#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা
পর্বঃ সাতাশ
“তুই কী পাগল হলি? পরীক্ষা শেষ হতে না হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাচ্ছিস? তাও আবার আমি না অন্য কারো সাথে? এতটা পর হয়ে গেলাম আমি?”
ধূ ধূ পরিবেশ। নিঃশেষ করা বাতাস, প্রবাহমান মধুসখী আর হৃদয়ের কিছু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তা। নিশ্চুপ,নিষ্প্রাণ তার দৃষ্টি ও ভাষারা। প্লাবন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কন্ঠ তার নির্জীব। হৃদয়ে তার হারানোর ভয়। সেই ভয়কে সাথে নিয়েই সে আবার বললো,
“আমার অন্যায় টা বল।”
“বিয়ের পিঁড়িতে বসার চিন্তা আপনি আগে করেছেন, মাস্টারমশাই। আমাদের পরীক্ষার জন্য ই এতদিন বিয়ে করেন নি তাই তো? আপনি বিয়ে করতে পারলে,আমি কেনো পারবো না? আমার অপরাধ কী!”
প্লাবন থামলো। বিয়েটা সে যথেষ্ট ঠেকানোর চেষ্টা করেছিলো। কিন্তু পারলো না৷ এইতো আজ তাদের গায়ের হলুদ, কাল বিয়ে। এরপর? এরপর সব শেষ। কিন্তু প্লাবন এখনো ভরসার বীজ বুকে পুষে রেখেছে। তবে তিস্তা কেনো ভরসা হারাচ্ছে!
প্লাবনের শিরা উপশিরা ভেদ করে রাগ উপঁচে পড়ছে। তার সব কিছু ধ্বংস করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তিস্তার সামনে নিজেকে এতটা কঠোর ভাবে প্রকাশ করবে না। তাহলে মেয়েটা হয়তো আরও জেদ করবে।
তিস্তা কতক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,
“আপনার আর আমার এ জন্মে এক হওয়া হলো না। আমার কিশোরী বয়সের প্রেম এভাবে ধূলিসাৎ হবে আমি ভাবি নি। তবে,পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে, সে জন্মে আপনি আমার হবেন। একান্তই আমার। সেখানে কেউ থাকবে না। কেউ না।”
কথা থামলো মানবীর। কণ্ঠনালী কাঁপলো৷ কান্নারা আর বারণ শুনলো না। শাষন শুনলো না। ছিটকে বেরিয়ে এলো। দিক ভুললো প্লাবন। আঁকড়ে ধরলো মানবীকে বাহুডোরে। কতখানি সময় ব্যয় হলো একান্ত ব্যাক্তিগত ভাবে। কান্নার বেগ মানবীর বেড়েই চলছে। থামছে না আহ্লাদ পেয়েও। মানবীকে এতটা নিকটে পেয়ে অসংযমী হয়ে পড়লো প্রেমিক পুরুষ। উষ্ণ ছোঁয়া একে দিলো মানবীর অধরে। সময়টা আরেকটু ব্যাক্তিগত হলো। কিশোরী বয়সের প্রথম এত গোপনীয়, নরম, কোমল অনুভূতির সাথে পরিচিত নয় তিস্তা। আবেশে বন্ধ হলো চোখ। গাল লাল হলো। লজ্জা আকাশ ছুঁয়েছে। অভিমান কী পাথর হতে পারে আর? সে তো আদুরে ছোঁয়ায় গলে পানি।
–
“তুমি তোমার কথার খেলাপ করছো না, বুবু?”
কঙ্কণার প্রশ্নে ক্ষাণিক হাসলো বিষাদিনী। ঠাট্টার স্বরে বললো,
“তুই বলছিস,অন্যায় করেছি?”
“তা নয় তো কী? এটা অন্যায় হচ্ছে না? তুমি তো বলেছিলে, মাস্টারমশাই কে বিয়ে করবে না। তবে,তুমিও কী স্বার্থপর হলে?”
“মাঝে মাঝে স্বার্থপর হতে ক্ষতি কী?”
কঙ্কণা আর উত্তর দিলো না। বিষাদিনী’র স্বার্থপরতা মানতে পারছে না সে। একদিন আধাঁর রাতে তাদের মধ্যে যে কথা হয়েছে সে কথা এখন আর বিষাদিনী রাখছে না। তবে কি নিজের ভালোবাসার জন্য মানুষ স্বার্থপর হয়?
বাহিরে তখন রঙিন কাপড় দিয়ে উঠোন সাজানো হচ্ছে। কাল দুপুরে বিয়ে। বিষাদিনী নিরলস জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। কঙ্কণা আর দাঁড়ালো না সেখানে। গটগট পায়ে বের হয়ে যাচ্ছে বিষাদিনী’র ঘর থেকে। তার মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল একটা কথা ই ঘুরপাক খাচ্ছে, “বিষাদিনী বিশ্বাসঘাতক নারী।”
কঙ্কণার ঠেলে কান্না আসছে। সে বিষাদিনীকে কত বিশ্বাস করেছিলো। আর বিষাদিনী কিনা এমন করলো?
কঙ্কণা দরজা অব্দি পৌঁছানোর পরই বিষাদিনী চিকন স্বরে ডাক দিলো,
“কঙ্কণা?”
কঙ্কণা থামলো। না চাইতেও সে থামলো। এই একটা মানুষ, যে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করতে শিখিয়েছে। তবে কেনো মানুষটার পিছু ডাকে সে থামবে না!
কঙ্কণা থামতেই বিষাদিনী হেসে বললো,
“রাতের দিকে একবার মধুসখী’র ঘাটে ঢু মারিস তো। তোদের একটা সত্যি জানাবো।”
“কিসের সত্যি? আমরা আর কোনো সত্যি জানতে চাই না। তুমি পুরোটাই মিথ্যে ঘেরা।”
কঙ্কণার এমন রুক্ষ জবাবেও বিষাদিনীর হাসি একবিন্দু কমলো না। বরং হাসিটা আরও প্রশস্ত করে বললো,
“বকুল আর তিস্তা আসবে। তুই তোরটা ভেবে দেখিস। আমি আবার এখন একটা চিঠি লিখে বাসায় পাঠাবো জরুরী তলবে। কাল সকালে পৌঁছে যাবে নিশ্চিত। এখন আমার অনেক কাজ। তুই এখন যেতে পারিস।”
কঙ্কণা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। গটগট পায়ে চলে গেলো। কঙ্কণা চলে যেতেই ঘরের পেছনের জানালা দিয়ে কেউ বিবাদিনী’কে ডাক দিলো।
বিষাদিনী প্রথমে ক্ষাণিকটা চমকে গিয়েও ঘাবড়ালো না। পেছন ফিরে হাসিমুখে বললো,
“কখন এলেন?”
মাহিন হেসে বললো,
“মাত্রই।”
“কাল কি হবে মাথায় আছে তো?”
“হ্যাঁ।”
বিষাদিনী বাঁকা হাসলো। কাল ঘটবে অনেক কিছু।
–
“তুই কী তোর দাদীর সাথে পা’গ’ল হলি?তোর চেয়ে তিনগুণ বয়সে বড় লোককে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছিস?”
তনয়া বেগমের প্রশ্নে জানালা থেকে ঘাঁড় ঘুরালো তিস্তা। প্রভাতের সেই মিষ্টি স্মৃতি তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। বারংবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে তাদের ব্যাক্তিগত সময় টুকু। তখনই মন বিদ্রোহী হয়ে বলে উঠছে মাস্টারমশাই কেবল তিস্তার। কিন্তু নিয়তি যে বলছে অন্য কথা।
তিস্তাকে চুপ থাকতে দেখে তনয়া বেগম মেয়ের পাশে এসে বসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“কেনো পা’গলামি করছিস, মা?”
“আমি যে মাস্টারমশাইকে অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারবো না, আম্মা।”
তনয়া বেগমের কলিজাটা ছোট হয়ে এলো। মেয়েটা তার একজনের মায়ায় খুব বাজে ভাবে পড়েছে। এই মায়া কী আর কাটানো যায়? খরস্রোতা নদীর মতন মেয়েটা, ভালোবেসে ম’রা নদীর মতন হয়ে গেলো। ভালোবাসা বুঝি এমন! আশালতা বেগমের পা’টা ধরা বাকি ছিলো তনয়া বেগম আর তার স্বামীর। এ কথা কেউ জানলো না।কেউ জানবে না। বিষাদিনী’র কাছেও তো কত আকুতি মিনতি করেছে। কিন্তু পাথর মেয়েটা শুনে নি সে আকুতি।
–
মধুসখী’র ঘাটে বসে আছে চার রমণী। বকুল অধৈর্য হয়ে বললো,
“আপা,কি বলার জন্য ডেকেছো? বলবে না!”
বিষাদিনী হেসে বললো,
“হ্যাঁ, অবশ্যই বলবো।”
তিস্তার তখন মনে চলছে ঝড়। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
“যা বলার, বলো আপা। সন্ধ্যা নামছে যে।”
“সন্ধ্যা তো দেখছি তোমার মনে বেশি নামছে। তাই না, তিস্তা!”
বিষাদিনী’র ঠাট্টার স্বরে বলা কথা টা তিস্তাকে চুপ করিয়ে দিলো। বিষাদিনী হাসতে হাসতে বললো,
“শুনো, আজ মধুসখী’র কাহিনী বলবো। মধুসখী কীভাবে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে তার কাহিনী বলবো। কারো জীবনের সাথে হয়তো মিলে যেতে পারে।”
সবাই এখন অধীর আগ্রহ নিয়ে শোনা শুরু করলো। বিষাদিনী বললো,
“মধুসখীকে তার স্বামী প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো। মধুসখী’র সকল আবদার এক কথায় পূরণ করতো জমিদার। সম্পর্কের প্রতি সে ছিলো যত্নশীল। কিন্তু সেই জমিদারই মধুসখী কে মে’রে পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো।”
শেষের কথা শুনে বুক কেঁপে উঠলো তিনজনের। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কী!”
#চলবে
[আমার হাত কাঁপে,লেখার ছন্দ কেটে যায় তবুও আমি লিখছি। তোমরা একটু গঠনমূলক মন্তব্য করতে পারবে না?]