#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২ য় খন্ড)
#মম_সাহা
অন্তিম পর্ব
“প্রিয় অষ্টাদশী,
পত্রের প্রথমে আমার এক আকাশ ভালোবাসা নিও। তুমি যখন পত্রখানা হাতে পাবে, তখন আমি তোমার থেকে অনেক, অনেক দূরে। উহুম, মরবো না। বেঁচে থাকার জন্যই অনেক দূরে চলে যাবো। জানো অষ্টাদশী, প্লাবন’দা কে নিয়ে আমি কত স্বপ্ন সাজিয়ে ছিলাম? তুমি আসার পর, সেই আশার সমুদ্রে ভাঁটা পড়লো। দোষ তোমার না। আবার আমারও না। ভালোবাসা কী আর দোষের হয়? আমিও ভালোবেসে ছিলাম তুমিও ভালোবেসেছো। পার্থক্য শুধু একটাই,তোমার ভালোবাসার মানুষটা কখনোই আমার না। পর মানুষকে ভালোবেসে ছিলাম।
আমাকে দেখলে কখনো মনে হয় আমি দুঃখ পোষা নারী? মনে হয় না। কিন্তু হৃদয় মাঝে অগাধ দুঃখ পুষে রেখেছি বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। আমার মা নেই। মা হারা সন্তানের যে সারাজীবন কষ্টই পেতে হয়, নিজেকে না দেখলে জানতামই না। বেশ প্রতিবাদী ছিলাম বলে সৎ মায়ের মার খেয়েছি। বাড়ি তে চলতো শরিরের ব্যবসা সব চুপ করে সহ্য করেছি। একটা সময় পর চুপ তো হতেই হতো। তারপর কী হলো জানো? মায়ের বন্ধু একদিন আমায় একা পেয়ে খুব নোংরা আচরণ করেছে। ছোট ছিলাম। দশ এগারো বয়সের বাচ্চা আর কতটুকুই বা বুঝতো! এরপর থেকে গুটিয়ে নিলাম নিজেকে। আমার একাকীত্বের সঙ্গী হলো আমার বোন বিলাসিনী।
জানো,ছোট বেলা থেকে শুনেছি প্লাবন দা আর আমার বিয়ের কথা। আমার মায়ের নাকি ইচ্ছে ছিলো। এরপর থেকেই কোঁকড়া চুলের, সুঠাম দেহী পুরুষকে জায়গা দিয়েছি মনের জমিনে। তিল তিল করে গড়ে তুলেছি ভালোবাসা। কিন্তু হাহ্! ভাগ্য যে আমার বেলা বড্ড নির্মম,নিষ্ঠুর। কিন্তু বুঝতে দেই নি কাউকে। পর মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পেতে হবে আজীবন। তাই চলে যাচ্ছি৷ তোমাদের মুক্ত করে। তোমার পবিত্রতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি। ভালো থেকো তিস্তা। আমার প্লাবন’দাকে নিয়ে।
ইতি
নীল কষ্টের “বিষাদিনী”
তিস্তা থমকে গেলো কঙ্কণার হাতের চিঠিটা পড়ে তার যেনো কিছু বলার ভাষা নেই। বিষাদিনী বুবু এতটা আত্মত্যাগ করলো! আর সে কিনা স্বার্থপরের মতন আশপাশে দেখলেও না! সে অবশ্য মাস্টারমশাই এর মায়ের কথামত মাস্টারমশাই এর কাছ থেকে দূরে যেতে চেয়ে ছিলো। কিন্তু তার আগে বিষাদিনী বুবুই চলে গেলো!
তিস্তা এবার নিজেও মাস্টারমশাই এর বাড়িতে ছুটে গেলো। সবটা কাহিনী নিজের চোখে না দেখলে তার বিশ্বাস যে হবে না।
–
“তনয়া, তোমার মাইয়া তো নিরপরাধ। এই যে, মোড়লের পোলা আর তার বন্ধুরা সব স্বীকার করছে। তারা সব মাইয়ার সাথে খারাপ আচরণ করলেও তোমার মাইয়ারে ধইরাও দেখে নাই। ডাক্তার সাহেব নিজে মিথ্যা বলছে। সব লিখিত দিয়া গেছে। ঐ পোলা গো রে ধরছে। কিন্তু ডাক্তার সাহেব তো শহুরে দিদির সাথে পলাইছে।”
গ্রামের মানুষের মুখে মুখে এক কথা। বিষাদিনী আর মাহিন নাকি পালিয়েছে। তিস্তা কেবল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো? বিষাদিনী তো মাহিনের সাথে পালানোর মেয়ে না। তবে?
গ্রামে গ্রামে ছড়ালো নতুন খবর।
–
পরিশিষ্টঃ
“আর ক’টা দিন পরই তো আমাদের ঘরে ছোট পুতুল আসবে, মাস্টারমশাই। যার নাম হবে বিষাদিনী।”
তিস্তার কথায় নাক ফুলালো প্লাবন। কপাল কুঁচকে বললো,
“তোমায় কতবার বলেছি মাস্টারমশাই না বলতে?”
“কিন্তু আমি তবুও বলবো। আমার কাছে আপনি যেন মাস্টারমশাইয়ে মানানসই।”
প্লাবন কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকলো গোলগাল মেয়েটার দিকে। সাত মাসের উঁচু পেট নিয়ে মেয়েটা মধুসখী’র ঘাটে আসার জন্য সে কী বায়না। প্লাবন এগিয়ে গেলো। তিস্তার মাথায় কিছুক্ষণ আদুরে হাত বুলিয়ে দিলো।
তিস্তা কতক্ষণ চুপ থেকে আনমনেই বললো,
“মাহিন সাহেব পালিয়ে যায় নি, তাই না মাস্টারমশাই?”
প্লাবন হকচকিয়ে গেলো। আমতা আমতা স্বরে বললো,
“তাহলে কোথায় গেছে?”
“তা তো আপনি ভালো জানেন।”
প্লাবন কিছুক্ষণ মৌন থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“চার বছর যাবত তোমায় একটা কথা বলবো, বলবো করে আর বলা হয় নি, তিস্তা।”
“কী কথা?”
তিস্তার গোল গোল উৎসুক দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে অনেক কিছু জানার আকাঙ্খা। প্লাবন ছোট্ট শ্বাস ফেলে বললো,
“মাহিন পালিয়ে যায় নি। তাকে মে’রে ভাসিয়ে দিয়েছি আমি আর বিষাদিনী।”
কথা থামিয়ে প্লাবন তিস্তার দিকে ভীতু দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিন্তু প্লাবনকে অবাক করে দিয়ে তিস্তা স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“কীভাবে মেরেছেন? আর সত্যি টা জেনেছেন কীভাবে?”
“এ সবকিছুতে আমায় সাথ দিয়েছে, বিষাদিনী। মাহিন ছিলো মেয়ে খেঁকো। মেয়েদের প্রতি লোভ। গ্রামের মেয়েদের ও ই তুলে নিয়ে গিয়ে বন্ধুদের সাথে ফূর্তি করে মেরে ফেলতো। কিন্তু তোমার বেলা ও তেমনটা করে নি। তোমার বাবাকে ও বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু তোমার বাবা সেটা না করে দেয়।”
কথাটুকু বলে থামলো প্লাবন। তিস্তা আৎকে উঠলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“কই? আমি এসব কিছু জানতাম না তো!”
“আমিও জানতাম না। সব মাহিন স্বীকার করেছে বিষাদিনীর কাছে৷ তোমার বাবার দুর্ঘটনা কাকতালীয় ছিলো না। মাহিনেই করিয়েছিলো জিদের বশে। তাও তোমার বাবা বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না বলে তোমার চরিত্রে লেপন করেছিলো কলঙ্কের কালী। ভেবেছিলো তুমি তার নাহলে, কারো হবে না। কিন্তু তার নরপিশাচ মনেও প্রেমের ফুল ফুটেছিলো বিষাদিনীকে দেখে। অবশেষে বিষাদিনী তার সাথে একদম মিলেমিশে গিয়ে সব সত্যি বের করেছিলো। তাকে কথা দিয়েছিলো বিয়ের আগের দিন রাতে তারা পালাবে। কিন্তু আমার আর বিষাদিনী’র প্ল্যান ছিলো অন্যকিছু। মাহিন আসতেই তাকে আমরা গলায় দড়ি দিয়ে মেরে পাথরের সাথে বেঁধে আমাদের বাড়ির পিছে পরিত্যক্ত পুকুরে ভাসিয়ে দেই। এমন মানুষের বেঁচে থাকা উচিৎ না।”
তিস্তা সবটা কথা মনযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর উঁচু পেটটা নিয়ে ধীর গতিতে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“চলুন আপার, আর দাদীর কবরটা দেখে আসি।”
প্লাবনও সাবধানে তিস্তার হাতটা ধরে হাঁটা ধরলো। তিস্তার বোন বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। তার পর পরই দাদীও মারা যান।
তিস্তা কবরস্থানের সামনে দোয়া-দরুদ পড়ে গ্রামের সরু পথটা দিয়ে হাঁটা শুরু করে। অনেক বছর আগে এই পথেই প্রথম দেখা হয়েছিলো মাস্টারমশাই এর সঙ্গে। এমনই রোদ্দুর ছিলো পরিবেশে।
তিস্তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। প্লাবন হঠাৎ দাঁড়াতে দেখে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
“কী সমস্যা?”
তিস্তা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
“আপনারে দেখলে আমার প্রেম প্রেম পায়,
ও আমার মধ্যাহ্নের মাস্টারমশাই।”
#সমাপ্ত
[অবশেষে মনমতন শেষ করেছি। কারো অভিযোগ থাকলে নির্দ্বিধায় বইলো। আর সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবে আশাকরি। এরপর আসবো নতুন উপন্যাস নিয়ে। তবে সেটা দীর্ঘ ছুটির পর। আর বিষাদিনী আমার সবচেয়ে প্রিয় চরিত্র। কখনো বই বের করবো সৃষ্টিকর্তার কৃপায়। একটা বইয়ের নাম হবে বিষাদিনী।]