#ভোরের_আলো
পর্ব-১
(ভোরের আলো আগে যারা পড়েছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি। এটা আমি নতুন করে আবার সাজিয়ে গুছিয়ে পোস্ট করছি। পুরাতনটার কথা ভুলে যান। নতুনটা পড়া শুরু করেন।)
মধ্যরাত। ঘড়িতে কয়টা বাজে? দেড়টা দুইটা বাজে হয়তো! সেদিকে খেয়াল নেই আশফাকের। বেডরুমের সাথে লাগোয়া বেলকনিটাতে রাখা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। চাঁদ নেই আকাশে। মিটমিট করে তারা জ্বলজ্বল করছে। আশফাকের চোখে দারুনভাবে শূন্যতা এবং অনুতপ্ততা ফুটে উঠছে। ইশ! অর্পিতা যদি থাকতো! আশফাকের চোখের গভীরে যদি এক মূহূর্ত্বের জন্য ডুব দিতো! তাহলে বুঝতে পারতো মানুষটা তার কর্মকান্ডে কতটা অনুতপ্ত। মেয়েটাকে ছাড়া সে কতটা একা। অর্পিতা ফের কখনো তার চোখে ডুব দিবে না সে কথা আশফাক জানে। তবুও মিথ্যে আশায় বারবার ছুটে যায় অর্পিতার কাছে। বারবার একই মিনতি করে
– এই মেয়ে, তাকাও আমার চোখে। দেখো তো কোনো ছলনা দেখতে পাও কিনা?
প্রত্যুত্তরে অর্পিতা বলে
– কারো চোখ পড়ার ক্ষমতা আমার একদম নেই। থাকলে হয়তো তোমাকে ভালোবাসতাম না।
ভুল! একটি ভুল সিদ্ধান্ত। অথবা বলা যেতে পারে বুঝার ভুল। নাহ, দুটোই হয়েছে। আশফাক ভুল বুঝেছে। এমনকি ভুল ভাঙার পরও সঠিক সিদ্ধান্ত সে নিতে পারে নি। মেয়েটা তাকে বলেছিলো,
তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব।
আজ সেই মেয়েটাই বলে
– প্রতারকের সাথে বাস করা অসম্ভব।
অসহ্য যন্ত্রণা হয় আজকাল। চারদিক অন্ধকার অন্ধকার লাগে৷ মনে হয় কেও বুঝি টেনে হিঁচড়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতর নিয়ে যাচ্ছে। টানা ১৪ বছর এই এক অসহ্য যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে তাকে। একটু আলোর খোঁজে কতখানেই না ঘুরে বেরিয়েছে। একটুখানির আলোর সন্ধান কোথাও পাওয়া যায়নি। জীবনে কম মেয়ে তো আর আসেনি। গুনে গুনে বোধহয় ১৫ টা হবে। নাহ আরো বেশি। ২০ টার উপর হবে নিশ্চিত। এই মূহূর্তে নির্দিষ্ট হিসাবটা মনে আসছে আশফাকের। কারো কাছে ঐ অনুভূতিটা পাওয়া যায়নি যা অর্পিতার মাঝে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো। মেয়েটা আসার পর মনে হতো আলো পাওয়া গেছে। বেঁচে থাকার আলো। সুখে থাকার আলো।আলোটা আসলো আবার নিভেও গেলো। আসলে আলোটা আপনা আপনি নিভে যায়নি। নিভার পিছনে তো তার নিজেরই হাত ছিলো। আজকাল আশফাক ঘুমানোর সময়ও লাইট জ্বালিয়ে রাখতে শুরু করেছে। অন্ধকার সহ্য হয়না আজকাল। বুকের মাঝে চাপ লাগে৷ অদ্ভুত রকমের ভয় হয়।
– ভাইয়া ঘুমুবে না?
রিমনের গলার শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকালো আশফাক।
– তুই ঘুমাসনি কেনো?
– ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পানি খেতে এসে দেখি তোমার রুমের লাইট জ্বলছে। দরজাটাও খোলা। তাই আসলাম দেখতে তুমি কি করো।
– ওহ্।
– আড়াইটা বাজে। ঘুমুবেনা?
– ও নিজে তো চলেই গেছে। সেই সাথে আমার ঘুম, সুখ-শান্তি সব পার্সেল করে নিয়ে গেছে।
কথাটা বলেই মুচকি হাসলো আশফাক। রিমন জানে এটা দুঃখের হাসি। ভাইকে এভাবে দেখতে ভালো লাগে না ওর। এই কয়েকদিনে বহুবার চেয়েছে অর্পিতার সাথে ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু সাহস হয় না। কোন মুখে দাঁড়াবে অর্পিতার সামনে?
আশফাকের আজকাল মরে যেতে ইচ্ছে হয়। আজকেও ডান হাতের মুঠিতে ব্লেড নিয়ে বসে আছে। প্রায় প্রতিদিনই কাজটা করে। বাম হাতের কব্জির রগটার উপর বহুবার ব্লেড রেখেও আবার সরিয়ে নিয়ে আসে আশফাক। আচ্ছা ও মরে গেলে কি অর্পিতা কাঁদবে? মেয়েটার কি আফসোস হবে ওর জন্য? মেয়েটা কি বুঝতে পারবে আশফাক সত্যিই ওকে ভালোবেসেছিলো?
কোনো এক বিকেলের ঘটনা। বন্ধুর জন্য রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করছিলো আশফাক। একসাথে ডিনার সারবে বলে। হুড়মুড় করে কোত্থেকে চারটা মেয়ে এসে ঢুকলো রেস্টুরেন্টে। হাতে একগাদা শপিং ব্যাগ। পুরো রেস্টুরেন্টে চোখ বুলিয়ে আশফাকের পাশের টেবিলটাকে খালি দেখতে পেলো ওরা। চেয়ার টেনে বসে পড়লো চারজন। মেনু কার্ড দেখছে চারজনে মিলে। কি খাবে না খাবে সেসব নিয়ে তোড়জোড় আলোচনা চলছে।
আশফাকের সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতে কৌশিক বললো,
– সরি লেট হয়ে গেলো।
– ইটস ওকে। আমি এসেছি ১০ মিনিট হয়নি এখনও।
– অর্ডার করেছিস কিছু?
– না তোর জন্য ওয়েট করছিলাম।
– সেট মেন্যু খাবি নাকি অন্য কিছু?
– চল পিৎজ্জা খাই।
– হুম খাওয়া যায়। কোনটা খাবি?
– যেকোনো একটা অর্ডার করে আয়।
কৌশিক চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো কাউন্টারের দিকে। পাশের টেবিল থেকে কথার আওয়াজ ভেসে আসছে আশফাকের কানে।
– কতদিন নাচাবি এই ছেলেকে?
– দেখি কতদিন নাচানো যায়।
– আরাফাত কিন্তু প্রচন্ড চতুর একটা ছেলে। তোর নাটক ধরতে পারছে না কেনো বুঝতে পারছি না। আর সবচেয়ে অবাক হচ্ছি তোর ছবি না দেখেই তোর জন্য পাগল হয়ে গেছে। শুধু কথা বলে একটা মেয়ে কিভাবে একজন ছেলেকে পাগল করতে পারে?
– অতকিছু জানি না। কথা ছিলো এই ছেলেকে জন্মের ঘুরানো ঘুরাবো। আমি পেরেছি। ওর পকেট থেকে টাকা কিভাবে বের করি দেখিস। প্রেমটা আরেকটু ভালোভাবে জমিয়ে নেই। এরপর শুরু করবো তামশা।
আশফাক পা থেকে মাথা পর্যন্ত মেয়েটাকে দেখলো। চোখ আটকে থাকার মতো সুন্দরী। তবে আশফাকের কাছে এমন সুন্দরী মেয়ে পান্তাভাতের মতো সহজলভ্য। এমন কত সুন্দরী মেয়ে জীবনে আসলো আর গেলো। টেবিলের নিচে রাখা শপিং ব্যাগগুলো গুনছে আশফাক। সর্বমোট ১২ টা শপিং ব্যাগ। বেশ ভালো টাকার শপিং করেছে দেখা যায়। করাটাই স্বাভাবিক৷ পয়সাওয়ালা বয়ফ্রেন্ডের তো আর অভাব নেই। বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে টাকা খসাবে আর শপিং করবে। একটু আগেই এক ছেলের কাছ থেকে টাকা বের করার কথা বললো। কোন ছেলেকে আবার ফাঁসিয়ে টাকা নিবে কে জানে? তবে প্রেম করার জন্য মেয়েটা মন্দ না। উহুম, মন্দ বললে ভুল হবে। মেয়েটাকে আশফাকের খুব পছন্দ হয়েছে৷ মেহরিনের পর আরও তিনটার সাথে প্রেম করেছিলো আশফাক। কিন্তু মেহরিনের মতো সুন্দরী না। বিগত দেড় বছর ধরে মেহরিনের মতো একটা মেয়ে খুজছিলো। এই মেয়েটা মেহরিনের মতো সুন্দর। বুঝাই যাচ্ছে টাকা ঢাললে দু সপ্তাহের মাথাতেই সম্পর্কটা বিছানা পর্যন্ত টানা যাবে। মেয়েটা উঠে অর্ডার করতে কাউন্টারের দিকে যাচ্ছিলো। ওর টেবিল থেকে অন্যজন ডেকে বললো
– অর্পিতা, আমি কোক খাবো না। আমার জন্য মিরিন্ডা আনবি।
অর্পিতা। মেয়েটার নাম জেনে গেছে আশফাক। নাম অর্পিতা। আশফাক এক দৃষ্টিতে অর্পিতাকে দেখছে। কৌশিকের নজর এড়ালোনা ব্যাপারটা। বন্ধুর স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে সে বললো
– তুই কি জীবনে মানুষ হবি না?
– আমি তো মানুষই।
– মেয়ে মানুষ দেখলেই কি পিছু নিতে হয়?
– আমি আমার কোয়ালিটির মেয়েদেরই পিছু নেই। ওরা ভালো না, আমিও ভালো না। এমন যদি হতো আমি কোনো ভালো মেয়ের দিকে নজর দেই তাহলে তুই বলতে পারতি আমি অমানুষ। মেয়েদের সাথে প্রতারনা করি। ওরা আমার টাকার মজা নেয়, আমি ওদের মজা নেই। হিসাব সমান সমান।
– ভালো লাগে না এসব। কত করে বলি বিয়ে কর। সেটেলড হ। না, তুই এসব করে বেড়াস।
– মেয়েটা সুন্দর। মেহরিনের মতো।
– অামরা অন্য কথা বলি?
– হুম বল না। মানা করেছে কে?
– অামার দিকে তাকিয়ে কথা বল।
– হুম বলছি তো। পিৎজ্জা আসতে কতক্ষণ লাগবে?
কাঁটা চামচ, ছুরি দিয়ে কেটে কেটে পিৎজ্জা খাচ্ছে আশফাক আর কৌশিক। পাশের টেবিলে টুংটাং শব্দ করে সেট মেনু খাচ্ছে অর্পিতারা। পাশের টেবিল থেকে একটা লোক কিছুক্ষণ পর পর ওর দিকে তাকাচ্ছে ব্যাপারটা আড়চোখে লক্ষ্য করছে অর্পিতা। খেতে বেশ অস্বস্তি লাগছে ওর। কিছুক্ষণ পর আশফাকের দিকে তাকিয়ে অর্পিতা বললো
– ভাইয়া আপনার জন্য কি সেট মেন্যু অর্ডার করবো?
– সরি?
– বললাম আপনি সেট মেন্যু খাবেন কিনা?
অর্পিতার এমন প্রশ্নে খানিকটা বুদ্ধি শূন্য হয়ে গেলো আশফাক। কয়েক সেকেন্ড অর্পিতার দিকে তাকিয়ে থেকে আশফাক উত্তর দিলো
– না খাবো না। এ কথা কেনো জিজ্ঞেস করলেন?
– আমি খাচ্ছি আর আপনি হা হয়ে আমার খাওয়া দেখছেন। ভাবলাম আপনার বোধহয় আমার সেট মেন্যুটা দেখে খেতে ইচ্ছে হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করলাম খাবেন কিনা। আপনি খেলে আমি অর্ডার করে দিতাম আর কি।
– ওটা খেতে ইচ্ছে হলে তো আগেই অর্ডার করতাম।
– খেতে যেহেতু ইচ্ছেই হচ্ছে না তাহলে এভাবে হা হয়ে আমার খাওয়া কেনো দেখছেন? নিজের খাবারের দিকে তাকান। আপনার জন্য আমি শান্তিমতো খেতে পারছি না।
(চলবে)
-মিম