#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই
#মম_সাহা
পর্বঃ নয়
ভীষন যত্নে বিষন্নতা মাখানো দিন দুই পাড় করলো তিস্তা। মাস্টারমশাই ছাড়া কেবল মাস্টারমশাই এর বাড়িটা না, এ গ্রামের রাস্তা, স্কুলের মাঠ, মধুসখী’র ঘাট, তিস্তার পাড়, আর সপ্তদশী’র হৃদয় খানা যেনো হাহাকার করে উঠছে। এ কেমন যন্ত্রণা! এ কেমন রিক্ততা? পুরো দুনিয়া যেনো ধূ ধূ মরুভূমি। গ্রীষ্মের চৌচির হওয়া পুকুরের মতন ভীষণ খড়া পড়েছে হৃদয়ে। ইশ, একটু বৃষ্টি, একটু প্রিয় মানুষের দেখতে পাওয়ার তৃষ্ণায় ছোট্ট লাল হৃদয়টা বিষন্নতায় নীল হয়েছে। বেদনার রঙ যে নীল!
চারদিকে আধাঁর করা সন্ধ্যা নেমেছে। তিস্তার রুমের দরজাটা হা করে খোলা। চাঁদ উঠেছে আকাশে। বেশ বড়সড় চাঁদ। রাত হলে বিদ্যুৎ থাকে না। এইতো বছর পাঁচেক আগে গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে। কেবল নামের আসা আরকি। দিনের বেলায় সূর্য তার উদার হস্তে দু’হাত ভরে অনেক আলো দান করে। আর তখনই ঘরে ঘরে কৃত্রিম আলো মানে বিদ্যুৎও থাকে। কিন্তু যেই সূর্য ঢেকে যায় আধাঁরে তখনই কৃত্রিম আলোও চলে যায়। বিদ্যুৎ টা ঠিক সুসময়ের বন্ধু প্রবাদটার উদাহরণ হয়েছে।
গ্রীষ্মকালের দিনের উত্তপ্ত রোদ টিনের চালে পড়ে ঘর গরম হয়ে থাকে। রাত হলে ধীরে ধীরে সে গরম কেটে যায়। ঠান্ডা ভাব আসে। তবে আজ চারদিকে বাতাস নেই। কেমন থম মারা আবহাওয়া। তিস্তা হঠাৎ অনুভব করলো পাশের রুম থেকে বাবা,দাদী আর আম্মার কেমন যেনো ফিসফিস কণ্ঠ ভেসে আসছে। তিস্তা কান খাড়া করলো। আজকাল সবাই যেনো তার গোপনে কিছু বলে। কেনো? কী এমন কথা আছে যে সে জানতে পারবে না?
কোনো বাহ্যিক শব্দ না থাকায়, পাশের রুম থেকে কথা গুলো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। তিস্তার মা রুক্ষ স্বরে বলছে,
-‘না,আমার মেয়ে এখনো ছোট। পাত্র যত সুপুরুষই হোক না কেনো বিয়ে দিবো না।’
তিস্তার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠে। তার বিয়ের কথা হচ্ছে কেন আজকাল? সে কাউকে বিয়ে করবে না। মাস্টারমশাই যে অনেক রাগ করবে তার উপর।
তিস্তার ভাবনার মাঝে দাদীর গলা ভেসে এলো। সে বুঝানোর চেষ্টা করে বলছে,
-‘মাইয়া মানুষ পাড় করা হইলো বড় দায়িত্ব। কার, কী, কখন হইয়া যায় কে জানে! এর আগে ঘাঁড় থেকে বোঝা নামানো ভালা।’
-‘আম্মা,আপনি উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না। আমার মেয়েটা ছোট। আর এসব ও শুনলে কষ্ট পাবে। এ কথা ওর কান অব্দি যেনো না পৌঁছায়।’
তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে। যাক, বাবা মা তো তার পক্ষেই। হঠাৎ দাদীর হেয় কণ্ঠে বলা কথা ভেসে এলো,
-‘মাইয়া মানুষ হইলো অল্প সময়ের অতিথি। তাগোরে কয়েকবছর যত্ন কইরা পাইলা মাইনষের হাতে তুইলা দেওয়া হইলো উচিৎ কাম।’
-‘আমি তো আমার তিস্তাার মাঝে আপনারে দেখি আম্মা। মেয়ে মানুষ অল্প সময়ের অতিথি কেনো হবে? মেয়ের মাঝে যেখানে আমি আমার মা’কে দেখি!’
তিস্তার চোখ গড়িয়ে সামান্য অশ্রুকণা বালিশের উপর পড়লো। জল গুলো শুষে নিলো নরম তুলোর দল, দাঁগ রেখে দিলো বালিশের কভার খানা। জীবনও ঠিক এমনই। কেউ ক্ষত মুছানোর চেষ্টা করে, আর কেউ আমাদের ত্রুটি গুলো যত্নে রেখে দেয়। সারাজীবন আমাদেরকে সেই ত্রুটি মনে করিয়ে আমাদের মুক্ত হয়ে উড়ার ডানা গুলো কেটে দেয়।
তিস্তা পাশের বালিশটা নিয়ে মুখের উপর চেঁপে ধরলো। কান্না গুলো যেনো দরজা পেরিয়ে পাশের ঘরে না যেতে পারে। তার চোখের জল যেনো না ঝরে তাই নিয়ে বাবা-মায়ের কত চিন্তা, আর সে এমন অশ্রু বিসর্জন করছে দেখলে তাদের কতটা না কষ্ট হবে!
প্রনয় মানে এক ঝাঁক বিষন্নতা। বালিশে মুখ চেঁপে কান্নার নাম প্রনয়। মুখে হাসি রেখে ভিতরে অনলে পু’ড়ে যাওয়া হলো প্রনয়।
সপ্তদশী বুঝে, মাস্টারমশাই এর জন্য হওয়া অনুভূতি গুলো তাকে আজীবন এক ব্যাথাময় সুখ দিবে। কী লাভ তবে এত ভেবে! নীল রঙটা বেছে নিয়েছে তো সে নিজ ইচ্ছায়। আর সামান্য বেদনা সহ্য করতে পারবে না?
______
‘আজকাল তোমার কী হয়েছে? খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছো দেখি! সারাদিন জানালার শিকলটা ধরে কাটিয়ে দিচ্ছো। পরীক্ষা যে সামনে মনে আছে?’
মায়ের কথায় ধ্যান ভাঙে তিস্তার। মৃত দৃষ্টিতে মায়ের পানে তাকায়। তনয়া বেগম এগিয়ে আসে। একটু আগে রান্না শেষ হলো। গরম ভাত আর গরম ডালের সাথে বড় মাছের এক টুকরো ভাজি নিয়ে মেয়ের রুমে এসেছেন। মেয়েটা আজকাল কেমন মন খারাপ হয়ে থাকে।
মায়ের মুখখানা লাল হয়ে আছে গরমে। তিস্তা একটু নড়েচড়ে বসলো। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বললো,
-‘না তো আম্মা,কী হবে আমার! কিছুই হয় নি।’
তনয়া বেগম চৌকির উপর বসলেন। ভাত মাখিয়ে মাছের কাটা বেছে মেয়ের মুখের সামনে এক লোকমা ধরে বললেন,
-‘আমি তোমার পেট থেকে হয় নি, তুমি আমার পেট থেকে হইছো। আজকাল কথা লুকাতেও শিখেছো। তা স্কুল যাও না কেনো?’
তিস্তা ভাতটা মুখে নেয়। চুপ করে থাকার মোক্ষম মাধ্যম এটা।
তনয়া আবার মাছের কাটা বাছতে ব্যস্ত হয়ে যায়। কাটা ছাড়াতে ছাড়াতে বলে,
-‘আবেগের বয়সে আবেগ দেখাতে গিয়ে বিবেকের কাছে লজ্জিত হইও না। মেয়ের জাত এমনেতেই দুর্বল ভাবে মানুষ। তার উপর যদি আবেগ ধরে বসে থেকে সব জলাঞ্জলি দেও তাহলে তুমি মূর্খ। যা হচ্ছে তা বদলানোর সাধ্যি তোমার না থাকলে তা নিশ্চুপে হতে দেও আর নিজের কাজ নিজে করে যাও।’
তিস্তা জানালার বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মা কী তবে কিছু বুঝে গেলো?
কোনোমতে সে ভাতটা গিলে নিলো। ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আরে না আম্মা। তুমি ভুলভাল বলছো। কয়দিন পর পরীক্ষা তো, তাই আমি পড়াশোনায় মন বসাতে চাইছি। স্কুল গিয়ে আর কী হবে? সব পড়া তো দাগানো শেষ। এখন বাড়িতে পড়বো। আর মাস্টারমশাইও তো নেই।’
মাস্টারমশাই এর কথা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই কথা থেমে গেলো তিস্তার। মাস্টারমশাই নেই! কে বলেছে নেই? সবসময় স্ব শরীরে থাকাকেই থেকে যাওয়া বলে? না থেকেও যে সারাটা সময় ভীষন গভীরে লেপ্টে থাকে, তাকে থাকা বলে না?
তনয়া বেগম আর কিছু বললেন না। মেয়েকে চুপচাপ খাইয়ে দিলেন। এঁটো থালাটা নিয়ে উঠে দরজা অব্দি গিয়ে ফিরে তাকালেন। বেশ শীতল কণ্ঠে বললেন,
-‘ভালো নাম্বার না করলে মাস্টারমশাই রাগ করবে। তুমি কী চাও, তোমার মাস্টারমশাই অন্য লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসুক রাগ করে?’
তিস্তা উত্তর দেয় না। কেবল ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। মা কি বললো? অন্য বউ মানে!
তনয়া বেগম চাপা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মায়ের মন মেয়েকে না বুঝলে কাকে বুঝবে?
_____
বাহিরে রাতের আঁধারে হুতুম পেঁচা ডাকছে। রাতের বিভীষিকাময় আঁধারকে আরও একধাপ ভয়ঙ্কর অবস্থায় রূপান্তরিত করছে এ ডাক।
হারিকেনের আলোটা উঠোনের মাঝে নিভু নিভু ভাবে জ্বলছে। পিঁড়ি পেতে বসে আছে তিস্তা তার বাবার ফেরার অপেক্ষায়। লতিকা বেগম ক্লান্ত হাতে, তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছে। তনয়া দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
দূর হতে শিয়ালের ডাক ভেসে আসছে। লতিকা বেগম বাতাস করতে করতে বললেন,
-‘যা তিস্তা, ঘরে গিয়া ঘুমা। এত রাতে মাইয়া মাইনষের বাইরে থাকতে নাই।’
তিস্তা দাদীর কথায় একটু বিরক্ত হলো। সবার বাবার জন্য চিন্তা হচ্ছে আর দাদী কিনা আজগুবি ভাবনায় ব্যস্ত।
তনয়া বেগম নিজের মেয়ের অভিব্যক্তি বুঝলেন। ছোট্ট কণ্ঠে বললেন,
-‘থাক না আম্মা। উনি আসলে নাহয় যাইবো।’
দাদী আর কিছু বলতে যাওয়ার আগে হুড়মুড় করে তাদের বাড়িতে কেউ প্রবেশ করলো। ভড়কে গেলো তারা তিনজন। দাদী ভীত কণ্ঠে বললো,
-‘কে? কে রে?’
ব্যতিব্যস্ত এক পুরুষালী কণ্ঠে কেউ বললো,
-‘চাচী, আমি। আমি আলতাফ।’
সবাই একটু ধাতস্থ হলো। তাদের প্রতিবেশী চাচার ছেলে আলতাফ। দাদী বিরক্ত কণ্ঠে বললো,
-‘আঃ মরণ। দাম’ড়া হইছোছ কী বাতাসে? এমন কইরা কেউ আহে?’
লোকটা যেনো গায়ে মাখলো না দাদীর কথা। কেবল উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
-‘আহা চাচী, আপনারা আমার সাথে বাজারে চলেন। তাড়াতাড়ি।’
এই সময় এমন কথা শুনে সবাই বিস্মিত হয়। দাদী অবাক কণ্ঠে বলে,
-‘এই রাইতে আমরা বেডি মানুষ গঞ্জের হাটে গিয়া কী করমু? নেশা করছোছ নাকি রে ছেমরা?’
ছেলেটা নিজের কণ্ঠে আকুতি ঢেলে বললো,
-‘না চাচী। আপনাগো সর্বনাশ হইছে। আমান ভাই এর পরাণ যে যায় যায় অবস্থা। বড় পথ দিয়া আসার সময় তার সাইকেল নাকি গাড়ির লগে ধাক্কা খাইছে। পা’টা শেষ। জানটা না আবার চইলা যায়। তাড়াতাড়ি চলেন।’
কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছাতেই সবার শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। ভুল শুনছে না তো? হুতুম পেঁচা’র কু ডাক বুঝি সত্যি হলো!
#চলবে
[দশটায় দেওয়ার কথা থাকলেও দিতে পারি নি। এত বড় লিখা ভুলবশত ডিলিট হয়ে গিয়েছিল। আবার লিখে দিলাম। ]