ভোরের_আলো পর্ব-২৮

0
1084

#ভোরের_আলো
২৮.

লাল শাড়ী পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্পিতা। শাড়ীটা গতকাল আশফাক কিনে দিয়েছে বিয়ে উপলক্ষ্যে। সঙ্গে আছে গোল্ড জুয়েলারী। চেইনের মতন পাতলা গড়নের একটা হার, ছোট্ট একজোড়া ঝুমকা আর একটা নাকফুল। সকাল সকাল গোসল সেড়ে শাড়ীটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। শাড়ীর প্রতিটা সুতোয় যেনো ভালোবাসা মেখে আছে। গতরাত থেকেই অস্থিরতা কাজ করছিলো৷ ভালো লাগার অস্থিরতা। আজকের সকালটাও অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে। একটা নতুনত্ব আছে। শুধু সকাল না, সবকিছুই আজ নতুন লাগছে। একদম নতুন। অদ্ভূত রকমের সুন্দর। বিয়ের দিন বোধহয় সবকিছুই দেখতে ভালো লাগে। কি জানি? আগে তো বিয়ে শাদী হয়নি৷ এবারই তো প্রথম। আপন মনেই হেসে উঠলো অর্পিতা। পর্দা সরিয়ে জানালা খুলে দাঁড়াতেই একরাশ ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগলো। সেইসাথে কারও গায়ের উষ্ণতার অভাব। এই মূহূর্ত্বে প্রিয় মানুষটার ভালোবাসামাখা একটু উষ্ণতা পেলে মন্দ হতো না।

– নয়টা বাজে। রেডি হচ্ছিস না কেনো?

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলো মুক্তা নীল রঙের একটা শাড়ী পড়ে সাজুগুজু করে একদম রেডি।

– বাহ্! তোকে তো বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে। খুব সুন্দর করে সেজেছিস।
– আমার বোনের বিয়ে। আমি সাজবো না?
– আব্বু-আম্মুর জন্য খারাপ লাগছে।
– আমারও। উনাদের জানিয়ে বিয়েটা করলে কত ভালো হতো!
– তবে এর মাঝে একটা মজাও আছে। ভেবে দেখ তো! লুকিয়ে বিয়ে করছি। বিশাল এ্যাডভেঞ্চারের ব্যাপার। দু’বার বিয়ে হবে আমার। একবার লুকিয়ে আরেকবার সবাইকে নিয়ে। বিয়ে নিয়ে কোনো আফসোসই থাকবে না। লুকিয়ে বিয়ে করার মজাটাও পাচ্ছি আবার সবাইকে নিয়ে বিয়ে করাটাও।
– ভালোবাসা বড্ড অদ্ভুত জিনিস। মূহূর্ত্বে চিরচেনা মানুষটাকে বদলে ফেলে। এই যে দেখ, তোর কথাই বলি। মাথা ঠান্ডা রেখে বহু বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ তুই। জীবনের ছোটখাটো সিদ্ধান্তগুলোও তোকে অনেক ভেবে-চিন্তে নিতে দেখেছি। আর সেখানে বিয়ের মত সিদ্ধান্তটা তুই দশ মিনিটের মধ্যে নিয়ে নিলি। তাও আবার ফ্যামিলিকে না জানিয়ে কাজটা করছিস। তোকে আজকাল যত দেখি তত অবাক হই।
– আমিও অবাক হই জানিস। মানুষটার মাঝে কি আছে আমি জানি না। ও যখন ওর ভরাট কন্ঠে আমাকে ডাক দেয় তখন আমি আর নিজের মধ্যে থাকি না। ভালো মন্দ বিচার করার ক্ষমতাটুকু আমার মাঝে থাকে না। মানুষটার মাঝে মোহ আছে জানিস। যতবার ওর ঐ কন্ঠ শুনি, ওর সামনে যেয়ে দাঁড়াই ততবার গভীর মোহে ডুবে যাই। ওর সাথে কাঁটানো প্রতিটা মূহূর্ত্বে মনে হয় আমি ওর মাঝে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছি। একবারের জন্যও মনে হয়না ওর মাঝে ডুব দিয়ে কোনো ভুল করছি। ইচ্ছে হয় আরো ডুবে যাই। ওর মাঝে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাই।

অর্পিতার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না মুক্তা। মুচকি হাসি দিয়ে কথার প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,

– কাজলটা আরেকটু গাড়ো করে লাগা। ভালো লাগবে।
– জুয়েলারীগুলো কি করবো?
– এখন পড়িস না। মামী দেখলে তো বুঝে যাবে এগুলো গোল্ডের। ঝামেলায় পড়ে যাবো। ব্যাগে নিয়ে নে। বাসায় ঢুকার আগে পড়ে নিস।
– তোরা কি বিয়ের পর চলে যাবি?
– হুম। আমরা থেকে কি করবো? তোরা তোদের মতো টাইম স্পেন্ড করবি। আজকে সারাদিন শুধু তোদের।
– হুম। শুধু আমাদের৷ একান্তই আমাদের।

-ঢাকার খিলগাঁও নিবাসী আমজাদ হোসেনের কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা হোসেন অর্পিতার সহিত ঢাকার শান্তিনগর নিবাসী এরশাদ আহমেদের কনিষ্ঠ পুত্র আশফাক আহমেদের পাঁচলক্ষ্য একটাকা দেনমোহরে বিবাহ ধার্য্য করা হইয়াছে।
বলেন মা আলহামদুলিল্লাহ।
– আলহামদুলিল্লাহ।

-ঢাকার খিলগাঁও নিবাসী আমজাদ হোসেনের কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা হোসেন অর্পিতার সহিত ঢাকার শান্তিনগর নিবাসী এরশাদ আহমেদের কনিষ্ঠ পুত্র আশফাক আহমেদের পাঁচলক্ষ্য একটাকা দেনমোহরে বিবাহ ধার্য্য করা হইয়াছে।
বলেন বাবা আলহামদুলিল্লাহ।

– আলহামদুলিল্লাহ।

চোখের সামনে বিয়ের দিনের প্রতিটা স্মৃতি ছুটোছুটি করছে অর্পিতার। কানের কাছে কারও শান্ত কন্ঠে কল্পনায় ছেঁদ পড়লো অর্পিতার।

– অর্পিতা, শুনতে পাচ্ছো? তাকাও তো দেখি একটু?

মাথা খানিকটা নাড়ালো অর্পিতা। কানে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। অপরিচিত একটা পুরুষ কন্ঠ। চোখ একদমই মেলতে পারছে না। মাথা বরাবর সাদা লাইটটা চোখটা মেলতে দিচ্ছে না। কোনোমতে খানিকটা চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেলতে হচ্ছে। চোখের কোনাগুলো যেনো ছিটকে যাচ্ছে।

পাশে দাঁড়ানো লোকটা চোখগুলো টেনে খুলে দেখছে। বোধহয় ডাক্তার হবে।

– অর্পিতা, হাতে কি বেশি পেইন হচ্ছে?

অজানা কোনো কারনবশত হাতে কোনো ধরনের ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না অর্পিতার। যত যন্ত্রণা সব হচ্ছে মাথায়। বুকের উপর কেও বোধহয় পাথরচাপা দিয়ে রেখেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব। অর্পিতা খুব ঘনঘন নিঃশ্বাস নিচ্ছে। খেয়াল করলো কানন।

অর্পিতার গালে হালকা ধাক্কা দিয়ে কানন জিজ্ঞেস করলো

– অর্পিতা শুনতে পাচ্ছো? তোমার কি পেইন হচ্ছে?

ক্ষীন কন্ঠে উত্তর দিলো অর্পিতা,

– না।
– নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?
– হুম।
– চোখ মেলতে অসুবিধা হচ্ছে?
– আমি পাপ করেছি,,,,
মুখটা বাবা মা কে দেখাতে পারবো না,,,,,
ও,,,, ও প্রতারনা করেছে,,,,,
আমাকে মেরে ফেলবেন প্লিজ,,,,,,,

অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসেছে কানন। আশফাকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

– আশফাক সমস্যা কি বেশ বড়সড়?
-………….
– ওর জ্ঞান ফিরেছে?
– হ্যাঁ ফিরেছে। তবে চোখটা মেলতে পারছে না আরকি। এমনিতে সব শুনতে পাচ্ছে। কথা বলছে। মেন্টালি ডিস্টার্বড আছে খুব। বিড়বিড় করছে। পাপ করেছে। ওকে মেরে ফেলতে বলছে। সমস্যা কি কৌশিক?
– আমি এখনো পুরোটা জানি না।
– আমি কি একটু ওকে দেখে আসতে পারি?
– হুম,,,,, হুম যাও। ঘুমের মেডিসিন দিয়ে এসেছি। ঘুমিয়ে গেছে বোধহয় অলরেডি। তবু তুমি চাইলে দেখে আসতে পারো।

চেয়ার ছেড়ে অবজারভেশন রুমে গেলো আশফাক। অর্পিতার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা বিড়বিড় করছে অর্পিতা। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। মুখ ফুটে কিছু বলার নূন্যতম সাহসটুকু তার হচ্ছে না। অর্পিতার কপালে হাত রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

আশফাকের স্পর্শ পেতেই থেমে গেলো অর্পিতা। স্পর্শটা ওর অতি পরিচিত। আলাদা একটা উষ্ণতা আছে এই স্পর্শে। প্রিয় একটা ঘ্রান ভেসে আসছে নাকে। ঘ্রানটা ওর আপন। অতি আপন।

– তুমি এসেছো?
-…………..
– নাকি আমার ভ্রম?
-…………..
– ভ্রমই হয়তো! ভালো তো বাসো না। অন্য কারো সাথে মিলেমিশে একাকার হতে ব্যস্ত তুমি। ভ্রম,,,, শুধুমাত্র ভ্রম। তুমি এখানে নেই আমি জানি,,,,,,

ভুলতে চাই,,,,,,
তোমাকে ভুলতে চাই,,,,,,
কেনো আসছো আমাকে বারবার আমাকে জ্বালাতে,,,,,,

কপালে উষ্ণ পানির স্পর্শ পাচ্ছে অর্পিতা। পানিগুলো কপাল বেয়ে কান অব্দি পৌঁছুচ্ছে।

– তুমি কি কাঁদছো,,,,,
নাহ্,,,,,,,
তুমি আমার ভ্রম,,,,,
তুমি নেই এখানে,,,,,,
ভুলতে চাই,,,,,,,,

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here