ভোরের_আলো পর্ব-৪৬

0
928

#ভোরের_আলো
৪৬.

পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে। গতকাল সকালে পুরো বাড়ীতে লাইট লাগানো হয়েছে। আর আজ ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে৷ গতকাল থেকেই মেহমান আসতে শুরু করেছে বাসায়। সবাই অসম্ভব খুশী। কেউ সত্যিকারের খুশি কেউবা লোক দেখানো খুশী৷ আত্মীয়গুলো খুশী হলেও পিছনে কানাঘুষো ঠিক চালিয়ে যাচ্ছে এই বাড়ীর হবু জামাইকে নিয়ে। আলোচনার মূখ্য বিষয় দুটি। প্রথমত, জামাইর তো অনেক বড়৷ দ্বিতীয়ত, ছেলের টাকা পয়সা তো আমজাদ ভাইয়ের মত না৷ পরিবারেও নাকি কেও নেই টেই৷ অর্পিতাকে তো আরো ভালো জায়গায় বিয়ে দেয়া যেতো। তাহলে এখানে কেনো?

অর্পিতার মা-চাচী আড়াল থেকে সব কথা শুনেও মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন৷ সেইসাথে পাখি তো আছেই কে কোথায় কোন কথা বলছে সেগুলো মনোযোগ সহকারে শুনে চাচীদের কাছে লাগানোর জন্য। তারমতে সে এই গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনাগুলো চাচীদ্বয়ের কাছে বলে বিশ্বস্ততার প্রমান দিচ্ছে। দিবে নাইবা কেনো? সেই ছোটকাল থেকে এই বাড়িতে থেকেছে, এই বাড়ির লোকজন তাকে পরিবারের সদস্যই মেনে এসেছে। নিজের পরিবার সম্পর্কে এমন সমালোচনা মোটেই বরদাস্ত করবে না সে৷
রান্নাঘরে কাজ করছেন লিপি আর মিনু। সেইসাথে গ্রাম থেকে আরো দুজন কাজের মানুষ আনানো হয়েছে। তারা বাড়ীর অন্যান্য কাজের দায়িত্ব নিয়েছে। আর রান্নাঘরের দায়িত্বে আছে মিনু, লিপি আর পাখি। রান্নাঘরে দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে। মাত্রই অর্পিতার মেজো মামী আর ছোট খালার মধ্যবর্তী সমালোচনা শুনে এসেছে পাখি। চেহারার ভাঁজে তার বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। রান্নাঘরে এসে চোখ মুখ কুঁচকে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পাতিল ঘষে পরিষ্কার করছে সে। কচকচ শব্দ হচ্ছে প্রচুর। মিনু ভ্রুঁ কুঁচকে পাখির উদ্দেশ্য বললেন,
– পাতিলের সাথে কুস্তি করছিস কেনো। আস্তে ঘষ।
– সমস্যা হইছে কি জানেন চাচী? বাসার মেহমান গুলারে ডলতে পারতাছি না৷ তাই পাতিল ডইলা মনরে সান্ত্বনা দিতাছি।
– আবার কে কি বললো?
– মেজো আর ছোট খালা বলতাছে অর্পি আপায় বোধহয় ফাঁইসা গিয়া বিয়া করতাছে। আর নয়তো প্রেমের বিয়াতে এমন মুখ বেজার কইরা ঘুরতাছে কেন? আরো বলছে, আজকে গায়ে হলুদ আপা এখন পর্যন্ত পার্লারে গিয়া ফেসিয়াল আরো হাবিজাবি কইরা আসে নাই কেন? ছোট ফুপুর গুতা খাইয়া আজকে কেন করাইতে গেলো? হিসাবে তো আপার নাকি সবার আগে পার্লারে গিয়া এসব করার কথা ছিলো।

মিনু আর লিপি একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে। বেশ হতাশ ভঙ্গিতে লিপি মাথাটা নিচু করে বললেন,

– বুঝলি মিনু, আমার বাপের বাড়ীর লোকগুলো না জন্মের খারাপ। এত নাটক করছি সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর। তবু কোনো না কোনো ফাঁক দিয়ে এরা দোষ বের করছেই।
– শুধু আপনার বাবার বাড়ির কথা বলছেন কেনো? শ্বশুড়বাড়ির লোকগুলো কি কম নাকি? এখানে আসার পর থেকে ননদ ননাশরাও কম সমালোচনা করলো না আশফাককে নিয়ে।

বেডরুমের খাটে বসে উদাসভঙ্গীতে বসে আছেন আমজাদ সাহেব। পাশেই খাতাকলম নিয়ে এখন পর্যন্ত বিয়ে বাবদ কত টাকা খরচ হয়েছে সে হিসেব করছে শাহীন। ক্যালকুলেটরে খরচগুলো যোগ করতে করতে শাহীন জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা আশফাকের বাবা এমন অবিচার করলো কেনো ছেলেটার সাথে?
– প্রথম তরফের বউ আর সন্তানদের পাল্লায় পড়ে এমন করেছে।
– কি অদ্ভুত বিবেক মানুষের! কি প্রয়োজন ছিলো দ্বিতীয় বিয়ে করার? আর প্রয়োজনটাই কি ছিলো এই ছেলেটার সাথে এমন অবিচার করার?
– জানিনাহ্।

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আমজাদ সাহেব। অলস ভঙ্গিতে ফোনটা হাতে নিয়ে কবির সাহেবকে ফোন করলেন তিনি।

– হ্যালো,,,,
– কেমন আছেন ভাই?
– খুবই ভালো। ছেলের বিয়ে, ভালো তো থাকবোই।
– আচ্ছা। তো ভাই আটটা নাগাদ কিন্তু আপনারা এখানে উপস্থিত থাকবেন৷ আপনি আর ভাবী অর্পিকে হলুদ লাগিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করবেন।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা চলে আসবো।
– ইয়ে, আশফাককেও নিয়ে আসবেন সাথে করে।
– আশফাক! ওকে কেনো? ওর বউয়ের গায়ে হলুদে ও এসে কি করবে?
– কি হবে আসলে? সবাই এখানে আনন্দ করবে। শুধুশুধু ও বাসায় বসে থাকবে কেনো?
– আচ্ছা দেখি।
– ঠিকাছে, রাখছি তাহলে। সময়মতো চলে আসবেন।
– জ্বি আসবো।

ফোনটা বালিশের পাশে রেখে আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
– হিসাব হয়েছে তোর?
– আর বলো না। এই নিয়ে দুইবার ভুল করলাম।
– ঠান্ডা মাথায় হিসাব কর।
– একটা কথা বলি?
– বল।
– চিন্তা করো না। আশফাক ছেলেটাকে আমি দুইদিন দেখেছি তো৷ কথা আর চালচলনে যা বুঝলাম ছেলে বেশ বুদ্ধিমান। তবে বেয়াদব বা মানুষ হিসেবে খারাপ না। হ্যাঁ মানছি ওর একটা দিক খারাপ আছে৷ তবে মনে হয়না এমন কাজ ও আর করবে। ঐ তো বুঝোনা এক বয়সে ছেলেরা এমন ভুলভাল কাজ করে ফেলে। লন্ডনে এমন কত লোকদেরই দেখি দেশে বউ ফেলে বিদেশ বাড়ি পড়ে থাকে। আরেক মেয়েদের সাথে কুকাজ করে বেড়ায়। অথচ বউ জানেও না। এখন ওর ব্যাপারটা সামনাসামনি হয়ে গেছে বিধায় ওকে আমরা খারাপ ভাবছি বা ওর হাতে মেয়েকে তুলে দিচ্ছো সেই চিন্তায় তুমি শেষ হয়ে যাচ্ছো। একটু পজিটিভলি যদি আমরা ভাবি তাহলে বিয়েটাকে আমরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবো৷ আশফাককে আমরা স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারবো৷ আর যদি নেগেটিভলি নেই তাহলে ইহজনমে আমাদের ওর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাবে না। ও হাজার ভালো হয়ে গেলেও মনের মধ্যে খচখচ লেগেই থাকবে। যেহেতু ভাই সমাজের দশটা লোকের সামনে মেয়ে বিয়ে দিয়ে বাড়ির জামাই হিসেবে ওকে আমরা গ্রহন করছি সেক্ষেত্রে ওর প্রতি আর নেগেটিভ ধারনা বা ও না শুধরালে অর্পিতার কি হবে সেসব নিয়ে ভাবাটা আমাদের উচিত হচ্ছে না। এভাবে মন কালো রেখে বিয়ে দেয়ার দরকার কি? বিয়ে দিলে খুশি মনে দাও আর যদি ভয় বা দুশ্চিন্তা কাজ করে তাহলে মেয়ে দিও না।
– দুশ্চিন্তা কে করতে চায় বল? চাই না দুশ্চিন্তা করতে৷ তবু চলে আসে।
– ঠান্ডা মাথায় আমার কথা ভেবে দেখো।
– হ্যাঁ, তা তো বুঝতেই পারছি। তবু অর্পিতা ওর সাথে কিভাবে এক ছাদের নিচে বাস করবে ভাবতেই কষ্ট লাগে।
– ছেলে মানিয়ে নিবে৷ তুমি দেখেছো ও আমাদের মেয়ের দিকে কিভাবে তাকিয়ে থাকে? আমি খেয়াল করেছি অর্পিতা কড়া কথা বললেও ছেলের চেহারায় বিন্দুমাত্র বিরক্তি বা রাগ আসে না। ও মাথা নিচু করে অর্পিতার কথা শুনে। কখনো বা হাসতে হাসতে কথার প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলে। ও কি করেছে সেই অপরাধবোধ ওর মাঝে আছে৷ টেনশন নিও না৷ মাস দুয়েক যাক। দেখবে সব ঠিক।

বাড়ির পেছনের উঠোনে বড় আমগাছটাকে কেন্দ্র করে স্টেজ সাজানো হচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে অনুষ্ঠান হবে এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আবিদ৷ পুরো উঠোনে মাথার উপর রঙীন কাগজ আর মরিচা বাতি দিয়ে সাজানো হবে। টেবিল চেয়ারগুলো সাজানো হচ্ছে রঙীন কাপড় দিয়ে। চতুর্দিকের গাছগুলোতে গাঁদাফুল আর বিভিন্ন রঙের মরিচাবাতি পেঁচানো হয়েছে৷ বাহির থেকে লোক আনিয়ে কাজ করানো হচ্ছে৷ বেশ দূরে রাতের অনুষ্ঠানের জন্য বোরহানী আর কাচ্চি বিরিয়ানি তৈরীর প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এদিককার পুরো তদারকীর দায়িত্ব নিয়েছে তিনভাই মিলে। পশ্চিম দিকের বড় জামগাছটার নিচে চেয়ার নিয়ে বসে আছে ওরা তিনজন। আংটি পড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে একটা অভিযোগও করতে শোনা যায়নি আবিদকে। এ ব্যাপারে মোটামুটি অবাক সায়েম। বিশেষ করে আজকে আবিদকে দেখে আরো বেশি অবাক হচ্ছে। হাসিখুশী ভাবে নিঁখুত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে আবিদ। তারমাঝে বিন্দুমাত্র রাগ বা বিরক্তি দেখা যাচ্ছে না৷ গত কয়েকদিনে সায়পম কয়েকদফা ভেবেছিলো আবিদকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে। কোনো না কোনো কারনে জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠেনি। আজ সুযোগ পেয়ে আবিদকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,

– ঘটনা কি বলো তো? তুমি কি সুন্দর হাসিখুশী কাজ করে যাচ্ছো। মনে হচ্ছে তোমার পছন্দ করা পাত্রের সাথে বোনকে বিয়ে দিচ্ছো।
– এছাড়া আর কি করার আছে বল? ভাই হিসেবে যতটুকু দায়িত্ব আমার পালন করার কথা ছিলো ততটা আমি করেছি। বাবার সাথে ঝগড়া করেছি। বাবা আমার কথা শুনলো না। বাবার উপর দিয়ে তো আর বিয়ে আমি আটকাতে পারবো না। অর্পিতাকে বললাম চল তোকে নিয়ে পালিয়ে যাই৷ অর্পিতাও রাজি হলো না। ও বাবার কথাই শুনবে। তাহলে এখানে আমি কি করতে পারি? সবাই বিয়েতে রাজি।বিয়ে যেহেতু হচ্ছেই ভালোভাবেই বোনের বিয়ে এনজয় করি৷ বাবা সেদিন আমাকে বাহিরে ডেকে নিয়ে অনেক কিছু বললো। শুনে মনে হচ্ছিলো এই বিয়েতে সবাই রাজি, মাঝখান থেকে যত ঝামেলা আছে সব আমি করছি। তবে বাবা ঐদিন আরো অনেক কথাই বলেছে আশফাক ভাইকে নিয়ে। মানে পজিটিভ সাইডগুলো আমাকে দেখালো আরকি। কথাগুলো অযৌক্তিকও ছিলো না। তবে মনকে বুঝাতে পারছি না। কিন্তু বুঝানোর তোড়জোড় চেষ্টা করছি। আশা করি বুঝে যাবো।

পার্লারে বসে আছে মুক্তা আর অর্পিতা। ফেসিয়াল করা শেষে এখন বসে আছে পেডিকিওর করাবে বলে। চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে অর্পিতা। রাতুলের সাথে ফোনে কথা বলছিলো মুক্তা। অর্পিতা হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দৌঁড়ে ওয়াশরুমের দিকে গেলো। অর্পিতার দৌঁড় দেখে বেশ চমকে গেলো মুক্তা। কলটা কেটে দিয়ে সেও ওয়াশরুমে গেলো। গিয়ে দেখলো বেসিনে গড়গড় করে অর্পিতা বমি করছে। অর্পিতার মাথা চেপে ধরে বললো,
– বারবার বলছি যা হওয়ার হবে। এভাবে টেনশন করে অসুখ তৈরী করিস না।
বমি করা শেষে মাথায়, চোখেমুখে পানির ছিটা দিয়ে ভিতরে সোফায় হেলান দিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলো সে।

কনের ডালা সাজাচ্ছে কৌশিক আর শিফা। অর্পিতাদের মত এই বাড়িতে কোনো মেহমান নেই। বাসার ভিতরকার পরিস্থিতি বেশ সাদামাটা৷ নিজেরা নিজেরা যতটা আনন্দ করা সম্ভব ঠিক ততটুক আনন্দই চলছে। আজ অর্পিতার গায়ে হলুদ। কাল আশফাকের৷ আগামীকালের অনুষ্ঠানে এই পক্ষের তেমন একটা লোক নেই। আশফাকের আর রিমনের বন্ধু-বান্ধব, ওদের বিল্ডিংয়ের কিছু প্রতিবেশী আর কৌশিকদের একদম কাছের কিছু আত্মীয়। এইতো,,,,। বেশীরভাগ মানুষ আসবে অর্পিতার বাড়ি থেকেই।

রুমে বসে নিজের ব্যবসায়ের কিছু কাজ ল্যাপটপে শেষ করে নিলো আশফাক। সকালের পর থেকে অর্পিতাকে একটা কলও করা হয়নি। মেয়েটার সাথে একটু কথা বলা দরকার। ল্যাপটপের পাশে থাকা ফোনটা নিয়ে ডায়াল করলো অর্পিতার নাম্বারে। ওপাশ থেকে ক্লান্ত কন্ঠে অর্পিতা রিসিভ করলো,
– হ্যালো,,,,
– ঘুমাচ্ছো নাকি?
– না, পার্লারে।
– তাহলে কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেনো?
– এমনি।
– মিথ্যা কেনো বলছো?
– কোনো মিথ্যুকের মুখে এমন প্রশ্ন মানায় না।
– হুম বুঝলাম। এখন বলো কি হয়েছে?
– কিছু না৷ পার্লারে বসে থাকতে থাকতে টায়ার্ড হয়ে গেছি। এজন্য কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে।
– সাজার জন্য গিয়েছো?
– হুম।
– আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেলে না কেনো?
– আব্বু দিয়েছে।
– তোমার খরচ চালানোর দায়িত্ব আমার৷ তোমার আব্বুর কাছ থেকে নেয়াটা খারাপ অর্পিতা।
– তোমার টাকা তোমার কাছেই রাখো। মেয়েরা তো আর এমনি এমনি তোমার সাথে শুয়ে পড়বে না৷ টাকা খরচ করবে গিফট কিনে দিবে এরপর তোমার সাথে বিছানায় যাবে৷ টাকাগুলো ওদের জন্য তুলে রাখো।
– নাহ্, আগে আমার বউ। এরপর অন্য মেয়ে। তোমার পিছনে টাকা খরচ করার পর যদি অবশিষ্ট কিছু থাকে তাহলে ওদের পিছনে খরচ করবো। ঠিকাছে?
-……………
– কেনো এক কথা বারবার বলো অর্পিতা? ভালোবাসি তোমাকে। তুমি ছাড়া অন্য আর কার কাছে যাবো আমি?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here