ভোরের_আলো পর্ব-২

0
1219

#ভোরের_আলো
পর্ব-২

কৌশিক মিনমিন করে আশফাককে বলছিলো,
– মেয়ে তোর টাইপ না রে আশফাক। চোখ সরিয়ে ফেল।
– এমন ভাব দেখালো কেনো?
– ঐ যে বললাম মেয়ে তোর মত না।
– হায় রে কৌশিক! মেয়ে মানুষ আমার চেয়ে বেশি চিনিস? ছেলে ভেজে খাওয়া মেয়ে ও।
– নারে আমি তো আর তোর মতো মেয়ে মানুষ নিয়ে ঘুরি না তাই আমার জ্ঞান কম। বলতে পারিস এ ব্যাপারে আমি নবজাত শিশু।
আশফাক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের চেয়ারটা নিয়ে অর্পিতার পাশে রেখে বসলো।
– দাও দেখি, তোমার সেট মেন্যু টেস্ট করি।
কথাটা বলেই অর্পিতার হাত থেকে চামচ নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে আশফাক। অর্পিতারা বেশ অবাক হয়ে আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে।
– হুম, বেশ মজা। আমি পুরোটা খেয়ে ফেলি?
– এটা কেমন অসভ্যতা?
– তুমিই না একটু আগে জিজ্ঞেস করলে আমি খেতে চাই কিনা।
– তাই বলে আপনি আমার প্লেট থেকে খাওয়া শুরু করবেন?
– চেঁচামেচি করছো কেনো? লোকজন তাকিয়ে আছে তো।
– উঠুন আপনি এখান থেকে।
– কিছু কথা আছে। সেগুলো বলি। এরপর নাহয় উঠবো। দেখো আমি সোজাসাপ্টা কথা বলতে পছন্দ করি। তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আসলে খুব বেশিই পছন্দ হয়েছে। তোমার মত একজনকে খুঁজছিলাম অনেকদিন যাবৎ। আই থিংক তুমি আমার জন্য একদম পারফেক্ট একটা মেয়ে। এখন কথা হচ্ছে, আমি তোমার সাথে রিলেশনশিপে যেতে চাচ্ছি।
– আপনি এখান থেকে উঠবেন নাকি আমি উঠে চলে যাবো বলুন?
– হাইপার হওয়ার মতো তো আমি কিছু বলিনি। তুমি এভাবে চিৎকার কেনো করছো?
– ও হাইপার হবে না তো কি করবে? চিনেন না জানেন না এগুলো কিসব শুরু করেছেন আপনি?
– কথা আমি আর অর্পিতা বলছি। এর মাঝে আপনি কেনো আসছেন?
– আমার নাম জানেন কিভাবে?
– তোমার বান্ধবী একটু আগে ডেকে বললো না, অর্পিতা মিরিন্ডা নিয়ে আসিস।
আশপাশের লোকজন সবাই খাওয়া ফেলে বসে বসে ওদের তামশা দেখছে। কৌশিক পিজ্জা ফেলে রেস্টুরেন্টের বাহিরে চলে এসেছে। আশফাকের সাথে থেকে লোকের সামনে নিজের নাক সে কাঁটাতে চায় না। ইতিমধ্যে চেঁচামেচি শুনে রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার অর্পিতার টেবিলে চলে এসেছে।
– ম্যাম..
– এসব লোককে কিভাবে এলাউ করেন রেস্টুরেন্টে? পাব্লিক প্লেসে অসভ্যতা করছে।
– ম্যাম আসলে উনি আমাদের রেগুলার কাস্টমার।
– রেগুলার কাস্টমার মানে? কি বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি? রেগুলার কাস্টমার দেখে কি অসভ্যতামীর লাইসেন্স দিয়ে দিবেন?
– ম্যাম সেটা বলিনি। স্যরি ম্যাম। ব্যাপারটা আমরা দেখছি।
– আপনার আর দেখতে হবে না। এই তোরা উঠ। খেতে হবে না। যার যার বাসায় গিয়ে ডিনার করিস। পুরো মেজাজটাই বিগড়ে দিয়েছে। আর আপনাকে বলি, এ ধরনের কাস্টমার রেস্টুরেন্টে জায়গা দিলে দুদিনে ব্যবসা আকাশে উঠবে আপনাদের।

টেবিলের নিচ থেকে শপিং ব্যাগগুলো বের করে ওরা চারজন বেরিয়ে এলো রেস্টুরেন্ট থেকে। সেখানকার বর্তমান মূল কেন্দ্র বিন্দু হচ্ছে আশফাক। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেরা নিজেরা ওকে নিয়ে কিছু একটা বলাবলি করছে। কি আর বলবে? হয়তো বলছে ছেলেটা অসভ্য। ম্যানারলেস। রাস্তাঘাটে মেয়েদের উত্যক্ত করে। তবে অর্পিতার আচরনে পুরোপুরি অবাক আশফাক। তার ধারনার বাইরে ছিলো অর্পিতা এমন কিছু করবে। মেয়েটা এমন ঢং করলো কেনো? কি বুঝাতে চাচ্ছে? সে একদম ভদ্র মেয়ে? মেজাজ তুমুল খারাপ হয়ে গেছে। কাকে অপমান করেছে সেটা এই মেয়ে জানে না। ওকে এমন শিক্ষা দিবে যেটা ও কখনো কল্পনাও করেনি।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দৌঁড় দিলো আশফাক। এই মেয়ের পিছু নিতে হবে। কোন এলাকায় থাকে, কি করে, কার মেয়ে সব খবর নিতে হবে। মেয়ে যেমন ভাব দেখালো মনে হচ্ছে এত সহজে ধরা দিবে না। বহু কাঠখড় পোড়াতে হবে। সিঁড়ি বেয়ে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নিচে নামলো আশফাক। পার্কিং এরিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ওরা চারজন। অর্পিতা কানে ফোন লাগিয়ে রেখেছে। বোধহয় ড্রাইভার কে ফোন করছে। আশফাক দেরী না করে নিজের গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে খানিকটা সামনে গিয়ে ওয়েট করছে অর্পিতার গাড়ির পিছু নিবে বলে। ঘাড় ঘুরিয়ে গাড়ির পিছনের গ্লাস দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে আশফাক। এক গাড়িতে অর্পিতা আর ওর আরেক বান্ধবী উঠেছে। আরেক গাড়ীতে বাকি দুজন উঠেছে। আশফাকের গাড়ির পাশ কাটিয়ে অর্পিতার গাড়ি এগিয়ে চলছে। সাথে সাথে আশফাক গাড়ি স্টার্ট করে অর্পিতার পিছু নিয়েছে। অর্পিতার গাড়ি খিলগাঁওয়ে একটা একতলা বাড়ির সামনে এসে থামলো। গাড়িটা বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলো। বাহির থেকে বাড়িটাকে দেখছে আশফাক। বিশাল বড় বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেকটুক ফাঁকা জায়গা। অনেকটা বাঁলো বাড়ির মতো। বাড়ি কি এই মেয়েদের? বাড়ি দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ পয়সাওয়ালা ঘরের মেয়ে। তাহলে এসব করে বেড়ায় কেনো? ব্যাপারটা খোলাসা হওয়া দরকার। এদিকে ওর বহু পরিচিত মানুষ আছে। অতীতের পরিচিত মানুষ। এদিকটাতে ওর আসতে ইচ্ছে হয় না। কেমন যেনো ঘেন্না লাগে। অতীত মনে পড়ে যায়। মাথা ঝিমঝিম শুরু হয়। এখানে ওর পরিচিত অনেক এলাকার ছোট ভাই আছে। অর্পিতার বাড়ির একপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে মোবাইলের কন্টাক্ট লিস্ট চেক করছে আশফাক। কাকে ফোন দেয়া যায়? কাকে জিজ্ঞেস করলে একদম পাকাপোক্ত খবর নেয়া যাবে। খুঁজতে খুঁজতে সজীবের নামের উপর চোখ আটকালো আশফাকের। ডায়াল করলো সজীবের নাম্বারে।
– কেমন আছেন ভাই?
– কই তুই?
– এই তো এলাকাতেই। আড্ডা দেই। কোনো কাজ ভাই?
– হুম। তিলপাপাড়া একটা বড় একতলা বাড়ি আছে। বাংলো টাইপ।
– হ্যাঁ আছে তো।
– ঐ তো রাস্তার সঙ্গেই।
– হ্যাঁ আছে।
– বাড়িটা কার জানিস?
– ঐটা আমজাদ কাকার বাড়ি।
– উনার কি অর্পিতা নামের কোনো মেয়ে আছে?
– হ্যাঁ আছে।
– তুই সিউর তো?
– হুম সিউর।
– কি করে এই মেয়ে?
– ভার্সিটিতে পড়ে।
– কোন ভার্সিটি?
– এটা আমি ঠিক জানি না ভাই। খবর নিতে হবে। কোনো সমস্যা ভাই?
– নাহ, সমস্যা না। একটু প্রয়োজন ছিলো।
– আপনাকে ডিটেইলস আমি রাতে জানাই?
– হ্যাঁ জানা। মেয়ের পুরো ডিটেইলস আমি চাই।

টেবিলে বসে রাতের খাবার খাচ্ছে আশফাক আর রিমন। খাওয়ার মাঝেই কৌশিককে ফোন দিলো আশফাক।
– তুই না বলে চলে আসলি কেনো?
– নিজের ইজ্জত খোয়ানোর বিন্দুমাত্র শখ আমার নেই।
– নিজের সুবিধা মতো কেটে পড়লি?
– তো আর কি করতাম? তোকে না করেছিলাম ওদিক যাসনা। পাত্তা পাবি না। কথা শুনলি না। সবাইকে এক পাল্লায় কেনো মাপতে যাস আশফাক?
– এই আমার একটা ফোন এসেছে। তুই কল টা কাট।
কৌশিক কল কাটতেই সজীবের কল রিসিভ করলো আশফাক।
– হুম সজীব।
– ও ইডেনে পড়ে। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে মাস দুই হলো। ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট। তিন ভাইবোন। এক ভাই, দুই বোন। ভাই লন্ডন থাকে। নাম আবিদ। ওখানে নাকি রেস্টুরেন্ট আছে। আমজাদ কাকা আর উনার ছোট ভাইয়ের পার্টনারশিপের রেস্টুরেন্ট। ওটার দায়িত্বে আমজাদ কাকার ছেলে আর ভাই আছে। এই দেশে কাকার ব্যবসা আছে ইসলামপুরে। আর অর্পিতার যে আরেক বোন আছে সেটা ওর আপন বোন না, পালক। ওর ফুফাতো বোন। নাম মুক্তা। বছর দশেক আগে ফুফা ফুফু মারা যাওয়ার পর এই মেয়ে ওদের এখানেই থাকে৷ অর্পিতার সমবয়সী। একই জায়গায় পড়ে। ওরা সবাই ভালো মানুষ। মেয়েগুলা যথেষ্ঠ ভদ্র। ছয়বছর হলো কাকা এখানে বাড়ি করেছে৷ আর হ্যাঁ, আরেকটা কথা। অর্পিতার বেইলি রোডের দিকে নাকি কসমেটিকস শপ আছে৷ আট নয় মাস হয়েছে ব্যবসা শুরু করেছে। দুই বোন মিলে ব্যবসা সামাল দেয়।
– খবর শেষ?
– আরও খবর দরকার?
– প্রেম করে কারো সাথে?
– না ভাই। ভদ্র মেয়ে। এসবের মধ্যে নাই। কত ছেলে ঘুরঘুর করে। কাউকে পাত্তা দেয় না।
– ও ভদ্র!
– কেনো ভাই? ও কি অভদ্র? আপনি কি কিছু শুনেছেন ওর নামে?
– না। বাদ দে। শোন ওর বাসার সামনে তিন চারদিন চক্কর দে। কখন কোথায় যায় ভালোমতো খোঁজ নিয়ে আমাকে জানা।
– আচ্ছা ভাই।
ফোন রেখে মাছের কাঁটা বাছার দিকে মন দিলো আশফাক। নিজের প্লেটে ডাল নিতে নিতে রিমন জিজ্ঞেস করলো
– আবার কার পিছনে লাগছো?
– অর্পিতা।
– অর্পিতা কে?
– হবু নতুন প্রেমিকা। তুমুল প্রেম করবো মেয়েটার সাথে।
– তুমুল প্রেম করবে মানে? এবার কি তুমি সিরিয়াস?
– সিরিয়াসের চেয়েও বেশি।
– মানে?
– মেয়েটা একটা বেয়াদব। ও আমাকে আজকে অপমান করেছে। কেনো করেছে জানিস?
– কেনো?
– ওর সাথে প্রেম করতে চেয়েছিলাম।
– তারপর?
আশফাকের মুখে পুরো গল্প শোনার পর রিমন উত্তর দিলো,
– কোথাও মিসআন্ডাস্ট্যান্ডিং হচ্ছে। তুমি মেয়েকে যেমন ভাবছো মনে হয়না ও এমন৷ ওরকম হলে তো তোমার প্রস্তাবে সহজেই রাজি হয়ে যেতো। কারন বাহিরে গেলে দেখি মেয়েরাই তোমার দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। সেখানে তুমি সেধে ওর কাছে গেলে। কিন্তু ও পাত্তা দিলো না। উল্টো রাগারাগি করে চলে গেলো। তারউপর সজীব বলছে মেয়ে ভালো। ও খারাপ হলে তো এলাকার ছেলেরা জানতোই। এসব খবর আর কেও জানুক আর না জানুক এলাকার ছেলেদের কানে ঠিকই পৌঁছায়। আর আমি বলি কি….

রিমনের কথা শেষ হওয়ার আগেই বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। বাসার কাজের লোক হুমায়ুন দরজা খুললো। রাত্রি এসেছে। ঘরে ঢুকেই কাজের লোক আর রিমনের সামনে আশফাকের গলা জড়িয়ে ধরলো রাত্রি। রাত্রির হাত ছাড়িয়ে আশফাক বললো
– রুমে যাও। আলমারির মাঝের দরজায় তোমার জন্য ড্রেস রাখা আছে। ওটা পড়ে নাও। আমি আসছি।
রাত্রিকে দেখলে পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায় রিমনের। খাওয়া শেষ না করেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো রিমন। আশফাক রিমনকে আটকায়নি। সে জানে রিমনকে এখন কিছু বলা মানে ওকে এখন ইচ্ছেমতো ঝাঁড়ি খেতে হবে। হাত ধুয়ে রুমে যেয়ে ঠাস করে দরজাটা আটকে দিলো রিমন। ধীরে সুস্থে খাবার খেয়ে নিজের বেডরুমে গেলো আশফাক। রাত্রি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে৷ আশফাক পিছন থেকে এসে রাত্রিকে জড়িয়ে ধরলো।
– এই শুনো না!
– হুম
– একটা ডায়মন্ড রিং পছন্দ হয়েছে৷ কিনে দাও না।
– হুম দিবো।
(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here