#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা
পর্বঃ পাঁচ
চাপা উত্তেজনায় পুরো গ্রাম স্তব্ধ। উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে মাস্টারমশাই’র সকল শিক্ষার্থীর মাঝেও। সবচেয়ে উত্তেজিত হয়েছে তিস্তা। কার লাশ ভেসে এসেছে নদীতে, তা না দেখলে জেনো তার শান্তি হবে না। মাস্টারমশাই সবাই’কে ছুটি দিয়ে দেয়। কারণ, এত উৎকণ্ঠা নিয়ে ছেলেমেয়ের আর পড়াতে মন বসবে না। সবাই যখন বের হয়ে গেলো, মাস্টারমশাই তিস্তাকে ভরাট কণ্ঠে বললো,
-‘তুই কিন্তু ভুলেও নদীর পাড় যাবি না। তুই এখানেই থাকবি এখন। গত দু’দিন যাবত অনেক পড়া পড়িস নি, এখন সব পড়ে শেষ করবি।’
তিস্তার চকচকে উত্তেজনা আকাশ সমান হতাশায় রূপান্তরিত হলো। এক রাশ নতুন কিছু দেখার উদ্দীপনা মিইয়ে গেলো ভরাট কণ্ঠে উচ্চারিত হওয়া শব্দ গুলোর কাছে। তার ভয়ঙ্কর রকমের রাগ হলো। পড়াশোনাটা সৃষ্টি কেনো হয়েছে? এমন ছোট্ট মনের ছোট্ট আশা গুলো খান খান করে দেওয়ার জন্য’ই বুঝি পড়াশোনার সৃষ্টি? পড়াশোনা ম’রে যেতে পারে না? ওর বাঁচার কোনো অধিকার নেই। এমন ডজন খানেক অভিশাপ দিয়ে তিস্তা পড়ার বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেলো।
তিস্তার উচ্ছ্বসিত মুখ ভঙ্গির সেকেন্ডের মাঝে বিরাট পরিবর্তে পেট ফেটে হাসি এলো প্লাবনের। এ মেয়ে’র যা আগ্রহ সব ব্যাপারে, এত সহজে লাশ না দেখে মিটবে না। একাই চলে যাবে সুযোগ পেলে। দীর্ঘক্ষণ নিজের মনের মাঝে আকাশ পাতাল ভেবে প্লাবন ঠিক করলো তিস্তার আগ্রহ শেষ করার উপায়।
তিস্তা ব্যাগ থেকে বই বের করতে যাবে তার আগেই প্লাবন এক রাশ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
-‘তুই সত্যিই নদীর পাড়ে যাবি না!’
-‘কীভাবে যাবো? আপনি ছুটি দিয়েছেন?’
-‘চল,আমি নিয়ে যাবো। কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো কথা বলতে পারবি না। রাজি?’
তিস্তা’র মিইয়ে যাওয়া উৎসাহ দ্বিগুণ আকারে ধারণ করলো। উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে বললো,
-‘সত্যি!’
-‘হ্যাঁ সত্যি। এবার চল।’
তিস্তা দিক বেদিক ভুলে ছুটে এলো। বেশ মজা’র কিছু দেখবে ভেবে উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘চলেন, চলেন। ধন্যবাদ মাস্টারমশাই।’
প্লাবন কিছু না বলে ধীর গতিতে বের হয়ে আসলো। সে জানে, তিস্তা তার মনের উত্তেজনা না মিটিয়ে থাকতো না। এর চেয়ে সে সাথে থেকে মনের উৎকণ্ঠা নিভিয়ে দিবে।
______
ভিজে বালুর মাঝে সাদা রাঙা ঝলমলে জামা পড়া একটি মেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। হ্যাঁ, এ মেয়েটিই এখন লাশ বলে চারদিকে গন্য হচ্ছে।
তিস্তা মাস্টারমশাই এর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। এতক্ষণ চাপা উত্তেজনা কাজ করলেও এখন ভয় করছে। কেমন বিধ্বস্ত দেহখানা। প্লাবন তিস্তার গুটিয়ে যাওয়া দেখে ফিসফিস কণ্ঠে বললো,
-‘কিরে, ভয় পাচ্ছিস? এ জন্যই বলেছি আসার দরকার নেই। শুনলি না তখন আমার কথা।’
তিস্তা ভীত চোখে মাস্টারমশাই এর দিকে তাকায়। সত্যিই মাস্টারমশাই’র কথা শোনা উচিৎ ছিলো তার। এই যে, এখন কেমন পস্তাতে হচ্ছে কথা না শুনে। অনাকাঙ্খিত উত্তেজনা, ভয় তাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। নদীর বাতাসে আজ জেনো কেমন ধূসর গন্ধ। এটা কী লাশের গন্ধ? নাকি কোনো পঁচে যাওয়া মস্তিষ্কের নোংরামির গন্ধ?
মেলার মতন হৈ হৈ করে লোক এলো লাশ দেখতে। এ যেনো কারো মৃত দেহ না, অসাধারণ এক রোমাঞ্চকর ঘটনা। নিজের চোখে দর্শন না করলে যেনো দুনিয়া টা মিথ্যে হয়ে যাবে, জন্ম বিফলে যাবে। ধাক্কাধাক্কি করে সবাই দাঁড়িয়েছে লাশ দেখার জন্য।
সদর থেকে পুলিশ আসতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো। ততক্ষণে ভীড় কমার বদলে দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। বাড়ি গিয়ে জমিয়ে নতুন গল্প করার লোভ ছাড়তে পারে নি পথিকরা, তাই তো আগ্রহ আর টানটান উত্তেজনা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটাকে দেখার জন্য। কোন গ্রামের মেয়ে, কার মেয়ে এসব চেহারা না দেখলে কীভাবে বলবে!
তিস্তার ছোট্ট মনও সেই পথিকদের বাহিরে না। সেও অনেক ভয় পাওয়া সত্বেও দাঁড়িয়ে আছে। শেষমেশ কী হয় দেখার জন্য।
পুলিশ আসতেই সবাই সড়ে দাঁড়ায়। চাপা উত্তেজনায় থম মেরে আছে সবাই। পুলিশদের মাঝেই একজন কনস্টেবল এগিয়ে গেলো বড় অফিসারের আদেশে। সবার অপেক্ষা’র পালা শেষ করে থুবড়ে পড়ে থাকা লাশটা’কে সোজা করলো। চুলে ঢেকে যাওয়া চেহারাটা’কে সড়াতেই আৎকে উঠে সবাই। ভীড়ের মাঝে এক গগণ বিদারক চিৎকার ভেসে আসে। সাথে ঝমঝম করে স্রোত বয় বিষন্নতার আফসোসের। হাজারো চিৎকারের মাঝে একটা কথাই সবাই বলছে,
-‘আরে এটা তো গ্রামের পুরোহিতের মাইয়া ভ্রমরী।’
ততক্ষণে তিস্তা লাশটা’র পাশে এসে ধপ করে বসে পড়ে। হৃদয়বিদারক আর্তনাদ করে বলে,
-‘আমার ভ্রমর,ও ভ্রমরী তুই এখানে শুয়ে আসিস কেন? ভ্রমর, উঠনা সই। উঠ। তুই ঘুমিয়ে আছিস কেনো? উঠ তাড়াতাড়ি।’
প্লাবন যেনো নিজের বাক্ শক্তি হারিয়ে ফেললো। ভ্রমরীর লাশ দেখার জন্য চারপাশে এত রমরমা? এত উচ্ছ্বাস? তার পাঠশালার আরেকটা দুরন্ত ছাত্রী, এভাবে এখানে শুয়ে আছে!
পুলিশ কর্মকর্তার কিছু লোক এগিয়ে এলো। ভুড়িওয়ালা বড় কর্তা নাক মুখ কুঁচকে ধমক দিয়ে বললো,
-‘এই মেয়ে, উঠ এখান থেকে। লাশ’কে ছুঁয়েছিস কেনো? পরে তো তোর উপর দোষ পরবে। যা উঠ।’
তিস্তা যেনো আরো এঁটে বসলো ভ্রমরীর নিস্তব্ধ দেহখানার সাথে। দু’দিন সে ঘর থেকে বের হয় নি বলে মেয়েটা নিজে গিয়ে দেখা করে এসেছে। কাল দুপুরেও তো দেখা করে এসেছিলো। হ্যাঁ, এ জামাটাই তো শরীরে ছিলো। তবে কী মেয়েটা আর বাড়ি ফিরে নি?
উৎকণ্ঠায়,উত্তেজনায় ঠান্ডা হয়ে আসে তিস্তার শরীর। জড়ানো কণ্ঠে বান্ধবীর লাশ খানায় হাত বুলিয়ে বলে,
-‘দেখেছিস সই, সবাই তোর নাম ভুলে গেছে! কেমন লাশ লাশ করছে! এই শোনো তোমরা, ওর নাম ভ্রমরী। কেউ লাশ বলবে না। আমার সই ঘুমিয়ে আছে। উঠ না সই। উঠবি না?’
আর কণ্ঠনালি থেকে শব্দ নিসৃত করতে সক্ষম হয় নি তিস্তা। বর্ণহীন পানিতে টইটম্বুর হওয়া তিস্তা নদীর পাড়ে লুটিয়ে পড়ে রক্তমাংসের গড়া তিস্তার দেহখানা। সইয়ের নিস্তব্ধতা অসার করে দেয় মেয়েটার শরীর।
গ্রামে যেকোনো খবর ছড়ায় বাতাসেরও আগে। অপরিচিত লাশ গ্রামের পরিচিত,ছুটন্ত, দূরন্ত মেয়ে ভ্রমরীর এ যেনো কেউ ভাবতেই পারে নি। মানুষজন এবার আরও দ্বিগুণ হলো। সাদা ধূতি পড়া, কপালে চন্দন লেপ্টানো মধ্যবয়স্ক বিপত্নীক পুরোহিত নেপাল ঠাকুর হন্তদন্ত হয়ে দিশেহারার মতন ছুটে আসে।
ততক্ষণে প্লাবন আর কয়েকজন এগিয়ে আসে তিস্তার জ্ঞান ফেরানোর আপ্রাণ চেষ্টায়।
মধ্যবয়স্ক নেপাল আহাজারি করে উঠে। নিজের কপাল চাপড়িয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে দিয়ে বলে,
-‘ও ঠাকুর গো, আমার কপাল ক্যান পুড়ো তুমি বারবার? আমার ফুলের মতন কন্যা কেন আজ ধূলোয় লুটালো? কোন পশুর ক্ষুধার নিবৃত্তি হলো আমার কন্যা? হে ঈশ্বর, তুমি বুঝি মরারে আবার মাইরা গেলা? আমার মাইয়া ছাড়া আমার যে কেউ নাই। আমি কি নিয়ে থাকবো।’
ভীড়ের মাঝে থেকে দু’একজন এগিয়ে এলো। নেপাল’কে স্বান্তনা দিচ্ছে তার মেয়ের খুবলে খাওয়া লাশটার সামনে। দূর দূরান্ত হতে মানুষ এসেছে লাশ দেখার তীব্র আকাঙ্খায়। এমন পৈচাশিক আকাঙ্খাও থাকতে পারে, এদের না দেখলে বুঝা যেতো না।
সবার মুখে মুখে আফসোসের স্বর। মেয়ে টা অনেক ভালা ছিলো, কারো মুখে মুখে তর্ক করতো না। একটু দুষ্টামি করতো তিস্তার সাথ দেওয়ার জন্য কিন্তু কোনো বেয়াদবি করতো না। এমন আরও গুনগান শুরু হলো গ্রামের পর গ্রাম। সাথে আফসোস ছিলো সবার মুখে। মা মরা মেয়েটা এমন অকালে মরলো!
________
ভর সন্ধ্যা তখন। চারপাশ আধাঁর করা বিষন্ন সন্ধ্যা নেমেছে আজ। মধুসখী নদীর কিনারায় রাজকীয় ঘাটের নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে তিস্তা। চুল গুলো তার অদৃশ্য বাতাসে উড়ছে।
গতকাল সইয়ের লাশ দেখার পর যে জ্ঞান হারালো একবারে রাতে ফিরেছে। জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে খাটে আবিষ্কার করলো সে। বাহির থেকে তখন ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে আসছে। সাথে ভেসে আসছে আম্মা, বাবা আর দাদীর চাপা কথোপকথনের শব্দ।
তিস্তা কান খাড়া করলো। এত চাপা গলায় তো কথা বলার মানুষ তারা না। মা – বাবার কথা বাদ দিলেও দাদী! সে কথা বললে কম পক্ষে গঞ্জের দোকান অব্দি কথা যায় আর সে কিনা এত ধীরে কথা বলছে?
তিস্তা নিজের ঘরের টিনের দরজায় কান পাতলো। বাবা বলছেন,
-‘জানো,মেয়েটারে যখন দাহ করতে নিলো, শরীরের কী অবস্থা তার। কুকুরও বোধহয় এমন হিংস্র হয় না।’
বাবা’র কথার পরিপ্রেক্ষিতে মায়ের চাপা স্বর ভেসে এলো,
-‘আচ্ছা, কে করেছে এসব! মেয়েটা তো খারাপ ছিলো না। গতকাল দুপুরে আমাদের তিস্তার সাথে দেখা করতে এসেছিলো যে জামাটা পরে সেটাই তো শরীরে দেখলাম। তাহলে কী বাড়ি যায় নি মেয়েটা?’
-‘নাহ্। নেপাল ঠাকুরের কথায় যা বুঝলাম, সে গতকাল কুমতি গ্রামে গিয়েছিলো কী পূজার জন্য । বাড়িতে এসেছিল মধ্যরাতে। বাড়িতে মেয়েকে না দেখে ভেবেছিলো তার বড় ভাইয়ের বাড়িতে হয়তো মেয়েটা ঘুমাতে গেছে। প্রায় নাকি সে দেরিতে বাড়ি আসলে মেয়েটা নিজের জেঠুর বাড়ি ঘুমায়। কিন্তু কাল যে অদৃষ্ট নির্মম খেলা খেলবে কে জানতো। মেয়েটাকে মেরে নদীতে ভাসিয়ে দিলো। কী অ’মানুষ।’
-‘পুলিশ কী বললো গো?’
-‘ওসব পুলিশ টাকার নিচে থাকে। বলেছে তো অনুসন্ধান করবে উনারা কিন্তু হাবভাবে তা মনে হয় না।’
তারপর কিছুটা সময় চুপ রয় পাশের রুমের মানুষ গুলো। তিস্তার চোখ দিয়ে অঝরে বর্ষিত হয় অশ্রু। দাদী হুশিয়ারি কণ্ঠে বলে,
-‘দেখিস, তিস্তারেও এহন থেইকা সাবধানে রাখতে হইবো। ম্যালা বছর পর গ্রামে বোধহয় মানুষ খেকো রাক্ষস এসেছে। ওরে একলা ছাড়িস না।’
দাদী’র কথার পরিপ্রেক্ষিতে আর কথা আসে না। বাবা-মায়ের মনে ভয় হয়। রাক্ষসটা কে? সে কী মানুষ খেকো না মেয়ে খেকো? বাকি রাতটা পুরো গ্রামবাসীরই বোধহয় নির্ঘুম কাটে। নিষ্পাপের মৃত্যু কেইবা মানতে পারে!
ভাবনার মাঝে হঠাৎ তিস্তা অনুভব করলো সে ভিজে যাচ্ছে। শরীর বেয়ে পানি পড়ছে। চোখ মেলে দেখে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝপঝপ করে বৃষ্টি নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছে চারপাশ। কিন্তু হঠাৎ তিস্তার চোখের সামনের দৃশ্যটি দেখে তিস্তার চোখ বড় হয়ে যায় বিষ্ময়ে।
এতদিন সব পানি শুষে নেওয়া মধুসখী পানি শুষছে না। বৃষ্টির পানি জমছে নদীখানায়। সাথে সজীব হয়ে উঠছে বোধহয় মধুসখী। এ কোন ভয়াবহ ইঙ্গিত!
#চলবে
[গঠনমূলক মন্তব্যের আশাবাদী।]