত্তর দিল পলক। এই মানুষটার সাথে কেন যেন সে জোর আওয়াজে কথা বলতে পারে না। আজব! নিজের মনে নিজেই ভাবলো পলক।
_কেন?
_কারণ, আপনি আমার সাথে প্রতারণা করেছেন। আপনার একটা বাচ্চা আছে। আর বিয়েটাও তার জন্যই করতেছেন। এ কথা আমাকে আগে জানাননি। আর আমি কোন প্রতারককে বিয়ে করবো না।
_এটাই তোমার ফাইনাল ডিসিশন?
_জ্বী।
_বেশ। এখন যাও, সাজগোজ ঠিক করো। বাইরে অপেক্ষা করছে সবাই। বলেই, উঠে দাঁড়ালো সে। প্যান্টের পকেটে ফোন ঢুকিয়ে একনজর দেখলো পলককে। তার মৃন্ময়ী আজ সাদা গোল্ডেন মিশেল জামদানী শাড়ি পড়েছে। হাত ভর্তি গোল্ডেন চুরি। টুকটাক গয়নাগাটি আছে গায়ে। আর মাথায় বেণী করে বেলি ফুলের গাজরাও লাগানো হয়েছে। কিন্তু কান্নার কারণে চোখমুখ কেমন এলোমেলো হয়ে আছে। চাপা সৌন্দর্যের অধিকারিণী কিন্তু কিছুটা পাগলী টাইপ এই নারীটা তার হবে। ভাবতেই একটা প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল তাকে। মৃদু হাসলো। কিন্তু সেটা পলকের নজরে পড়লো না। তারপর, ওকে পাশ কাটিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। পলক ওভাবেই থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মুখ দিয়ে আপনা আপনি বেরিয়ে এলো, কি হইলো এটা??!
সিফাত বেরিয়ে যাওয়ার একটু পরেই নিশাত ঘরে এলো। পলককে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কাঠকাঠ গলায় বললো,
_ওভাবে দাঁড়ায় আছিস ক্যান! এদিকে আয়। সাজ ঠিক করে দেই। আর কতক্ষণ অহেতুক বসায় রাখবি সবগুলারে!
নিশাতের কথা শুনে পলকের মন খারাপটা আরও বেড়ে গেল। সবাই একপ্রকার মানসিক অত্যাচার করছে তাকে। সবার কথা বাদ দিলেও নিশাতের এমন আচরণ সে কিছুতেই নিতে পারছেনা। কান্না পাচ্ছে তার আবারও। পলকের কোন হেলদোল না দেখে এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো নিশাত। চেঁচিয়ে বললো,
_তুই কি আসবি নাকি আমি গিয়ে নাজু আপারে পাঠাবো?
নাজিয়া কথা শুনে একটা চাপা শ্বাস ফেললো পলক। কারণ, সে আসা মানেই আরেক চোট বকার মুখের পড়া।যেটার লোড নেওয়ার মত মানসিক শক্তি এখন তার নেই।তাই নিশুর কথা মেনে নেওয়াই ভালো এখন। নিশাতকে একনজর দেখলো পলক।মুখটা কেমন ভার ভার হয়ে আছে।কিন্তু কি কারণে,সেটা জানে না সে। আপাদত বাইরে যাওয়া দরকার। তাই সে নিশাতের কথা মত সাজ ঠিক করতে বসে গেল।
_________________________________
পলক ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই আড়চোখে একবার সিফাতকে দেখলো।সেও পলকের দিকেই তাকিয়ে ছিল। ইশারায় পলককে দেখিয়ে ইয়ানাকে কিছু বলছিল। আর ওমনি সিফাতের কোল থেকে নেমে দৌঁড়ে এসে পলকের কোমড় জাপটে ধরলো। আচমকা ঘটা এ ঘটনায় পলক অবাক হলেও ঘরে উপস্থিত বাকি সবাই মুচকি মুচকি হাসছে। যেন বেশ আনন্দঘন মূহুর্ত চলছে কোন। কিন্তু ঘরে উপস্থিত একজন কিছুতেই এই মূহুর্তটায় আনন্দিত হতে পারলো না।
পলককে জাপটে ধরেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে তার উচ্ছ্বসিত কন্ঠে ইয়ানা বললো,
_তুমিই তাহলে আমার মামণি। খুউউউব মিষ্টি দেখতে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে তোমাকে। -বলেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে।
পলকের নিজেরও খুব ভালো লেগেছে বাচ্চাটাকে। কিন্তু সিফাতের ওপর রাগও আছে। কিন্তু একজনের রাগ অন্যজনের উপর দেখানোর মেয়ে পলক নয়। তাই সে মিষ্টি হেসে কোলে তুলে নিল ইয়ানাকে। তার গালে চুমু দিয়ে বললো,
_মাশাল্লাহ, আমারও এই মিষ্টি পুতুলটাকে খুব পছন্দ হয়েছে।
ইয়ানা ভীষণ খুশি।তার মামণি তাকে আদর করছে এভাবে। এটা দেখে ঘরে উপস্থিত সবাইও বেশ খুশি। সেই মূহুর্তে সিফাতের মা মিসেস. রেহনুমা আলম উঠে এসে পলকে জড়িয়ে ধরে কপালে আলতো করে চুমু দিলেন। বললেন,
_মাশাল্লাহ। খুব মিষ্টি লাগছে আমার বৌমাকে। তারপর বিছানায় বসা মানুষগুলোকে উদ্দেশ্যে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি গো পছন্দ হলো তোমাদের আমার বৌমাকে?’ ওখানে বসা ভদ্র মহিলা উঠে এসে পলকের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
_হ্যাঁ, আপা। পছন্দ হওয়ার মতই মেয়ে। সিফাতের সাথে মানাবে বেশ। ভদ্রমহিলার সাথে বসা মেয়েটিও উঠে এলো। পলককে দেখে খুব মিষ্টি করে হাসলো। রেহনুমা এক এক করে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন পলককে।
প্রথমেই ভদ্রমহিলাটিকে দেখিয়ে বললেন,এই যে এটা তোমার খালা শাশুড়ি,রেহানা। রিহানের মা। বিছানায় বসা ভদ্রলোকদের একজনকে দেখিয়ে বললেন এটা রিহানের বাবা। তোমার খালুশশুড়। আর এটা তোমার মামা শশুড়। আমাদের একমাত্র ভাই। আমাদের দুজনেরই বড় উনি। আর এটা (মেয়েটিকে দেখিয়ে) রুকাইয়া। আমার বড় মেয়ে। পেশায় গাইনোলজিস্ট। ওর বর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। দেশে নাই এখন। তাই আসতে পারেনি আজ।আর তোমার শশুড়ও গতকাল সিলেট গেছে বিজনেসের একটা কাজে। তাই আজ সেও আসতে পারলো না।
সিফাত আর সারা ওকে রুকু আপা বলেই ডাকে। আর তুমিও তাই বলবা।পাশ থেকে বলে উঠলো রুকাইয়া। পলক মৃদু হেসে সায় জানালো। আর সবশেষে সোফায় বসা সারার পাশের ভদ্রলোকটিকে দেখিয়ে বললেন,এই হলো আমাদের ছোট জামাই। সারার বর আবিদ। এরপর আবার পলক সবাইকে সালাম জানালো।
তারপর মিসেস. রেহনুমা একটা বক্স থেকে একজোড়া বালার একটা বালা তুলে পলকের হাতে পড়িয়ে দিয়ে অন্যটা ইয়ানাকে দিয়ে বললেন,
_নানুসোনা,এইটা তুমি তোমার মামণিকে পড়িয়ে দাও।
নানুর কথা মত স্বাচ্ছন্দ্যে বালাটা হাতে নিল। তারপর কোল থেকে নেমে পলকের হাত ধরে টেনে সিফাতের সাথে সোফায় বসিয়ে দিল। ছোট ছোট হাতে পড়িয়ে দিল বালাটাও। বালা পড়িয়ে দিয়েই হাতে একটা চুমু দিল সে। ইয়ানার নিষ্পাপ মুখ,আদর দেখে মন নরম হয়ে গেল পলকের। কিন্তু সত্যিই বিয়েটা করবে কি করবে না এই নিয়েও তার দ্বিধা গেল না।
_________________________________
সিফাতের কথা অনুসারে ঠিক ১ মাস পরে অর্থ্যাৎ পরের মাসের ২১ তারিখ বিয়ের দিন ঠিক হলো। সিফাতের বড় বোন রুকাইয়া এসে একটা আংটি সিফাতের হাতে দিয়ে বললো পড়িয়ে দিতে।কিন্তু সিফাত এতে আপত্তি জানালো। পলকের দিকে একবার দেখলো,পলক চোখ নামিয়ে নিয়েছে। তাকাচ্ছেনা সিফাতের দিকে। একটা চাপা শ্বাস ফেলে সে রুকাইয়াকে বললো,
_রুকু আপা,আজ তুই পড়িয়ে দে। তোরও তো হবু ভাই বউ।’ বলেই ম্লান হেসে ব্যাপারটা এড়িয়ে যেতে চাইলো।
রুকু একবার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুঁজলো। হয় তো ভাইকে বোঝার চেষ্টা।তারপর, ভাইয়ের কথামত পলকে আংটি পড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের কথা পাকা করলো । পলকের মাও একটা সোনার চেইন এনে সিফাতকে পড়িয়ে দিল। বর কনে কে মিষ্টিমুখ করিয়ে পানচিনির অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হলো।
________________________________
দুপুরের খাওয়ার পরে সবাই একসাথে বসে বিয়ের আয়োজন নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা বলছিল। পলক নিজের ঘরে ছিল। ঘরে পলকের সাথে মিলি,নাজিয়া আর নিশাতও ছিল। সে সময় রুকু এলো ঘরে। বললো,পলকের সাথে কথা ছিল কিছু। একটু একা ছাড়া যাবে কিনা তাদের। নাজিয়া কিছু একটা আন্দাজ করে মিলি আর নিশাতকে ইশারা করলো। তারাও বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তারপর, রুকু গিয়ে দরজাটা চাপিয়ে দিল। এটা দেখে পলকের মনে নানা রকম চিন্তা এসে উঁকি দিতে শুরু করলো। কি বলবেন উনি?
রুকু মিষ্টি হেসে পলকের পাশে এসে বসলো। প্রথমেই জিজ্ঞেস করলো,
_কেমন আছো পলক?
_জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন আপু?
_আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
পলক খেয়াল করলো মানুষটার মুখে সবসময় একটা মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে। খুব নরম সুরে কথা বলেন উনি।বিষয়টা পলকের ভালো লাগলো খুব।
_পলক…-নরম সুরে ডাকলো রুকু।
_জ্বী?
_ভাইয়ের সাথে কি কোন সমস্যা চলছে তোমার?
পলক কি বলবে এবার! সত্যি বলে দেবে?নাকি কিছু একটা বলে কাটিয়ে দিবে ব্যাপারটা? কিন্তু মিথ্যা বলতেও বাঁধছে পলকের। তাই চুপ করে রইলো। পলকের চুপ করে থাকা দেখে রুকু বুঝে নিল যে তার ধারণাই ঠিক। কোন একটা সমস্যা হয়েছে দুজনের মাঝে। তাই, পলকে বুঝিয়ে বলার কথা ভাবলো
_পলক শোনো…-রুকু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই ইয়ানা ছুটে এলো ঘরের দরজা খুলে। ঘরে এসেই পলককে বললো,
_মামণি,তুমি এখানে? জানো আমি তোমাকে সারা বাসায় খুঁজছি! তুমি এখানে কেন লুকিয়ে আছো?
_পলক আর রুকু দুজনেই হেসে দিল ইয়ানার কথায়।পলক ইয়ানাকে কাছে টেনে নিয়ে কোলে বসিয়ে বললো,
_আমি তো লুকিয়ে নেই সোনা। এটা আমার ঘর। তাই এখানেই ছিলাম আমি। বলেই টুক করে একটা চুমু খেয়ে নিল ইয়ানার নরম তুলতুলে গালে। পলকের কথা শুনে ইয়ানা পুরো ঘরে একবার চোখ বুলালো। তারপর, রুকুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_আম্মু, দেখো মামণির ঘরটা কি সুন্দর না? পাপার ঘরের মতন বড় না কিন্তু সুন্দর। তাই না?
_হ্যাঁ,আম্মা। তোমার মামণির ঘরটাও খুব সুন্দর। আর তোমার মামণিটাও খুব মিষ্টি।
_আচ্ছা,আম্মু বাবাই কবে আসবে? কত্তদিন বাবাইকে দেখি না। পাপার বিয়েতেও কি আসবে না? মন খারাপ করে বললো ইয়ানা।
_আসবে আম্মা। পাপার বিয়ের আগেই চলে আসবে। এ কথা শুনে ইয়ানার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
_আচ্ছা, আম্মা শোন..এখন তুমি যাও এখান থেকে। আমি তোমার মামণির সাথে একটু কথা বললো।
ইয়ানা তার দুই ঝুটি করা মাথাটা দুলিয়ে হ্যাঁ বললো।তারপর, পলকের গালে একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে বললো, আমি যাই মামণি। কিন্তু কথা শেষ করে তুমি আসবে তো আমার কাছে?
_হ্যাঁ,সোনা। আমি আসবো। বলেই ইয়ানার গাল ছুঁয়ে আদর করে দিল । তারপর, ইয়ানা আগের মতোই দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে চলে গেল ঘর থেকে।
ইয়ানার মুখে রুকুর জন্য আম্মু ডাক শুনেই পলক শকড হয়েছিল। আর তারপর কাউকে বাবাই বলায় নতুন কিছু প্রশ্ন এসে কড়া নাড়লো পলকের মাথায়।সিফাত বললো ইয়ানা তার বড় সন্তান। সেই হিসেবে তাকে সে পাপা বলে ডাকে। কিন্তু রুকুকে সে আম্মু বলছে।আবার কাউকে বাবাই বলছে। তাহলে বাবাইটা কে?এতসব কিছুর চাপ পলক নিতে না পেরে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো।
_আপু ওর বাবাই…?
_হ্যাঁ,,আসলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হলে যা হয় আর কি! মাসের পর মাস সমুদ্রে ভেসে বেড়ায়। ছুটিতে আসে। মেয়েটা খুব কম সময় পেয়েছে তার বাবাকে। কিন্তু ভাই খুব করে চেষ্টা করে সেই কমতিটা পূরণ করার। ইয়ানা তো পাপা বলতে পাগল। সে বলে তার বাবাই আর পাপা নাকি ওর বিশাল বিশাল দুইটা সম্পদ। তুমিই বলো,কি বুঝে এই পিচ্চি সম্পদের! বলেই হাসতে লাগলো রুকু।তার কথা শুনে পলকও হেসে দিল।
আর ভাই সবাইকে ইয়ানার পরিচয় কি বলে জানো?
পলক জানে না,তবে আন্দাজ করে নিল। তবুও জিজ্ঞেস করলো।
_কি বলে?
রুকু প্রশান্তির এক হাসি হেসে বললো,’তার বড় সন্তান!’
চলবে…