ভোরের_আলো পর্ব-৪৭

0
1006

#ভোরের_আলো
৪৭.

পুরো ঘর সাজানো। পারফিউমড ক্যান্ডেল, গোলাপ আর রজনীগন্ধার মিষ্টি ঘ্রানে পুরো ঘর ছড়িয়ে পড়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে আশফাক। মিষ্টি ঘ্রান আর সিগারেটের গুমোট গন্ধে অদ্ভুত ঘ্রান তৈরী হয়েছে। আয়নার সামনে বসে গহনাগুলো এক এক করে খুলছে অর্পিতা৷ ঘ্রানটা কি তার কাছে ভালো লাগছে নাকি মন্দ লাগছে সেটা বুঝে পাচ্ছে না সে। আপাতত যে অনুভূতিটা স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে সেটা হলো দগদগে ক্ষতে লবন ছিটিয়ে দেয়ার অনুভূতি। এই সাজানো ঘর, ফুল সবকিছু ওর ক্ষতগুলোকে যেনো তীব্র থেকে তীব্রতর করে দিচ্ছে। সেদিন এই ঘরটাতে, ঠিক এই আয়নার কাছেই তো ওরা অন্তরঙ্গে নিজেদের কামনা মিটাচ্ছিলো। ভাবতে ভাবতে বারবার চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে অর্পিতার৷ সেইসাথে চোখের কোনে পানি৷

গহনা আর চুলের খোপাটা খুলে ওয়াশরুমে চলে গেলো অর্পিতা। ঝর্না ছেড়ে দিয়ে শাওয়ারের নিচে বসে রইলো। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে সে। এমন শীতের মাঝেও এইরাতে ঠান্ডা পানির নিচে বসে আছে অর্পিতা৷ তিল পরিমাণ ঠান্ডা অনুভব হচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে যেনো পুরো শরীরে জ্বালা পোঁড়া হচ্ছে। হীম শীতল পানিতেও যন্ত্রণা কমছে না৷

এই রুম সেই রুম পায়চারী করছে আশফাক৷ পুরো বাসা ফাঁকা৷ রিমন হুমায়ূন আছে কৌশিকদের বাসায়। প্রথমে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো অর্পিতাকে ঐ বাসাতে উঠানো হবে। পরে আবার কি ভেবে কবির সাহেব সিদ্ধান্তের পরিবর্তন করলেন। এই বাসায় ওদের বাসর ঘর সাজিয়ে এখানে পাঠিয়ে দিলেন দুজনকে৷ কৌশিক, রিমন আর শিফা এসে এই বাসায় দিয়ে গেছে ওদেরকে৷ কৌশিক বেরিয়ে যাওয়ার আগে আশফাককে আলাদা ডেকে বলে গিয়েছে,
– বউ অবশেষে পেয়েছিস। জোর করে নাহয় বউ ঘরে আনা গেছে৷ জোর করে ভাই সংসার করতে পারবি না। বউয়ের ভালোবাসাটাও পাবি না। যদি ওকে আগের মত ফিরে পেতে চাস তো অধৈর্য্য হবি না একদম৷ তোকে অনুভব করার মত সময় ওকে দে। তোর প্রতি বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনার সময়টুকু দে।

প্রায় ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে অর্পিতা ওয়াশরুমে গিয়েছে৷ এখন অব্দি বের হওয়ার কোনো নাম গন্ধ নেই। মাঝে দুইবার ডেকেছে আশফাক। ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসেনি। এবার বেশ অধৈর্য্য হয়ে গেছে সে। শীতের মধ্যে এতক্ষণ ধরে গোসল করার কি হলো? অর্পিতার নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ভ্রুঁ জোঁড়া কুঁচকে ওয়াশরুমের দরজার দিকে এগুতেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো অর্পিতা। পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর৷ ঠান্ডায় মুখের রঙ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। ওয়াশরুমের দিকে নজর পড়তেই আশফাক টের পেলো অর্পিতা ঠান্ডা পানিতে গোসল করে এসেছে। চাহনীতে একরাশ বিস্ময় ঢেলে অর্পিতার হাত গাল ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
– তুমি এতক্ষণ ঠান্ডা পানিতে গোসল করেছো?

নিরুত্তর অর্পিতা নিজেকে আশফাকের স্পর্শ থেকে ছাঁড়িয়ে অন্যরুমে চলে গেলো। ফ্যানের সুইচ অন করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। শরীর এখনো কাঁপছে অর্পিতার। ওর পিছু পিছু আশফাকও চলে এসেছে এই রুমে। ফ্যান ছেড়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে আশফাকের বিস্ময় আরও কয়েক ধাপ উপরে উঠে এলো। ফ্যানের সুইচ অফ করে অর্পিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
– পাগল হয়ে গেছো? শীতে কাঁপছো তুমি৷ আবার ফ্যান ছেড়েছো কেন?
খুব ঠান্ডা গলায় অর্পিতা জবাব দিলো,
– ভালো লাগছে তাই।
অর্পিতার গায়ে খুব দ্রুত একটা কম্বল টেনে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে ছুটলো আশফাক৷ কিছুক্ষণ বাদে একবাটি কুসুম গরম সরিষার তেল হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে এলো। এসে দেখলো অর্পিতা শরীর থেকে কম্বল সরিয়ে আবার ফ্যানটা ছেড়ে শুয়ে আছে। বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে ফ্যানটা অফ করে অর্পিতার কাছে গিয়ে বসলো সে। অর্পিতার হাতে পায়ে গরম তেল মালিশ করবে সে। পায়ের উপর থেকে প্লাজোটা সামান্য উপরে উঠাতেই শোয়া থেকে হুড়মুড় করে উঠে গেলো অর্পিতা। চিৎকার করে বলতে লাগলো,
– কাপড় উপরে উঠাচ্ছো কেনো? বাসর রাতের শখ জেগেছে মনে?
– তেল মালিশ করার জন্য কাপড়টা সামান্য উপরে তুলেছি।
– বলেছি আমি তেল মালিশ করতে?
– এমন শীতের মধ্যে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করেছো। এখন তেলটাও দিতে দিবে না। জ্বর বাঁধাবা নাকি?
– হ্যাঁ, বাঁধাবো। তোমার কি? যাও, বের হও এখান থেকে।
– অর্পিতা, কথা শুনো। তেলটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। গরম থাকতে লাগিয়ে দেই। আরাম লাগবে।
– আমার অস্বস্তি লাগছে। প্লিজ এসব তেল টেল লাগাবো না।
– কেমন অস্বস্তি লাগছে বলো আমাকে?
– দম আটকে আসছে আমার। মনে হচ্ছে শরীরের ভেতর আগুন জ্বলছে। তুমি প্লিজ এখান থেকে বের হও। ভালো লাগছে না আমার।
– আচ্ছা যাও আমি তেল মালিশ করবো না৷ এটা গেস্ট রুম। এখানে থাকার দরকার নেই। চলো, আমাদের রুমে চলো।
– নাহ, ঐটা আমার রুম না৷ ঐটা তোমার আর ঐ মেয়েটার রুম৷ ঐ যে মেয়েটার সাথে নোংরামী করছিলে তার কথা বলছি।
– ঐটা তোমার রুম অর্পিতা। অন্য কারো না।
– আমি যাবো না ঐ ঘরে৷ আমি এখানেই থাকবো।

গলা ধরে আসছে অর্পিতার৷ চোখে পানি ছলছল করছে৷ এতক্ষণ ধরে অর্পিতা কোন আগুনের কথা বলছে সেটা আন্দাজ করতে পারছে আশফাক। মাথাটা নিচু করে অর্পিতাকে বললো,

– ঠিকাছে থাকতে হবেনা ওখানে। আমি কালকে এইরুমের জন্য নতুন ফার্নিচার আনিয়ে নিবো। ঐরুমে তোমাকে যেতেও হবে না৷ যা লাগবে আমাকে বলো। আমি ওখান থেকে এনে দিবো। ঠিকাছে?
– নতুন ফার্নিচার কিনে এনে বা ঐরুমে যেতে হবে না এসব বলে কি বুঝাতে চাও? আমার কষ্টগুলো ঘুচাতে চাও?
– হ্যাঁ, চাই।
– ঐ ঘর কোনো দোষ করেনি৷ সবচেয়ে বড় অন্যায় তো করেছো তুমি। এখন কি তোমাকে বাদ দেয়া উচিত না?
– তোমার এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার জানা নেই অর্পিতা। তবে এতটুকু বলতে পারি আমি বদলে গেছি৷ ভালোবাসি তোমাকে। নিজের চেয়েও বেশি। এখন তুমি বিশ্বাস করো আর না করো। যতটুকু পারি তোমাকে সুখে রাখার চেষ্টা করবো৷ জানি ঐ ঘটনাটা কখনো ভুলতে পারবে না। তবে ভালোবাসার আড়ালে কষ্টটা লুকানোর চেষ্টা করবো যতটা সম্ভব৷ তুমি আমাকে শুধু একটা সুযোগ দাও অর্পিতা। আমি আর কিছু চাই না তোমার কাছে।
– আশফাক?
– হুম?
– আমি যদি এমন কিছু করতাম তাহলে কি তুমি আমাকে সুযোগ দিতে?
– হয়তোবা…
– কখনোই দিতে না। কবেই আমাকে ফেলে চলে যেতে৷ অথচ দেখো নিজের বেলায় ষোলোআনাটা ঠিকই আদায় করে নিচ্ছো।
– তোমার মতো করে তো কেও কখনো আমাকে ভালোবাসেনি। তোমাকে যেতে দিতাম কিভাবে বলো তো?
– নাহ্, আমার ভালোবাসায় বোধহয় কোনো ঘাটতি রয়ে গিয়েছিলো। তাইতো অন্য কারো শরীরের ঘ্রান আমার ভালোবাসার চেয়ে আরো বেশি প্রিয় মনে হয়েছে তোমার কাছে।
– ঘাটতি তোমার ভালোবাসায় না আমার অনুভূতিতে ছিলো। ভালোবাসাটা ঠিক অনুভব করতে পারিনি। এত ভালোবাসা পেয়ে তো আমি অভ্যস্ত না৷ এতটা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা আমার আছে বলে আমার জানাও ছিলো না৷ বুঝতে পারিনি৷ ভেবেছিলাম আমার ভ্রম আর নয়তো তোমার প্রতারণা।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো অর্পিতা। রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দার চেয়ারে যেয়ে বসলো। নীরবে চোখের পানি ফেলছে। চারদিন ধরে কষ্টগুলো গলা অব্দি আটকে ছিলো। একফোঁটা চোখের পানি ফালানোর মত অবস্থা ছিলো না বাসায়৷ ঘর ভর্তি লোকজন। এমনিতেই হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ কাঁদতে দেখলে হয়তোবা সন্দেহমাখানো প্রশ্নগুলো আরেকটু জোড়ালো হতো৷ চারদিন ধরে হাসিমুখে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে গেছে সে। এবার একটু চিৎকার করে কাঁদা দরকার। ক্রমশ কন্ঠস্বর বেড়ে চলছে। সেইসাথে আগুনে পোঁড়ার যন্ত্রনাটা ক্রমশ কমছে। দুহাতে মুখ গুঁজে চিৎকার করে কাঁদছে অর্পিতা৷ পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আশফাক৷ ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার। অপরাধবোধটা সীমানা ছাড়িয়ে প্রচন্ড পীঁড়া দিচ্ছে। চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে তার। অর্পিতাকে একটাবার বুকে জড়িয়ে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,
– ভালোবাসি তোমাকে৷ কোনোদিন ভালোবাসায় তিল পরিমাণ ঘাটতি পাবে না৷ সবটা উজাড় করবো ভালোবাসবো। অতীতটা ভুলে শুধু একটাবার আমাকে আবার আঁকড়ে ধরো।

কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলছে অর্পিতা,
– কেনো করলে এমন? কেনো এতবড় কষ্টটা দিলে আমাকে? কি ক্ষতি করেছিলাম তোমার আমাকে এভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিলে? উত্তর আছে কোনো আশফাক? উত্তর?
-……………..
– শেষ হয়ে যাচ্ছি আমি৷ ভেতরটা তোমাকে একবার দেখাতে পারতাম তাহলে হয়তো বুঝতে কতটা কষ্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এরচেয়ে মরে যাওয়া ভালো।

নিজেকে আরমসামলে রাখতে পারছেনা আশফাক। হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো অর্পিতার মুখোমুখি। ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here