ভোরের_আলো পর্ব-৫০

0
891

#ভোরের_আলো
৫০.

বাহিরে বসে অপেক্ষা করছে অর্পিতা। ভেতরে একজন আছে। তারপরই অর্পিতার সিরিয়াল৷ পাশেই বসে আছে মুক্তা৷ হসপিটালে ঢুকার আগে আশফাককে কল করেছিলো সে৷ আশফাক বলেছিলো অর্ধেক রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছেছে৷ অথচ এখনও এখানে এসে পৌঁছায়নি। বারবার হসপিটালের সিঁড়ির দিকে তাকাচ্ছে মুক্তা। মনে মনে প্রচুর অস্থির হয়ে আছে সে। অর্পিতাকে এতক্ষণ বলেও কোনো লাভ হলো না৷ আশফাকও পৌঁছাচ্ছে না৷ সে আসতে আসতে না আবার,,,,,,,, আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না মুক্তার৷ অর্পিতার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা কাজ করছে। কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সে! যখন যা খুশি করে যাচ্ছে। নিজেই তো খুশিমনে আশফাককে বিয়ে করেছে। এমন তো না যে আশফাক জোর করে ওকে বিয়ে করেছে বা রেইপ করেছে। সবকিছু হয়েছে অর্পিতার সম্মতিক্রমে। তাহলে কেনো সন্তানটাকে এতটা অবহেলা করছে ও? কি দোষ বাচ্চাটার? অর্পিতার পাশে আর বসে থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না মুক্তার। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেলো আশফাক খুব দ্রুত পায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মুক্তা। অর্পিতার সামনে এসে আশফাক দাঁড়াতেই একরাশ বিস্ময় নিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো অর্পিতা। মুক্তার দিকে তাকিয়ে বললো,

– কে খবর দিয়েছে ওকে? তুই?
– আমিই দিয়েছি।
– কেনো?
– কারন এবার তুই অন্যায় করছিস।

অর্পিতার এক হাত শক্ত করে ধরলো আশফাক। বললো,
– বাসায় চলো।
– যাবো না আমি।

চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে আশফাকের। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

– ভদ্রভাবে বলছি, বাসায় চলো।
শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে অর্পিতা বললো,

– যদি না যাই কি করবে তুমি? হুম?

অর্পিতার ডান হাতের বাহু ধরে টানতে টানতে হসপিটালের বাহিরে নিয়ে আসছে আশফাক। অর্পিতাও আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছে নিজেকে ছাড়ানোর। কিন্তু পারছে না। উপস্থিত লোকজন দাঁড়িয়ে ওদের ধস্তাধস্তি দেখছে। সেইসাথে কিছু একটা কানাঘুষাও করছে। অর্পিতাকে টেনে হিঁচড়ে বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলো না আশফাক। সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। শেষমেষ উপায়ন্তর না দেখে অর্পিতাকে কোলে তুলে নিলো সে।

ফ্লোরে কাঁচের টুকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে৷ বেডরুমে খাটের উপর বসে আছে অর্পিতা৷ মাত্রই শান্ত হয়ে বসেছে সে। মাথাটা আপাতত ঘুরাচ্ছে খুব। এতক্ষণ ইচ্ছামতো ঘরে ভাংচুর করেছে সে। সেইসাথে আশফাককে মুখে যা এসেছে তাই বলে গেছে। চিৎকার চেঁচামেচি আর ভাংচুরের পর এতক্ষণে শান্ত হয়েছে সে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।
অর্পিতার পা ধরে বসে আছে আশফাক। অর্পিতাকে নিয়ে বহুকষ্টে ড্রাইভ করে বাসায় ফিরেছে সে। ওর জন্য ড্রাইভ করাই যাচ্ছিলো না৷ দুবার এক্সিডেন্ট হয়েও হয়নি। শেষমেশ বাসার সামনে এসে লিফটে উঠতে চাচ্ছিলোনা অর্পিতা। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি আশফাক। কি যেনো মাথায় চেপে বসলো! অর্পিতার সাথে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে ডানগালে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো সে। চিৎকার করে বলতে লাগলো,

– কখন থেকে বুঝাচ্ছি এমন কিছু করো না যেটাতে তোমার গায়ে কোনোধরনের প্রেশার পড়ে! কথা কানে যায় না কেনো? আমার বাচ্চার ক্ষতি হবে এই সহজ কথা মাথায় যায় না?

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অর্পিতাও সমানতালে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,

– কুলাঙ্গার কি জগতে কম মনে হচ্ছে? তোর মত ইবলিশ আরেকটা দুনিয়াতে আনতে চাস? কি হবে তোর বাচ্চার? মরে যাবে আমি উল্টাপাল্টা কিছু করলে? মরুক। আমি চাই তোর বাচ্চা মরুক৷ দরকার পড়লে নিজে মরে গিয়ে এরপর তোর বাচ্চার অস্তিত্ব দুনিয়া থেকে মিটাবো।

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই সেখান থেকে দৌঁড়ে বাহিরে আসতে চাচ্ছিলো অর্পিতা৷ কয়েক পা দৌড়ে এগুতেই আশফাক আবার টেনে হিঁচড়ে ওকে তিনতলা পর্যন্ত বহুকষ্টে লিফটে করে উপরে এনেছে। বাসায় ঢুকেই হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ফ্লোরে ছুঁড়ে মেরেছে অর্পিতা। সেইসাথে আশফাকের দেয়া ধোঁকার স্মৃতিগুলো চিৎকার করে একের পর এক স্মরণ করে গেছে৷ অর্পিতার পিছন পিছন ঘুরঘুর করে বহুবার বুঝানোর চেষ্টা করেছে আশফাক৷ তাকে শেষ একবার সুযোগ দেয়ার মিনতি করেছে বারবার৷ সেসব কিছু কানে তুলেনি অর্পিতা৷ সে তার নিজের মত ভাংচুর করেই গেছে। এই মূহুর্তে আশফাক তার পা ধরে ফ্লোরে বসে আছে এটা নিয়েও বিরক্তির সীমা নেই অর্পিতার৷ দুবার পা ছাড়াতে চেয়েছে সে। পারেনি। আপাতত খরচ করার মত নূন্যতম শক্তি নেই গায়ে। দেয়ালে পিঠ এলিয়ে দিয়ে বিরক্তভরা কন্ঠে আশফাককে বললো,
– তুমি আমার পা ধরে কি বুঝাতে চাচ্ছো?
– ভুল হয়ে গেছে অর্পি। আমার শাস্তি বাচ্চাটাকে দিও না।
– তো কাকে দিবো? তোমার শাস্তি তো আমি তোমাকেও দিতে পারছি না৷ অন্যায় করলে তুমি, অথচ শাস্তি পাচ্ছি আমি। তুমি তো ভালোই আছো৷ যখন যা চাচ্ছো তাই পাচ্ছো। অন্যায় করেও সবকিছু তোমার ইচ্ছেমতোই আছি৷ আমি? আমি তো কারো সাথে অন্যায় করিনি৷ অথচ তুমি যেভাবে যা খুশি আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো৷ আমাকে সেটা মেনেও নিতে হচ্ছে। কেনো আশফাক? কিসের শাস্তি পাচ্ছি আমি বলো তো? আমার অন্যায়টা কি ছিলো?
– কে শাস্তি দিচ্ছে তোমাকে?
– কে শাস্তি দিচ্ছে! আসলে কথাটা কি জানো? ওরকম বাজে অবস্থায় তুমি আমাকে দেখোনি। যদি দেখতে তাহলে হয়তো তুমি বুঝতে ধোঁকার পরিমানটা কতবড় ছিলো আর যে এতবড় ধোঁকা দিয়েছে তারই সাথে নিজের বাবা মা যখন একই ছাদের নিচে বাস করার জন্য ছেড়ে দেয়। খুব সহজে তো বলে দিলে শাস্তি কে দিচ্ছে তোমাকে। তুমি তো আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই৷ থাকলে এই প্রশ্ন কখনোই করতে না। তোমাকে দেখলো আমার দম বন্ধ হয়ে আসে৷ ইচ্ছে হয় মরে যাই। একটা ভুল করেছিলাম, তোমাকে ভালোবেসে। সেটার শাস্তি মরণের আগ পর্যন্ত আমাকে ভোগ করতে হবে৷ আর তুমি যে অন্যায়টা করলে তার কোনো শাস্তি নেই৷ তোমার কোনো শাস্তি নেই।
– তুমিও আমার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই অর্পিতা। থাকলে হয়তো এই কথাটা বলতে পারতে না যে আমি আমার শাস্তি পাচ্ছি না। আমার চেয়ে বেশি শাস্তি পাচ্ছো তুমি? নিঃস্ব হওয়া কাকে বলে বুঝো তুমি? ধারনা আছে তোমার? আমার সব হারিয়ে তোমাকে পেয়েছি৷ কতগুলো বছর পর সুখের অনুভূতিগুলো আমার কাছে ধরা দিয়েছিলো৷ একটু স্বস্তির জায়গা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম৷ নিজ দোষে সুখগুলো হারিয়েছি। আমি আমার যোগ্যতার চেয়ে বেশি ভালোবাসা পেয়েছিলাম। ভালোবাসাটা তখন ঠিক মূূল্যায়ন করতে পারিনি৷ এখন যখন মূল্যায়ন করতে পারছি ভালোবাসা আমার কাছ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে চলে গিয়েছে। তোমাকে আমি জোর করে আমার ঘরে এনেছিই যা৷ ভালোবাসা কি আমি পাচ্ছি? কতটা মিসবিহেভ তুমি আমার সাথে করে যাচ্ছো? কিভাবে আমি তোমার ইগনোরেন্স মিসবিহেভ সহ্য করছি সেসব নিয়ে কোনো আন্দাজ আছে তোমার? তোমার এতটা ভালোবাসা পাওয়ার পর এখন তোমার ঘৃণা কিভাবে সহ্য করছি সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেও জানে না। কাওকে আমি বুঝাতেও পারবো না৷ তুমি তো আগে আমার চেহারা দেখলেই বুঝে ফেলতে আমার মন ভালো না খারাপ। সেই তুমি এখন আমার কষ্টের পরিমাণ আন্দাজ করতে পারো না। সারাদিন ভালোবাসি বলে বলে আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলতে আর এখন আমার ছায়াও তোমার সহ্য হয়না। তুমি আমার সাথে থেকেও নেই অর্পিতা৷ তোমার আগের স্মৃতিগুলো আমাকে শেষ করে দিচ্ছে৷ ফের কখনো তুমি আমাকে আগের মত ভালোবাসবে কিনা তাও আমি জানিনা। এত ভালোবাসা পেয়ে হারিয়ে ফেলার কষ্ট তো কখনো পাওনি। পেলে হয়তো আমাকে এই কথাগুলো বলতে না৷ জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি আমি। সব মেনেও নিয়েছি৷ কিন্তু তোমাকে হারানোটা আমি মানতে পারছি না। আসলে এসব কথা তোমাকে এই মূহুর্তে বলে কোনো লাভ নেই। তুমি আমাকে আজকাল একদম বিশ্বাস করো না৷ বলে লাভ কি বলো? আমি কিসের মধ্যে আছি সেসব তুমি কখনোই বিশ্বাস করবে না। বাদ দেই সেসব কথা,,,,,।

নিচের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশফাক। নির্লিপ্ত অর্পিতা৷ কোনোপ্রকার ভাবান্তর তারমাঝে দেখা যাচ্ছে না৷ ফ্লোর থেকে উঠে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো আশফাক। সিগারেট ফুঁকছে সে। পা থেকে রক্ত বের হচ্ছে তার৷ সাদা টাইলসটা একটু একটু করে লাল হয়ে যাচ্ছে৷ পায়ে কাঁচ ঢুকেছে অনেক আগেই৷ সেদিক কোনো প্রকার খেয়াল নেই। আপাতত নিজের সন্তানের ভাবনাটা প্রচন্ড ভোগাচ্ছে ওকে। অর্পিতাকে কতক্ষণ সামলে রাখা যাবে এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা সে পাচ্ছে না৷ তার অন্যায়ের শাস্তি অর্পিতা পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে সে। এখন বোধহয় বাচ্চাটাকেও শাস্তি ভোগ করতে হবে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here