ভোরের_আলো পর্ব-৭

0
922

#ভোরের_আলো
পর্ব-৭

আরাফাতের কলটা কেটে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো অর্পিতা। ও কোন পথে হাঁটছে সে কথা ওর জানা নেই। একদিকে আরাফাত। অন্যদিকে আশফাক। আশফাকের ধ্যানে পড়ে আরাফাতের দিকে মনোযোগ দিতে পারছে না অর্পিতা। অথচ এই শেষ মূহূর্ত্বে আরাফাতের প্রতি মনোযোগ দেয়াটা যে বড্ড জরুরী। তীরে এসে তরী ডুবানোর শখ নেই অর্পিতার।

– মুক্তা…..
– হুম।
– কি করছি আমি?
– মানে?
– আরাফাত, আশফাক। দুজনের তাল সামলাতে পারছি না। আশফাকের প্রতি মনটা খুব টানছে। আরাফাতের ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাতে পারছি না।
– আরাফাতের সাথে নাটক করছিস। আশফাক ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছিস। তাই উনার কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি বলি কি, নিশা আর সুমি আপুর ইস্যুটা যত দ্রুত শেষ করতে পারবি তত ভালো হবে। কারন তোর নিজেরও একটা লাইফ আছে তাই না? অন্যের প্রবলেম সলিউশন করতে যেয়ে তো নিজের লাইফ কমপ্লিকেটেড করে ফেলছিস।
-হুম। ব্যাপারটা শেষ করতে হবে।
– আরাফাতকে দেশে আনবি কবে?
– বললে তো আজই টিকেট কনফার্ম করে ফেলবে।
– ব্যাটাকে দেশে আনার ব্যবস্থা কর।
– দেশে আনলেই তো আর হলো না। উনার সাথে হোটেলে পাঠাবো কাকে?
– টাকা দিলে মেয়ের অভাব পড়ে না অর্পি।
– অভাব হয়না জানি। কিন্তু মেয়ে পাবো কোথায়? আমরা তো তেমন কাওকে চিনি না।
– সেটা একটা ব্যবস্থা করা যাবে। গোছানো একটা কাজকে তো আর এভাবে শেষে এসে নষ্ট হতে দিতে পারি না।
– হুম।
– কাল কি করবি?
– মানে? কিসের কথা বলছিস?
– আশফাক ভাইয়ের সাথে মিট করার ব্যাপারটা।
– করবো।
– হ্যাঁ বলে দিবি?
– আগে আমার কথাগুলো বলবো। আমার গ্র্যাজুয়েশন, বিজনেস এসব ব্যাপারে আগে কথা বলে নেই। দুবছর আমাকে সময় দিতে পারবে কিনা আগে জেনে নেই। দেখি উনি কি বলে। উনার রিপ্লাইয়ের উপর ডিপেন্ড করবে আমি কি হ্যাঁ বলবো নাকি না। তাছাড়া উনার সম্পর্কে তো কিছু জানি না। উনি কে? কি করেন এসব ব্যাপার জেনে নেই। এরপর কি করবো ভাবা যাবে।
– আমার যেতে হবে?
– কি আশ্চর্য! তুই যাবি না?
– আমি অহেতুক একা বসে থাকবো তোদের মাঝে। কেমন দেখায় না?
– কেমন দেখাবে আবার? রাতুল ভাইয়ের সাথে মিট করতে গেলে তো আমাকে সাথে করে নিতি। এখন কেনো আমার বেলায় এভাবে বলছিস?
– আরে, ক্ষেপে যাচ্ছিস কেনো? যাবো তোর সাথে। রাগারাগি করিস না।

ড্রইং রুমে বসে সিগারেট ফুঁকছে আশফাক। টিভিতে ফুটবল খেলা দেখছে সে। ফোন বাজছে আশফাকের। রাত্রি ফোন করেছে। কলটা রিসিভ করলো আশফাক।
– হুম, বলো।
– তোমাকে মিস করছি।
– দুপুরে না রিং কিনে দিলাম। আবার মিস করছো কেনো?
– আমি কি কোনো কিছু কিনে দেয়ার জন্য মিস ইউ বলি নাকি?
– তো কি জন্য বলো?
– আই রিয়েলি মিন ইট।
– মাঝরাতে কি কমেডি করার জন্য ফোন করেছো?
– কমেডি মানে? আমার কথা তোমার কাছে কমেডি মনে হয়?
– তুমি তো আমার জীবনটাকেই কমেডি বানিয়ে দিয়েছিলে।
– দেখো আশফাক, সেটা ছিলো আমার জীবনে নেয়া সবচেয়ে বড় ভুল ডিসিশন। সেটার শাস্তি এখন আমি পাচ্ছি। এটা কি তোমার যন্ত্রনা কমানোর জন্য যথেষ্ট না? আমাকে এভাবে কথা শুনিয়ে আরও কষ্ট দেয়াটা কি খুব জরুরী?
– তোমাকে কি কিছু কিনে দিতে হবে?
– না। তোমাকে লাগবে। এক্ষুনি।
– বাসায় আসলেই তো হয়।
– দেড়টা বাজে।
– তো?
– এতরাতে একা আসবো কিভাবে? তুমি আমার এখানে আসো।
– যে বাড়ি থেকে তোমার হাজবেন্ড শ্বশুড় মিলে আমাকে বের করে দিয়েছে সে বাড়িতে আমি পা দিবো না। তোমার মন চাইলে তুমি আসতে পারো। আর নয়তো কাল এসো।
– খুব বেশি মিস করছি যে!
– আমি পারবোনা আসতে।
– তাহলে গাড়ি নিয়ে আমাকে পিক করতে আসো।
– পারবো না। ইম্পরট্যান্ট ম্যাচ দেখছি। তুমি কাল এসো।

রাত্রিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না আশফাক। কলটা কেটে দিলো। এই মেয়ের ভালোবাসা দেখলে গা জ্বলে আশফাকের। কত্ত প্রেম! একেবারে উথলে উথলে পড়ছে। যত্তসব! ১৩ বছর আগে যখন ফেলে চলে গিয়েছিলো তখন তো ভালোবাসা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিলো। আর এখন টাকার গন্ধে ভালোবাসা জেগে উঠেছে।

রেস্টুরেন্টে বসে আছে আশফাক। উল্টো দিকের চেয়ারে বসে আছে মুক্তা, অর্পিতা। গরম কফির মগে চুমুক দিচ্ছে আর অর্পিতার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে আশফাক। ভীষণ অস্বস্তি লাগছে অর্পিতার৷ এভাবে একনজরে তাকিয়ে আছে কেনো? চোখ তুলে আশফাকের দিকে তাকাতে পারছে না অর্পিতা। মাথা নিচু করেই বললো
– এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?
– হা হা হা…. কেনো লজ্জা পাচ্ছো?
– হ্যাঁ পাচ্ছি।
– লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে ভালোবাসি৷ তোমাকে দেখতে ভালো লাগে।
– তাই বলে একনাগাড়ে?
– হুম। একনাগাড়ে। প্রেমিকরা তো এভাবেই তাকিয়ে থাকে।
– মুক্তা, রাতুল ভাই তোর দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকে?
– হুম থাকে তো।
– দেখেছো? রাতুলও তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আচ্ছা এই রাতুলটা কে?
– মুক্তার হবু বর।
– ওহ তুমি এ্যাংগেইজড?
– হ্যাঁ।
– তো, অর্পিতা আমরা কবে বিয়ে করছি?
চোখ তুলে আশফাকের দিকে তাকালো অর্পিতা।
– আপনাকে কিছু বলার ছিলো।
– হুম বলো।
– আসলে আপনার আমার ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি।
– হুম তারপর?
– আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি আগে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করতে চাই। তাছাড়া আমার একটা কসমেটিকস শপ আছে।
– হ্যাঁ জানি৷ আটমাস হলো তোমার দোকানের।
– আপনি জানেন?
– হ্যাঁ জানি। তারপর বলো।
– বিজনেসটা আমি বড় করতে চাই। আপনি আমাকে বিয়ে করতে চাইলে দুবছর সময় দিতে হবে। আমি এখন বিয়ে শাদি করবো না।
– তোমার স্টাডি বিজনেস হ্যাম্পারড হবে তাই?
– হ্যাঁ।
– বিয়ের পরও তো এসব করা যায় তাই না?
– বিয়ের পর আমি মনে করি প্রথম ছয়মাস একবছর নিজের হাজবেন্ড আর সংসারটাকে বেশি সময় দিতে হয়। আমার পক্ষে সব একসাথে মেইনটেইন করা পসিবল না।
– তুমি সময় চাচ্ছো তাই তো?
– হ্যাঁ।
– দিলাম সময়। আমার ওয়েট করতে প্রবলেম নেই। যাকে ভালোবাসি তার স্বপ্নগুলোকে যদি প্রায়োরিটি না দেই তাহলে ভালোবাসা কিসের? আর কোনো কথা?
– আপনার সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে চাই।
– খুবই ভালো কথা। কারো সাথে না জেনে রিলেশনশিপে যাওয়া ঠিক না। এখানে পুরো জীবনের প্রশ্ন। তবে তুমি একটা বোকা। কারো সম্পর্কে খবর নিতে চাইলে তার অগোচরে অন্য লোকের কাছে খবর নিতে হয়। তুমি আমাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তো আর আমি নিজের সম্পর্কে মন্দ কিছু বলবো না। বেছে বেছে নিজের ভালো দিকগুলো বাড়িয়ে বলবো। নিজেকে মহাপুরুষ হিসেবে প্রেজেন্ট করবো।
– আপনার অগোচরে খোঁজ নিবো কিভাবে? আমি তো আপনার বাসা অফিস কোনো কিছুর ঠিকানা জানি না। খোঁজ নিতে হলে তো আপনার এলাকার লোকের কাছ থেকে খোঁজ নিতে হবে।
– তোমাকে বাসা আর অফিসের এড্রেস টেক্সট করে দিবো। তুমি কি নিজে যেয়ে আমার খোঁজ নিবে নাকি অন্য কাওকে দিয়ে খোঁজ নিবে সেটা তোমার ব্যাপার।
– আপনি কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসেন?
– মিথ্যামিথ্যি ভালোবাসা যায় নাকি? জানতাম না তো।
– অনেকের গল্প শুনি৷ মিথ্যা ভালোবাসার গল্প।
– হতে পারে। অসম্ভব কিছু না। তবে আমি তেমন কেও না। ভালোবাসা আমার কাছে স্বর্গীয় ব্যাপার। এটার মাঝে মিথ্যা এনে অপবিত্র করতে চাই না।
– আপনি কি আমার সম্পর্কে সব জানেন?
– যতটুক বাহিরের লোক থেকে জানা যায় ততটুক জানি৷ কিন্তু তোমার পছন্দ অপছন্দ সেসব জানি না। তবে জানতে চাই।
– এখন না। আগে আপনার সম্পর্কে সব জেনে নেই এরপর।
– প্লিজ আজই খবর নাও। আমি আগামীকালের মধ্যে তোমার মুখ থেকে হ্যাঁ শুনতে চাই।
– যদি না বলি?
– সব জেনেশুনে না করার কথা না। আমাকে দেখে আমার সম্পর্কে জেনে যে কেও আমাকে বিয়ে করতে চাইবে সে ব্যাপারে আমি কনফিডেন্ট। এরপরও যদি তুমি না করো তাহলে অন্য পথে হাঁটা শুরু করবো। সোজা তোমার বাসায় যাবো। তোমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করে আমার ঘরে তুলবো। তোমার সংসার বা হাজবেন্ড কিছু দেখতে হবে না। পুরো দুবছর নিজের মতো করে কাটাবে৷ এরপর নাহয় আমাকে আর সংসার সামলাবে। তুমি রাজি থাকো আর না থাকো বিয়ে আমি তোমাকেই করবো।
– বললেই হলো? আব্বু আম্মু কেনো রাজি হবে এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে বিয়ে দিতে?
– সেটা আমার ব্যাপার। তোমার জানার দরকার নেই।
– কফি তো শেষ। পিৎজ্জা খাবে নাকি ম্যাক্সিকান ডিশ?
– ম্যাক্সিকান ডিশ।
– মুক্তা তুমি?
– ঐটাই খাবো।
– বসো, আমি অর্ডার করে আসছি।
আশফাক উঠে গেলো অর্ডার করতে। অর্পিতাও পিছু পিছু গেলো। কাউন্টারে বিলের কাগজটা অাশফাকের আগে অর্পিতা নিয়ে নিলো। পার্স খুলে অর্পিতা বিল পরিশোধ করে দিলো।
– এটা কি করলে?
– বিল দিলাম।
– আমাকে তুমি ইনসাল্ট করছো।
– কিভাবে?
– আমি কি বিল পে করতে পারি না নাকি আমার এ্যাবিলিটি নেই?
– নিজের লোক ছাড়া অন্য কারো কাছ থেকে আমার খেতে ভালো লাগে না।
– আমি কি অন্য কেও?
– আপাতত অন্য কেও। সম্পর্ক এখনো অতি আপনের দিকে যায়নি। আপন মানুষের তালিকায় আপনার নাম আসুক। তখন আপনার কাছ থেকে চেয়ে খাবো।
মনে মনে প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে আশফাক। আজাইরা ঢংয়ের মানে কি? এমব ভাব দেখাচ্ছে মনে হয় যেনো ছেলেদের কাছ থেকে টাকা খায় না। মেয়ে মানুষগুলো পারেও বটে।
(চলবে)

-মিম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here