#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা
পর্বঃ চব্বিশ
তিস্তা’র সামনে সাদা কাপড়ে মোড়ানো লা’শ খানা। তবুও তিস্তার মুখে দুঃখের কোনো রেশ নেই। সে ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের এক কোণায়। তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকা বকুল অব্দি কেঁদেকেটে ভাসাচ্ছে অথচ মেয়েটা কাঁদছে না। কী আজব! মেয়েটা কী পাথর হলো?
উঠোনের মাঝে নেতিয়ে আছে আহ্লাদী। এতক্ষণ সে গড়াগড়ি খেয়ে কেঁদেছে। আর দেহে কুলচ্ছে না কাঁদাকাটি। আহ্লাদী’কে ধরে বসে আছে দাদী। মেয়েটা’র পেটে তিন মাসের সন্তান অথচ তার স্বামী আজ খাটিয়া’তে ঠাঁই পেয়েছে। কী দুর্ভাগ্য! হাহ্!
গ্রামের লোক কত স্বান্তনা দিলো। মেয়েটা সবসময় শান্ত শিষ্ট থাকতো। আহারে মেয়েটার কপাল পুড়লো শেষমেশ!
বোন জামাইয়ের লা’শ দেখার পরও তিস্তা’র হেলদোল না দেখে অবাক হয় বিষাদিনী। সবার অগোচরে ফিসফিস করে বলে,
“তুমি কাঁদছো না যে? খারাপ লাগছে না দুলাভাই’র জন্য?”
তিস্তার ভাবলেশহীন উত্তর,
“নাহ্ তো।”
বিষাদিনী অবাক হয়। তারপর নিজেকে সামলে নেয়। সন্দিহান কণ্ঠে বলে,
“কেনো? বাজে লোক ছিলো নাকি সে?”
এবার অবাক হওয়ার পালা তিস্তার। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে অঢেল বিস্ময় নিয়ে বলে,
“তুমি জানলে কীভাবে, বুবু?”
“নারী আমি। পুরুষের প্রতি একজন নারী’র ঘৃণা’র দৃষ্টি, বুঝতে পারি আমি। আমারও এমন দৃষ্টি আছে কোনো না কোনো পুরুষের জন্য। তোমায় না বুঝলে হবে?”
তিস্তা থামকায়। বিষাদিনী’র প্রতি তার ভালো লাগা আরও দ্বিগুণ বাড়ে। হঠাৎ করেই বাড়ির পরিবেশে তার বিতৃষ্ণা জন্মায়। সবার অগোচরে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। মাস্টারমশাইটা অকারণেই তাকে ধরে নিয়ে এলো এখানে। এর চেয়ে মধুসখী’র ঘাট বেশি ভালো ছিলো।
তিস্তা বেরিয়ে যেতেই তর পিছে পিছে বিষাদিনীও বেরিয়ে যায়। তিস্তাকে সে যতটা চিনেছিলো, মেয়েটা যে এত পাষাণ হবে সে ভাবে নি। যতই হোক,নারী শরীরেে অপমানের আঁচড় কেটেছিলো সে মানুষ। দয়ামায়া না থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
গ্রামের পথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছে তিস্তা আর বিষাদিনী। কথা’র এক পর্যায়ে বিষাদিনী অদ্ভুত স্বরে বললো,
“তোমার দুলাভাই কীভাবে মারা গিয়েছে, শুনেছো কিছু?”
“হ্যাঁ। হৃদরোগের কারণে। তবে,শ’য়’তা’ন গো শাস্তি এমন ভাবেই দেন সৃষ্টিকর্তা।”
“শাস্তি টা সৃষ্টিকর্তা দিলো না তার সৃষ্টির সেরা জীব দিলো সেটা পরিষ্কার না আমি।”
বিষাদিনী’র কথায় অবাক হয় তিস্তা। ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মানে!”
“ও কিছু না। আচ্ছা, তুমি নাহয় তোমার দুলাভাই’কে অপছন্দ করতে। কিন্তু তোমার আপু? তাকে তো তুমি ভালোবাসো, তার দুর্দিনে তোমার এত কাঠিন্যতা মানায়? আর তাছাড়া,তার তো কোল জুড়ে অন্য কারো আগমনী বার্তা বইছে।”
“আপা তো আমার দুর্দিনে দাঁড়ায় নি,বুবু। অবশ্য এ নিয়ে আমার রাগ নেই। এখন ওখানে আমার দমবন্ধ লাগছিলো। আমার এত কান্নাকাটি ভালো লাগে না। ভয় হয় কেবল। হৃদয় মাঝে কেমন ভয়ঙ্কর প্রলয় হয়। কাউকে দেখাতে পারি না। তাই ছুটে চলে এসেছি। মানুষটাকে আমি অপছন্দ করতাম ঠিকই, কিন্তু কখনো চাই নি সে আমার আপা’র সুখ কেড়ে নিয়ে মৃত্যু’র মুখ দেখুক। তবুও উপরওয়ালার ইচ্ছে বুঝি অন্য কিছু ছিলো।”
বিষাদিনী ছোট্ট শ্বাস ফেললো। এতটুকু মেয়েও চায় নি কখনো, তার সাথে খারাপ আচরণ করা ব্যাক্তিটা মারা যাক। কিন্তু সে,এত বড় মেয়ে হয়েও প্রতিনিয়ত নিজের বাবার মৃত্যু কামনা করতো। বাবা হয়তো তার জীবনে নোংরামির আঁচড় কাটে নি। কিন্তু সহজ সরল মেয়েদের যে ক্ষতি করতো। যতই সে বাবা হোক, আগে তো তাকে মানুষ হতে হবে। মানুষ রূপে অ’মানু’ষ হয়ে বেঁচে থেকে আদৌও কোনো লাভ আছে?
বিষাদিনী আর তিস্তা’র নিরব মুহূর্তের মাঝে হাজির হয় দারুণ এক সুপুরুষ। তিস্তাকে দারুণ রঙিন রূপে দেখে পুরুষটা এগিয়ে আসে। মিষ্টি স্বরে বলে,
“ভালো আছেন, তিস্তা?”
তিস্তা অবাক নাহয়ে পারে না। এতদিন পর এ মানুষটার সম্মুখে পরবে ভাবে নি। এ মানুষটার কাছ থেকে অনেক কিছু জানা বাকি তার।
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে মাহিন আবার প্রশ্ন করলো,
“চিনতে পারেন নি আমায়?”
“না চেনার কী আছে? আমার জীবনে দারুণ ক্ষতির কারণ হলেন গিয়ে আপনি। আপনাকে না চিনলে হবে?”
তিম্তার কাঠ কাঠ জবাবে সামান্য ভড়কে গেলো মাহিন। কিন্তু সে উত্তর দেওয়ার আগেই হঠাৎ তার নজর গেলো তিস্তা’র পাশে দাঁড়ানো রমনী’র দিকে। বিস্ফোরিত কণ্ঠে সে বললো,
“বিষাদিনী, আপনি!”
বিষাদিনী মাহিনের দিকে তাকালো। মাহিনের অবাক দৃষ্টি দেখে সামান্য হাসলো। খুব স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, আমি। কেমন আছেন, ডাক্তার সাহেব?”
“এইতো,ভালো। আপনি?
“আমি তো সবসময়ই ভালো থাকি,তাই না? তা,এখন কী গ্রামেই থাকেন?”
“না,না,সদরে থাকি। মাঝে মাঝে আসি।”
“তো,আমাদের বাড়িতে যাবেন। আপনার কথা এখনো অনেকে আলোচনা করে।
“হ্যাঁ, যাবো সময় করে।”
“তিন-চার বছরেও আপনার সময় হয়ে উঠে নি!”
বিষাদিনী’র প্রশ্নে হাসে মাহিন। প্রশ্নটা এড়িয়ে বলে,
“আপনি আগের চেয়ে বেশিই সুন্দর হয়েছেন।”
“তখন বুঝি ভীষণ অসুন্দর ছিলাম?”
এহেন প্রশংসায়ও আর পাঁচটা মেয়ের মতন লজ্জায় কুঁকড়ে যায় নি বিষাদিনী। স্বাভাবিক ভাবো আরও টুকটাক কথা হলো দু’জনের মাঝে। তিস্তা কেবল হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। তার বোধগম্য হলো না ব্যাপার টা। দু’জন দুই মেরুর প্রাণী হয়েও পরিচিত কীভাবে?
অবশেষে বিষাদিনী’র আলাপ আলোচনা শেষ হলো। মাহিনকে বিদায় জানিয়ে সে তিস্তা’র হাত ধরে আবার হাঁটা ধরলো গ্রামের পথ ধরে। তিস্তা ফিরে চাইলো মাহিনের দিকে। মাহিন এখনো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মাহিনের দৃষ্টিতে কেবল মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে। উপচে পড়া মুগ্ধতা। কিন্তু কার জন্য সে মুগ্ধতা? বিষাদিনীর নাকি তিস্তার?
মাহিনের থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতেই বিষাদিনী’র কিছু মনে পড়লো। থেমে গেলো তার পা। হঠাৎ সন্দিহান কণ্ঠে সে তিস্তাকে বললো,
“তুমি তখন ডাক্তার সাহেব মানে মাহিনকে কী বললে? তোমার দারুণ ক্ষতির কারণ সে কীভাবে?”
তিস্তারও এবার হুঁশ হলো। সে বিষাদিনী আর মাহিনের আলোচনায় এতই মত্ত হয়েছিলো যে নিজের প্রশ্ন গুলো ছুঁড়তে পারে নি মাহিনের দিকে। তিস্তাকে চুপ থাকতে বিষাদিনী আবারও প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“বললে না, কী ক্ষতি?”
“আমার চরিত্র নষ্ট হওয়ার মিথ্যে খবরটা উনিই ছড়িয়ে ছিলো, বুবু। অথচ আমার সাথে তেমন কিছুই হয় নি।”
বিষাদিনী ভারী অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“তার মানে? সবাই যা বলে, তোমার সাথে আসলে তা ঘটে নি?”
“নাহ্। আমাকে কেবল পাঁচদিন অন্ধকার একটা ঘরে আটকিয়ে রেখেছিলো। এছাড়া কিছুই করে নি। কিন্তু গ্রামের মানুষ সেটা বিশ্বাস করে নি একমাত্র এই ডাক্তারের জন্য। উনিই আমাকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে বলেছিলো আমার সাথে খারাপ কিছু হয়েছে।”
বিষাদিনী সামান্য হোঁচট খেলো বোধহয়। ডাক্তার সাহেব মিথ্যে কেন বলেছে? নিশ্চয় এর ভিতরে কাহিনী আছে।
_
রাত নেমেছে চারপাশে। তিস্তা বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে কেবল পড়তে বসেছে। হারিকেনের আলোটা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে পড়ায় মনোনিবেশ করেছে মাত্র। হঠাৎ তার ঘরে ধীর গতিতে কেউ প্রবেশ করলো। তিস্তা সামান্য চমকে তাকাতেই দেখলো একদম সাদা ধবধবে শাড়ি পড়া তার আপা।
তিস্তা নিজের বোনের দিকে তাকিয়ে আবারও চোখ নামিয়ে নিলো। সাদা শাড়িতে আপাকে কেমন ভয়ঙ্কর লাগছে! তিস্তার ভাবনার মাঝে আহ্লাদী’র কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“কিরে,কথা বলবি না আমার সাথে?”
তিস্তা চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,
“ওমা,কথা কেন বলবো না? তুমি বসো এখানে।”
“না না। বসতে আসি নি। তোরে একটা দায়িত্ব দিলে পালন করতে পারবি?”
তিস্তা ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কী?”
“আমার সন্তানকে তুই মানুষ করতে পারবি?”
আপার কথায় তিস্তা বিচলিত হলো। আপার মাথায় কী অন্য কিছু ঘুরছে? তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে আপাকে জড়িয়ে ধরলো তিস্তা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললো,
“নাহ্, পারবো না। তুমি থাকতে আমি মানুষ করতে যাবো কেন? কীসব বলছো আপা!”
“আচ্ছা, তুই আগের মতন আমায় ভালোবাসিস তো? নাকি আর মনে পড়ে না আমায়?”
“আমি তোমাকে সবসময় ভালোবাসি, আপা। এমন করে বলছো যে!”
আর উত্তর দেয় না আহ্লাদী। কেবল মনে মনে কী যেন ভাবে।
_
আজকে থেকেই তিস্তার মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। মাস্টারমশাই আর বিষাদিনী’র সাথে তিস্তা, কঙ্কণা,বকুল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে। তিস্তা তার সাথে নিজের মাকে আনতে ভুলে নি। চোখ গুলো ফুলে ঢোল হয়ে আছে মেয়েটার।
আজ দিন দুই যাবত সে কারো সাথে কথা বলছে না। কিন্তু যতটুকু মনে হয় মেয়েটা খুব কাঁদছে। কিন্তু কেনো?
প্লাবনের ক্ষানিকটা খটকা লাগে। ওর দুলাভাই যেদিন মারা গেলো, মানে গত তিনদিন আগেও মেয়েটা ঠিক ছিলো। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো মেয়েটার? তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে কেনো?
স্কুলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সবাই। প্লাবন সবাইকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। তিস্তা তাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। প্লাবন বকুল আর কঙ্কণাকে বুঝিয়ে তিস্তার দিকে গেলো।
প্লাবনকে দেখে তিস্তা মুখটা ঘুরিয়ে নিলো। প্লাবন বেশ অবাক হলো তিস্তার আচরণে। এমন করছে কেনো মেয়েটা?
প্লাবন অবাক কণ্ঠে বললো,
“এমন করছিস কেনো তুই? কথা বলছিস না যে আমার সাথে? আমি কিছু করেছি?”
তিস্তা তবুও চুপ৷ প্লাবনের একটু রাগ উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“বে’য়া’দ’ব হয়েছিস? একটা কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতে হয় জানিস না? কী হয়েছে তোর? নাটক করছিস কেনো?”
“আমার কিছু হয় নি। আপনি আমার সামনে আর কখনো আসবেন না। চলে যান এখান থেকে।”
প্লাবন তাজ্জব বনে গেলো। এ কেমন কথার ধরণ মেয়েটার!
#চলবে
[গত পর্বের গঠনমূলক কমেন্টকারী তিনজনঃ
Najeat Anjum Jasy
মোঃ আলপাজ
Mehnaj Shila
আর তাছাড়া বাকি সবাইও বেশ দারুণ দারুণ কমেন্ট করেছো। তোমাদের কমেন্ট গুলো পড়লে আমার উৎসাহ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ধন্যবাদ সবাইকেই। ]