ভোরের_আলো পর্ব-২৭

0
863

#ভোরের_আলো
২৭.

মাত্রই হসপিটালে এসে পৌঁছেছে মুক্তা আর নিশি। একরাশ প্রশ্ন নিয়ে আশফাকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ওরা। কোনো উত্তর নেই আশফাকের মুখে। মাথা নিচু করে বসে আছে। মুক্তা বেশ চটে যাচ্ছে আশফাকের উপর। দুশ্চিন্তা, রাগ দুটো একসাথে ভর করেছে ওর মাথায়। অবস্থা বেগতিক হয়ে যাচ্ছে দেখে মুখ খুললো কৌশিক।

– মুক্তা, আশফাক অলরেডি বিষয়টা নিয়ে প্রচন্ড আপসেট৷ ওর বউয়ের এমন অবস্থায় ওকে এসব জেরা করো না। প্লিজ। অর্পিতা একটু সুস্থ হোক এরপর নাহয় এসব নিয়ে কথা বলা যাবে।
– মামা-মামীকে কি বলবো আমি?
– সেটা তো আমিও ভাবছি।

ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বেশ ক্ষীন কন্ঠে আশফাক বললো,
– যা সত্যি তাই বলবে।
– মানে?
– বলবে অর্পিতা ওর হাজবেন্ডের সাথে ঝগড়া করে সুইসাইড এটেম্পট নিয়েছে।
– ছাগলের মত কথা বলছেন কেনো? বললেই হলো! সত্যিটা বলে দিবো! পরিস্থিতি বুঝে কথা বলুন। একে তো অর্পিতার এই হাল। এটা দেখে মামা মামী কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে সেটাই তো ভেবে কূল পাচ্ছি না। তারউপর আপনি বলছেন বিয়ের কথা জানিয়ে দিতে? এসব বলে কি এখন আগুন লাগাবো নাকি?
– আগুন লাগানোর কিছু নেই। তুমি না বলতে পারলে আমি বলবো। ঠিকাছে? ও আমার বিয়ে করা বউ। ওর পরিচয় লুকিয়ে রাখবো কেনো? খারাপ কিছু করেছি? করিনি তো। বিয়ে করেছি। গলা ফাঁটিয়ে পুরো দুনিয়ার মানুষকে জানাবো এটা আমার বউ।

একরাশ বিরক্তি আর বিস্ময় নিয়ে অাশফাকের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে মুক্তা। আপাতত আশফাককে তার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তবে অস্বাভাবিক থাকাটাই স্বাভাবিক। স্ত্রীর এমন সংকটপূর্ণ মূহূর্ত্বে কেউই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। তবে মুক্তা ভালো করেই জানে অর্পিতার সুইসাইডের পিছনে এই লোকটারই হাত আছে। নিশ্চয়ই লোকটা খুবই কড়া কথা শুনিয়েছে অর্পিতাকে। আর নয়তো এ জাতীয় কাজ করার মানুষ ও না।

রক্ত দিয়ে অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসতেই মুখোমুখি হলো মুক্তা আর রিমন। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রিমন জিজ্ঞেস করলো,

– কখন এসেছো?
– এইতো বিশমিনিট ।
– বাসায় জানিয়েছো?
– না।
– জানিয়ে দাও। অর্পিতার কন্ডিশন বিশেষ ভালো না। পাঁচ ব্যাগ রক্ত লাগছে বুঝতেই তো পারছো। যেভাবে ব্লিডিং হচ্ছিলো আমি তো ভেবেছিলাম এখানে আনতে আনতেই বুঝি শেষ হয়ে যাবে।

নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে মুক্তা। কি দরকার ছিলো এসব করার? কি এমন হয়ে গেলো যে মরতে হবে? হিসেব মেলাতে পারছে না সে।

– তোমার মামাকে কল করে আসতে বলো। কখন কি হয়ে যায় বলা তো যায়না।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আশফাক। রিমনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ডানগালে কষে চড় লাগালো।

– বেয়াদব, কথা বলার আগে বুঝে শুনে বলতে পারিস না? বাজে কথা বলার উপর পি এইচ ডি করেছিস? কখন কি হয়ে যায় মানে কি হ্যাঁ? কি হবে অর্পিতার? কিচ্ছু হবে না ওর। ও আমাকে ভালোবাসে৷ আমাকে ছেঁড়ে কোথাও যাবে না।
– ওহ্, আমি এই কথা বলেছি তাই এত গায়ে লাগছে। এত ভালোবাসা তাই না? আর তুমি……

মুক্তার পিছনে দাঁড়িয়ে রিমনকে চুপ করতে ইশারা করলো কৌশিক। কথা থামিয়ে সেখান থেকে উঠে চলে এলো রিমন।

আশফাক কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করলো,

– তোর কাছে কি মনে হয়? অর্পিতা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?

আশফাককে দেখে বেশ করুনা হচ্ছে কৌশিকের। মানুষটা সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে। সেই ছোট থেকে একসাথে দুজন বড় হয়েছে। আশফাকের চোখ পড়ার ক্ষমতাটা বেশ ভালোই আছে কৌশিকের। অর্পিতার প্রতি টান টা চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠছে।

– কৌশিক? ও কি সত্যিই আমাকে ফেলে চলে যাবে? আমি যে আবার একা হয়ে যাবো এটা কি ও জানে?
-……………..
– আমি যাই। ওকে আটকাতে হবে।

অপারেশন থিয়েটারের দরজার দিকে এগুচ্ছে আশফাক। পিছন থেকে কৌশিক তার হাত টেনে ধরে আটকালো।
– কোথায় যাচ্ছিস?
– ঐ তো রিমন না বললো ও নাকি চলে যাবে। ওকে আটকাতে হবে তো?
– কোথাও যাবে না। তুই এখানে বস।
– না, না। যদি চলে যায়? তখন? ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে তো আমি একা হয়ে যাবো।
– অর্পিতা জানে তুই একা হয়ে যাবি। যাবে না কোথাও। একটু পরই দেখবি ওকে বাইরে নিয়ে আসবে।

আশফাককে একপ্রকার জোর করে চেয়ারে বসিয়ে রেখেছে কৌশিক। আশফাককে দেখে কষ্ট পাচ্ছে মুক্তা। বিয়ে হলো সবেমাত্র ১৬ দিন। কি থেকে কি হয়ে গেলো এদের দুজনের মাঝে? অর্পিতা কি পাগল? রাগ করে নাহয় দুটো কথা শুনিয়েছে। তাই বলে কি সুইসাইড করবে? ইচ্ছে হচ্ছে চড় মেরে ও.টি. থেকে বের করে এনে বলতে,

– দেখ, তোর জন্য মানুষটা কেমন ছটফট করছে। পাগলামির একটা লিমিট থাকে অর্পিতা।

ও.টি. থেকে বেরিয়ে এলো কানন। ভাইকে দেখামাত্রই কৌশিক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

– কি অবস্থা ওর?
– চার জায়গায় কেঁটেছে। দুইটা ডিপ কাট ছিলো। ওখানকার আর্টারী কেঁটে গেছে। বাকি দুইটা অতটা ডিপ না। ব্লিডিং হয়েছে প্রচুর। আপাতত অবজারভেশনে থাকুক। ব্লাড আরও লাগতে পারে। সিচুয়েশন বুঝে এরপর বলবো।
– সেন্স আছে?
– না। বেঁচে আছে এটাই তো অনেক।
– কতক্ষণে সেন্স আসতে পারে?
– দেখা যাক কতক্ষণে আসে।

খুব মনোযোগ দিয়ে কাননের কথাগুলো শুনছিলো আশফাক। অর্পিতা বেঁচে আছে শুনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।

কৌশিককে ইশারা দিয়ে আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলো মুক্তা।

– কৌশিক ভাই, মামা মামীকে কি বলবো?
– ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। মেয়ের এমন অবস্থা বাবা মাকে না জানালে কিভাবে কি? আবার জানালেও বিপদ। কিজন্য এই কাজ করেছে সেটার উত্তর জিজ্ঞেস করবে তোমার কাছে৷
– কিজন্য এমন করেছে আপনি জানেন?
– নাহ্। এসব আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
– মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। উনাদের কি উত্তর দিবো আমি? তাছাড়া আশফাক ভাইয়ের যেই অবস্থা দেখছি মনে হচ্ছে না উনাকে এখান থেকে সরানো যাবো। উনার কথা এখনই কিভাবে মামা মামীকে বলবো?
– ওকে নিয়ে ভেবো না। আশফাককে আমি এখান থেকে সরিয়ে নিবো। তুমি এক কাজ করো, উনাদেরকে ওর কথা জানাও। যা হওয়ার হবে। পরেরটা পরে দেখা যাবে। সময়মতো না জানালে আরো ঝামেলায় পড়ে যাবে তুমি।

পার্স থেকে ফোনটা বের করে অর্পিতার বাবা মায়ের নাম্বারে ডায়াল করলো মুক্তা।

একটু একটু করে জ্ঞান ফিরছে অর্পিতার। কানে আশপাশের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু চোখ মেলে তাকানোর জোরটা পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেনো কিছু একটার উপর ভাসছে সে। অপরিচিত দুটো মহিলা কন্ঠ কানে ভেসে আসছে। সেই সাথে পরিচিত একটা কন্ঠ। অতি পরিচিত।

– ভালোবাসি অর্পিতা।

চোখ বন্ধ রেখেই বিড়বিড় করছে অর্পিতা,
– ভালোবাসো না,,,,,,

আমি জানি,,,,

বিশ্বাস করেছিলাম,,,,,,

পাপ করেছি,,,,,

অর্পিতার বিড়বিড় শব্দে কাছে এগিয়ে এলো নার্স। ওর জ্ঞান ফিরছে দেখে বেরিয়ে এলো অবজারভেশন রুম থেকে। ডক্টর কাননকে খবরটা দিতে হবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here