মনের মানুষ ❤️ পর্ব-২২

0
643

#মনের_মানুষ ❤️
#দ্বাবিংশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি

“আমার কিন্তু মনটা একেবারে সায় দিচ্ছে না আহু…..তুই অতদূরে কিভাবে একা থাকবি বল তো মা?”

বাবার কথায় আহেলি জামা-কাপড় গোছানো থামিয়ে বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো….আহেলির মা উমা দেবীও পাশেই মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছেন।আর মাত্র একটা গোটা দিন তারপর কাল দুপুরের প্লেনেই মুম্বাই যাবে আহেলি তাও আবার সাতমাসের জন্য।মেয়ের সাথে এই দূরত্ব কিছুতেই মানতে রাজি নন অমিও বাবু আর উমা দেবী।আহেলি এবার হালকা হেসে বললো,,,,

“তোমরা দুজন যদি এরকম করতে থাকো তাহলে কি চলে বলো?আমি এই কাজটা পাওয়ার জন্যই তো এতদিন এতো খাটলাম…..এবার তো ওদের কথা মতোই আমায় চলতে হবে।”

“বোম্বাটা কাছে নয় আহু…..ওই শহরে তুই কিভাবে থাকবি একা?তোর কোনো বিপদ হলে তখন?”

“মা তুমি তো এবার থামো….এমন করছো যেনো আমি মুম্বাই নয় মোম্বাসা যাচ্ছি।এসব এক্সপিরিয়েন্স থাকা ভালো মা,পরে কাজের জন্য আমায় বাইরে যেতে হলে অভিজ্ঞতা থাকবে।আর হ্যাঁ ওটা যতই নতুন শহর হোক আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।”

“সে কতো ম্যানেজ করবে আমার ভালোই জানা আছে….তা আজ দুপুরে আসছে তো প্রান্তিক?”

“হ্যাঁ মা..প্রথমে তো রাজি হচ্ছিলো না।আমি অনেকবার বলার পর রাজি হলো শেষমেশ।তবে প্যাকিং সেরে আমায় যে বেরোতে হবে মা।”

“সেকিরে?আবার কোথায় যাবি?”

“আমি যখনই কোথাও গেছি মামনিকে জানিয়ে গেছি।মামনি যতই আমার ওপর রাগ করুক,আমি মামনির কাছ থেকে একবার ঘুরে আসবো বাবা।”

“কি দরকার আহু?ওতো তোর মা আর আমায় কম কথা শোনায় নি….আর ঐ ঋষভ এখন সাংসদ।ওর বাড়িতে যাওয়া এতই সোজা নাকি রে?”

“আমি তো সাংসদ ঋষভ সেন এর বাড়িতে যাচ্ছি না বাবা….আমি যাচ্ছি মামনির সাথে দেখা করতে।আমি মানুষটাকে ভীষণ ভালোবাসি তাই না জানিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় সে উনি যেমনই হোক না কেনো।”

“যাবি যখন বলছিস ঘুরে আয়….তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।দুপুরে আবার তোর বন্ধু আসবে তো।”

মায়ের কথায় আহেলি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বললো,,,
“আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো মা।তুমি চিন্তা করো না।আর তোমার রান্না কি শেষ?”

“প্রায় শেষ….তুই প্রথমে সাথে ছিলিস বলেই সম্ভব হয়েছে।”

আহেলি আবার জামা-কাপড় গোছানোতে মন দেয়।ট্রলির চেন আটকে ব্যাগ লক করে বিছানায় বসে পরে….একবার ঘরের দিকে তাকাতে আহেলির মনটা খারাপ হয়ে যায়।এসব চেনা জায়গা ছেড়ে অনেকগুলো দিন ওকে বাইরে থাকতে হবে।”

🌸🌸🌸🌸

আহেলি বরাবরের মতো বাইরে স্কুটি রেখে গেটের সামনে যেতেই একজন কালো পোষাক পরা লোক এসে দাঁড়ালো ওর সামনে…..জিজ্ঞেস করলো কি দরকার।আহেলি ভেতরে যাওয়ার কথা আর নিজের নাম বলতেই লোকটা চলে গেলো বাড়ির ভেতরে,খানিকক্ষণ পর ফিরে এসে গেট খুলে দিলো।আহেলি ভেতরে ঢুকতেই বেশ অবাক হয়…..বাড়িটা নতুন করে রঙ হয়ে গেছে,সামনে দুটো নতুন গাড়ি দাঁড়িয়ে।এরমধ্যে একটার মাথায় বাতি লাগানো,তারমানে ঋষভ বাড়িতেই আছে যদিও ওর মুখোমুখি হতে চায় না আহেলি।

আহেলি ভেতরে যেতেই দেখলো ওর মামনি ড্রয়িং রুমে বসে ফোনে কারোর সাথে কথা বলছে হেসে হেসে….আহেলি কে দেখে ফোন নামিয়ে রেখে ওকে ভেতরে আসার ইশারা করলো।আহেলি সোফার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা হেসে বললো,,,,

“কেমন আছো মামনি?”

“ভালোই….তা হটাৎ তুই এখানে?কোনো দরকার নাকি?কিছুতে ঋষভ এর সইয়ের দরকার?”

মামনির কথায় আহেলি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বললো,,,,
“নাহ মামনি তেমন কোনো দরকার নয়….তোমার সাথেই দেখা করতে এলাম।আমি জানি তুমি রেগে আছো কিন্তু আমি তোমার সাথে দেখা না করে যেতেও পারছিলাম না।”

“আহেলি আমার পুরোনো কথা মনে রাখার মতো সময় নেই….হ্যাঁ এটা ঠিক তুই অমিওর মেয়ে আর আমার ঋষির প্রাক্তন প্রেমিকা।একটা সময় আমি তোকে ভীষণ ভালোবাসতাম….কিন্তু তুই আসলে আমার ভালোবাসার যোগ্যই নোস।আমার ছেলের গায়ে হাত তোলার জন্য তোকে আমি এখনই একটা থাপ্পর মারতে পারতাম কিন্তু আমার এই মুহূর্তে তার ইচ্ছা নেই….তোর ভাগ্য খারাপ যে তুই ঋষিকে জীবন থেকে হারিয়ে ফেললি।ওর করা সামান্য একটা ভুলের জন্য এতো বড়ো মানুষ হয়েও তোর মতো মেয়ের কাছে ক্ষমা চেয়েছে….আর তুই নিজের দেমাগ দেখিয়েছিস।ভালোই করেছিস….নিজের কবর নিজের হাতে কজন আর খোরে?এমনিও তোর মতো সামান্য একটা গ্র্যাজুয়েট মেয়েকে আমার ঋষির পাশে মানায় না!তাই যা হওয়ার ভালোই হয়েছে।”

“আমি তোমার সাথে কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে চাই না মামনি….তাই তুমি যা বলবে তার উত্তরে কোনো কথাও বলবো না।আমি একটা চাকরি পেয়েছি মামনি….সামান্য চাকরি আর তার জন্য মুম্বাইতে যেতে হবে ট্রেনিং পারপাসে।কাল আমার ফ্লাইট,যাওয়ার আগে তোমায় জানিয়ে গেলাম।”

“তোর আবার চাকরি হয়েছে?তা ভালো….দেখিস বাবা ওসব জায়গায় গিয়ে আবার কোনো কান্ড ঘটিয়ে বসিস না।আসলে তোদের মতো মেয়েরা তো আবার ছেলেদের ছাড়া চলতেই পারে না তাই না?নাহলে ঋষির থেকে আলাদা হওয়ার পরই আরেকজন জুটিয়ে নিস!”

“ঠিকই বলেছো মামনি…..আমার মতো মেয়েরা এসবই পারে।কথায় বলে ক্ষমতা প্রতিপত্তি আর অর্থ মানুষকে বদলে দেয়,আজ তা নিজের চোখে দেখেও নিলাম।আমি আসছি মামনি….আর কোনদিন তোমার বাড়িতে আসবো না বিরক্ত করতে,কথা দিলাম।”

আহেলির কথা শেষ হওয়ার আগেই আরেকটা মেয়ে ভেতরে এলো….মেয়েটার বয়স আহেলির মতনই।বেশ ফর্সা আর দেখতে সুন্দর….চুলে লালচে রঙ,পরনে চুড়িদার।মেয়েটা একবার আহেলির দিকে তাকিয়ে তারপর ঋষভ এর মায়ের দিকে ফিরে বললো,,,

“আন্টি ঋষভ কোথায়?ওকি বেরিয়ে গেছে?আজ কিন্তু আমাদের শপিংয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।”

মেয়েটার কথায় ঋষভ এর মা হেসে বললো,,,

“আরে সারা তুমি এসেছো?এতক্ষন তোমার মায়ের সাথেই কথা হচ্ছিলো,ঋষি তো ঘরেই আছে।যাও তো গিয়ে টেনে নিয়ে তোমার সাথে নিয়ে যাও।সারাক্ষণ কাজ আর কাজ।”

“একদম আন্টি,তুমি আর মম তো সারাক্ষণ বিয়ের প্ল্যান করেই চলেছো।এদিকে আরেকজনের তো কোনো হুশ নেই।প্রি-ওয়েডিং শুটের কোনো ডেট দিতে পারছে না….ভালো লাগে না আমার।”

“সারা…তুমি না একজন মেয়ে।ঋষি কে তো বশ করেই ফেলেছো তোমার রূপে….বাকিটাও হয়ে যাবে।আসলে কি বলোতো…ছেলেদেরকে বাঁধতে জানতে হয়।শুধু তর্ক করলেই হয় না।তুমি যাও গিয়ে ঋষি কে নিয়ে এসো।”

“ওকে আন্টি।”

সারা নামের মেয়েটা ওপরে যেতেই ঋষভ এর মা আহেলির দিকে তাকিয়ে বললো,,,

“ও কে জানিস আহেলি?ও হলো সারা….আমাদের মন্ত্রী-মশাইয়ের একমাত্র ভাইঝি।অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে দুমাস আগেই কলকাতায় এসেছে আর তারপরই ঋষির সাথে ওর বিয়ে দিতে চেয়েছে মন্ত্রী-মশাই।তুই কি ভাবলি আহেলি?তুই আমার ঋষিকে ছেড়ে চলে গেলে ও তোকে ফেরাতে যাবে?তোর আর সারার মধ্যে কতটা ফারাক বুঝতে পারছিস তো?আমার ঋষির জন্য সারা পারফেক্ট তাইতো তোকে চলে যেতে হলো।আসলে ভগবান যা করে মঙ্গলের জন্যই করে।তোর জন্য শুভকামনা রইলো রে….চাকরি বাকরি কর তারপর একটা তোর মতো ছেলেকে বিয়ে করে নিস।”

ঋষভ এর মায়ের কথার মাঝেই ঋষভ এর একটা হাত ধরে সারা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো….ঋষভ এর পরনে আগের মতোই পাঞ্জাবি,পাজামা আর হাফ ব্লেজার তবে প্রতিটা পোশাক দামি ব্র্যান্ডের…..ঋষভ আহেলির দিকে অবাক হয়ে তাকাতেই ওর মা তাচ্ছিলের হাসি হেসে বললো,,,

“আহেলি চাকরি পেয়েছে রে ঋষি…মুম্বাই যাবে তাই বলতে এসেছিলো।ওকে বাড়িতে ঢোকানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলো না আমার কিন্তু কি করবো বল?ফেরানো তো যায় না….”

“বাহঃ তুই চাকরি পেয়েছিস?ভালো লাগলো….মন দিয়ে কাজ করিস।আর কোনো দরকার হলে বলিস আমি হেল্প করবো।”

ঋষভ এর কথা শুনে আহেলি হাসলো….তারপর ওর সোজাসুজি দাঁড়িয়ে বললো,,,

“আমার এই তিনমাসে ভীষণ আফসোস হচ্ছিলো…..”

“সেটা হওয়ারই কথা আহেলি….তুই হয়তো ভেবেছিলিস আমি তোর হাতে পায়ে ধরে ফেরাতে যাবো কিন্তু আমি তা করিনি।আর তুই আমার জন্য পারফেক্ট ছিলিস না।তোর কতো অভিযোগ থাকতো….আর সারাকে দেখ,আমার সমস্ত বদঅভ্যাসগুলো মানিয় নিয়ে আমার সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে।”

“সেই….তোমার সাথে তাল মেলাতে পারিনি।আসলে তুমি আর আমি একেবারে এক নয়।যাক সেসব কথা….কিন্তু আমি আমাদের সম্পর্ক ভাঙা নিয়ে আফসোস করিনি।আমি আফসোস করতাম তোমায় চড় মেরে….কিন্তু আজ আমার মনে হচ্ছে সেদিন আরো দুটো চড় মারা উচিত ছিলো তোমায় তাহলে যদি শিক্ষা হতো।ক্ষমতার লোভ মানুষকে কতটা নিচে নামাতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ তুমি নিজেই…..তবে আজ আমি তোমায় ক্ষমা করে আমার মন থেকে একেবারে মুছে দিলাম।তোমার মতো একটা মানুষকে আমি আমার মনের মানুষ এর স্থান দিয়েছিলাম ভাবতেই নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে।আর এই যে সারা….সামলে রেখো তোমার বরকে নাহলে কবে দেখবে কোনো মেয়ের সাথে রাত কাটিয়ে ফিরে বলবে এটা তেমন কিছুই না।দলের জন্য এমন স্যাক্রিফাইস করতেই হয়….তোমার জ্যেঠুর কথাতেই করেছি।”

সারা আহেলির কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকাতে আহেলি ঋষভ এরদিকে ফিরে বললো,,,,

“তোমার নতুন জীবনের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো….আর মামনি কে যে কার যোগ্য সেটা তো সময় বলবে।আজ আমি আসি।”

ঋষভ এর বাড়ি থেকে বেরোতেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো আহেলির….স্কুটি চালাতে গিয়ে এতটাই অন্যমনস্ক হয়ে পরলো কখন যে ওর সামনে একটা ফোর হুইলার এসে গেছে তা খেয়ালই করেনি।নিজের স্কুটিটাকে নিয়ে সরতে গিয়েও ব্যর্থ হলো আহেলি….পাশের একটা অটোর সাথে ধাক্কা খেয়ে পরে গেলো রাস্তার মাঝে।

“ইসসস কি অবস্থা হয়েছে তোর আহু?কিকরে পরে গেলি রাস্তার মধ্যে?যদি গাড়িটা এসে তোকে ধাক্কা দিতো তখন?আমি এজন্যই তোকে আজ বেরোতে বারন করছিলাম।

মায়ের কথায় আহেলি বললো,,,
“উফফ মা!আমি ঠিক আছি…..তেমন কোথাও তো লাগেনি।”

“না লাগেনি….চারদিক কেটে ছরে কি অবস্থা হয়েছে।”

“ঠিক বলেছেন আঙ্কেল…তবে চিন্তার কিছু নেই।আপনাদের বাড়িতে ফার্স্ট-এড বক্স আছে?থাকলে একটু দেবেন,আমিই তাহলে ব্যান্ডেজ করে দিতে পারতাম।”

প্রান্তিকের কথায় আহেলির মা উমা দেবি তৎক্ষনাৎ শো-কেসের মধ্যে থেকে ফার্স্ট-এড বক্স এনে প্রান্তিকের হাতে দিলেন।প্রান্তিক বক্স খুলে সবটা দেখে বললো,,,

“শুধু ওষুধ দিলেই হবে না….যেভাবে কেটেছে পিচ রাস্তায় তাতে একটা টিটেনাস নেওয়ার খুব প্রয়োজন।আপনাদের বাড়ির কাছেই তো একটা ফার্মেসী আছে দেখলাম আঙ্কেল।প্লিস আমি যেটা লিখে দেবো সেটা আনবেন?”

“হ্যাঁ নিশ্চই।আজ তুমি না থাকলে কি হতো কে জানে?তুমি দাও লিখে….আমি এক্ষুনি আনছি।”

প্রান্তিক একটা নোটপ্যাডে লিখে দিতেই সেটা নিয়ে আহেলির বাবা বেরিয়ে গেলেন।প্রান্তিক তুলোয় করে সেভলন নিয়ে প্রথমে কাটা জায়গায় দিলো,আহেলি মুখ কুঁচকে আহঃ বলে উঠতেই প্রান্তিক ওর দিকে না তাকিয়ে বললো,,,

“এখন আর ব্যথা পেয়ে কি হবে?অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় গাড়ি চালালে এই হয়….এখন চুপচাপ বসে থাকুন।”

“সেই…আচ্ছা তুমিই বলো তো আজ ওর বেরোবার কি দরকার ছিলো?ওই ঋষভ এর বাড়িতে যাওয়ার খুব প্রয়োজন ছিলো কি?”

প্রান্তিক আহেলির মায়ের কথায় অবাক হয়ে তাকাতেই আহেলি নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো।প্রান্তিক ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে আবার নিজের কাজে মন দিলো।খুব যত্ন করেই প্রান্তিক দুহাতের কনুই আর পায়ের পাতায় ব্যান্ডেজ করে দিলো।এরমাঝে আহেলির বাবা প্রান্তিকের লিখে দেওয়া টিটেনাস আর সিরিঞ্চ আনতেই আহেলি ভয়ার্ত মুখে ওর মায়ের দিকে তাকালো।কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,,,,

“ওষুধ খেলে হবে না?ইনজেকশন নিতেই হবে?”

“একদম কাদবি না….এতো বড়ো হলি তবু তোর ইনজেকশন নিয়ে ভয় গেলো না?”

“আহেলি আবার ভয়ও পায় নাকি?জেনেও খুশি হলাম…..”

সিরিঞ্চ থেকে তুলোয় অল্প ওষুধ নিতে নিতে কথাটা বললো প্রান্তিক।আহেলির বাবা আর মা দুজনই ওদেরকে খেতে আসার কথা বলে বাইরে গেলেন….এতক্ষন আহেলি কে নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন অথচ টেবিলে খাওয়ার সাজানো হয়নি।প্রান্তিক সিরিঞ্চ এগিয়ে নিয়ে যেতেই আহেলি চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে ধরলো।আহেলির মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো প্রান্তিক তারপর নিজেই আহেলির বাঁহাতের জামার হাতাটা সরিয়ে পুশ করলো…..তৎক্ষনাৎ আহেলি চোখ মেলে তাকাতেই দুজনের চোখাচুখি হলো।আহেলির মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে,প্রান্তিক আহেলির ডান হাতটায় তুলোটা ধরিয়ে বললো,,,

“অল্প কিছুক্ষন ধরে থাকুন তাহলেই হবে।”

আহেলি নিজের বাঁহাতের দিকে তাকিয়ে বললো,,,,

“কখন দিলেন?কিছু তো বুঝতেই পারলাম না….”

“এটাই আমার স্পেশালিটি,কেউ জানতেও পারে না অথচ কাজ হয়ে যায়।তবে আপনার হাতের চোটগুলো গুরুতর না হলেও সামান্য নয়…..আঙ্কেল যে ওষুধগুলো এনেছেন,সেগুলো সময়মতো খাবেন তাহলে কালকের মধ্যেই ব্যথা সেরে যাবে।”

“হুমমম….ভাগ্যিস কালকের ফ্লাইটটা সন্ধ্যেয়।সারাটাদিন বাড়িতেই থাকতে পারবো।”

“তা আজ হটাৎ ঋষভ এর বাড়িতে গেলেন যে?ব্যাপারটা কি মিটিয়ে নিচ্ছেন?”

“সবটা জানার পরেও বিদ্রুপ করছেন আমার সাথে?”

“আমি বিদ্রুপ কখন করলাম আহেলি?আপনার যদি ঋষভ এরজন্য রাগ থেকেই থাকে তাহলে ওদের বাড়িতে গেলেন কেনো?”

“মামনির সাথে দেখা করতে গেছিলাম….আসলে এরআগে যেখানেই গেছি মামনি কে জানিয়ে গেছি তাই এবারেও।তবে আমি ভাবিনি গিয়ে এতকিছু জানতে পারবো।”

“মানে?কি জানতে পেরেছেন?”

“ঋষভদার বিয়ে ঠিক হয়েছে মন্ত্রীর ভাইঝির সাথে…..মেয়েটার নাম সারা।অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা কমপ্লিট করে ফিরেছে।আমি ঋষভদার থেকে কতটা অযোগ্য আজ সেটাই বুঝিয়ে দিলো ওরা,ইভেন ঋষভদাও এখন নতুন সম্পর্কে খুশি।এই মেয়েটা আমার মতো নয় বলে,আমি আর পাঁচটা টিপিক্যাল প্রেমিকার মতোই ঋষভদার থেকে সময় চাইতাম,রাস্তায় হাত ধরে হাঁটতে চাইতাম,ওকে সব বিষয়ে জোর করতাম অথচ সারা নাকি ঋষভদাকে ওর মতো করেই মেনে নিয়েছে।ব্যাস আর কি চাই?”

“আর ইউ সিরিয়াস আহেলি?”

“তো আপনার মনেহয় আমি মজা করছি?”

“আমি কিন্তু ভেবেছিলাম ঋষভ ছেলেটা আপনাকে ভালোবাসে,হয়তো ভুলত্রুটি আছে তাও আপনাকে চায়।কিন্তু…..”

“নাহ প্রান্তিক…..ঋষভদা ভালোবাসে না আমায়।ও আসলে নিজেকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসতে পারে না।এটা অবশ্য ঠিক যে নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতে হয় তবে তা স্বার্থপরের মতো নয়।সারাজীবন ঋষভদা একটাই জিনিস বুঝেছে আর তা হলো রাজনীতি।প্রথমে ঋষভদা ভালোবাসে রাজনীতি করতো কিন্তু যতদিন গেছে ওর লোভ বেড়েছে,এখন তো ক্ষমতার লোভে রাজনীতি করে…তাই ওকে ওর ওপরমহল থেকে যা আদেশ করা হয় সেটাই করে।এবারে হয়তো সারাকে বিয়ে করাটাও ওই শ্রেয়ার মতোই ব্যাপার।”

“আপনাকে কি কোনোভাবে ওরা কিছু বলেছে?আর সেজন্য রাস্তায় এতটা অন্যমনস্ক ছিলেন আপনি?”

“হ্যাঁ বলেছে….তবে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।টাকা প্রতিপত্তি আর ক্ষমতা মানুষকে কতটা নিচে নামাতে পারে তা আজ আমি নিজের চোখে দেখেছি।হ্যাঁ এটা ঠিক যে ওদের কারণেই আমার এক্সসিডেন্টটা হয়েছে….আসলে হটাৎ করে চেনা মানুষগুলোর বদলে যাওয়া রূপটা হজম করতে পারিনি।”

“আপনি কেনো চুপচাপ চলে এলেন আহেলি?ঋষভ একজন মন্ত্রী বলে ও যা খুশি করবে,আপনাকে অপমান করবে আর আপনি সবটা শুনে চুপচাপ চলে এলেন?আর আজ যদি আপনার কিছু হয়ে যেতো তখন?”

আহেলি এই প্রথম প্রান্তিককে এতটা উত্তেজিত হতে দেখলো সাথে রেগেও গেছে।প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে আহেলি বললো,,,

“সবসময় মুখে বলে জবাব দিতে নেই,কিছু কিছু উত্তর সময় দেয় আর সেই সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।কিন্তু আপনি এতো রেগে যাচ্ছেন কেনো?আমার কিছু হলে আপনার কি?”

“আমার আবার কি?আমার কিছুই না…..আপনারই ব্যাথা লাগতো।”

আহেলি কিছু বলবে তার আগেই ওর মা ওদেরকে ডাকলো খাওয়ার জন্য।আহেলি ইশারায় প্রান্তিককে উঠতে বলে নিজেও উঠে দাঁড়ালো….পায়ের পাতায় চোট থাকায় আহেলি ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে পড়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই ওকে ধরে নিলো প্রান্তিক।প্রান্তিকের দিকে আহেলি চোখ রাখতেই প্রান্তিক দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে বললো,,,,

“এবার থেকে নিজেই নিজের খেয়াল রাখার চেষ্টা করুন।কাল থেকে আপনার কাছে আপনার বাবা,মা কিংবা আমি কেউই থাকবো না।”

আহেলি প্রান্তিকের কথার কোনো উত্তর দিলো না।আজ সত্যিই আহেলির অনেক বড়ো ক্ষতি হতে পারতো,স্কুটি থেকে রাস্তায় পরে গিয়েও আহেলি খেয়াল করে উল্টোদিকের গাড়িটা একদম ওর সামনে ঠিক তখনই ওকে কেউ টেনে নেয়।ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেও কিছু না হওয়ায় ধীরে ধীরে চোখ খুলে আহেলি দেখে ওর সামনে প্রান্তিক।ও নিজেও গাড়ি নিয়ে আহেলির বাড়ির দিকে যাচ্ছিলো।আহেলি কে দেখেই গাড়ি থেকে নেমে এসেছে….এরপর প্রান্তিক আহেলি কে নিজের গাড়িতে করে নিয়ে আসে।

সকলে একসাথে খেতে বসলো।আহেলি দেখলো প্রান্তিক খুব সহজেই ওর বাবা মায়ের সাথে মিশে গেছে…..খাওয়ার শেষে প্রান্তিক তৃপ্তির সুরে বললো,,,,
“আহেলি আমাকে বাড়িতে ইনভাইট করে ভালোই করেছিলো,রেস্টুরেন্টে এতো সুন্দর খাওয়া হতোই না।উফফ আন্টি আপনি সত্যিই দারুন রান্না করেন…..স্পেশালী এই চিকেন চাপটা।”

“তোমার যে ভালোলেগেছে এতেই আমি খুশি তবে চিকেনটা আমি নয় আহু রান্না করেছে।মেয়ে আমার রান্নাতেও খুব পাকা….সব নিজে নিজেই করে।”

“আই কান্ট বিলিভ দিস!আহেলি এতো সুন্দর রান্না করতে পারেন?আমি ভাবতাম আমাদের কাছে দেয়।”

প্রান্তিকের কথায় আহেলি মুখ ফুলিয়ে নিলেও ওর বাবা মা আর প্রান্তিক হেসে উঠলো।সকালে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলেও বাকি দিনটা আহেলির ভালোই কাটলো।
🌸🌸🌸🌸🌸🌸

প্রান্তিক আহেলি দুজনই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে…..এবার বাকি রাস্তাটা আহেলিকে একাই যেতে হবে।আহেলির বাবা মা আসতে চাইলেও আহেলি রাজি হয়নি…..এমনিই দুজনের মনখারাপ।নীরাবতা ভঙ্গ করে আহেলি বললো,,,

“এবার আমায় যেতে হবে।”

“হুমমম….সাবধানে যাবেন।আর নিজের খেয়াল রাখবেন।বাজে চিন্তা মাথায় আনবেন না।”

“বাজে চিন্তাগুলো আমি এখানেই ফেলে রেখে গেলাম,সাতমাস পর আমি যখন ফিরবো,আমার মুখে হাসি থাকবে।”

“তাই যেনো হয়…..আর আঙ্কেল আন্টিকে নিয়ে চিন্তা করবেন না।আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো ওনার খেয়াল রাখার।”

“আচ্ছা…..তবে সাতমাস পর ফিরে আপনাকে যেনো একা না দেখি।এবার কাউকে একটা আনুন যে আপনার যত্ন নেবে।”

আহেলির কথায় প্রান্তিক হালকা হাসলো তারপর বললো,,,,

“আমার জন্য এতো ভাববেন না….নিজের নতুন জীবন নিয়ে ভাবুন।আপনার ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে,যান এগিয়ে যান।”

প্রান্তিকের কথায় সম্মতি জানিয়ে ম্লান হাসলো আহেলি…..তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো।কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর আবারো ফিরে তাকালো আহেলি….প্রান্তিক তখনো একইভাবে ওরদিকে তাকিয়ে।প্রান্তিকের দিকে উদ্দেশ্য করে মুচকি হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানালো আহেলি।প্রতুত্তরে প্রান্তিক নিজেও তাই করলো তারপর দুজনই ঘুরে যে যার রাস্তা ধরলো।

এয়ারপোর্ট থেকে কিছুটা দূরে একটা ফাঁকা নির্জন রাস্তায় প্রান্তিক গাড়ি থামিয়ে,গাড়ির ওপরে বসে সামনের কাঁচে হেলান দিয়ে আছে।প্রান্তিকের দৃষ্টি আকাশের দিকে নিবদ্ধ…..ঠিক এমন সময় শব্দ করে একটা প্লেন চলে গেলো প্রান্তিকের মাথার ওপর দিয়ে।সাথে সাথে প্রান্তিকের বুকটা ধক করে উঠলো…..চোখ বন্ধ করতেই কয়েকফোটা জল গড়িয়ে পরলো।প্রান্তিকের ফোনের পছন্দের মিউজিক লিস্টে বাজছে,,,,,,

রাখো শরীরে হাত যদি
আর জল মাখ দুই হাতে
প্লিস ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে।

আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারি।
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোঁয়া বাড়ি
আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারি।

নিজের সিটে বসে জানলা দিয়ে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে আসা শহর কলকাতাকে দেখছে আহেলি….ক্রমাগত মনটা খারাপ হয়ে উঠছে।বাবা মায়ের সাথে সাথে আরো একটা হাস্যোজ্জ্বল চেহাড়া চোখের সামনে ফুটে উঠতেই আহেলির মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো।তৎক্ষনাৎ জানলা থেকে চোখ সরিয়ে সিটে সোজা হয়ে বসলো।হাতের ব্যান্ডেজগুলোর দিকে তাকাতেই আহেলি ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে সিটে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।

চলবে……….

(আগেও পোস্টের মাধ্যমে জানিয়েছি আজ আবারো বলছি…কারোর রিপোর্ট মারার জন্য পেজ থেকে কিছুই পোস্ট করা যায়নি তাই এতো দেরি হলো দিতে।অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here