#ভোরের_আলো
৫৭.
-আসলে কোত্থেকে শুরু করবো বুঝে পাচ্ছি না।
– যেখান থেকে খুশি।
– আম্মুকে দিয়েই শুরু করি?
– করো।
– উনার সাথে স্মৃতিগুলো আমার তেমন মনে নেই৷ তেমন বলতে শুধু দুটো স্মৃতি মনে আছে৷ একতলা একটা বাসা থেকে আম্মু আমাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসছিলো। আমার মামার হাতে দুইটা বড় লাগেজ ছিলো৷ কুমিল্লার বাসা ছিলো ওটা। আর আরেকটা হচ্ছে আম্মু আমাকে একবার ছাদ থেকে ফেলতে চেয়েছিলো। ফেলেনি৷ সেখান থেকে আমাকে সরিয়ে ছাদে দাঁড় করিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলো৷ তারপর রেলিংয়ে চড়ে…….
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আশফাক। চোয়াল বেশ শক্ত হয়ে আসছে। গম্ভীর কন্ঠে অর্পিতাকে বললো,
– জীবনের প্রথম ধোঁকা আমার মা আমাকে দিয়েছিলো। মায়েরা সন্তানকে বুকে আগলে রাখে। উনি আমাকে রাখেননি। মাঝসমুদ্রে ভাসিয়ে চলে গেলো।
– উনার জায়গায় দাঁড়িয়ে ভেবে দেখো তো? তোমার বাবা যা করেছেন একজন মানুষের সুইসাইড পর্যন্ত যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।
– হ্যাঁ সুইসাইড করার জন্য যথেষ্ট ছিলো যদি আমি উনার জীবনে না থাকতাম। আমি তো ছিলাম তাই না? তুমি জানো আমার মায়ের মুখটা পর্যন্ত স্পষ্ট খেয়ালে আসে না। এবার বুঝে নাও কতটা ছোট ছিলাম। নিজের হাতে আমি খেতে পারতাম না, গোসল করতে পারতাম না। একা ঘুমাতে ভয় পেতাম। দিন দুনিয়ার কিচ্ছু চিনতাম না একমাত্র মা ছাড়া। সেই মা আমাকে ফেলে চলে গেলো। কোন যুক্তিতে অর্পিতা? সেসময় মা আমাকে সাথে নিয়ে কেনো মরেনি?
– তুমি উনার সন্তান। যে হাত দিয়ে তোমাকে কোলে নিয়েছে, যত্ন করে বড় করেছে সেই হাত দিয়ে তোমাকে কি করে মারতে পারতো? প্রতিটা মা চায় তার সন্তান বহুবছর বেঁচে থাকুক।
– আমি কি বেঁচে ছিলাম? বা এখন কি আছি?
– আচ্ছা বুঝলাম তোমার মা খুব অন্যায় করেছে। এখন বলো পানি খাবে ? পানি দিবো তোমাকে?
– উহুম।
– তারপর বলো।
– সে তো মরে গিয়েই মুক্তি। আমার মামার বাড়ির লোক আমাকে আপন করে নেয়নি। আমি নাকি কুকুরের রক্তের৷ আমাকে কুকুরের রক্তের কেনো বলেছিলো ওরা? আমি তো ওদের কোনো ক্ষতি করিনি৷ তবু কেনো আমার প্রতি এত ঘৃনা? দোষ করেছিলো আমার বাবা। সেই অন্যায়ের ফসল ছিলাম আমি৷ এটাই আমার দোষ। আমি তো বাবাকে বলিনি আমার মায়ের সাথে এতবড় অন্যায়টা করতে৷ তবু কেনো আমাকে দোষী বানালো৷ অকারনে আমাকে শাস্তি দিলো? ওরা জানতো আমার বাবার বাসায় আমাকে পাঠালে আমাকে তিলেতিলে শেষ করবে৷ তবুও আমাকে সেখানে পাঠিয়েছে। কোনোদিন একটা খোঁজ নিয়ে দেখেনি আশফাক কি হালে আছে। মরে গেছে নাকি বেঁচে আছে? একটা মানুষই তো আমি ছিলাম৷ এক পেট পালা কি খুব বড় কিছু? উনারা তো গরীব ছিলেন না৷ আমি যতদূর জানি আমার মা বড় প্রভাবশালী পরিবারের ছিলো৷ আমাকে কি একটু উনারা কাছে রেখে ভালোবাসা দিতে পারতো না? বা ভালোভাবে বেঁচে থাকার একটা সুযোগ? আমি তো উনাদের মেয়েরও অংশ ছিলাম। শুধুই কি এরশাদ সাহেবেরই অংশ ছিলাম?যে বয়সে ভালো মন্দ বিচার করারই ক্ষমতাটুকু আমার হয়নি সে বয়সে উনারা আমাকে কুকুর বলে দিলো। যে আসলে কুকুরের মত কাজ করেছে তাকে তো একটা শাস্তি দিতে পারলো না। আমি দুর্বল ছিলাম তাই আমাকেই পিষে মারতে হলো?
আশফাকের চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। কন্ঠস্বরে রাগ স্পষ্ট। আশফাকের চোখের পানির কারনটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না অর্পিতা। এটা কি রাগের কান্না নাকি কষ্টের?
– আমার বাবার ঘরভর্তি খাবার ছিলো। অথচ আমি খেতে পেতাম না৷ নিজের হাতে খাওয়া তখনো আমি শিখিনি। বাবা বেশিরভাগ সময় বাহিরে থাকতো৷ বাসায় ছিলো আরো তিনজন। উনার প্রথম স্ত্রী আর ঐ পক্ষের দুই ছেলে। কেও কোনোদিন আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেখেনি৷ খাওয়াবে কি? গালি দিয়েই তো কূল পেতো না। আমার জন্য তিনবেলা খাবার বরাদ্দ ছিলো। তাও একদম মেপে রাখা খাবার। খেতে বসলে ঘর নোংরা করতাম। খাবার মুখে তুলতে হাত থেকে অর্ধেক খাবার পড়ে যেতো ফ্লোরে বা টেবিলে। খাবার পড়তে দেরী আমাকে মারতে দেরী নেই৷ মারতো আর বলতো,
– তোর মা একটা নোংরা মহিলা ছিলো। আমার সংসারে আগুন ধরিয়েছে। জন্ম দিয়েছে একটা নোংরাকে৷ এটাকে এখন আমার বাড়ি পাঠিয়েছে আমার সাজানো ঘরটা নোংরা করতে।
খাওয়ার সময় যদি তোমাকে কেও মারে তোমার গলা দিয়ে কি খাবার নামবে?
এতটুকু শুনেই রাগে কানবন্ধ হয়ে আসছে অর্পিতার। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এখনই ধৈর্য্যহারা হলে চলবে না। পুরো গল্পটা তাকে ধৈর্য্য নিয়ে শুনতে হবে। তবে চেহারা স্বাভাবিক রাখলেও কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে কথা বলাটা আপাতত বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। এখন কোনো ধরনের কথাই বলতে চাচ্ছে না সে। প্রশ্নটা এড়িয়ে আশফাককে ধীর গতিতে বললো,
– হুমম,,, তারপর?
– পেটের ক্ষুধা পেটেই রয়ে যেতো৷ খাওয়া আর আমার হতো না৷ কখনো বাবা আমার খাওয়ার সময় ঘরে থাকলে খাইয়ে দিতো৷ তখন মোটামুটি পেট ভরে খেতাম। ভাইদের দেখতাম হরেক রকম বিস্কিট চিপস খেতো। আমাকে দেয়া হতো না৷ আমার জন্য শুধু তিনবেলা ভাত বরাদ্দ রাখা হতো৷ তাও যেকোন একপদ তরকারী আমাকে খেতে দেয়া হবে। ক্ষুধার জ্বালা কেমন হয় তা তোমরা কখনো বুঝবে না। প্রচন্ড ক্ষুধায় আমার পেট জ্বলতো। সে মূহুর্তে ওরা দুইভাই আমার সামনে বসে ভালো ভালো খাবার খেতো। আমি কিচ্ছু বলতে পারতাম না। ঐ সংসারে প্রচন্ড ক্ষুধার সময় কিছু চেয়ে খাওয়ার মত ক্ষমতা আমার ছিলো না অর্পিতা।
-…………………..
– তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?
– উহুম।
– কিছু বলছো না যে?
– আমি কিছু বলার জন্য তোমাকে ডাকিনি। শোনার জন্য ডেকেছি। তুমি বলো। আমি সব শোনার পর তোমাকে বলবো।
– তো যেটা বলছিলাম,,,, মাস ছয়েক বাদে কিল থাপ্পর খেয়ে সুন্দর করে খাওয়া পুরোপুরি শিখে গেলাম। স্পেশাল খাবার তো ভুলেও আমাকে ছুঁয়ে দেখতে পর্যন্ত দেয়া হতো না। এই যেমন ধরো নুডলসের কথাই বলি। এটা তো বাচ্চাদের দারুণ আকর্ষণের খাবার। ভদ্রমহিলা রান্নাও করতেন বেশ লোভনীয় করে৷ কখনো চিকেন থাকতো কখনোবা বড় সাইজের চিংড়ি। সাথে একটু সবজিও দিতো। মোটকথা দেখেই লোভ লাগার মত অবস্থা। আমি দূর থেকে দেখতাম। ভাইগুলো খুব তৃপ্তি নিয়ে খেতো। ওদের খাওয়া দেখেই জিহ্বায় পানি চলে আসতো। ঐ পানিটুকু আবার ঢোক গিলে ফেলতাম। কৌশিকদের বাসায় যখন আমার আনাগোনা শুরু হলো তখন খালাম্মা এটা সেটা আমাকে খাওয়াতেন। শুরুর দিকে খেতাম৷ পরে আর খাইনি। ওদের বাসায় খাওয়ার অপরাধে মার খেতে হতো৷ দুবেলা ঘরে আর খাবার জুটতো না৷ ঐ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে আমার কপালে কখনো নতুন কাপড় জুটেনি৷ ভাইদের পুরান কাপড় পড়ে বড় হয়েছি। এমনকি ঈদে পর্যন্ত না৷ ওদের জন্মদিনগুলো বেশ ধুমধাম করে পালন করা হতো৷ বরাবরই রুমের একটা কোনায় দাঁড়িয়ে ওদের অনুষ্ঠান দেখতাম। সব মেহমান চলে যাওয়ার পর যদি কেকের পিস অবশিষ্ট থাকতো তো খেতে দিতো আর নয়তো না৷ কখনো কখনো থাকলেও দিতো না৷ কারনে অকারনে সবার হাতে মার খেয়েছি। আমার কপালের দাগটা দেখতে পাচ্ছো?
– হুম।
– আমার বাবার মেজো ছেলে আমাকে স্টিলের জ্যামিতি বক্স দিয়ে ঢিল মেরেছিলো।
– কেনো?
– অকারনে। ও নতুন গেঞ্জি কিনে এনেছিলো। আমি প্যাকেট খুলে গেঞ্জিটা হাতে নিয়ে শুধু দেখেছিলাম। ব্যস, এটাই আমার দোষ৷ একটা গালি দিলো, এরপর টেবিলের উপর থেকে জ্যামিতি বক্সটা ছুঁড়ে মারলো আমার দিকে।
– ওরা কি সবাই মানসিকভাবে অসুস্থ?
– নাহ অর্পিতা। ওরাই সুস্থই ছিলো। অসুস্থ কেনো হতে যাবে?
– সামান্য একটা গেঞ্জি ধরার জন্য কপালটাই ফাটিয়ে দিবে? এরা কি মান……… যাই হোক,,,,, কি বলছিলে বলো।
– আমার ভাইদেরকে বাবা কয়েকটা টিচার রেখে পড়িয়েছেন। আমার জন্য একটা টিচারও কখনো রাখা হয়নি। সোজা স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। যা শিখার ওখানে শিখেছি। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত কানন ভাই কৌশিক আর আমাকে পড়িয়েছে। ক্লাস ফোর থেকে ইন্টার পর্যন্ত কৌশিক টিচারের কাছে যা শিখতো তা আমি ওর কাছ থেকে শিখে নিতাম। অর্পিতা, আজকে আমি এতদূর আসার পিছনে কৌশিকের অবদান কম ছিলো না। ও আমাকে ছায়ার মত আগলে রেখেছে সবসময়। স্কুলে কম বেশি সবাই আমার কথা জানতো। তোমার ভাই আর দুই তিনটা বন্ধু ছিলো আমার খুব ভক্ত। বিশেষ করে তোমার ভাই। আবিদ প্রায়ই দুই বক্স টিফিন নিয়ে আসতো। আমার হাতে দিয়ে বলতো,
– এটা তোমার জন্য। খেয়ে দেখো। আমার আম্মু খুব ভালো রান্না করে।
আমি খেতাম না। খুব অস্বস্তি লাগতো কেও আমাকে করুনার নজরে দেখলে। আমি জানতাম ও আমাকে করুনা করে না। যা দেয় ভালোবেসে দেয়৷ তবুও মনের মধ্যে একটা খচখচ লেগেই থাকতো। এমনকি কৌশিকের কাছ থেকেও সহজে আমি কিছু নিতাম না৷ ওরা কখনো রাগ করতো, মন খারাপ করতো। আসলে ওরা আমাকে বরাবরই নিঃস্বার্থভাবেই ভালোবেসেছে। ছোটসময় না আমি অতকিছু বুঝতাম না৷ খালি কাঁদতাম আর ভাবতাম ওরা এমন কেনো করে আমার সাথে? কি করেছি আমি? যখন বুঝতে শিখলাম আপন আর সৎ এর মাঝে পার্থক্য কোথায় তখন নিজের দোষটাও খুঁজে পেলাম। আমি কে আমি কি সেটা বুঝে গেলাম। আমার মত মানুষের স্বপ্ন কতটুক হওয়া উচিত, কারো কাছ থেকে কতটুকু আশা করা উচিত সেটাও বুঝে নিলাম। জানো অর্পিতা কাঁদতে কাঁদতে আমার এমন একটা অবস্থা হয়েছিলো আমার আর কান্নাই পেতো না৷ ওরা মারলেও আমার আর ব্যাথা লাগতে না। তখনকার সময়টাতে মনে হতো আমার মত এমন বেজন্মা মানুষ এই সমাজে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সেটাই তো অনেক। এর চেয়ে বেশি আশা করা কি ঠিক?
– নিজেকে বেজন্মা কেনো বলছো? তোমার বাবার কি পরিচয় নেই?
– বেজন্মা না হলে কি আর এমন কুকুরের মত আচরন করতো সবাই?
(চলবে)