মনের_অন্দরমহলে পর্ব ৫৫
#আনিশা_সাবিহা
সকাল সকাল হসপিটালে নিজের কেবিনে বসে বসে ফাইল ঘাঁটাঘাঁটি করে ফাইলের মধ্যেই মগ্ন হয়ে ছিল রুদ্র। ফাইল দেখা শেষ করে সে সব ফাইল একসাইড করে রেখে দিয়ে চশমা খুলে চেয়ারে ভালো করে ঠেস দিয়ে বসে চোখ বুঁজে বিড়বিড়িয়ে বলল,
–“এখন আবার রাউন্ডে যেতে হবে। তারপর আবার সার্জারি করতে ওটিতে ঢুকতে হবে। উফফ…আজকে এতো কাজ।”
দেরি না করে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। চশমাটা আবার চোখে দিয়ে নেয়। লটকে থাকা সাদা এপ্রনটা নিজের গায়ে জড়াতে জড়াতে তার মস্তিষ্ক হঠাৎ জানান দেয়, ‘আজকে তো আনিশার জন্মদিন।’
সে দূরন্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–“ওহ নো! আজকে তো আনিশার জন্মদিন। কালকে তো আয়াশ বলেছিল। একবার তো উইশ করা যেতেই পারে। নয়ত মনে শান্তি পাব না।”
যেই ভাবা সেই কাজ। রুদ্র টেবিল থেকে ফোনটা নিতে যাবে তখনই দরজা খোলার আওয়াজে পেছন ঘুরে তাকায় সে। সিয়া দ্রুত গতিতে দরজা আঁটকে দিয়ে ঝড়েরবেগে এসে রুদ্রের সামনে দাঁড়ায় আর বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে। তা দেখে রুদ্র হালকা ভ্রু কুঁচকে বলে,
–“আর ইউ ওকে সিয়া? টেনসড দেখাচ্ছে তোমায়।”
–“আই এম নট ওকে রুদ্র। আমার দম বন্ধ লাগছে।”
রুদ্র সিয়ার কাছে আসে। ওকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
–“এনি প্রবলেম?”
–“বললাম তো আমার দম বন্ধ লাগছে। আমি মারা যাব। তুমি প্লিজ হসপিটালের বিল্ডিংয়ের ছাঁদে যাবে আমার সাথে?”
রুদ্র চাইলেও সিয়ার কথা ফেলতে পারে না। সিয়াকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সে সম্মতি জানিয়ে বলে,
–“ওকে লেটস গো।”
ছাঁদের একপ্রান্তে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে শান্ত হয়ে নিল সিয়া। রুদ্রের দিকে তাকাতেই রুদ্র প্রশ্ন করল,
–“কি হয়েছে তোমার?”
সিয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে অসহায় চাহনি নিয়ে বলল,
–“বাবা হঠাৎ করেই আজ সকালে পাত্রপক্ষ আনলো। বিয়ে ঠিক করে ফেলল আমার।”
রুদ্র থমকে তাকালো সিয়ার দিকে। স্থির হয়ে বেশ কিছুক্ষণ থাকল সে। সিয়ার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে। রুদ্র জানে এটা কীসের অশ্রু! তবুও রুদ্র এই অনুভূতির দাম দিতে প্রস্তুত নয়। কি করে প্রস্তুত হবে হবে সে? এই অনুভূতির দাম তো সে দিতে পারবে না। নড়েচড়ে উঠে রুদ্র সিয়ার সামনে ফিরে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দম ফেলে স্তম্ভিত হয়ে বলল,
–“এটা তো খুশির খবর। কংগ্রাচুলেশনস। বিয়েটা করে নাও।”
সিয়ার এবার বড্ড রাগ হয়। কান্নামাখা চোখে এসে ভর করে অজস্র রাগ। রেলিংয়ে হাত দিয়ে আঘাত করে রুদ্রের একেবারে কাছে এসে বলে,
–“আর ইউ কিডিং উইথ মি? তুমি কি বুঝতে পারছো না নাকি বুঝতে চাইছো না?”
–“আমি কেন তোমার সঙ্গে মজা করতে যাব তাও বিয়ের মতো সিরিয়াস ব্যাপারে? যদি ছেলে ভালো হয় তাহলে বিয়েতে আপত্তি কোথায়?”
–“সেটাই। আসলে তোমার মেইন প্রবলেমটা কি জানো? তুমি দুনিয়ার সবার কথা ভাবো, নিজের শত্রুর কথাও ভাবো। সকলের জন্য কেয়ার করো। সবাইকে বোঝার ক্ষমতা রাখো। কিন্তু এই সবাই এর মধ্যে আমি কোথাও নেই। আমি এই সবার লিস্ট থেকে বাদ। আমাকে বোঝো না তুমি। নাকি বলব বুঝতে চেষ্টা করো না?”
রুদ্র অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইতস্তত বোধ করে দুইপা সরে আসে। রেলিং ধরে আকাশ পানে চেয়ে বলে,
–“কি বোঝার কথা বলছো তুমি?”
সিয়া রেগে কটমট করে রুদ্রের হাত ধরে তার দিকে ফেরায়। রাগ নিয়েই শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
–“আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুনতে পেয়েছো তুমি? ভালোবাসি তোমাকে। আমি তোমায় ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
অবশেষে মেয়েটার মুখে এসব কথা শুনে হতাশ চোখে তাকালো রুদ্র। সে শুনতে চায়নি এসব কথা। সিয়া মেয়েটা ডক্টর হলেও একদম বাচ্চামি যায়নি মন থেকে। সময়ে সময়ে জেদ ধরে বসতে সময় লাগে না তার। সে পারবে না সিয়াকে মেনে নিতে। যেই বুকে এখনো আনিশার সঙ্গে কাটানো বেশ কয়েকটা মূহুর্তকে স্মৃতি হিসেবে বেঁধে রেখেছে সেখানে এটা করা খুব জটিল। রুদ্র মিহি সুরে বলল,
–“সিয়া, তুমি তো সব জানো। তুমি জানো আমার মনে এখনো আনিশা রয়েছে। ওকে এই জীবনে মন থেকে বের করতে পারব কিনা জানি না। আমি তোমার অনুভূতির অসম্মান করছি না। কিন্তু আমার পক্ষে তোমায় মেনে নেওয়া অসম্ভব।”
সিয়া থরথর করে কেঁপে ওঠে। তার চোখে রাজ্যের কান্না এসে ভর করে। কোনোমতে কান্না দমিয়ে রাখে সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
–“আমি তোমায় ছাড়া অসম্পূর্ণ হয়ে বাঁচতে পারব না।”
–“বিয়েটা করে নাও। তাহলে খুব সহজেই এসব ভুলে যাবে।”
রুদ্র বেশ সহজভাবে কথাগুলো বলে দিল। সিয়া ক্রুদ্ধ হয়ে বলে,
–“এই অনূভুতি যদি সত্যিই বিয়ে করে ভুলে যাওয়া যায় তাহলে তুমিও তো একই কাজটা করতে। বিয়ের করতে পারো।”
–“পারি না। বিয়ে করে সুখে রাখা আর সুখে থাকা আলাদা ব্যাপার। আমার কাছে এই মূহুর্তে অন্য কাউকে বিয়ে করা মানে মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জে আমি হেরে যাব। সুখে রাখতে পারব না। কাউকে ইচ্ছে বিরুদ্ধে বিয়ে করে তাকে সুখে রাখতে না পারলে ভেতরে থেকে আরো মুষড়ে পড়ব আমি।”
আনমনে কথাগুলো বলতেই রুদ্রের দুটো হাত সিয়া খপ করে চেপে ধরে বলে,
–“আমার লাগবে না তোমার ভালোবাসা। আমি তো তোমায় ভালোবাসি। সেটা নিয়ে সারাজীবন আমি কাটাতে পারব। তোমায় চোখের সামনে দেখে আর সকাল বেলা তোমার ঘুম ভাঙিয়ে, তোমার সেবা করে আমার সারাজীবন এমনিই সুখে কেটে যাবে।”
–“বাস্তবতা নিজের আবেগ দিয়ে বিচার করতে নেই সিয়া।”
নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় রুদ্র। তৎক্ষনাৎ সিয়া চিল্লিয়ে কেঁদে বলে,
–“ঠিক আছে। তাহলে এটাও শুনে রাখো আমি অন্য কাউকে বিয়ে করব না। যদি সেটা হয় তাহলে আমি নিজেকে শেষ করে দেব। এ জীবন আমি রাখব না। মনে রেখো।”
বলেই কাঁদতে কাঁদতে ছুটে নিচে নেমে যায় সিয়া। রুদ্র বারংবার তাকে ডাকা সত্ত্বেও সে শোনে না। এখন যদি সত্যি সে কিছু করে বসে? এসব ভেবে দোটানায় পড়ে গেল রুদ্র। কি করবে সেটা ভেবে কূলকিনারা পেলো না সে।
বাড়িতে বসে আছি আমি। চেয়ার শক্ত করে চেপে ধরে রয়েছি। আয়াশ আমায় প্রায় ঘুমন্ত অবস্থায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেছেন। আমাকে না কিছু বলার সুযোগ দিয়েছেন না নিজে কিছু বলেছেন। তখন আমায় ঘুম ঠিকঠাক ভাঙেনি। সবকিছু অস্পষ্ট দেখছিলাম আর শুনছিলাম সব অস্পষ্ট। তখন উনি আমায় ধরে আমার ঘরে নিয়ে এসে শুইয়ে মাকে বলে গেছেন,
–“সে আমার হতে চায় না মা। আমি পারিনি তার মনে জায়গা করতে। ভুলটা কোথাও আমারই। দেরিতে হলেও বুঝেছি আমি। তাই রেখে গেলাম ওকে। ভালো থাকবেন।”
কথাগুলো আমার কানে অস্পষ্ট হয়ে ঠেকলেও পরে মিলিয়ে দেখেছি আমি। বর্তমানে স্তব্ধ হয়ে বসে রয়েছি। মাথা ঘুরছে আমার। মনে বার বার একটাই প্রশ্ন আসছে, ‘উনি সত্যিই আমায় রেখে চলে গেলেন? সত্যিই?’
চোখের পানিতে রীতিমতো সামনের সবটা ঘোলা হয়ে এলো। ঠোঁট কামড়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম আমি। কাঁদতে কাঁদতে অন্যমনস্ক হয়ে বললাম,
–“আসল কথা হলো উনি আমাকে বোঝেনই না। একটা সময় ছিল যখন উনি আমায় বলেছিলেন যে উনি নাকি আমার কর্মকান্ড আর আচরণই যথেষ্ট আমার মনে কি চলছে সেটা বোঝার জন্য। শেষমেশ আমাকে এই বুঝলেন উনি? বাজে লোক! অসভ্য লোক!”
এসব কথা বার বার বলছিলাম একা একা। জন্মদিনে এই যন্ত্রণা না দিলেই উনার চলছিল না? অবশ্য উনার মতে এটাই তো আমার কাছে বেস্ট গিফট। এখন উনাকে কি করে বোঝাই যে এটা আমার কাছে এক ভয়াবহ যন্ত্রণা!
কারো পায়ের শব্দ কানে আসতেই চট করে নিজের চোখ ডলে চোখের পানি মুছে নিয়ে বড় শ্বাস ফেললাম। দরজার দিকে নজর দিতেই হেলেদুলে ধীর গতিতে পান খেতে খেতে প্রবেশ করলেন দাদিমা। আমি উঠে দাঁড়িয়ে দাদিমাকে সালাম দিতেই দাদিমা তপ্ত মেজাজে বলে ওঠেন,
–“অবশেষে নিজের জেদ টাই পূরণ করে ছাড়লি অ্যা? থাকলি না বরের সাথে। বলি কি সংসারের থেকে তোর কাছে নিজের জেদটাই বড়?”
আমি কিছু বলতে উদ্যত হলেই উনি আমায় থামিয়ে দেন। আরো তিক্ত সুরে বলেন,
–“আরে বিয়ের পর যতই হক স্বামীই সব হয়। যার জন্য নিজের দৃষ্টি ফিরে পেলি, যার জন্য তোর ভাই আজ সুস্থ। যে তোরে নিয়ে সারা দিনরাত চিন্তা করে তারে পাত্তা দিলি না? আরে ভালোবাসা কয়জনে পায়? বিয়ে সবাই করে। বিয়ে মানে একটা দায়িত্ব আর দায়বদ্ধতা। সারাজীবন দায়িত্ব পালন করলেও অনেকে ভালোবাসা পায় না। তুই সেটা পেয়েও হারালি? আমি আগেই তোর মাকে পইপই করে বলেছিলাম এই মেয়ে সুবিধার না। যেখানে যাবে তার মন টিকবে না। একজনের লগে তো পালাইতে নিছিলি। পোলাডা নিজের আসল রুপ দেখাইলো তো?”
নীলাদ্রের কথা শুনতেই মনটা আরো বিষণ্ণ হয়ে গেল আমার। দাদিমার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে রইলাম। আমায় কেউ বুঝতেই চাইছে না। ইচ্ছে করছে নিজের চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে কান্না করতে। এমন সময় আগমন ঘটে মায়ের। হাতে খাবার আর পানি নিয়ে ভেতরে আসে মা। মায়ের দিকে নিজের কষ্টভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই মাও দৃঢ় গলায় বলল,
–“আজকে আমি আর মাকে আটকাব না। মা যা বলছে ঠিকই বলছে। কীসের অভাব ছিল তোর? কোন খুশিটা আয়াশ দেয়নি তোকে? সবথেকে বড় সম্পদ ভালোবাসা পেয়েছিস। সেটা পেয়েও হারিয়ে বর্তমানে তুই দুনিয়ার সবথেকে বড় দুর্ভাগা। তোকে আর কিছুই বলার নেই। খাবারটা খেয়ে উদ্ধার কর আমায়।”
–“মা আমি…”
–“কি মা আমি? নিজের স্বামীকে ধরে রাখার মুরোদ নেই আবার বড় বড় কথা? আর একটা কথাও মুখ থেকে বের করবি না। এইযে বউমা? দেখলে তো? এই মেয়েকে মাথায় তোলার পরিণাম?”
মায়ের উদ্দেশ্যে শেষ কথাগুলো দাদিমা বলতেই মাও দাদিমার সঙ্গ দিয়ে বলল,
–“ঠিকই বলেছেন মা। আমারই ভুল। মেয়েটাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছি। জানতাম না এর পরিণাম এমন হবে। আর তুই? তোকে আমি জোর করব না। তোর মনে যদি একবিন্দুও ভালোবাসা থেকে থাকে তাহলে ফিরে যাস। নয়ত আয়াশ বলেছে মৌখিক তালাক দিতে। ছেলেটা কিছু খেয়েও গেল না। তুই খেয়ে নে অন্তত।”
দাদিমার সঙ্গে এবার মাও চলে গেল ঘর থেকে। আমি অসহায় চাহনি নিয়ে বসে রইলাম। খাটে বসে পড়ে হাত-পা ছুড়াছুঁড়ি করলাম। নজর গেল পার্সের ওপর। পার্সের মধ্যে তো ফোন থাকার কথা। আয়াশ কি চলে গেছেন ঢাকা? সেটা জানার জন্য তৎক্ষনাৎ তাড়াহুড়ো করে ফোনটা বের করলাম। আয়াশের নম্বরটা লিস্টের সবার ওপরে থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম এভাবে আমাকে ফেলে যাওয়ার কারণে খুব ঝাড়ব। এই ভেবে ফোন লাগালাম। বেশ কয়েকবার ফোন করেও আশাহত হলাম। এবার ফোনটা ফেলে দিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করতে দিতে ইচ্ছে করছে। রাগে কটমট করে পঞ্চম বার ফোন করার পর শেষদিকে রিসিভ হলো ফোনটা। ব্যস্ততার সঙ্গে বললেন,
–“হ্যালো? এডভোকেট আয়াশ রায়হান ইজ হেয়ার!”
চোখজোড়া বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো আমার। উনি কি আমার নম্বর চিনতে পারছেন না? এটা কি করে সম্ভব? ঝাঁঝালো গলায় বললাম,
–“আয়াশ? এটা আমি।”
–“ওহ আনিশা? বলো কি বলবে? কেমন আছো? ভালো তো? খুশি আছো নিশ্চয়? নাচানাচি শুরু করে দিয়েছো নিশ্চয়?”
–“তার আগে আপনি বলুন কি এমন কাজ করছেন যে আপনার ফোন ধরতে লেট হলো? আর আমার নম্বরটা চিনতেও পারলেন না?”
–“আই এম বিজি নাউ। মৃধার সঙ্গে কাজ করছি।”
মাথায় যেন ফট করে আগুন লেগে গেল। মৃধাকে আয়াশ বাদ দিতে চাইলেও মৃধা আমায় বলেছিল সে প্রফেশন হিসেবে এই লইয়ার হতে চায়। আর গুরু হিসেবে আয়াশের থেকে সব শিখতে চায়। সেদিন আমি মানা করিনি। কিন্তু বর্তমানে মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি। চরম ভুল করেছি। কাঠকাঠ গলায় বললাম,
–“আপনি এতো তাড়াতাড়ি ঢাকায় পৌঁছালেন?”
–“ঢাকায় পৌঁছেছি বলেছি তোমায়? কক্সবাজারেই আছি হোটেলে। কেস বিষয়ক কাজ আছে এখানে আমার। মৃধাও এসেছে।”
রাগটা চড়চড় করে বাড়তে লাগে আমার। ব্যস্ততা থাকলেও আমার ফোন কখনো ইগনর করেননি উনি আর আজ? রাগে-দুঃখে চুপ করে রইলাম। আয়াশ নিজে থেকে বললেন,
–“ওহ ইয়েস, সো ডিভোর্সের কথা কিছু ভাবলে? কোনো ঝামেলা নেই এতে। মুখে বলবা তাহলেই শেষ। কবে বলছো মুখে? আজই? সন্ধ্যায় কি যাব? এই মুক্তি নামক গিফট টা দিতে?”
বুক ধক করে উঠল আমার। বলার মতো কোনো ভাষা না পেয়ে চোখ দিয়ে অশ্রু বেয়ে পড়ল। আচমকা উনি বললেন,
–“মৃধার সঙ্গে কাজ আছে আমার। আমি রাখছি। সন্ধ্যার পর পর আসছি। নিজেকে তৈরি রাখছো নিশ্চয়!”
বলেই আমার মুখে ওপর ফোন কেটে দেওয়াতে ফোনটা এবার ফেলেই দিলাম। আয়াশের মুখে মৃধা নামটা শুনে সহ্য হলো না আমার। এখন কি সারাক্ষণ মৃধা মৃধা করবেন? আমার আগে মৃধা বেশি ইম্পরট্যান্ট? ভুলটা আমারই। না পেরেছি উনাকে নিজের মনের কথা বলে আঁটকে রাখতে না পেরেছি উনাকে বোঝাতে।
সারাদিন ঘরেই কাটিয়ে দিলাম আমি। সন্ধ্যার আগমুহূর্ত। গোধূলিবেলা। নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে বসেই থাকলাম ঘরের এককোনায়। আশেপাশের পরিবেশ বড্ড বিষাক্ত! সবজায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে বিষণ্ণতা। অবশেষে আমায় ডাকতে এলো ছোট ছোট ছেলেমেয়ে গুলো। যাদের সঙ্গে আগে আমি থাকতাম। প্রথমে যেতে না চাইলেও ওরা আমার হাত ধরে টেনে আনলো।
আনমনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছালাম সেই চিরচেনা সমুদ্রের পাড়ে। বড় বড় ঢেউ খেলে যাচ্ছে। পাড়ে অন্যদিনের মতো সব কাজ শেষে সকলে মিলে গল্পগুজব করছে কেউ কেউ গান গাইছে। সকলে আমায় সেখানে গিয়ে বসতে বলল। কিন্তু আমি গিয়ে বসলাম খানিকটা দূরে। বালিময় চারিপাশ। সমুদ্রের ঢেউ আমার পা পর্যন্ত এসে সেখানেই থেমে যাচ্ছে। সেটাই মনোযোগ দিয়ে ভাবছি। আজ আয়াশ এলে সমস্ত কথা ভনিতা না করে বলেই ছাড়ব। এটা আমার প্রতিজ্ঞা। দমকা হাওয়া এলোমেলো করে দিচ্ছে সবটা। হাতখোঁপা টাও খুলে গেল অবশেষে বাতাসের বেগে। তবুও আমি চুপ। আচমকা একটা পিচ্চি মেয়ে দৌড়ে এলো আমার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
–“এই আনিশা আপা! তুমি এইহানে কি করো?”
–“এমনি বসে আছি। কেন করে বেনু(মেয়েটির নাম)?
বেনু ইশারায় আমায় পাড় ঘেঁষে অনেকটা দূরে দেখিয়ে বলে,
–“ওইতো ওইটা তোমার বর না? দেখো দেখো?”
আমি ওর ইশারা অনুযায়ী তাকালাম। দূরে হলেও চিনতে খুব একটা কষ্ট হলো না আমার। সাদা শার্ট পরিহিত, লম্বাটে মানুষটি আয়াশই। তবে উনার সাথে মেয়েটা কে? ভালো করে দেখতেই মনে হলো মৃধা। চোখ ছলকে উঠল আমার। উনি সমুদ্র পাড়ে মৃধার সঙ্গে? কেন? কি কারণে? উনি যে বললেন উনার কাজ আছে কেস নিয়ে? এই উনার কাজ?
–“দেখো দেখো। ওইটা তোমার বরই না? অন্য মাইয়ার লগে কথা কয়?”
আমি বেনুর কথায় পাত্তা না দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একপ্রকার তড়িৎ গতিতে হাঁটা দিলাম উনার দিকে। মাথা আর সারা শরীর আগুনে জ্বলছে আমার। হাউ ডেয়ার হিম? আজকে চোখই খুলে নেব আমি। রাগে-দুঃখে আবারও কান্না পেলো আমার। উনার নিকটে যেতে যেতে মৃধা চলে গেল। সেদিকে চোখ দিলাম না। আয়াশ থাকলেই হলো। উনি কি করে পারছেন আমায় বাড়িতে রেখে এখানে এসে মৃধার সাথে সমুদ্র পাড়ে কথা বলতে? ভয়ংকর রাগ খেলে গেল আমার মস্তিষ্কে। উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই উনি চমকে উঠে ভ্রু বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকালেন।
–“তুমি এখানে?”
–“কেন রে? আমার আসার কথা ছিল না তাই না? তোদের ডিস্টার্ব করলাম?”
ফোঁস ফোঁস করে বললাম আমি। আমার চাহনি দিয়েই উনাকে ভস্ম করে দিতে ইচ্ছে করছে এবার। কিন্তু আমার মুখে হয়ত তুইতোকারি শুনে বেজায় অবাক হলেন আয়াশ। কিছু বলতে নিলেই সরাসরি আবারও উনার শার্টের কলার দুহাতে টেনে ধরে আমি। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিই আমি। আচমকা এমন কাজের আশা হয়ত করেননি উনি। তাই টাল সামলাতে না পেরে পড়েই গেলেন। উনার অর্ধেক শরীর বালুতে আর বাকি অর্ধেক শরীর পানিতে ভিজে গেল। তবুও ক্ষ্যান্ত হলো না আমার মন। আমিও উনার বুকে উঠে আবারও শার্টের কলার ধরলাম। আয়াশ আধশোয়া হয়ে আমার কান্ড দেখে হা হয়ে রয়েছেন। আমি কলার ধরে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললাম,
–“খুব তো বড় বড় কথা বলেছিলি! আমার কর্মকান্ডে বুঝে নিবি আমি তোর জন্য কি অনুভব করি। কোথায় গেল তোর সেসব কথা? এতোদিনে এই বুঝলি আমায়? ঠকবাজ লোক, অসভ্য! আমি যেতে না যেতেই মেয়েদের সঙ্গে ঢলাঢলি শুরু হয়ে গেছে না? একটা কথা ভালো করে শুনে রাখ। আমি বেঁচে থাকতে এসব হতে দেব না। তোকে ডিভোর্স দেওয়া তো দূর সেটার কথা মনেও আনব না। খুন করে ফেলব তোকে আজকে। একবারও মনে হয় নি? আমার #মনের_অন্দমহলে তুই সবটা জুড়ে রয়েছিস? ভালোবাসি তোকে আমি। খুব ভালোবাসি। পাগলের মতো ভালোবাসি তোকে।”
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কালকে গল্প নাও দিতে পারি। অপেক্ষা করবেন না। আর গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবতা খুঁজবেন না।]