ভোরের_আলো পর্ব-৫৮

0
1134

#ভোরের_আলো
৫৮.

-দিনগুলো এভাবেই যাচ্ছিলো। ছন্নছাড়া আর স্বপ্নহীন। জীবনে কোনো রঙ নেই, ছন্দ নেই, তাল নেই। বেঁচে থাকার দরকার তাই বেঁচে আছি। নিঃশ্বাস নেয়া দরকার তাই নিচ্ছি। এস. এস.সি. দিলাম৷ রেজাল্ট বেরুলো। ইন্টারে ভর্তি হলাম। এরপর এলো রাত্রীর পালা। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে ছিলো৷ প্রায়ই ওর মা বাবার সাথে আমাদের বাসায় আসতো। কখনো সেভাবে ওকে খেয়াল করে দেখিনি। যতটা সৌজন্যমূলক কথা বলা দরকার ছিলো ঠিক ততটুকুই বলতাম। আমার আবার গল্পের বই পড়ার নেশা ছিলো৷ ইন্টারে ভর্তি হওয়ার পর টিউশনি করতাম। সেই টাকা দিয়ে বই কিনে জমাতাম। একবার ও এলো আমাদের বাসায়। দুপুরের পরপর সময় ছিলো৷ খেয়ে দেয়ে যে যার যার রুমে চলে গেছে। ও সেদিন এসেছিলো ওর মা বাবার সাথে৷ ওর মা আর আমার সৎ মা মিলে উনার বেডরুমে বসে কথা বলছে। বাবা আর উনার বন্ধু ছিলো উনার বড় ছেলের ঘরে। আর ঐ দুইভাই ছিলো মেজোটার ঘরে। আমি আমার রুমে বসে বই পড়ছিলাম৷ দরজাটা হালকা করে লাগানো ছিলো৷ ও কোনো ধরণের নক টক ছাড়াই ঘরে ঢুকে পড়লো। আমার আলমারিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

– বই পড়তে খুব ভালোবাসো তাই না?
– হুম।
– আচ্ছা আমাকে দেখে ওভাবে লাফিয়ে উঠলে কেনো?
– না বলে ঘরে ঢুকেছেন তাই।
– আমি বেশ ম্যানারলেস তাই না?
– না, না আমি তা বলিনি। আমি বুঝিয়েছি যে আমি প্রস্তুত ছিলাম না৷ বইয়ের দিকে মনোযোগ ছিলো। হঠাৎ করে এসেছেন তো তাই একটু,,,,,,,,, আপনি প্লিজ অন্যভাবে আমার কথাটা নিবেন না।
– আমাকে আপনি করে কেনো বলো?

এই কথাটা বলেই ও আমার পাশে এসে বসে পড়লো। বলতে পারো কিছুটা গা ঘেষে। ঐ মূহূর্ত্বে বেশ অস্বস্তি লাগছিলো। ওর চোখের ভাষাটাই যেনো মূহূর্ত্বে বদলে গেলো৷ কোনো কিছুর আবদার স্পষ্ট চোখে ভাসছিলো ওর। আমি চোখের ভাষাটা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু আবদারটা কি সেটা ঠিক ধরতে পারছিলাম না। আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলতে পারছিলাম না৷ জিহ্বায় জড়তা চলে আসছিলো৷ আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে বিছানার উপর রেখে দিলো। আমার একটা আঙুলে ওর আঙুল পেঁচিয়ে বললো,

– তুমি এমন কেনো বলো তো? একবারও কি আমার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হয় না? আমি যে তোমার দিকে কাঙালের মতো তাকিয়ে থাকি তুমি দেখো না? নাকি দেখেও না দেখার ভান করো?
-…………….
– কথা বলো না কেনো? হুম? আমি যে তোমাকে ভালোবাসি সেটা কি তুমি জানো?

বিশ্বাস করো অর্পিতা সেই মূহূর্ত্বে মনে হচ্ছিলো আমার দম আটকে আসছে। আমার হাত কাঁপছিলো তখন। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে আমার আঙুল জড়িয়ে ধরে বললো সে নাকি আমাকে ভালোবাসে৷ এতটাও আশা কখনো আমি করিনি। পুরোপুরি আনএক্সপেক্টেড ঘটনা৷ আমার মনে হচ্ছিলো আমি বুঝি কোনো জড় পদার্থ। একটু নড়াচড়ার ক্ষমতাটুকু কয়েক মিনিটের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিলো৷ আমি শুধু ওর দিকে চুপচাপ তাকিয়ে ছিলাম। কিচ্ছু বলতে পারছিলাম না। একটা শব্দও না৷ রাত্রি আমার দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছিলো৷ বেশ কয়েক সেকেন্ড পর আমার আঙুলটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমার দিকে সামান্য ঝুঁকে বললো,

– কি? অন্য কাওকে ভালোবাসো বুঝি? ওসব আর চলবে না। সব বাদ। তোমার মাঝে এখন থেকে শুধুমাত্র আমার আনাগোনা চলবে। অন্যকারো না৷ আশফাক শুধুমাত্র রাত্রির। অন্য কারো না৷

ও কথাটা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো৷ ও এগুলো আমাকে কি বলে গেলো আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না৷ মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো সবকিছু। মাতাল মাতাল লাগছিলো নিজেকে। মাত্রাতিরিক্ত মদ খেলেও বোধ হয় কারও এতটা মাতাল লাগে না যতটা আমার লাগছিলো৷ আর হার্টবিটের কথা তো নাইবা বলি! কি যে একটা হাল করেছিলো মেয়েটা আমার!
– তারপর? এক কথাতে রাজি হয়ে গিয়েছিলে?
– নাহ। ঘোরটা কেঁটে গিয়েছিলো । সেই ঘোর কাঁটতে কাঁটতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় লেগেছিলো আমার৷
– ওর প্রতি একটুও অনুভূতি জাগে নি?
– হুম জেগে ছিলো৷ প্রথম কেও এভাবে এসে প্রপোজ করেছে৷ বয়সটা একদম কাঁচা ছিলো তখন। অনুভূতি জাগাটাই তো খুব স্বাভাবিক তাই না?
– হুম, সেটা তো স্বাভাবিক বটেই।
– হুম হতে পারে স্বাভাবিক৷ কিন্তু আমার জন্য স্বাভাবিক ছিলো না। আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানতাম৷ নিজেই তো ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছিলাম৷ সেই জীবনে আরেকটা মেয়েকে টেনে এনে লাভ কি? ওকে ভালো রাখার কোনো যোগ্যতা কি আমার ছিলো? ছিলো না তো। তাহলে কেনো আমার সাথে এই মেয়েটাকে টেনে আনবো? বড় ভাই তখন ব্যবসা শুরু করেছে। ওর অনেক কাজই আমার করে দিতে হতো। সে সুবাদে আমার হাতে একটা সেলফোন দেয়া হলো যাতে যখন তখন ফরমায়েশ করতে সুবিধা হয়৷ ঐ ফোন নাম্বারটা কোনোভাবে রাত্রি ম্যানেজ করে৷ সেদিন রাতেই আমাকে ফোন দেয়। আমি ওকে সাফ গলায় না করে দেই। কারণটা অবশ্য ও আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো। কিন্তু আমি এক কথায় বলে দেই, আমার আরেকজনের সাথে এ্যাফেয়ার আছে।
বলেই ফোনটা কেঁটে দিয়েছিলাম। ও বারবার ফোন করে যাচ্ছিলো। মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে যাচ্ছিলো। শেষমেশ ফোনের সুইচটাই অফ করে দিলাম। তুমি জানো ভিতরটা আমার দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর সাথে একটু কথা বলি৷ ফোনটা রিসিভ করে বলি, শোনো ভালো তো আমারও বাসতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু কি করে ভালোবাসি বলো তো? আমার তো কারো জীবন নষ্ট করার অধিকার নেই।

সেদিন সারাটারাত ধরে আমার ডান হাতের এই আঙুলটা কয়বার যে দেখেছি তার হিসেব নেই। যতবার দেখছিলাম বুকের ভেতরটায় শুধু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। আমি ঘুমাইনি অর্পিতা। এক ফোঁটা ঘুমও সেদিন আমার হয়নি৷ কি এক অস্থিরতার মধ্যে পুরোটা রাত কাটিয়েছি সে খবর কেও জানে না৷ পরদিন একদম ভোরবেলা কৌশিকের বাসায় চলে গেলাম। আগেরদিন ও আমার মুখ দেখেই বুঝেছিলো আমার কিছু হয়েছে৷ জিজ্ঞেস করেছিলো কি হয়েছে। কিন্তু আমি কিছু বলিনি। এটা সেটা বলে কাঁটিয়ে গিয়েছি। শেষমেশ আর পারছিলাম না এসব হজম করতে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ওর বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। খালু এসে গেইট খুলেছিলো। আমার চেহারা তখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত। তারউপর এত ভোরে এসেছি। খালু বেশ উৎকন্ঠা নিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-কি হয়েছে? এতো সকালে আসলি যে? কোনো সমস্যা?

আমি শুধু এতটুকু বললাম,
– খালু খুব জরুরী কাজ আছে কৌশিকের সাথে৷
এটা বলেই ওর ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। তখন ও বেঘোরে ঘুমুচ্ছে৷ ঘুম থেকে ওকে উঠালাম৷ আমাকে ঐ সময় দেখে সেও বেশ অবাক৷ হুরমুরিয়ে শোয়া থেকে উঠে আমাকে জিজ্ঞেস করলো,

– কি রে ভাই? কোনো সমস্যা?

তখন ওকে রাত্রির পুরো ব্যাপারটা বললাম। কেনো ওকে না করেছি সেটাও খুলে বলেছি। সব শুনে ও বললো,

– দেখ, সবার দিন কিন্তু একরকম থাকে না। তুই যে একদিন ভালো কিছু করবি না এমন কোনো কথা আছে? তোকে তো একদিন এই অবস্থা থেকে বের হতে হবে তাই না? তাছাড়া মেয়ে তো সব জানে৷ এমন তো না যে মেয়ে কিছু জানে না৷ জেনেশুনেই তোকে প্রপোজ করেছে৷ তাহলে তুই এত কেনো ভাবছিস?
– ও হয়তোবা না বুঝেই কাজটা করেছে। এত কিছু ভেবে হয়তো বলেনি।
– তো এটা মনে মনে রেখে লাভ কি? ওকে সরাসরি কথাগুলো বলে পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার কর। তাহলেই তো হয়। পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলার পর ওর রিএ্যাকশনটা দেখ। এরপরও যদি মেয়ে তোর সাথে সম্পর্ক জড়াতে রাজি হয় তাহলে তোর তো সমস্যা হওয়ার কথা না।
– কি বলবো ওকে আমি? কথা কিভাবে শুরু করবো?
– কোনো ভণিতা করবি না৷ যা বলার স্ট্রেইট বলবি। তবে আশফাক একটা কথা বলি। মেয়েটাকে আগেও আমি দেখেছি। কেমন যেনো ন্যাকা আর ওভারস্মার্ট। ওর সাথে কথা বলার আগে একটু খোঁজ নেয়া উচিত। কারণ আমি নতুন করে তোর আর কোনো কষ্ট দেখতে চাই না৷ আমরা আগে খোঁজ নেই। সবকিছু ঠিক থাকলে তুই ওর সাথে কথা বলিস।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here