ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৪

0
1317

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_৪
©জারিন তামান্না

একটা ফাইভ স্টার হোটেল বসে আছে পলক। সিফাতের অপেক্ষায়। সে রাতে যখন পলক তার সাথে ঘটা আজকের ঘটনাগুলোর প্রেক্ষিতে ভ্যাবাচ্যাকা দিবস পালন করছিল আর সিফাত তার মৃন্ময়ীতে মশগুল,তখনই কথায় কথায় আজকের দেখা করার প্রস্তাব রাখে সিফাত। সে রাতে…

_কাল দুপুরে আমার ফ্লাইট। ইউএস যাচ্ছি। ৩ দিন পরে ফিরবো।

_অহ। বলেই চুপ করে গেল পলক।:

_বিয়ের ডেট ফাইনাল করবো। কিন্তু আপনার উত্তর না পেলে তো ফাইনাল কিছু বলতে পারছিনা তাদের। তখন তো ছাদে কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল।তাই উত্তর জানতেই কল করেছিলাম। (সিফাতের নির্বিকার কথা।)

_কিসের উত্তর?

এবার সিফাতের মেজাজ পুরোপুরি বিগড়ে গেল।এই মেয়ের মেমোরি এত খারাপ কেন?এই মেমোরি নিয়ে সে কি না টিচারগিরি করে। এত এত বাচ্চা কাচ্চা পড়ায়। নাকি আমার বেলাতেই তার মেমোরি ড্যাম!

খিঁচানো মেজাজের স্বরেই সে বললো,এই নিয়ে তৃতীয় বার বলতে হচ্ছে কথাটা আমাকে। ৩য় বার কথাটা শুনেই দুপুরের কথাটা মনে পড়ে গেল পলকের। যে প্রশ্নের মাধ্যমে আজ তার ভ্যাবাচ্যাকা দিবসের উদ্বোধন হয়েছিল। কিন্তু সবটা জেনেও সে চুপ করে রইলো। বলবে না সে কিছু। এমন কথা কি এভাবে মুখে বলা যায় নাকি! এই লোকটা পারলেও সে পারবে না। তাই চুপ করেই থাকবে। যা বলার সেই বলুক।

_আমরা ভালোবেসে বিয়ে করবো নাকি বিয়ের পর ভালোবাসবো?? দাঁতে দাঁত চিপে বললো সিফাত।

_এসব কি কথা! এরেঞ্জম্যারেজে তো যা হওয়ার বিয়ের পরেই হয়। বিয়ের আগে কিভাবে…

সিফাত বুঝে গেছে। এভাবে বললে পলক বুঝবে না। তাকে ব্যাপরটা এবার পোস্টমর্টেম করেই বোঝাতে হবে। এই মেয়ে যে কি করে টিচার হলো আল্লাহ মালুম। মনে মনে কথাটা বললেও মুখে বললো অন্য কথা।

_ওকে ফাইন।ছাড়ুন এখন। আপনি বরং একটা কাজ করুন..

_কি কাজ? পলক অধীর আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো।

_৩ দিন পর আমি দেশে ফিরবো। মিট করতে পারবেন?

দেখা করার কথা শুনে কিছুটা দ্বিধায় পড়লো পলক। কিন্তু তারও তো দেখা করাটা দরকার।উনি বিয়ের ডেট ফিক্স করার কথা বলছেন।কিন্তু তিনি তো জানেন না এখনো কিছু। সত্যিটা তো উনাকে জানাতে হবে।এরপর তো বিয়েটাই আর হবে না!এসব সাত পাঁচ ভাবছে পলক। আর ওদিকে ফোনের ওপাশে সিফাত অপেক্ষা করছে তার মৃন্ময়ীর জবাবের।
খানিক সময় নিয়ে ভাবলো পলক। তারপর রাজি হয়ে গেল। সত্যিটা সে মুখোমুখি হয়েই বলতে চায়। তাই দেখা করার সুযোগটা তার মিস করা উচিৎ হবে না।

_হ্যাঁ,,পারবো।
_ওকে। আমি তাহলে সময় আর এড্রেসটা আপনাকে পরে জানিয়ে দিচ্ছি। আপনি একবার চেক করে নেবেন। আপনার শিডিউলের সাথে ম্যাচ করে কিনা।

_জ্বী,আচ্ছা।

ঘড়িতে সময় দেখলো সিফাত। রাত ১২:২০ বাজে। কাল দুপুর ৩ টার ফ্লাইট তার। বাসা থেকে বেরোতে হবে ১২ টা নাগাদ। আজ সারাদিন বেশ ধকল গেছে। এখন একটা ফ্রেশ ঘুম দরকার। নয় তো কাল সমস্যা হতে পারে।তাই ভণিতা ছাড়াই সে বললো,

অনেকটা রাত হয়েছে।ঘুমোন এবার। আমারও ঘুমাতে হবে।কাল দুপুরের ফ্লাইট আমার।

_অহ,আচ্ছা। সাবধানে যাবেন। কথাটা বলে পলক আরও একবার ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। কেন বললো সে এমন?তাও আবার উনাকে! নিজের কাজে নিজেই ব্যাক্কল বনে গেল সে। লজ্জাও পেল খানিক। তাই চুপ করে গেল।

ওদিকে পলকের কথা শুনে মুচকি হাসছে সিফাত। ভালো লাগছে তার।তার মৃন্ময়ী তাকে নিয়ে ভাবছে। ভালোবাসার অফুরন্ত জার্নিতে তবে কি এটাই তাদের প্রথম পা ফেলা?কথাগুলো ভেবতেই মুখের হাসিটা আরও চওড়া হলো তার। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সেও সম্মতি জানালো।

_হুম। রাখছি তবে আজ। দেখা হবে ইন শা আল্লাহ।
_জ্বী।
_ভালো থাকবেন মৃন্ময়ী।
_জ্বী..আপনিও।
_গুড নাইট। বায়।
_গুড নাইট।আল্লাহ হাফেজ।
মৃদু হাসলো সিফাত। হাসি মুখে ধরে রেখে সেও বিদায় জানালো তার মৃন্ময়ী কে।
_আল্লাহ হাফেজ।

এরপর আরও কিছুটা সময় সে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলো। কেমন যেন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে তার। অন্য রকম একটা ভালো লাগায় ছেয়ে আছে মন। জীবনের বিশেষ মানুষের আগমন ঘটলে বুঝি এমনই লাগে?

ওদিকে, পলক চুপচাপ বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে। কিছুক্ষণ আগে ঠিক কি ঘটলো তার ছক মেলানোর চেষ্টা করছে। আজ সারাদিন কত কি ঘটে গেল। একটা অন্য রকম মানুষের আগমন ঘটেছে তার জীবনে।কিন্তু সত্যি জানার পর এই মানুষটাও যে অচিরেই হারিয়ে যাবে এটা ভেবেই মন বিষাদে ভরে উঠলো তার। কিন্তু,,তারও কিছুই করার নেই। ভাগ্যে যা নেই তার জন্য কষ্ট পাবে না সে। এখন শুধু দেখা হওয়ার অপেক্ষা..তারপর আরও একবার শুরুর কথা বলার আগেই শেষ!
_________________________________

দুপুর ২:১৫ বাজে।প্রায় মিনিট ১৫ হলো সে একা একা বসে আছে। সিফাতের অপেক্ষা করছে। গতকাল হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট করে সময় আর এড্রেস জানিয়ে দিয়েছিল সিফাত। সাথে এও জানিয়েছিল যে সে আগে থেকেই টেবিল বুকিং দিয়ে রাখেছে। পলক যেন ঠিক সময় মত পৌঁছে যায়। সেদিনের পর আর একবারও যোগাযোগ হয়নি তাদের।আর আজ সরাসরি দেখা হবে।

আরও মিনিট ৪ পরে দেখা মিললো সিফাতের। হাতে ছোট একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে রেস্টুরেন্টের গেট দিয়ে ঢুকছে। পরনে বাংলাদেশ পাইলটের পোশাক। শুভ্রতায় ছেয়ে আছে মানুষটা। মাথায় ক্যাপ। চোখে কালো সানগ্লাস।হাতে সিলভার কালারের মোটা চেইনের ব্রেন্ডড ঘড়ি।পায়ে পলিশড সুজ।বেশ লাগছে তাকে। এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি এখানেই এসেছে সে। পলক যে একধ্যানে তাকিয়ে আছে তো আছেই। সেদিন খুব একটা ভালো করে দেখা হয়নি। ছবিও নেই তার কাছে কোন। তাই আজ যখন দেখছে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। ফর্সা গায়ের রঙ।গড়নেও বেশ লম্বা চওড়া মানুষটা। তাকে এভাবে দেখে তার মুখ দিয়ে আপনাআপনি বেরিয়ে এলো,মাশাল্লাহ! সিফাত দূর থেকে পলকে দেখতে পেয়েই একগাল হেসে দিল। যেন এবার হুশ হলো। ইশশশ..কি।বেহায়ার মত তাকিয়ে ছিল সে মানুষটার দিকে। না জানি সে কি ভাবলো। মনে মনে কথাগুলো বিড়বিড় করলো পলক। অবশ্য এমন কথা বলার মতই,যে মেয়েটা কখনো কোন ছেলেকে নিজের দৃষ্টিসীমানায় ঘেঁষতে দেয় না,সেই মেয়েটাই আজ কাউকে দেখে বেহায়ার মত তাকিয়ে দেখছিল। ব্যাপারটা প্রথমবার হলো। তাই পলকের জন্য এটা যেমন অবাক হওয়ার মত তেমনি লজ্জ্বারও। দ্রুত চোখ নামিয়ে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ‘Hi’বলতেই পলকের ঝটপট প্রতিউত্তর,
_আসসালামু আলাইকুম।
পলকের সালাম জানানো দেখে একমূহুর্ত থমকে গেল সিফাত। সে তো ভুলেই গেছিল,তার মৃন্ময়ী এসব হাই-হ্যালোর চাইতে বেশি সালামে অভ্যস্ত। এটা মনে হতেই মৃদু হাসলো সে। হাসি মুখেই সালামের জবাব দিল।

_ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছেন মৃন্ময়ী?
পলক এবার সত্যিই বিচলিত। তার চোখ মুখে সে ভাবটাও সুস্পষ্ট। ভ্রুকুটি কুচকে তাকালো সে সিফাতের মুখের দিকে। উদ্দেশ্য কিছু একটা বুঝতে চাওয়ার কিংবা কোন গভীর রহস্য উদ্ধার করার।
পলকে নিজের দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিফাতও এবার ভ্রুকুটি কুচকালো। একবার দেখলো নিজেকে। নাহ সবই তো ঠিক আছে। এবার তার কপালেও চিন্তার ভাজ। পলক চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। তাই সিফাত নিজেই জানতে চাইলো।
_ এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন মৃন্ময়ী ?আমাকে কি খুব বেশিই সুন্দর লাগছে আজ?যদিও এত ঘন্টা ফ্লাই করে আমি কিছুটা.. উমমম..না,বেশ ভালোই ক্লান্ত! তাও কি খুব বেশি হ্যান্ডসাম লাগছে আমায়???

সিফাতের এমন কথায় পলক যেন তার রহস্য উদঘাটনের জন্য মাঠে নামতেই বিশাল বড় গোল খেলো। একেবারে উস্টা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ার মত অবস্থা হলো তার। সে এতটাই হতভম্ব আর লজ্জিতবোধ করলো যে তার মুখে সে স্পষ্ট দেখতে পেল সিফাত। পলক ব্যাক্কলের মত তাকিয়ে আছে। আর সেটা দেখে সিফাত মিটিমিটি হাসছে।
এটা দেখে এবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো পলক। তবে সেটা ভেতর ভেতরেই। বাইরে থেকে যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখেই বললো,
_এ এএ এই সব কি বলছেন! এমন কিছু না।
_কেমন কিছু না?
সিফাতের এমন প্রশ্নে এবার সত্যিই বিপাকে পড়লো পলক।কি বলবে সে? এটা বলবে যে আপনাকে সুন্দর লাগছে না।আর আমি মোটেও আপনাকে দেখছিলাম না। আমি তো অন্য কিছু ভাবছিলাম। ধুর,এভাবে কি বলা যায় নাকি!

পলকে এভাবে নাস্তানাবুদ হতে দেখে বেশ মজা পেল সিফাত। যদিও সে জানে মেয়েটাকে এভাবে পেরেশান করাটা তার মোটেই ঠিক হচ্ছে না।কিন্তু কেন জানি এই সব ধরণের অন্যায় তার শুধু এই মেয়েটার সাথেই করতে ইচ্ছে করে। মেয়েটা যখন হতভম্ব হয়ে কথা হারিয়ে ফেলে সেই বিচলিত মুখখানা দেখতে ভারী ভাল্লাগে তার। তবে কি এই সব অন্যায় শুধুমাত্র এই চেহারাটা দেখার লোভেই কি? আপনমনেই হাসলো সে। পলকের মুখপানে চেয়ে বড্ড মায়া হলো তার। মুখটা কেমন চুপসে গেছে। কিন্তু তাও সে শেষবারের মত মজাটুকু করতে ছাড়লো না। আবারো জিজ্ঞেস করলো,
_কি হলো বললেন না তো কেমন কিছু না? আমাকে কি তবে আজ সুন্দর লাগছে না?ফ্লাই করে কি পুরো চেহারারাটাই বিধ্বস্ত লাছে আমার?করুণ মুখ করে বললো সিফাত। এবারে তাড়াহুড়োয় পলক চেঁচিয়ে উঠলো।
_এইই না!!! এমন কিছুই না। মানে তেমন কিছুই না। না…মানে কোন কিছুই না..মানে আমি…
_হুম..আপনি?
_আ আ..আমি অন্য কিছু ভাবছিলাম।
_অন্য কিছু!সেটা আবার কি? কিছুটা বিজ্ঞদের মত চিন্তিত ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলো সিফাত।
_এইইই যে সেদিন থেকে দেখছি যে আপনি আমাকে মৃন্ময়ী বলে ডাকছেন বারেবার।কিন্তু এটা তো আমার নাম নয়।তাহলে এই নামে কেন ডাকছেন?
ঘটনা বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো সিফাত। বেশ ভাব নিয়েই বললো,
উউমমম, আমি আপনাকে এই নামেই ডাকবো বলেই বারেবারে এই নামেই ডাকি।
_কেন? এই নামে কেন? আমার কি কোন নাম নেই,নাকি আমার নামটা আপনার পছন্দ নয়। কিছুটা মন খারাপের ভঙ্গী করেই বললো সে। ঠিক যেন একটা অবুঝ বাচ্চা কথা বলছে।বেশ আদুরে লাগছে পলকের মুখখানা।
সেদিকে চেয়েই এবার কিছুটা জোরে শব্দ করে হেসে উঠলো সিফাত।তার হাসি দেখে পলকের রাগ হলো আবার। এই মেয়ের এই এক সমস্যা। এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের হলেও হুটহাট রেগে যায়। তার সেই রাগের প্রকাশও নিরবতায় ঘটে। খুব বেশি রাগ হলে নিজেকে আঘাত করবে সব রাগ নিজের উপরেই ঝাড়বে সে। তাই সিফাতের হাসি দেখেও এবার রাগে সে শক্তভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। দৃষ্টি টেবিলের উপর রাখা ছুরির দিকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here