ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৯

0
1003

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৯
©জারিন তামান্না

পলক বাকরুদ্ধ।সারাঘরে পিনপতন নিরবতা বিরাজমান। পলকের নিশ্বাসের শব্দটাও বড্ড বেশি মনে হচ্ছে এখন তার নিজের কাছেই।মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় দুটো কথাই দৌঁড়ে বেড়াচ্ছে তার।-“ইয়ানা আমার বড় সন্তান।আর ভবিষ্যতে আপনারও মেয়ে।”অতঃপর নিজের মনেই একটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধে জড়িয়ে গেল সে। একের পর এক প্রশ্ন এসে ভীড় করছে মন-মস্তিষ্কে। নিজের মনে নিজেই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।কিন্তু আদতে সেই প্রশ্ন কার জন্য আর উত্তরই বা কে দিবে কোন কিছুই বোধ নেই এই মূহুর্তে পলকের। সে শুধু ভাবছে,
_তবে কি এই জন্যই এত কিছু? এই কারণেই তার মত মেয়েকে পছন্দ করেছে তারা? মানুষটা তাকে এভাবে ঠকালো? আর বাবা মা? নিশাত! তারা জানে? ও তো আমার আগে থেকেও জানে উনাকে। ওকে বলেছেন উনি?নাকি লুকিয়ে গেছেন! নাহ..আর যাই হোক নিশাত জেনে শুনে এটা করবে না। কিন্তু উনার আগে থেকেই একটা মেয়ে আছে এটা উনি এ বাড়ির কাউকে কেন বলেননি?কেন লুকিয়ে গেছেন!!

পলক আপন মনেই নিজের মত এতকিছু ভেবে চলেছে।আর ওদিকে সিফাত নিজের মত কথা বলেই যাচ্ছে।কিন্তু পলকের কোন সাড়া নেই।হঠাৎ সিফাতের খেয়াল হলো সে বলে যাচ্ছে অথচ পলক চুপ। ফোনটা চেক করলো আবারও,কল কানেক্টেড। কিন্তু পলকের সাড়া নেই। সিফাত দুবার” হ্যালো..হ্যালো ” বললো কিন্তু পলকের সে সবের ধ্যান নেই। সিফাত ফোনটা কেটে দিল।কিন্তু সাথে সাথেই আবার কল করলো। ফোনের রিংটোনে পলকের ঘোর কেটে গেল। দেখলো সিফাত কল করেছে। তখনই ওর খেয়াল হলো ও তো সিফাতের সাথেই কথা বলছিল।তাহলে কল কখন কেটে গেল?সিফাতের কথা মনে হতেই মনে পড়ে গেল ইয়ানার কথাটাও। মূহুর্তেই নিদারুণ এক কষ্ট এসে চেপে ধরলো পলককে। ভারী হয়ে এলো নিশ্বাসের চলন। কিছুক্ষণ ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো।রিং হচ্ছে। স্ক্রিনে দেখাচ্ছে “captain calling”. কিন্তু পলক কল রিসিভ করছে না।রিং হতে হতেই কলটা কেটে গেল এবার।
________________________

এদিকে,
সিফাতের টেনশন হচ্ছে এখন। হঠাৎ কি-ই বা হলো যে কথা বলতে বলতে পলক চুপ হয়ে গেল?এখন কল করছে সেটাও রিসিভ করছে না। ঠিক আছে তো সে?বাড়িতে কিছু হয়েছে কি? এসব ভাবতে ভাবতেই আবারও কল করলো পলকের নাম্বারে। আর এবার একবার রিং হতেই পলক কলটা রিসিভ করলো।কানের কাছে ফোন ঠেকাতেই সিফাতের উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেল।
_হ্যালো..মৃন্ময়ী! আপনি শুনতে পাচ্ছেন?
পলক চুপ।
_মৃন্ময়ী!! Are you ok..? hey?! speak out..plzz..
_করুণা করছেন আমাকে? নাকি আমার অতীতের সুযোগ নিতে চাইছেন আপনি?

সিফাতের উত্তেজিত,চিন্তিত কন্ঠস্বরের বিপরীতে পলকের অসম্ভব রকমের শান্ত গলায় করা প্রশ্নটা মূহুর্তের জন্য সিফাতকে থমকে দিল। পলকের প্রশ্নগুলোর অর্থ তো সে বুঝলই না বরং পলকের এমন শান্ত কণ্ঠস্বর তাকে আরও বেশি বিচলিত করে তুললো । তারপরেও নিজেকে ধাতস্ত করে প্রশ্ন করলো পলককে,
_মানে? কি বলছেন এটা আপনি?
_মানেটা তো খুবই সহজ। আপনার সন্তানের জন্যই তো বিয়ে করছেন আমাকে।তার মা চাই হয় তো। কিংবা দলিলকৃত কোন ন্যানি।ওই জন্যই তো বিয়েটা করছেন আমায় তাই না? আমার মত মেয়েকে তো এছাড়া বিয়ে করা কোন কারণ দেখছি না আর।আচ্ছা,আমার বাড়ির লোক জানে যে আপনি আপনার মেয়ের জন্য একজন মা চাই বলেই বিয়ে করছেন? আমার অতীতের কারণে কেউ আমায় বিয়ে করছে বলে এই বিয়েটা করে উদ্ধার করতে চাইছেন আমাকে, তাই না?আর বিনিময়ে আপনারও সার্থসিদ্ধি হয়ে যাবে।এটাই তো আপনার উদ্দেশ্য তাই না?? কি হলো বলুন!এটাই তো চান আপনি,তাই জন্যই বিয়ে করতে চাইছেন আমার মত একটা মেয়েকে!! ‘

কল রিসিভ করার পর ঠিক যতটা শান্ত গলায় প্রশ্ন করেছিল পলক তার চেয়েও বেশি গমগমে গলায় কথাগুলো বললো সে। আচমকা কোথায় থেকে কিসের এত রাগ কিসের এত ক্ষোভ এসে ভর করলো তাকে কে জানে! কিন্তু পলক যে অসম্ভব এক ঘোরের মাঝে আছে,কি ভেবে কি বলছে সে নিজেও জানে না হয় তো।

একদিকে সিফাত হতভম্ব! পুরো দমে হতভম্ব।আচমকা এমন অহেতুক ক্ষোভের মুখে পড়ার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। তার মাথায় কিচ্ছু আসছে না। পলক কি বলছে এসব? কেনই বা বলছে।সত্যি না জেনে..কিছু না বুঝে এ কি ধারণা করে নিল সে?

_কি হলো বলছেন না কেন? এখন কেন চুপ করে আছেন আপনি? বলুন না…করুণা করছেন…সুযোগ নিচ্ছেন আমার, তাই না?

পলকের কথায় ঘোর কাটলো সিফাতের। পলকের কন্ঠটাও এবার কেমন ধরে ধরে আসছে।কাঁদছে কি মেয়েটা?এটা ভাবতেই ভেতর থেকে কি যেন খাঁমচে ধরো সিফাতকে। ভেতরে যন্ত্রণা মতন হচ্ছে কিছু একটায়। অস্থির গলায় পলকের উদ্দেশ্যে বললো সে,
_মৃন্ময়ী …শান্ত হোন প্লিজ। কি সব বলছেন আপনি? এমন কিছুই না। আমরা পরে কথা বলি বরং।এখন কিছু শোনার বা বোঝার মত অবস্থা নেই আপনার। I promise.. I will explain you everything. But now please, calm down.

এতক্ষণ পলক ভেতর ভেতর ফুপাচ্ছিল।অতিরিক্ত উত্তেজিত হলে সে এমন করে। কিন্তু এখন সিফাতের কথা শুনে সেটা বাহ্যিক রূপে প্রকাশ পেয়ে গেল। কান্না উপচে পড়লো দু চোখ বেয়ে। সে কাঁদছে। নীরবে কাঁদলেও শ্বাস ঠিকই ঘন হয়ে আসছে তার। ফোনের ওপাশে সিফাত সেটা বেশ বুঝতে পারছে। অস্থির লাগছে তারও। আচমকা এমন কিছু ঘটবে তার ধারণার বাইরে ছিল সেটা। কিন্তু পলক যে থামছেই না। তার সহ্যও হচ্ছে না এমন।কি করবে মাথায় আসছে না তার। তাই না পারতে এবার ধমকে উঠলো সে,
_এই…চুপ করবা তুমি? কান্না করতে মানা করলাম না? কথা কানে যায় না…?চুপ করো। কাঁদবানা এভাবে। শান্ত হও আগে।

সিফাতের ধমকে কান্না আরও বেড়ে গেল পলকের। এবার কিছুটা জোরেই কেঁদে দিল সে। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে কাঁদছে। যথা সম্ভব চেষ্টা করছে সে যেন আওয়াজ না হয় কান্নার। সিফাতের আর সহ্য হলো না সেটা। কি শুরু করেছে কি মেয়েটা? কি এমন বললাম আমি যে এভাবে কাঁদতে হবে?!ধ্যাততত…’মনে মনে বললো কথাগুলো।কিন্তু মুখে বললো,
_চুপ করবা না তো তুমি?আচ্ছা,ঠিক আছে। কাঁদো।যত ইচ্ছা কাঁদো।একবার শুধু কাছে পাই তোমায়।তখন বিচার করবো তোমার।পরে কথা বলবো।রাখছি। -বলেই কল কেটে দিল। ভাল্লাগছে না তার। সামান্য একটা কথায় কেউ কি করে এত কিছু ভেবে নিতে পারে? How?? একটাবার জিজ্ঞেস তো করতে পারতো..কিন্তু তা না করে…!আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না তার। বেড সাইড টেবিল থেকে লাইটার আর সিগারেটটা নিয়ে ব্যালকোনিতে এসে দাঁড়ালো সে।আজ রাতটা তার নির্ঘুম কাটবে। তার মৃন্ময়ীর কেমন কাটবে কে জানে!
একটা বিষাদের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিল সে। ক্ষণে ক্ষণে হাওয়ার ছড়াচ্ছে একটা গোমট যন্ত্রণার ধোঁয়াটে প্রলেপ।

_________________________________

এক সপ্তাহ পর…

পলকদের বাড়িতে আজ বেশ হৈ চৈ। সকাল থেকে বাড়িতে রান্নাবান্না চলছে। ছোট খাটো অনুষ্ঠান হোক তবুও তো অনুষ্ঠান বলে কথা। মেহমানরা আসবে। একটু ভালো মন্দ খাবারের আয়োজন না করলেই নয়। নিশাতও আজ কলেজ যায়নি। সকাল থেকে মায়ের সাথে হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে তাই দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার হওয়ায় বেলা ১২ টার দিকেই বাড়ি ফিরেছে পলক। বাড়িতে ঢুকেই এমন উৎসব উৎসব রব দেখে অবাক হলো সে। কি হচ্ছে, কেন হচ্ছে কিচ্ছু জানে না সে। নিশাতকে দেখলো ঘরদোর ঝেড়ে পরিষ্কার করছে। ড্রয়িংরুমে নতুন সোফার কভারগুলো লাগানো হয়েছে। এই কভারগুলো শুধুমাত্র ঈদের দিন কিংবা বাড়িতে কোন বিশেষ মেহমান এলে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আজ তো ঈদ নয়। বাড়িতে কোন মেহমান আসবে এমন কোন কিছুও জানা নেই পলকের। এমন হলে মা অন্তত বলতো। হাফডে হওয়ায় দুপুর ৩ টায় কলেজ ছুটি হওয়ার কথা আজ নিশাতের। কিন্তু এই সময় সে বাড়িতে।তাও কাজ করছে এভাবে। ঘটনা কি সেটা উদ্ধার করতে এবার পলক সরাসরি নিশাত কে জিজ্ঞেস করলো।
_হ্যাঁ রে নিশু… বাড়িতে আজ এত আয়োজন কিসের রে?কোন মেহমান আসছে নাকি?

কর্নারসেটের শো-পিসগুলো পরিষ্কার করছিল নিশাত। বেশ ধুলো জমেছে। সেই ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তেই জবাব দিল নিশাত।
_হু।
_কিসের হু? পরিষ্কার করে বল।
_বিশেষ করে বলার মত কিছু নেই বুবু। মেহমান আসছে বাড়িতে। -কাঠকাঠ গলায় বললো নিশাত।

আজ বেশ ক’দিন ধরেই এমন আচরণ করছে নিশাত পলকের সাথে। প্রথম প্রথম খুব একটা আমলে না নিলেও আজকাল এসব একেবারেই ভালো লাগে না পলকের। আচমকা বোনের এমন পরিবর্তনের কোন কারণ সে খুঁজে পায় না। আর আজও সামান্য একটা কথা জানতে চাওয়ায় বোনের এমন আচরণে বেশ কষ্ট পেল সে। কিন্তু আর কত সহ্য করবে সে! নিশাত তার খুব আদরের বোন। প্রিয় মানুষ। তার থেকে এমন আচরণ সে নিতে পারছেনা আর। তাই আজ এর একটা বিহিত করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। কিছুটা তেঁতানো গলায় জিজ্ঞেস করলো,
_এই তোর সমস্যা কি বলতো?
পলকের এহেন কথায় যেন চরম পর্যায়ে অবাক হলো এমন ভাব করে নিশাতও পাল্টা প্রশ্ন করলো,
_কিসের সমস্যা?
_সেটাই তো আমিও জিজ্ঞেস করতেছি। কি সমস্যা তোর হ্যাঁ? ক’দিন ধরেই দেখতেছি তুই আমার সাথে ঠিকমতন কথা বলিস না। কি..হইছেটা কি তোর?-বেশ গমগমে গলায় বললো পলক।

নিশাতের শো-পিস পরিষ্কার করা শেষ।এতক্ষণ যাবৎ পলক ওর পিছনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। তাই এবার সে পলকের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।একটা চাপা শ্বাস ফেলে শান্ত স্বরে বললো,
_আমার কিছু হয় নাই। আর কোন সমস্যাও নাই। মা রান্নাঘরে আছে। যা জানার তাকে গিয়েই জিজ্ঞেস করে নিস।-বলেই হনহন করে পলককে পাশ কাটিয়ে অন্য ঘরে চলে গেল নিশাত। বোনের এমন আচরণে খুব কষ্ট পেল পলক। দুঃখভরাক্রান্ত চাপা শ্বাস ফেলে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল সেও।

রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখলো শাহনাজ বানু মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা রান্না করছেন। গন্ধে মনে হচ্ছে তিনি মুরগীর রোস্টের মশলা কষাচ্ছেন। এছাড়াও ডাইনিং এ সে কয়েক বক্স দই মিষ্টিও দেখে এসেছে। এখানেও পোলাও, কাবাব,বড় মাছের ভুনা,ডিমের কোরমা,দেশি মুরগীর ঝোল,খাসির রেজালা করা হয়েছে। এক এক করে সাজিয়ে রাখা আছে চুলার পাশের তাকে। মোটামুটি এলাহি কান্ড যাকে বলে। খাবারের পরিমাণ দেখেও মনে হচ্ছে মোটামুটি ২০/২৫ জনের মত মানুষের আয়োজন করা হয়েছে। হঠাৎ করে এত আয়োজন হলো কই কেউ তো কিছু বলেনি তাকে আগে থেকে।মা আর নিশাতের পক্ষেও একা একা এত সব আয়োজন, রান্নাবান্না করা সম্ভব না। তাছাড়া মাসের শেষে এত এত টাকা খরচ করে বাজার করলো কিভাবে বাবা? কিসের জন্যই বা এই আয়োজন পলক কিছুই বুঝতে পারছে না। পলক তার মা কে জিজ্ঞেস করতে যাবে তার আগেই পিছন থেকে মেয়েলী কন্ঠের কেউ একজন বললো,
_এই সাজি…কখন এলি তুই? আর এখানেই বা এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা যা ফট করে গোসল সেরে রেডি হয়ে নে।
পলক পেছনে ফিরে দেখলো একটা বড় ট্রে হাতে তার মামী দাঁড়িয়ে আছেন।হয় তো ভেতর ঘরেই ছিলেন এতক্ষণ। ট্রেটা আনতেই গেছিলেন। পলক আবারও বেশ অবাক হলো। পলকের এই অবাক হওয়ার পরিমাণ আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে ভিতরের ঘর থেকেই ভাবী ভাবী বলতে বলতে পলকের ফুপু আর সাথে বড় চাচীও বেড়িয়ে এলেন।এই মূহুর্তে পলক ব্যাপকভাবে বিস্মিত। একবার ভাবলো হয় তো এনারাই এসেছেন বলেই এত রান্নাবান্না। কিন্তু পরমূহুর্তেই খেয়াল হলো এদের জন্য আচমকা এত আয়োজন কেন?উপলক্ষই বা কি! কিছুই ভেবে পায় না সে। এরমাঝেই আবার তার ফুপু এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। আদুরে গলায় বললেন,
_আলহামদুলিল্লাহ। আমরা সবাই অনেক খুশি হয়েছি রে সাজি। আল্লাহ শেষমেশ মুখ তুলে চেয়েছেন।খুব সুখী হ তুই। আল্লাহ তোকে ভালো রাখুক।

পাশ থেকে বড় কাকীও এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মিষ্টি হেসে তিনিও দোয়া করে দিলেন তাকে।
আর পলক! সে তো ব্যাক্কলের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে সব দেখছে। কি হচ্ছে সব তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব। এরই মাঝে আবার রান্নাঘর থেকে শাহানাজ বানু তাড়া দিলেন।
_এই,তুই এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস! যা, জলদি গোসলে যা। ভালো করে সাবান শ্যাম্পু মেখে গোসল দিবি। বিছানায় শাড়ি রাখা আছে। তোর মামী দিয়েছে, ওটা পড়বি গোসল সেরে। এখন যা তাড়াতাড়ি।
শাহানাজ বানুর কথা শুনে বাকিরাও তাড়া দিল। বলতে গেলে রীতিমতো ঠেলেঠুলে তাকে গোসলের জন্য পাঠানো হলো সেখান থেকে।
________________________________

ঘরে পা দিতেই আরেক দফা ঝটকা খেলো পলক। তার চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো বোনগুলো সব তার রুমে।চাচাতো বোন মিলি। বয়সে তার থেকে ২ বছরের ছোট।সে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে চুড়ি সেট করছে। মামাতো দুই বোন রিয়া আর দিয়া তার ড্রেসিং টেবিলে তল্লাশি চালাচ্ছে। এক এক করে গয়না, লিপস্টিক, সাজগোজের জিনিস বের করে ঘাটছে।এরা যমজ দুই বোন। বয়স ১৫ বছর।কিন্তু আচার ব্যবহারে মনে হবে এরা নিশাতের থেকেও বড়। লোকে বলে যমজ বাচ্চাদের মধ্যে কাজে কর্মে স্বভাবে খুব মিল থাকে। আর এদের দেখলে মনে হবে এরা একে অন্যের জাত শত্রু। কারো সাথে কারো মিলে না।শুধু চেহারা ছাড়া। আর তার ফুপাতো বোন নাজিয়া।তার থেকে ৩ বছরের বড়।সে খুব মনোযোগ দিয়ে বেলী ফুলের গাজরা বানাচ্ছে।তাদের বাসার ছাদে একটা বেলী ফুলের গাছ আছে। শাহনাজ বানুর খুব পছন্দ বেলী ফুল। ছোট চাকরী হলেও চাকরীর প্রথম বেতন পেয়ে মায়ের জন্য বেলীফুলের একটা চারা কিনে এনে দিয়েছিল পলক। গাছটা এখন বেশ বড় হয়েছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, তাজা ফুলগুলো ওখান থেকেই আনা। পলকের এখন রীতিমতো মাথা চক্কর দিচ্ছে। কিছুতেই কিছু বোধগম্য হচ্ছে না তার। তাই একপ্রকার চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করলো সে,
_এইসব কিইই?? কি চলতেছে এইখানে হ্যাঁ? তোরা সব একসাথে ক্যান?

পলকের এমন প্রতিক্রিয়ায় সবাই একসাথে তার মুখের দিকে তাকালো। মিলি তাকে দেখেই একগাল হেসে দিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। বললো,
_Congratulations api. খুব খুশি হইছি আমরা সবাই। পাশ থেকে রিয়া দিয়াও চঁচিয়ে উঠলো,
_হ্যাঁ,আমরা তো সবাই মুটামুটি প্ল্যানও করে ফেলেছি কি কি করবো না করবো। ইশশশ আমরা কত্ত মজা করবো তোমার বি..এটুকু বলতেই নাজিয়া খেঁকিয়ে উঠলো। চোখ গরম করে রিয়া দিয়ার দিকে তাকিয়ে পলকের উদ্দেশ্যে বললো,
_এইই,সাজি। এম্নে সং এর মত দাঁড়ায় আছিস ক্যান। যা..বাথরুমে ঢুক। ১০ মিনিটে গোসল দিয়ে বেরোবি।

আচমকা এমন ধমকে থতমত খেয়ে গেল পলক। বোনদের মধ্যে নাজিয়া একটু রাগী স্বভাবের। সব কাজিনরা নাজু আপা বলতেই ভয়ে রীতিমত কাঁপে ।জমের মত ভয় পায় বলতে গেলে। কিন্তু মনটা বড্ড ভালো তার। তাই দরকারে অদরকারে নাজু আপাকেই সবার আগে মনে পড়ে সবার।রাগী স্বভাবের হলেও সোগাহ আর শাসন তার থেকে বেশি আর কেউ বোধয় তাদের করেনা। বিয়ে হয়েছে বছরখানেক।স্বামী কানাডা থাকে।মাস ৪ পরে সেও পাড়ি জমাবে সেখানে। আপাদত বাপের বাড়ি আছে সে।

একের পর এক ঘটনায় পলকের মাথা হ্যাং হয়ে গেছে অলরেডি। কিন্তু এই মূহুর্তে এসব না ভেবে গোসলে যাওয়া উচিৎ বলে মনে হলো তার। মাথায় একগাদা পানি ঢালবে আজ সে। তাছাড়া এখন এখান থেকে না গেলে আরেকদফা নাজু আপার তোপের মুখে পড়া থেকে তার রক্ষে হবে না…For sure! মানে মানে কেটে পড়াই ভালো।
এসব ভাবতে ভাবতেই পলক ভ্যানিটিব্যাগটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে একপ্রকার ভৌ দৌঁড় দিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।তার এমন কান্ড দেখে রিয়া, দিয়া,মিলি অট্টোহাসিতে ফেঁটে পড়লো।।আর নাজিয়া মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে গাজরা গাঁথায় মনোযোগ দিল।

________________________________

গোসল সেরে আসার পর নাজিয়া নিজ হাতে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছে পলককে।রিয়া দিয়া নিজেদের মধ্যে খুঁটাখুঁটি চালিয়ে যাচ্ছে। সাথে নাজু আপা থাকায় চুপিসারে চালিয়ে যেতে হচ্ছে এই চুলাচুলির কার্যক্রম। একজন একটা ঝুমকো দেখাচ্ছে তো অন্যজন আরেকটা। মিলি নিজ হাতে সাজাচ্ছে পলককে। বিছানায় বসে নাজু আপা টুকিটাকি ইন্সট্রাকশন দিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও একবারের জন্যও নিশাত এ ঘরে আসেনি। পলকের মন খারাপ লাগছে। একে তো কেউ কিছু বলছে না। কি হচ্ছে জানে না সে। বাকিরাও সাজগোজ করেছে। তাকেও সাজানো হচ্ছে। কিন্তু,ব্যাপারটা কি?! মনে মনে ঘটনা কি জানার জন্য ব্যাকুল হলেও নাজু আপার উপস্থিতিতে মুখ ফুটে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না। নয় তো মিলি, রিয়া দিয়া কারও কাছ থেকে ঠিক কথা বের করে নেওয়া যেত। কিন্তু,হায়…তিনটেকে একসাথে পেয়েও সেটা করার সুযোগ পাচ্ছে না পলক।

_কি রে তোদের হলো? ওরা এসে পড়েছে। নিয়ে আয় পলককে। বলতে বলতে পলকের মামী ঘরে ঢুকলেন। পলকের সাজ সজ্জা এতক্ষণে একেবারে কমপ্লিট। বেশ মিষ্টি লাগছে তাকে। মামী মুগ্ধ চোখে দেখলেন ওকে। গা’য়ের রঙটা একটু চাপা হলেও ভারী মিষ্টি মেয়েটা।গা’য়ের রঙের মতই একটা চাপা সৌন্দর্য আছে মেয়েটার মাঝে। সহজে চোখে না পড়লেও একেবারে উপেক্ষা করার মতও না। মিষ্টি হাসলেন উনি। তারপর, নাজুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
_তোদের হলে নিয়ে চল ওকে। অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে তো।

_হ্যাঁ,মামী হয়ে গেছে। তুমি যাও। আমরা আসছি।
_হু,তাড়াতাড়ি আয়। বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন রুম থেকে।

তিনি যেতেই নাজু আপা পলকের দিকে চাইলো। পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার দেখে নিল পলককে। সব ঠিকঠাক আছে। জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রথম পা ফেলবে আজ মেয়েটা। তাই জন্যই কি আজ এতটা সুন্দর লাগছে ওকে? একটা প্রশান্তির হাসি ফুঁটে উঠলো নাজিয়ার মুখে। তারপর, এগিয়ে এসে পলকের মাথায় আঁচল তুলে দিল। পলক অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে সব। কিন্তু প্রশ্ন করার সাহস নেই। একদমই নেই।

________________________________

ড্রয়িংরুমে ঢুকতেই হতভম্ব হয়ে গেল পলক। সিফাতের পুরো পরিবার এসেছে।দরজায় দাঁড়িয়েই আড়চোখে পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিল পলক। সাইডের বড় সোফায় সিফাতের বাবা মা,ছোট বোন সারা, সাথে একজন অপরিচিত ব্যক্তি। তার পাশের সিঙ্গেল সোফায় রিহান বসা।জানলার ধারের খাটটায় বসা চারজন অপরিচিত ব্যক্তি। এদের মধ্য দুজন মহিলা দুজন পুরুষ। মাঝের দুই সিটের সোফাটায় কেবল সিফাত একাই বসা। তবে সিফাতের কোলে একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে।একদম পুতুলের মত দেখতে। ৫/৬ বছরের হবে হয় তো। এটাই বোধয় ইয়ানা। সিফাতের মেয়ে। কি সুন্দর শান্ত হয়ে বসে আছে তার বাবার কোলে। মনে মনে ভেবে নিল পলক।পলকের বাড়ির লোকজন সবাই তাদের মেহমানদারি করছে। শেষে নাজু আপাও তাতে যোগ দিল। নাজু আপা পাশ থেকে সরতেই পলকের বা’পাশে দাঁড়ানো মিলির কুনুই ধরে টান দিল পলক। টান খেয়ে পলকের দিকে চাইতেই সে খানিকটা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘ঘটনা কি? এরা সব এখানে কেন?’

মিলি উৎফুল্ল স্বরে বললো,’আজ তো তোমার পানচিনির অনুষ্ঠান গো বুবু….বিয়ের ডেট ফিক্স করে আংটি পড়িয়ে যাবে ওরা তোমায়।’

মিলির কথা শুনে পলকের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। সে তো ভুলেই গেছিল আট দিন আগের সেই রাতের কথা। সিফাত তো বলেছিল এই সপ্তাহে স্বপরিবারে আসবে। কিন্তু,এটা কি হলো? এত কিছু বলার পরেও লোকটা সত্যি সত্যি চলে এলো বিয়ের ডেট ফিক্স করতে?! এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই নিজের জন্য এক ভয়ানক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো পলক।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here