#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা
পর্বঃ চার
“আপা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলো কেনো,আম্মা?”
নিজের ছোট মেয়ের কথায় তনয়া বেগম ফিরে তাকালেন। তার হাতে ছাই লেগে আছে। গতকাল রাতের এঁটো থালাবাসন গুলো ধুচ্ছিলো সে। হাতের পাতিলটা নিচে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
-‘ভালো হয়েছে তুমি এসেছো এখানে। তা কাক ডাকা ভোরে উঠার মেয়ে তো তুমি না! কেনো উঠেছো!
-‘ঘুম ভেঙে গেলো আম্মা। বললা না তো, আপা চলে গেলো কেন?’
তনয়া বেগম বিরক্তিতে ক্ষাণিকটা ভ্রু কুঁচকে অধৈর্য মাখানো কণ্ঠে বললো,
-‘এখানে এসে একটু পানি তুলে দিয়ে যাও তো। হাঁড়িপাতিল গুলো ধুঁয়ে ফেলি। বাসি কাজ গুলো আগে শেষ করে নেই। আসো, আসো।’
মায়ের তাড়াহুড়ো মাখানো কণ্ঠে বুঝাই যাচ্ছে মায়ের প্রতিটা সেকেন্ডের মূল্য কতটা৷ আর তাছাড়া মা কিছু এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিস্তা আর কিছু না বলে মায়ের হাতে হাতে একটু সাহায্য করে দিলো। তনয়া হাঁড়ি পাতিলে পরিষ্কার পানি ঢেলে পরিষ্কার করতে করতে সেদিকে মনযোগ স্থাপন করে বললো,
-‘মেয়ে হয়েছো তুমি, সবার আগে নিজের নিরাপত্তার কথা তোমাকে ভাবতে হবে। আর তা তুমি ভেবেছো,কিন্তু যখন দেখবে তোমার একার পক্ষে নিজেকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হচ্ছে না তখন কাউকে জানাতে হবে। নিজের নিরাপদের জন্য মাঝে মাঝে অন্যের কথা ভুলতে হবে। যাই হোক, কাল মোতালেবের হাতে গরম তেল তুমি মেরেছিলে তাই না?’
মায়ের সবটা কথা এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিলো তিস্তা, কিন্তু শেষের প্রশ্নে তার হাতে থাকা থালের পাঁজা টা পরে গেলো ঝনঝন শব্দে। শরীরের মাঝে অস্থিরতা কাজ করলো। কাল রাতে আধাঁরিয়া প্রতিবাদের কথা তার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। যখন দুলাভাই তার বাহু শক্ত করে ধরে রেখেছিলো সে তখন কড়াই থেকে অনেক খানি গরম তেল গোল চামচের মাধ্যমে নিয়ে দুলাভাই এর হাতে ছুঁড়ে ফেলে। দুলাভাই আৎকে উঠে। সামন্য চেঁচিয়েও উঠে। ততক্ষণে মা আর আপা বাড়িতে এসে পড়েছিলো। দুলাভাই এর অস্থিরতম চিৎকারে তারা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে এসে দেখে দুলাভাই এর হাতের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। যখন সবাই জিজ্ঞেস করলো কীভাবে এমন হয়েছে তখন তিস্তা খুব চালাকি’র সাথে বলে ছিলো দুলাভাই মাছ ভাজতে এসেছিলো আর গরম কড়াইয়ের অনেকখানি তেল উল্টে পড়ে যায় তার উপর।
তিস্তা ভেবেছিলো,সে ঘটনা হয়তো আর কেউ জানবে না কিন্তু আম্মা কীভাবে জানলো?
তিস্তা’কে চুপ থাকতে দেখে তনয়া উঠে দাঁড়ালো, মেয়ের গালে শক্ত এক চড় বসালো। কর্কশ কণ্ঠে বললো,
-‘তুমি কতটা বড় হয়েছো যে তোমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা আমাদের জানাতে পারো না? তোমার সাথে মোতালেব খারাপ আচরণ করে সেটা আগে বললে এত দূর ব্যাপার টা যেতো না। নোংরা আচরণ করার সাহস ওর হতো না। তোমারই বা কী দোষ! যেখানে তোমার বড় বোনই সংসার টিকিয়ে রাখার আশায় নিজের ছোট বোনের সাথে হওয়া অন্যায়’কে পশ্রয় দিয়েছে। এমন মেয়েও আমি পেটে ধরেছিলাম! ছিহ্।’
তিস্তার চড়ের ব্যাথায় চোখ টলমল করে উঠে। গালটা যেনো জ্বলে যায়। কিন্তু তার চেয়ে বেশি জ্বলে যায় হৃদয়টা। আম্মা তাকে ভুল বুঝে নি তাহলে!
তনয়া থালাবাসন গুলো একটা একটা করে মাটি থেকে তুলতে তুলতে বলে,
-‘আজ থেকে ফ্রক পড়া বন্ধ। আমি তো ভুলেই গেছিলাম, সব মানুষ এক হয় না৷ তোমার দৌড়ঝাঁপ কমাবে। মোতালেব কেবল একটা তো আর না, এ সমাজে অনেক গুলো আছে। যাও ঘরে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে স্কুলের জন্য তৈরী হও। বড় হচ্ছো,শরীর বাড়ছে, বুদ্ধিটাও বাড়াও।’
তিস্তা মায়ের উপর অভিমান করে। ছুটে চলে যায় ঘরে। তনয়া ছোট্ট শ্বাস ফেলে। বড় মেয়েটা এত স্বার্থপর ভাবতেই তার গা শিরশির করে উঠে। ভাগ্যিস গতকাল তার শাশুড়ি লতিকা বেগম রান্নাঘরের দৃশ্যটি দেখেছিলো। নাহয় তো এই মোতালেব আরও নোংরামি করতো তার ছোট মেয়েটার সাথে আর তারা জানতেও পারতো না। বড় মেয়েকে সে আড়ালে নিয়ে গিয়ে সব বলার পরে বড় মেয়ে নিজের বোনকে খারাপ বলে। তার বোন নাকি ফ্রক পড়ে ছেলেদের আকর্ষণ করছে। কতটা নিচু মনের হলে এসব বলেছে! তাই তো ঠাটিয়ে দু’খানা চড় দিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছে। সংসার যেহেতু তার এত প্রিয়, চরিত্রহীন সঙী নিয়েই যদি সংসার করার এত শখ তবে এ বাড়ির মুখো দর্শনও যেনো না করে।
______
তীর্যক রোদ খাড়াখাড়ি আকারে শরীরে পড়ছে। গরমে যেনো শরীর জ্বলে যাচ্ছে। স্কুলে বড় মাঠ টার মাঝখানে তিস্তা তার বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করছে। শরীরটা তার আজ ভীষণ খারাপ লাগছে। ভেবেছে না খেয়ে আসার জন্য হয়তো এমন হচ্ছে।
গোল্লাছুট খেলায় মত্ত তিস্তা’কে ভরাট কণ্ঠে মাস্টারমশাই ডাক দিলো,
-‘তিস্তা, এখানে আয়।’
খেলায় মত্ত তিস্তা খেলাতে বিঘ্ন ঘটায় একটু বিরক্ত হলো। তবুও মাস্টারমশাই ডেকেছে বলে কথা। খেলা রেখে সে ছুটে আসলো। ঘর্মাক্ত লাল বর্ণা মুখ খানায় লেপ্টে থাকা ছোট্ট চুল গুলো কপাল থেকে সড়িয়ে হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে বলে,
-‘কী মাস্টারমশাই?’
মাস্টারমশাই উত্তর দিলো না। বরং, তিস্তার বই বহন করা থলেটা তিস্তার দিকে এগিয়ে দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,
-‘বাড়ি যা তাড়াতাড়ি। আর স্কুলে থাকার দরকার নেই, যা। পারলে স্কুলের পিছনের রাস্তা দিয়ে বাড়ি যাবি। বড় রাস্তায় উঠবি না কেমন?’
তিস্তা অবাক হয়। হতভম্ব কণ্ঠে বলে,
-‘মাত্র তো একটা বিষয় পড়াইলো মাস্টারমশাই। ছুটি হতে তো ম্যালা দেড়ি। এখন গেলে বড় মাস্টার বাবা’র কাছে বিচার পাঠাইবে।’
-‘তুই বড় হবি কবে? নিজের শরীরে প্রতি তো অন্তত একটু যত্নশীল হওয়া উচিত। যা বাড়ি যা।’
তিস্তা অবাক হলো। হঠাৎ তার মনে পড়লো তার শরীর অসুস্থ হওয়ার কারণটা। প্রতিমাসের রুটিনমাফিক অসুখটা আবার তাকে ধরেছে আর সে ভুলে গেলো? মাস্টারমশাই কীভাবে জানলো? তিস্তা ভীরু চোখে নিজের পড়নের কাপড় খানার দিকে তাকালো। লজ্জায় সে মিইয়ে গেলো। ব্যাগটা হাতে নিয়ে দৌড়ে ছুটে গেলো স্কুলের পিছন দিকটাতে। কোনো থামা থামি নেই। এ বিশ্রী লজ্জা ঢাকার জন্য প্রাণপনে তাকে ছুটতে হবে। যতদূর গেলে মাস্টারমশাইয়ের চোখে চোখ পড়বে না।
_____
দীর্ঘ দু’দিন পর বাড়ি থেকে বের হয়েছে তিস্তা। দাদী তাকে এ দু’দিন বাড়ি থেতে বের হতে দেয় নি। বন বাদাড়ে ছুটে বেড়ালে নাকি ভূ*ত পে’ত্নী ধরবে সে ভয়ে। গ্রামের প্রচলিত কিছু যুক্তিহীন নিয়ম সবসময়ই প্রচলিত থাকে। আজ জোড় করে তিস্তা বের হয়েছে। স্কুলে নাকি পরীক্ষা শুরু হবে তাই মাস্টারমশাই এর কাছে পড়তে যেতে হবে। তাছাড়া বাকি সহপাঠীরা জানিয়েছে কঙ্কণা নাকি মাস্টারমশাই এর সাথে অনেক ভাব জমিয়েছে। সেই ভাবও তো দেখতে হবে।
পাঠশালায় বাকি সহপাঠীরা চলে এসেছে তিস্তার আগেই। পড়ানো প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে,তন্মধ্যেই হাজির হয় তিস্তা। প্রতিদিন দেরি করে পড়তে আসাটা যেনো তার বদ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
প্লাবন তখন কালো বোর্ডটাতে গুটি গুটি অক্ষর লিখতে ব্যস্ত। দরজায় কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে দরজার পানে তাকাতেই দু’দিন পর কাঙ্খিত মুখখানা দেখতে পেলো। দু’দিন যাবত এ মুখখানা দেখার আশায় কতবার যে সে দরজার পানে তাকিয়েছিলো। আজ অবশেষে তার তাকানো টা বিফলে গেলো না।
তিস্তার আজ অন্যরকম রূপ। নীল রাঙা ঝলমলে থ্রি-পিস শরীরে জড়ানো। চুল গুলো ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টানো। চোখের নিচে মোটা করে কাজল দেওয়া। গলায় কালো একটা তাবিজ বাধাঁ। ফ্রক পড়া ছোট্ট তিস্তা জেনো থ্রি-পিস পড়ে বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। নিজেকে সাজিয়েছেও ভীষণ সুন্দর করে। কে বলবে মেয়েটা ছোট!
তিস্তা প্লাবনের দিকে তাকিয়ে বিনীত কণ্ঠে বললো,
-‘আসবো মাস্টারমশাই?’
প্লাবন কিছু বলার আগেই কঙ্কণা খোঁচা মারা কণ্ঠে বললো,
-‘কিরে, তিস্তা? এত সাজুগুজু কেনো করেছিস? বিয়ে ঠিক হলো নাকি?’
তিস্তার এতক্ষণে কঙ্কণার দিকে দৃষ্টি গেলো। মেয়েটা কালো রঙের মখমল কাপড়ের জামা পড়ে এসেছে। বেশ সুন্দর লাগছে। দশজনের মাঝে দাড়ালে বেশ নজর কাড়বে তার রূপ নির্দ্বিধায়।
পরক্ষণেই কঙ্কণার বলা কথাটা মাথায় খেলে যেতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে সে। তেড়ে গিয়ে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই প্লাবন আটকে দেয় তাকে। রামধমক দিয়ে বলে,
-‘দু’দিন পর কী করতে এসেছিস এখানে? এমন পড়াশোনা করার চেয়ে না করা’ই ভালো। আর, মুখে এমন রঙচঙ মেখেছিস কেনো? বিয়ের বাতাস শরীরে লেগেছে নাকি?’
প্লাবনের ধমকে সশব্দে হেসে দেয় কঙ্কণা। তিস্তা হা হয়ে যায়। হঠাৎ ই তো তার সাজতে মন চাইলো। তাই বলে মাস্টারমশাই এসব বলবে? তাও কঙ্কণার সামনে?
ভীষণ অভিমান জাগে তিস্তার। দ্রুত সে বের হয়ে যায়। প্লাবন দু একবার পিছে ডাকলেও সে শুনে না। মন খারাপ হয় প্লাবনের। এভাবে না বললেও হয়তো পারতো। মেয়েটাকে দু’দিন পর দেখলো অথচ ভালো করে দেখতেও পেলো না।
ছোট্ট একটা আফসোসের শ্বাস ফেলে আবার নিজের পড়ানো তে মনযোগী হবে প্লাবন, এমন সময় তিস্তা আবার দরজার সামনে দাঁড়ায়। লাল টকটকে ফুলো গাল আর নাক টা প্রমাণ করে দিয়েছে মেয়েটা ভীষণ কেঁদেছে।
প্লাবন এবার দারুণ ভাবে অবাক হয়ে যায়। চোখের নিচে গাঢ়ো কাজল টা ধুঁয়ে এসেছে তিস্তা। এর কালো রঙটা খুব এলোমেলো হয়ে গেছে তবুও এঁটে বসে আছে চোখের কোণে। জামার সামনের অংশ কিছুটা ভিজে গিয়েছে। মেয়েটা তবে মুখ ধুয়ে এলো? এত রাগ!
প্লাবন ঘরে ঢুকার অনুমতি দিতেই তিস্তা গটগট পায়ে রুমে ঢুকলো। কঙ্কণা খোঁচা মারা কণ্ঠে বললো,
-‘আচ্ছা তিস্তা,পৃথিবীতে এত নাম থাকতেও তোর নাম তিস্তা কেনো রাখলো? তাও আবার আমাদের গ্রামের পাশের তিস্তা নদী থাকতেও তোকে আবার সেই নাম দেওয়ার কোনো দরকার ছিলো?’
প্লাবণ তিস্তার দিকে এক মুহূর্ত তাকালো, তিস্তার মুখ খোলার আগে সে’ই ধমকের স্বরে বললো,
-‘কঙ্কণা, উল্টোপাল্টা কথা বললে এখানে পড়তে আসার দরকার নাই। এটা তোমার এসব কথা বলার জায়গা না।’
কঙ্কণা চুপ হয়ে গেলো। তিস্তা নিজের জায়গায় বসতে যাবে এমন সময় বাহির থেকে হৈচৈ ভেসে এলো। প্লাবন ছুটে বের হয়ে আসলো। তার পিছে পিছে সব শিক্ষার্থী ছুটে আসলো। প্লাবন সদর দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখলো গ্রামের অনেক লোক বড় রাস্তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। প্লাবণ গ্রামের এক মুরুব্বি’কে ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘চাচা,কী হয়েছে?’
মুরব্বি ব্যতিব্যস্ত কন্ঠে বললো,
-‘তিস্তা নদীতে একটা মাইয়ার লাশ ভাইসা উঠছে। কী সুন্দর মাইয়া নাকি। সবাই তো তা-ই দেখতে যাইতাছে।’
প্লাবণ বিষ্মিত কণ্ঠে বলে ,
-‘মেয়ের লাশ!’
-‘হ মাস্টার, মাইয়ার লাশ। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখনও এমন লাশ ভাইসা উঠতো। আমরা সবাই ছড়া বাইন্ধা বলতাম,
”নদীর নাম তিস্তা,লাশ আসে ভাইস্যা।”
অনেক বছর পর সেই দিন দেখি আবার আইতাছে। তাইলে আর মাইয়ারা, ছোট বাচ্চা’রা নিরাপদ না।’
#চলবে