#ভোরের_আলো
৪৯.
ওড়নার আঁচল একবার আঙুলে পেঁচাচ্ছে, আবার খুলছে। বিগত পনেরো মিনিট যাবৎ এই কাজটাই করছে অর্পিতা। গতকাল কৌশিকের মা বলে যাওয়ার পর আজ সকালে টেস্ট করিয়েছে সে৷ রেজাল্ট পজিটিভ। খবরটা জানার পর থেকে নানান ধরণের বাজে চিন্তা মাথায় ঘুরছে। সেইসাথে আশফাক আর রাত্রির নগ্ন দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠছে। সমস্ত চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আশফাকের অংশটুকু এই পৃথিবীতে আনতে চায় না সে। দুনিয়াতে আরেকটা কুলাঙ্গার আনার নূন্যতম সাধ তার নেই। এই সন্তান একদিন বড় হয়ে আশফাকের মতই হবে৷ এরপর হয়তো আবারো কোনো মেয়ের জীবনটা নষ্ট করবে যেমনটা আশফাক করেছে। তারপর সেই মেয়েটাও বাঁচা মরার মাঝামাঝি অবস্থায় দাঁড়াবে ঠিক অর্পিতারই মতন।
নাহ্,,, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়া যাবে না৷ পুনরাবৃত্তি হওয়ার আগেই শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে।
গতরাতে ঘুমায়নি আশফাক। বৌভাত শেষ হতে হতে রাত সাড়ে বারোটা বেজেছে। বাসায় ফিরে সারাটারাত পুরো ঘরময় পায়চারী করেছে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে সকাল হওয়ার। ঘন্টাখানেক আগে অর্পিতা সাফ কন্ঠে জানিয়ে গেলো রেজাল্ট নেগেটিভ। মূহুর্তেই সমস্ত আশাগুলো নিঁখোজ হয়ে গেলো। গতকাল থেকেই সম্পর্কটাকে নতুন করে সাজানোর মজবুত একটা সুতার আশায় ছিলো আশফাক। ভেবেছিলো ছোট্ট হাতজোড়া বোধহয় ওদের দুজনের হাত আবার এক করে ছাড়বে। রেজাল্ট নেগেটিভ শোনার পর থেকে আশফাকের মনে হচ্ছে ওর মাথায় কেও ক্রমাগত হাতুড়ি পেটা করছে৷ অজানা কোনো কারণবশত কথাটা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না৷ অর্পিতাকে তীব্র সন্দেহ হচ্ছে। সেই কখন থেকে অর্পিতাকে আড়াল থেকে লক্ষ্য করছে আশফাক। কিছু একটা নিয়ে অর্পিতা ভীষন চিন্তিত। সেইসাথে চেহারায় ক্ষোভটাও ভেসে উঠছে। হিসেবটা ঠিক কষতে পারছে না আশফাক। অর্পিতা কি মিথ্যা কথা বলছে? ও কি চাচ্ছে না বাচ্চাটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক রাখতে? ও কি বাচ্চা নিয়ে কোথাও চলে যাওয়ার প্ল্যান করছে? হতেও তো পারে। অসম্ভব কিছুই না৷ কলিজায় মোচড় কাটলো আশফাকের৷ সত্যিটা খোঁজা দরকার। ছুটে ওয়াশরুমে গেলো স্ট্রিপটা খুঁজতে। ওয়াশরুমের আনাচে কানাচে খুঁজে কিছুই পেলো না সে। রান্নাঘরে ময়লার বাক্সেও খুঁজেছে। সেখানেও কিছু ছিলো না৷ তারমানে অর্পিতা এটা কোথাও লুকিয়েছে এ ব্যাপারে আশফাক মোটামুটি নিশ্চিত৷ সন্দেহ খানিকটা গাড়ো হচ্ছে আশফাকের। মনে মনে হাজারো চিন্তা করতে করতে বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ালো আশফাক। ক্ষীন কন্ঠে অর্পিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
– ইয়ে,,,, অর্পি,,,,, স্ট্রিপটা কোথায়?
প্রশ্ন শোনা মাত্রই চমকে গেলো অর্পিতা। বেশ বিরক্ত ভঙ্গিতে আশফাককে বললো,
– ফেলে দিয়েছি।
– কোথায়?
– তুমি ওটা দিয়ে কি করবে?
– নাহ, তুমি ভুলভাল দেখলে কিনা তাই আমি আবার দেখতে চাচ্ছি আরকি।
– ভুলভাল দেখবো কেনো?
– হতেও তো পারে তাই না?
– ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না জিজ্ঞেস করে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেই তো পারো আমি মিথ্যা বলছি কি না?
– তুমি রেগে যাচ্ছো কেনো? আমি কি একবারও বলেছি তুমি মিথ্যা বলছো?
– তোমার কথার ধরনে তো তাই বুঝা যাচ্ছে।
– তুমি ভুল বুঝছো। তেমন কিছুই না৷ আমি জাস্ট একটু সিউর হওয়ার জন্য দেখতে চাচ্ছি আরকি। ওয়াশরুমে খুঁজলাম, বাস্কেটে খুঁজলাম। কোথাও পেলাম না। বলো না কোথায় ফেলেছো?
ভ্রুঁ কুঁচকে আশফাকের দিকে তাকিয়ে আছে অর্পিতা। ময়লার ঝুড়িটাসহ খুঁজে এসেছে! এত বাড়াবাড়ির আদৌ কোনো মানে আছে কি? কড়া কন্ঠে আশফাককে উত্তর দিলো,
– স্ট্রিপ ভেঙে কমোডে ফ্ল্যাশ করে দিয়েছি। এখন যাও ড্রেন থেকে খুঁজে বের করো।
– ফ্ল্যাশ করার কি দরকার ছিলো?
– আমার খুশি।
গম্ভীর মুখে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো আশফাক। সিগারেট খাওয়ার নেশা চেপেছে খুব৷ ঘরে একটা সিগারেটও নেই৷ বাসার বাহিরে বেরিয়ে এসেছে সিগারেট কিনবে বলে।
আশফাক বেরিয়ে আসা মাত্রই মুক্তাকে ফোন করলো অর্পিতা৷ প্রথমবার রিং হতে হতে কলটা কেটে গেলো। এরপরেরবার রিং হওয়ার সাথে সাথে কলটা রিসিভ করলো মুক্তা। বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে অর্পিতা বললো,
– কোথায় ছিলি?
– ডাইনিংরুমে ছিলাম রে।
– শোন, তোকে নিয়ে একটু হসপিটাল যাবো।
– কখন?
– এখনই।
– কেনো?
– আগে আয়। এরপর বলছি।
– আচ্ছা আমি কি তোর ওখানে আসবো?
– না৷ আমি এসে তোকে বাসার সামনে থেকে পিক করবো। তুই জলদি রেডি হ। আর শোন বাসায় কাওকে কিছু বলার দরকার নেই।
– কোনো সমস্যা অর্পি?
– না।
– তাহলে?
– বললাম তো, আগে আয় এরপর বলবো।
ড্রইংরুমে বসে সিগারেট ফুঁকছে আশফাক। আশফাকের সামনে দিয়েই বেরিয়ে আসছিলো অর্পিতা। পিছন থেকে ডাকলো আশফাক,
– কোথায় যাচ্ছো?
কোনো উত্তর না দিয়েই খুব দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এলো অর্পিতা। আজকাল অর্পিতার আচরনে বড্ড দিশেহারা লাগে আশফাকের। কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে সবকিছু?
– তুই ঐ হসপিটালে যাবি কেনো? আমি যতটুক জানি ওটার মান অতটাও ভালো না। কার কি হয়েছে সেটাই তো বললি না। কে অসুস্থ?
– মুক্তা, আমি প্রেগন্যান্ট। ওখানে যাচ্ছি এ্যাবরশন করাতে।
গাড়িতে পাশাপাশি বসে আছে দুইবোন। অর্পিতা অসম্ভব রকমে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে দিলো। বিস্ময়ের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে মুক্তা। অর্পিতার দিকে চোখজোড়া গোল করে তাকিয়ে আছে সে।
– এটা কি বললি অর্পি?
-………….
– তুই এ্যাবরশন কেনো করাবি?
– আরেকটা কুলাঙ্গার জন্ম দিতে বলছিস?
– কুলাঙ্গার কেনো জন্ম নিবে?
– ঐটা আশফাকের সন্তান।
– তোর সন্তান না?
– না।
– কি বলিস এগুলো?
-…………….
– হুঁশ করে কথা বল অর্পিতা৷ নিজের সন্তানকে তুই কিভাবে মেরে ফেলতে চাচ্ছিস?
– আমি এ ব্যাপারে কোনো কথা শুনতে চাইনা।
– মানে কি এসবের? বিবেক বুদ্ধি সব কি মরে গেছে তোর?
– একদম নীতিকথা শোনাবি না।
– তো কি করবো শুনি? যখন যা খুশি করে যাচ্ছিস। ইচ্ছে হলো হুট করে বিয়ে করলি। আনন্দ ফূর্তি করে প্রেগন্যান্ট হয়েছিস। এখন চাচ্ছিস বাচ্চাটাকে শেষ করতে? আর কত ভুল সিদ্ধান্ত নিবি তুই? বাচ্চার দোষ কোথায় সেটা বল? তুই খোঁজ না নিয়ে বিয়ে করেছিস, ঐ লোক তোকে ঠকালো। এখানে বাচ্চার দোষ কি? কান্ড করবি তোরা আর ভুগবে নিষ্পাপ বাচ্চাটা?
– এই তুই গাড়ী থেকে নাম।
– কেনো? উচিত কথা ভালো লাগছে না তাই না?
– মুক্তা, আমার হাতে থাপ্পড় খাওয়ার আগে গাড়ী থেকে নাম তুই।
– অর্পি, শোন একটু ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর। এটা তোরও সন্তান৷ তোর অংশ৷ এভাবে তুই ওকে মেরে ফেলতে পারিস না৷
তুমুল বাক বিতন্ডা চলছে দুইবোনের মাঝে৷ তর্কের কোনো এক ফাঁকে আশফাককে মেসেজ পাঠিয়েছে মুক্তা।
টুংটাং শব্দে মেসেজ এসে পৌঁছেছে আশফাকের ফোনে৷ মেসেজ পড়া মাত্রই কোনোমতে ঘর থেকে গাড়ীর চাবিটা নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুটলো আশফাক।
(চলবে)