মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্বঃ২৮

0
1804

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ আটাশ

“আপা,তুমিই তবে দুলাভাইকে মে’রেছো? কেনো আপা? এত ভালোবাসা স্বত্তেও কেনো মেরেছো?”

তিস্তার প্রশ্নে ক্ষাণিক কেঁপে উঠলো আহ্লাদী। ভোরে আজান ভেদ করে এমন প্রশ্ন সে মোটেও আশা করে নি।

আহ্লাদীকে চুপ থাকতে দেখে তিস্তা আবার প্রশ্ন করলো,
“কেনো মারলে,আপা?”
“তুই এসব কীভাবে জানলি? কে বলেছে তোকে এসব?”

তিস্তা হাসলো। আপার ঘর্মাক্ত মুখ খানা মুছে দিলো। চারপাশে তখন সদ্য ভোর। নতুন সকাল। পাখির কিচিরমিচির চারদিকে। তিস্তা বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিলো। ভোরের হিমশীতল বাতাস ছুঁয়ে গেলো তাদের দু’জনকে। উঠোনের মাচার উপর বসে আছে দু’জন। তিস্তা-ই তার আপাকে ঘুম থেকে তুলে এখানে নিয়ে এসেছে কথা বলার জন্য। কিন্তু এমন প্রশ্ন করবে,কে ভেবেছে!

তিস্তার মুখে রহস্যময় হাসি দেখে আহ্লাদী নিজের মুখের বিন্দু বিন্দু ঘাম টুকু মুছে ফেললো। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বললো,
“বল,তোকে কে বলেছে এসব?”
“সে একজন বলেছে। তার আগে তুমি একটা গল্প শুনবে?”

আহ্লাদীর ভয়ে অন্তর আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তবুও কোনো মতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“বল।”
“জানো বুবু, বিষাদিনী আপা কী বলেছে?”
“তুই অত বিষাদিনী, বিষাদিনী করিস কেনো? যাই হোক,যা বলার বল।”
“আমাদের গ্রামের মধুসখী নদী আছে না! সেখানে জমিদারের বউ পা পিছলে পড়ে মারা যায় নি। জমিদার তাকে মে’রে ফেলেছে।”

আৎকে উঠলো আহ্লাদী। বোন এসব কী বলে? জমিদার সাহেব নিজের স্ত্রী’কে জানের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তাদের গ্রামে প্রচলিত কথা আছে “প্রেম করিলে জমিদারের মতন করো, বধূ হলে মধুসখী হও।” দুজনের ভালোবাসার দৃষ্টান্ত হিসেবে এ ছড়া খানি। তবে, বোন এসব কী বলে?

আহ্লাদী’র বিরক্ত লাগলো এবার। ধমকে বললো,
“এই শহুরে দিদি’র সাথে থেকে তুইও পা’গ’ল হচ্ছিস? জমিদারের ভালোবেসে পা’গলামীর কথা আমরা সবাই জানি। তবুও এসব কথার মানে কী? আর বিষাদিনী দিদি এসব কথা কীভাবে জানে?”

“জমিদারকে নিয়ে অনেক পড়াশোনা করেছে বিষাদিনী। এমনকি জমিদার বাড়ির আনাচে কানাচে কী আছে সেটাও তার জানা। সে কোনো একটা বই পড়েছে। আর জমিদারদের বংশধরেরাই হলো বিষাদিনী বুবুদের পরিবার। তাই সে সব কিছু জেনেছে নাকি।”

এবার আহ্লাদীর আগ্রহ জাগলো। আগ্রহী কণ্ঠে বললো,
“এরপর বল? এরপর কী হলো? জমিদার কেনো মা’রলো মধুসখীকে?”

“জমিদার তার স্ত্রীর সকল চাওয়া পাওয়া পূরণ করতো। একবার জমিদার শহরে যায় মধুসখীকে রেখে। জমিদারের কোনো সন্তান ছিলো না৷ জমিদারের শারীরিক সমস্যার জন্য। কিন্তু মধুসখী এটা জানতো না। আসলে জমিদার ভেবেছে মধুসখী এসব জানলে কষ্ট পাবে। সেবার জমিদার শহর থেকে এসে দেখে জমিদারনী মানে মধুসখী অনেক অসুস্থ। ডাক্তার, বৈদ্য ডাকা হলো। সবাই জানালো জমিদারের ঘর আলো করে বংশধর আসতে চলেছে। জমিদারের তখন মাথায় হাত। এত ভালোবাসার পরও বে’ইমানী করলো মধুসখী! যার জন্য জমিদারের জান হাজির ছিলো। তার জান ই অবশেষে কেড়ে নিলো জমিদার। সে ভেঙে পড়েছিলো। মানতে পারে নি সে ঘটনা৷ একদিন রাতে প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্ত্রীকে মে’রে মধুসখীতে ভাসিয়ে দেয়। সবাই ভাবে পা পিছলে মারা গেছে। কিন্তু যে মানুষ সাঁতার জানে সে কী কখনো ডুবতে পারে, আপা?”

আহ্লাদী বিষ্মিত,হতবাক। আধ্যাত্মিক ভাবে তার আর জমিদারের ঘটনা মিলে গেলো প্রায়। তবে কী তিস্তা বুঝে ফেলেছিলো?

“আপা,একদম সুস্থ মানুষ হঠাৎ হৃদরোগে মারা যেতে পারে?”

যে ভয়টা পেয়েছে তা-ই ঘটলো। আহ্লাদীর কণ্ঠ ছোট হয়ে আসছে। কণ্ঠনালি কাঁপছে। চোখ থেকে অশ্রুকণা ঝড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“হ্যাঁ, আমিই মে’রে’ছি ঐ নরপিশাচকে। জানিস ও আমাকে টাকার জন্য বিক্রি করতে চেয়েছিলো। প্রেমে অন্ধ ছিলাম বলে প্রথমে বুঝি নি। কিন্তু যখন বুজেছি অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তাই মে’রে দিছি। একবারে শেষ করে দিছি জা’নো’য়া’রকে।”

কথা থামলো। কান্নায় ভেঙে পড়লো আহ্লাদী। তিস্তা জড়িয়ে ধরলো বোনকে। আদুরে স্বরে বললো,
“তুমি ভুল করো নি, আপা। কোনো ভুল করো নি। তবে তোমার পরিণতি যেন জমিদারের মতন না হয়। সে তো নিজের স্ত্রীর শোকে ফাঁসি দিয়ে ছিলো।”

তিস্তা আর আহ্লাদীর কথার মাঝে ছুটে এলো কঙ্কণা। হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে বললো,
“তিস্তা,বিষাদিনী আপা চলে গেছে। অনেক দূরে।”

তিস্তা যেনো থ বনে রইলো। আহ্লাদী সাথে সাথে দৌড় দিলো। তিস্তা অবাক কণ্ঠে বললো,
“বিষাদিনী বুবু যাকে ভালোবাসতো,তার সাথে গিয়েছে?”
“নাহ্। বুবু যাকে ভালোবাসতো তাকে মুক্ত করে দিয়ে গেছে।”

তিস্তা অবাক হলো। বিষ্মিত কণ্ঠে বললো,
“কাকে ভালোবাসতো?”

কঙ্কণা মাথা নিচু করে। নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে বলে,
“মাস্টারমশাই।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here