#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৫
©জারিন তামান্না
_হ্যালো,আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই। -বেশ উচ্ছ্বসিত স্বরে খানিক টেনে টেনে বললো নিশাত। তবে ওপাশ থেকে শোনা গেল সিফাতের শান্ত, ধীর আর খানিক বিচলিত কণ্ঠস্বর।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম নিশাত। কেমন আছো তুমি?
সিফাতের এহেন ধীর আর কথার পরিবর্তনে মূহুর্তেই মিইয়ে গেল নিশাতেই উচ্ছ্বাসিত ভাবখানা।আর সেখানে এসে চকিতেই জুড়ে বসলো কিছুটা বিচলিতভাব। আর সেটা হওয়াটাও খুব স্বাভাবিক ছিল।কারণ,পরিচয়ের সেই শুরু থেকেই সিফাত কখনো নিশাতের ডাকনামে নয়,বরং ছোট আপু বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু, আজ হঠাৎই সেই মানুষটার মুখে নিজের ডাকনামটা শুনে কেমন অদ্ভুত ঠেকলো ব্যাপারটা তার কাছে। নিশাত বরাবরই স্পষ্টভাষী আর বুদ্ধিমতীও।তাই মনে আসা চিন্তার চাকায় লাগাম দিতেই চকিতেই সে প্রশ্ন করলো সিফাতকে,
_আমি তো ভালো আছি, ভাইয়া। কিন্তু, আপনার কি হয়েছে?
নিশাতের এহেন প্রশ্নে সচকিত হয়ে গেল সিফাত। সে জানেই মেয়েটা বোঝদার আর বুদ্ধিমতী। চট করেই বুঝে ফেলো সবকিছু।কিন্তু,এবার তার এই প্রশ্নের কারণ সিফাত ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তাই জানতে চাইলো।
_আমার কি হবে আবার। I am totally fit & fine.
_yeah…u can be…but this time u r a little bit unmindful too. -নিশাত বললো।
_unmindful? শব্দটা শুনে সেটাকে নিজের মনেই একবার আওড়ালো সিফাত। তারপরেই নিজ থেকে ভাবার চেষ্টা করলো, সে কি ভুল কিছু বলে ফেলেছে,যার জন্য নিশাত এভাবে বলছে তাকে? কিন্তু, বললেও সেটা কি? সহসা কিছু ভেবে পেল না সিফাত। তাই জবাবে কি বলবে সেটাও বুঝতে পারলো না সে। চুপ করে রইলো।
আর ওদিকে সিফাতকে চুপ থাকতে দেখে নিশাত ঠিক বুঝে নিল যে কোন একটা সমস্যা হয়েছে। চকিতেই আবার মাথায় এলো-
পলক কি আবার কোন কান্ড ঘটিয়েছে,যার জন্য সিফাত চিন্তিত?! আর এই জন্যই এমন বেখেয়ালি হয়ে কথা বলছে! আর বাড়ি ফিরেছে পর থেকে তো পলকও কেমন চুপচাপ হয়ে আছে। সেই যে সন্ধ্যা নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকেছে রাতে খেতে অবদি আসেনি।নিশাত গেছিলও ডাকতে কিন্তু, সে বলেছে খাবে না।মাথাব্যথা করছে..ঘুমাবে সে। নিশাত ভেবেছে সারাদিন বাইরে থাকায় সত্যিই বেশ ক্লান্ত সে।তাই আর বিরক্ত করেনি। কিন্তু এখন সিফাতের এমন অবস্থা দেখে বেশ ভালো রকম খটকা লাগছে তার। কিছু তো একটা নিশ্চয় হয়েছে।নয় তো তারা দুজনেই এমন… -এসব সাতপাঁচ ভেবেই সে ঠিক করলো সিফাতকেই জিজ্ঞেস করবে সবটা। তাই বেশ আদুরে আর ভরসাদায়ক গলায় প্রশ্ন করলো সে সিফাতকে,
_কি হয়েছে ভাইয়া? বলা যাবে কি আপনার এই ছোট আপুটাকে? আপুটা কিন্তু এতটাও ছোট নয় যে বুঝবে না!
নিশাতের এমন ধাঁচের কথায় বিচলিত অবস্থাতেও প্রশান্তির হাসি হেসে দিল সিফাত। এই মেয়েটা সত্যিই অনেক বুদ্ধিমতী আর কিউট। অনেকটা তার রুকু আপার মতো।কিভাবে যেন বুঝে যায় সবটা। তখন চাইলেও লুকোচুরির কোন সুযোগই থাকে না আর।আর সে এও জানে এই মূহুর্তে নিশাত ছাড়া তাকে সাহায্য করার মতও কেউ নেই। তাই, কোন রকম ভণিতা ছাড়াই বললো,
_তেমন কিছু হয়নি ছোট আপু। জাস্ট সারাদিনের ঘুরাঘুরিতে টায়ার্ড একটু।
_তাই?
_হ্যাঁ।
_বেশ।
_আচ্ছা,শোনো..তোমার বুবু কই? ওর ফোনটা বন্ধ সম্ভবত।
_ফোন বন্ধ? -মনে মনে কথাটা ভেবেই বেশ অবাক হলো নিশাত। কারণ, পলক কখনো তার ফোন বন্ধ রাখে না। আর সে খুব একটা ফোন ইউজও করে না যে চার্জ শেষ হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তাহলে? সে কি ইচ্ছা করে ফোন বন্ধ করে রেখেছে?কিন্তু কেন?এসব ভাবতেই এবার সত্যি সত্যি বেশ চিন্তায় পড়ে গেল নিশাত। কিন্তু, সেই চিন্তাটা সিফাতের কাছে প্রকাশ করলো না। তাই,ব্যাপারটা খানিক এড়িয়ে যেতেই স্বাভাবিকভাবেই বললো,
_অহ! ফোনের বোধয় চার্জ শেষ হয়ে গেছে। নয় তো বুবু কখনো ফোন বন্ধ রাখে না।আর আপনি এই সামান্য বিষয় নিয়ে এতটা ওরিড হচ্ছেন ভাইয়া? বিয়ের আগেই এত্ত চিন্তা নিজের হবু বউয়ের জন্য,হুউউমমম??শেষ কথাটা খানিক রসিকতা করেই বললো নিশাত। নিশাতের এহেন কথায় ফোনের ওপারে সিফাত মুচকি হাসলো শুধু। কিন্তু কিছু বললো না। নিশাত ছোট হলেও বেশ গুছিয়ে সব হ্যান্ডেল করতে পারে এটা সিফাত জানে। তাই এই ব্যাপারটাও যে সে বেশ সচেতন ভাবে এড়িয়ে যেতেই” ফোনে চার্জ নেই” বললো সেটা সিফাতও ঠিক বুঝতে পারলো। তার চিন্তাটা কম হলো না কিছুতেই। তাই, সরাসরি নিশাতকে বললো,
_মৃন্ময়ী কি ঘুমিয়ে গেছে? নয় তো একটু কষ্ট করে ফোনটা ওকে দিয়ে এসো,প্লিজ ।একটু দরকারি কথা ছিল আমার।
সিফাতের এমন সহজ সাবলিলভাবে বলা কথায় এবার পুরোদমে মিইয়ে গেল নিশাত। ব্যাপারটা তবে সত্যিই সিরিয়াস কিছু। নয় তো সিফাত এতটা জরুরি খোঁজ লাগাতো না পলকের। তাই,তড়িঘড়ি করেই বললো,
_আ…হ্যাঁ। আপনি একটু হোল্ড করুন। আমি যাচ্ছি ওর ঘরে। -বলেই পা বাড়ালো পলকের ঘরের উদ্দেশ্যে।
_________________________________
পলকের ঘরটা বাসার একেবারে শেষ মাথায়।নিশাতের ঘর থেকে বেরিয়ে একটা লম্বা করিডোর পেরিয়ে মুখোমুখি ঘরটায় পলক থাকে। খুব দ্রুত পায়ে গেলেও সেকেন্ড বিশেক সময় লাগে। কিন্তু, নিশাত এক প্রকার দৌঁড়েই গেল পলকের ঘরটায়। খুব আস্তে করে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেল। ঘরে সবুজ রঙ এর একটা ড্রিম লাইট জ্বলছে । তার মৃদু আলোতেই নিশাত দেখতে পেল কপালে হাত রেখে চোখ বুজে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে পলক। ঘরের বাকি সব দরজা জানলাও বন্ধ করে রেখেছে মেয়েটা। কিছুটা বড় হবার পর থেকেই বাকি দু বোনের সাথে একই ঘরটাতেই থেকেছে সে এত বছর। বোধবুদ্ধি হওয়া পর থেকে তাদের বড় বোন অন্তরার সাথে নিশাতের কখনোই এতটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি যতটা পলকের সাথে হয়েছে। বলতে গেলে, অন্তরা বরাবরই একটু একরোখা, স্বার্থপর স্বভাবের ছিল। নিজের আগে কখনোই সে পলক আর নিশাতকে গুরুত্ব দেয়নি। তাই একই ঘরে যখন তিন বোন থাকার কথা উঠেছিল সে নিজের জন্য আলাদা একটা খাট বানিয়ে আনিয়েছিল বাবার কাছে আবদার করে। একমাত্র ছেলের পরে প্রথম আর বড় মেয়ে হওয়ার সুবাদে তাদের বাবা সবসময় একটু বেশিই স্নেহ করতো অন্তরাকে। এই নিয়ে নিশাতের একটু আধটু অভিযোগ থাকলেও পলক কখনোই কিছু বলতো না। আর পলকের এমন নিঃস্বার্থ স্বভাবের প্রভাবে পড়ে একটা সময় নিশাতও ছেড়ে দিয়েছিল সেসব অভিযোগ করা। কারণ, বাবার আর বড় বোনের থেকে খুব বেশি স্নেহ, ভালোবাসা না পেলেও তার আরেক বোন, একমাত্র ভাই আর মা সেটা পুষিয়ে দিয়েছে । কিন্তু, অন্তরা চলে যাওয়ার পরে যখন পলকের বিয়ে ভাঙার জের ধরে ভাইটাও আলাদা হয়ে গেল তখন ভাইয়ের খালি ঘরটায় জায়গা হলো নিশাতের। তাই, এই ৩ বছর আগেও বেশ কয়েকটা বছর তার এই বোনের খুব কাছাকাছি থেকেছে সে। খুব ভালো করেই জানে বোনের স্বভাব আর প্রতিটা অভ্যাস। ঠিক সেই কারণেই, পলককে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখেই সে বুঝে গেল পলক কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত। কারণ,কেবল কোন কিছু নিয়ে খুব বেশি চিন্তায় পড়লে,মন খারাপ কিংবা অস্থিরতায় পলক এভাবেই কপালে হাত রেখে চোখ বুঝে শুয়ে থাকে। পলকের শোয়ার ভঙ্গিমায় নিশাত এটাও বুঝে গেছে যে পলক একটুও ঘুমিয়ে নেই। তাই,কোন আড়ম্বনা ছাড়াই খট করে সুইচ টিপে রুমের আলো জ্বালিয়ে দিল।
আচমকা ঘরে এত তীব্র আলোর রেশ সচকিত করলো পলককেও। চোখের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকালো।বেশ দীর্ঘ সময় চোখ বুজে থাকার কারণে হঠাৎ করেই আলোটা সহ্য হলো না পলকের। তাই কিছুটা সময় নিয়ে ধীরে ধীরে চোখ খুলে উঠে বসলো সে। বিছানার কাছে আবিষ্কার করলো নিশাতকে । কোমড়ে দু হাত দিয়ে মুখে কিছুটা রাগ রাগ ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।আর নিশাত আবিষ্কার করলো বিধ্বস্ত মুখে তার বোনকে। কেঁদেকেটে চোখ লাল করে ফেলেছে এক্কেবারে। কিন্তু কেন? কি এমন হয়েছে আবার! এবারে সত্যিই অনেক বেশিই চিন্তায় পড়ে গেল নিশাত। কিন্তু, এ মূহুর্ত কিছু জিজ্ঞেস না করাই ঠিক হবে বলে মনে করলো সে।ফলে, ওভাবেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো বিছানার কাছে।
আর হঠাৎ করে বোনকে এভাবে নিজের ঘরে দেখতে পেয়ে মুহূর্তেই কিছু ঠাওর করতে পারলো না পলক। রুমের বন্ধ জানলায় পর্দা টানা থাকায় এখন রাত নাকি সকাল সেটাও বুঝতে পারলো না। তাই সময় দেখার জন্য বিছানা হাতড়ে ফোনটা হাতে নিল সে। বোনকে ফোন হাতে নিতে দেখেই গম্ভীর গলায় নিশাত বললো,
_ফোনটা বন্ধ হয়ে আছে তোর।
ফোন বন্ধ শুনে অবাক হলো পলকও। মনে মনে ভাবলো, কই সে তো ফোন বন্ধ করেনি।শপিংমল থেকে বেরোনোর সময় যখন শেষবার নিশাতের কথা হয়েছিল তখনো তো ৬৭% চার্জ ছিল ফোনে। দেখেছিল সে। তাহলে ফোন বন্ধ হলো কিভাবে! আর ওর ফোন বন্ধ সেটা নিশাতই বা জানলো কি করে! ব্যাপারটা মাথায় কড়া নাড়তেই চট করে ফোনের পাওয়ার বাটনে প্রেস করলো পলক। আর সাথে সাথেই ফোনের লক স্ক্রিনের আলোটা জ্বলে উঠে জানান দিল যে ফোনটা বন্ধ নয়। ফোনের আলো জ্বলে উঠতে দেখে দু’বোনই বেশ চককে গেল । এবার নিশাত চেঁচিয়ে উঠলো। বললো,
_এই তোর ফোন তো বন্ধ না। তাইলে ভাইয়া তোরে কল করে ক্যান পাইতেছে না? তুই আবার ভাইয়ার নাম্বার ব্লকে দিছিস, না??
নিশাতের এমন অহেতুক আর আচমকা আক্রমণাত্মক কথায় থতমত খেয়ে গেল পলক। হতভম্ব চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
_আমি ক্যান ব্লক করবো তারে? আর ফোনই বা বন্ধ হবে.. এটুকু বলতেই ফোনের স্ক্রিনে চোখ পড়লো পলকের। দেখলো ফোনটা এরোপ্লেন মোডে সেট হয়ে আছে। কখন এমন হয়েছে সেটা পলক নিজেও জানে না। এদিকে বোনকে এভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেমে যেতে দেখে নিশাতও উঁকি দিল ফোনের স্ক্রিনে। দেখতে পেল ওটা এরোপ্লেন মোডে আছে। এটা দেখে হতাশাজনক একটা শ্বাস ফেলে নিজের ফোনটা বাড়িয়ে দিল বোনের দিকে। কাঠকাঠ গলায় বললো,
_নে ধর। ভাইয়া লাইনে আছে। কথা বল।
নিশাতের কথা সহসা কিছু বুঝে উঠতে পারলো না পলক। কিন্তু হাত বাড়িয়ে ফোনটা ঠিকই নিল। পলক ফোনটা হাতে নিতেই নিশাত বললো,
_কথা শেষ হলে ফোনটা দিয়ে আসিস। এলার্ম দেওয়া আছে। লাগবে আমার। বলেই উল্টো দিকে ঘুরে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হঠাৎ ঘটা এ ঘটনার আগামাথা কিছুই বুঝলো না পলক। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত ১১:১৫ বাজে। এতরাতে নিশাতের ফোনে সিফাতের কল দেখে অবাক হলো সে। তারপর, একটা ছোট্ট ক্লান্তির শ্বাস ছেড়ে কানে নিয়ে ঠেকালো ফোনটা। শান্ত কিন্তু কিছুটা ভারী স্বরে বললো,
_হ্যালো..আসসালামু আলাইকুম।
নিশাত ফোন হোল্ড করতে বলার পর মিনিট দুই পেরিয়ে গেছে। এরমাঝে বেশ কয়েকবার ফোন চেক করে ফেলেছে সিফাত।লাইনেই আছে কিন্তু ফোনের ওপারে না নিশাত আর না পলকের কোন সাড়া পাওয়া যাচ্ছিল। যা ক্রমশ সিফাতের উদ্বিগ্নতা আর অস্থিরতার কারণ হয়ে উঠছিল। তবে শেষমেশ পলকের এমন শান্ত, ধীর কন্ঠ পেয়ে ভেতরের অস্থিরতাটা খানিকটা কম হলো তার।কিন্তু, তার উদ্বিগ্নতা কমলো না এতটুকুও।তারপরও, নিজেকে ধাতস্ত করে যথা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় সালামের জবাব দিল।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম।বলেই চুপ হয়ে গেল। শুধু তার উদগ্রীবতা মিশ্রিত নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেল পলক।কিন্তু বুঝলো না সেটার অর্থ। কিছু সময় দুজনেরই নিরবতায় কাটলো।
পলক ঠিক কি বলবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না আর সিফাত নিজের উদগ্রীবতা পলকের কাছে প্রকাশ করতে চাইছিল না বলেই তার মনে চলা প্রশ্নটাও সরাসরি জিজ্ঞেস করতে পারছিল না পলককে।
আজ শপিং এর পুরোটা সময় বেশ চুপচাপ ছিল পলক। যদিও এমনিতেই সে বেশ শান্ত স্বভাবের। তারপরেও তার এই শান্তভাব আজ বেশ অস্বাভাবিক লাগছিল সিফাতের কাছে। তার চোখমুখের ওমন অবস্থা দেখে মিসেস.রেহনুমা, রুকু তারা সবাই জিজ্ঞেসও করেছিল তার শরীর খারাপ লাগছে কিনা। কিন্তু সে বারবার হাসি মুখে না বলে এড়িয়ে গেছে ব্যাপারটা। বাড়িতে ড্রপ করে দিতে আসার পুরোটা সময়ও সে সিটের সাথে হেলান দিয়ে একপাশে মাথা কাত করে চোখ বুজে ছিল। সিফাত ভেবেছিল ক্লান্ত সে। মাথাব্যাথাও ছিল। তাই, বেশি কিছু বলেনি তখন। বাসার সামনে এসেও চুপচাপ নেমে গেছে গাড়ি থেকে। সিফাতকেও ভালো মন্দ কিছু বলেনি। অনেকটা অন্যমনস্কভাবেই চলে এসেছিল সে। বাড়িতে না ঢোকা পর্যন্ত পলকের চলে যাওয়াটা একধ্যানে দেখেছে সিফাত। পলক একবারও ফিরে তাকায়নি। কিছুটা এলোমেলো পায়েই হেঁটে হেঁটে বাড়ির ভিতরে চলে গিয়েছিল। আর তারপরে একটা হতাশার শ্বাস ফেলে সিফাতও ফিরে এসেছিল। কিন্তু বাড়ি ফেরার পরেও তার মনের অস্বস্তি কমেনি একটুও। ভিতরে ভিতরে ঠিকই চিন্তায় ছিল পলককে নিয়ে। রাতে ফ্রি হয়ে একবার খোঁজ নেওয়ার কথা ভাবতেই কল করেছিল পলকের নাম্বারে। কিন্তু ১ ঘন্টা লাগাতার ট্রাই করার পরেও যখন কল কানেক্ট হলো না, তার চিন্তা উদ্বিগ্নতায় পরিণত হলো। তাই না পারতে বাধ্য হয়ে নিশাতকেই কল করতে হয়েছে তার। কিন্তু এত কিছুর পরে পলকের এমন ভারী গলার স্বর শুনে তার মনে হচ্ছে মেয়েটা বোধয় খুব কেঁদেছে। শরীর কি বেশি খারাপ করলো নাকি? কথাগুলো ভাবতেই ভাবতেই সে বললো,
_ফোন বন্ধ কেন আপনার?
_এরোপ্লেন মোডে চলে গিয়েছিল।খেয়াল করিনি আমি। তাই…
_ফোনের ডেটা অন করুন।
_জ্বী? অবুঝ স্বরে প্রশ্ন করলো পলক।
_এরোপ্লেন মোড অফ করে ডেটা অন করুন ফোনের।
_ক্যা…এ..কেন?
_এত প্রশ্ন কেন করছো মৃন্ময়ী! বেশ গম্ভীর স্বরে বললো সিফাত। যেটা শুনে নিমিষেই দমে গেল পলক।তাড়াহুড়ো করে বললো,
_জি…জ্বী..! করছি।
_হুম। বলেই কল কেটে দিল সিফাত।
ফোনের ডেটা অন করার কয়েক সেকেন্ডের মাথায়ই সিফাতের থেকে ভিডিও এলো। হঠাৎ করে ভিডিও কল দেখে ভড়কে গেল পলক। কিছুটা সময় নিয়ে রিসিভ করলো কলটা। রিসিভ করার পর স্ক্রিনে পলকের মুখটা ভেসে উঠতেই সিফাতের মনে হলো কেউ যেন খুব জোরে খমচে ধরেছে তার পাঁজরে। চিনিচিনে ব্যাথায় জর্জরিত হচ্ছে ভেতরটা। কি অসম্ভব রকম এলোমেলো হয়ে আছে পলকের টলটলে মুখটা।বেশ অনেকক্ষণ ধরে চাপা কান্নার ফলে তা শুকিয়ে দাগ হয়ে আছে।মনে হচ্ছে ভেজা মাটির গায়ে খুব জোরে আঁচড় কেটেছে কেউ। চুলগুলোও এলোমেলো হয়ে আছে। পলকে যখন এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত সিফাত ঠিক তখনই তার চোখ পড়লো পলকের গলায়। ডান পাশে তিনটা সূক্ষ ভাজের মাঝ বরাবর কালো রঙের ছোট একটা তিলটা। ছোট হলেও বেশ গাঢ় হওয়ায় কাছ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওটা। এই তিল সে আগে কখনো দেখেনি। দেখবেই বা কি করে! পলককে সে যতবার মুখোমুখি দেখেছে ততোবারই ওড়না দিয়ে মাথা থেকে প্রায় শরীরের অনেকটাই ঢাকা থাকতে দেখেছে। আর তার সিঁথির দুপাশের লম্বা চুলের কারণে মুখটাও অর্ধেকটা ঢাকা থাকে। তাই এই তিলটা দেখা যায় না। আর পানচিনির দিন যখন পলকের ঘরে দেখা হয়েছিল তাদের,মাথায় আঁচল না থাকলেও পলকের মুখটা নিচু করে রাখায় সেদিনও খেয়াল করেনি যখন সে পলককে দেখেছিল।কিন্তু আজ সেই তিলটা দেখার পর বেশ কিছুক্ষণ সেখানেই চোখ আটকে গেল তার। মুগ্ধতায় ডুবে গেছে সে। পলকের মেটে গা’য়ের রঙের সাথে কি সুন্দর মানিয়েছে তিলটা!খুব করে টানছে তাকে। ছুঁয়ে দেওয়ার কিঞ্চিৎ লোভও হচ্ছে। এসব ভেবেই মুচকি হাসলো সে আপন মনেই।
সিফাতকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখেও কারণটা ঠিক বুঝলো না পলক। কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে তার। উশখুশ করছে সে। পলকের এহেন অবস্থা দেখে হুঁশ হলো সিফাতের। আর সেই সাথে চকিতেই তার এটাও খেয়াল হলো পলকের গায়ে ওড়না নেই। সেজন্যই তিলটা এতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চট করেই চোখ নামিয়ে নিল সে। কিন্তু আগের মতই গম্ভীর গলায় বললো,
_আপনার ওড়না কই মৃন্ময়ী?
সিফাতের মুখে আচমকা এমন একটা অপ্রত্যাশিত কথা শুনে হকচকিয়ে গেল পলক। সেকেন্ড কয়েক সময় লাগলো তার ব্যাপারটা বুঝতে। আর সিফাত ঠিক কি বলেছে সেটা মাথায় ক্যাচ করতেই থতমত খেয়ে গেল পলক। নিজের দিকে চাইতেই চক্ষুচড়কগাছ হলো তার। তড়িঘড়ি করে ফোনটা বালিশের উপর উল্টো করে রেখে আশেপাশে ওড়না খোঁজা শুরু করলো। একটু খোঁজার পরেই খাটের কোণায় ঝোলানো অবস্থায় পেল সেটাকে। চট করে নিয়েই ভালোভাবে মাথাসহ শরীরে জড়িয়ে নিল ওটাকে। ওড়না ঠিকঠাক করতেই করতেই ব্যাপারটা কি ঘটলো সেটা মনে হতেই লজ্জায় গুটিয়ে গেল পলক। চোখ খিঁচে বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিল একবার। উদ্দেশ্য নিজেকে ধাতস্ত করা। এরই মাঝে ফোনে সিফাতের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।
_মৃন্ময়ী..
মৃন্ময়ী ডাকটা শুনতেই চট করেই চোখ খুললো পলক। পাশ ফিরে বালিশের উপর রাখা ফোনটা হাতে নিল সে। যথাসম্ভব স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
_জ্বী..
পলকের সাড়া পেয়ে চোখ তুলে চাইলো ফোনের স্ক্রীনে। এই মৃন্ময়ীটা তার চেনা। কিঞ্চিৎ হাসলো সে মনে মনে। তার চোখের তারায় উঁকি দিল সে হাসি। তবে সেটা পলকের চোখে পড়লো না। পড়বেই বা কি করে!পলক যে চোখ নামিয়ে রেখেছে। একটু আগে ঘটা ঘটনাটার জন্য লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতে পারছে না সে সিফাতের মুখপানে। পলককে এভাবে দেখে সিফাতও বুঝতে পারলো, একটু আগের ঘটনায় লজ্জা বেশ পেয়েছে তার মৃন্ময়ী। আর এটাই স্বাভাবিক। শিক্ষিত আর আধুনিক চিন্তাধারার মেয়ে হলেও নম্রতা, ভদ্রতার একটুও কমতি নেই মেয়েটার মাঝে। অথচ নম্র ভদ্র এই শান্ত মেয়েটার মাঝেই বন্দী আছে কত কত রহস্য, অব্যক্ত কথা। হয় তো আছে অনেকটা চাপা যন্ত্রণাও। কিন্তু বাইরে সে এসবের কিছুই প্রকাশ করে না।বাইরে বাইরে নিজেকে শক্তপোক্ত দেখায়। অথচ ভালোবাসা দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিতে পারলেই ভেজা মাটির মতই নরম হয়ে ওঠে সে। এসব ভাবতে ভাবতেই মুচকি হাসি ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে। তারপর বললো,
_দেখি,,এদিকে তাকান। দেখতে দিন আমার মৃন্ময়ীকে।
“আমার মৃন্ময়ী” কথাটা শুনে চমকে চোখ তুলে তাকালো সে ফোনের স্ক্রিনে। ঠান্ডা কিছু একটা যেন বয়ে গেল তার শিরদাঁড়া বেয়ে। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো ফোনের স্ক্রিনের দিকে। এদিকে তার মৃন্ময়ীর এহেন অবস্থা দেখে ঠোঁটের হাসিটা চওড়া হলো সিফাতের।তারপর মিষ্টি হেসে খানিক রসিকতা করেই বললো,
_একি হাল করেছেন আপনি আমার মৃন্ময়ীর? পুরো ভূতুড়ে টাইপ লাগছে তাকে। এখন তো চাইলেই অনায়াসে কোন হরর ফিল্মের ক্যারেক্টার হিসেবে চালিয়ে দেয়া যাবে। বলে সজোরে হাসতে লাগলো সে।
সিফাতের এমন ঠাট্টায় চকিতে রাগ হলো পলকের। রাগ মিশ্রিত ভারী ভারী গালায় বললো,
_আপনার মৃন্ময়ীর যা খুশি হোক তাতে আমার কি! তার কোন কিছুর দায় ভার আমি নিয়ে রাখিনি।তাই তাকে ভূতুড়ে লাগুক আর সত্যি সত্যি সে মরে ভূত হয়ে যাক তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।বলেই একটা ভেংচি কেটে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল পলক।
খুব দ্রুত ঘটলো ব্যাপারটা।পলকের শেষ কথাটায় বেশ মেজাজ চড়ে গেল সিফাতের। যদিও সে জানে এটা পলক সজ্ঞানে ভেবে চিন্তে বলেনি। তারপরেও, সে তার মৃন্ময়ীকে নিয়ে এভাবে বলেছে বলে রাগ লাগছে তার। কিন্তু এখন পলকের এ অবস্থায় তাকে আর রাগ দেখাতে চাইছে না সে। তাই নিজের রাগকে যথাসম্ভব দমিয়ে রেখেই গম্ভীর গলায় সে বললো,
_তবে চাইবো এমন কিছু ঘটার আগেই যেন আমার অস্তিত্ব ফুরিয়ে যায় এই পার্থিব জগতে ।কারণ, এখন মৃন্ময়ী ছাড়া অর্ধজীবিত থাকার মত মরণ যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতাটা শেষ হয়ে গেছে আমার…বহু আগেই। ভরাট শূন্যতায় ডোবা ওই শান্ত চোখের তারায়! পদ্মপাতার জলের মতো টলটলে চাহনীর ওই মুখখানির মায়ায়!
চলবে…