মন চায় তোকে পর্ব-এক্সট্রা_পার্ট

0
3075

#মন_চায়_তোকে
#এক্সট্রা_পার্ট
#নিশাত_জাহান_নিশি

মল্লিকা মাথাটা নিচু করে ফুঁফিয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।

প্রায় তিন ঘন্টা পর,,,,,

দুপুর বারোটা। অন্তর গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছে চট্টগ্রাম। অন্তরের ফুফু মিসেস হৈমন্তী বাড়ির গার্ডেনে ফুল গাছে পানি দিচ্ছিলো। অন্তর গাড়ি নিয়ে বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথে মিসেস হৈমন্তী এক গাল হেসে জোরে চেঁচিয়ে বলল,,,,,,

—–“কি রে বিয়ের পরের দিনই চলে এলি? আমরা সবাই তো আরো রেডি হচ্ছিলাম বউ ভাতে যাবো বলে। কাল তো বিয়েটা মিস করে গেলাম হসপিটালে ছিলাম বলে। বউভাত কিন্তু ছাড়াছাড়ি করা যাবে না।”

অন্তর গাড়ি থেকে নেমে মলিন হেসে মিসেস হৈমন্তীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—-“ফুফু আম্মু। আমি চলে এসেছি ঐ বাড়ি থেকে। তোমাদের আর বউভাতে যেতে হবে না।”

মিসেস হৈমন্তী কপাল কুচকে বলল,,,,,

—–“মানে?”

—-“মানে, আব্বুর ঠিক করা ঐ সাইকো মেয়ের সাথে আমি সংসার করতে পারব না। সি ইজ টোটালী ম্যাড।”

—–“কি করেছে সে?”

—-“আর বলো না, কাল রাতে ইচ্ছে করে আমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। কপালে এখনো এক্টু এক্টু ব্যাথা করছে।”

—-“হোয়াট। কি বলছিস এসব তুই?”

—-“সত্যি বলছি ফুফু আম্মু। তাই তো বাড়ী ছেড়ে চলে এসেছি।”

অন্তর এদিক সেদিক তাকিয়ে আবার বলল,,,,

—“আচ্ছা ফুফু আম্মু…. সাহেদ কোথায়?”

—–“সাহেদ তো উপরে ওর রুমে।”

—-“ওকে আমি আসছি।”

অন্তর আর দেরি না করে বাড়ির সদর দরজা পাড় হয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা দুই তলায় উঠে গেলো। সাহেদের রুমের দরজা খোলে অন্তর সাহেদকে বেডের উপর ল্যাপটপ নিয়ে বস থাকতে দেখল। অন্তরকে দেখা মাএই সাহেদ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে অন্তরের দিকে তাকালো। অন্তর এক ছুটে সাহেদের পাশে বসে বেশ সিরিয়াস হয়ে বলল,,,,,,

—–“সাহেদ প্লিজ রেজিস্ট্রি অফিস চল। আজ তাকে খুঁজে বের করবই করব।”

সাহেদ চোখে, মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলল,,,,,

—–“পাগল হয়েছিস তুই? নতুন বই রেখে এসব কোন ধরনের ছেলে মানুষী? তাছাড়া ঐ মেয়েকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না। কজ আমরা মেয়েটার নাম পর্যন্ত জানি না। ছবি ও নেই। কেউ কি করে ঐ মেয়ের সন্ধান দিবে। আর আমরাই বা খুঁজব কি করে? তুই খামোখা মরিচীকার পিছনে ছুটছিস। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে সংসারে মন দে।”

অন্তর মুখটা কালো করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। সাহেদ কিছুটা নরম হয়ে অন্তরের কাঁধে হাত রেখে বলল,,,,,

—–“দেখ অন্তর, যা হওয়ার হয়ে গেছে। মেয়েটা জাস্ট তোর ভালো লাগা ছিলো। ভুলে যা ঐ একদিনের ভালো লাগা। সামনে যে আছে তাকে নিয়ে ভাব। ঐ এক দিনের ভালো লাগার জন্য সারাজীবনের ভালো লাগাকে কষ্ট দিস না। আমাদের নতুন ভাবীকে আপন করে নে। ভালোবাসা দিয়ে নিজের কাছে টেনে নে। এতেই সবার মঙ্গল।”

অন্তর কিছুট মন মরা হয়ে বলল,,,,,,

—–“ঐ মেয়ের সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। খুবই ঝগড়ুটে আর অসভ্য এক্টা মেয়ে। ওর চাল চলন কিছুই আমার পছন্দ না।”

—–“দেখ, ভাবীর বয়স ও তো তেমন ও হয় নি। মাএ আঠারো পাড় করে ১৯ এ পা দিয়েছে। হয়তো এজন্য এক্টু বেশিই ছেলে মানুষী করছে। স্বামী হিসেবে তোর সেটা বুঝে নেওয়া উচিত। ভালো ব্যবহার করে, বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের হাতের মুঠো করে নে ভাবীকে। আশা করছি ভাবী ও তোকে মেনে নিবে। বাড়ি ফিরে যা। আমরা ও তোর সাথে যাবো। ভাইয়া, ভাবী হয়তো অাধ রেডি হয়ে গেছে। গত কাল আম্মুর অসুস্থতার জন্য যেতে পারি নি। তবে আজ কেউ মিস করব না। আগামী কাল একেবারে বউভাত খেয়ে বাড়ি ফিরব।”

কথাগুলো বলে সাহেদ বসা থেকে উঠে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে আর অন্তরকে উদ্দেশ্য করে বলছে,,,,,

—-“তুই বস। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

সাহেদ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। অন্তর মাথাটা নিচু করে কপালে হাত ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলছে,,,,,,

—-“সবাই শুধু আমাকেই দোষ দিচ্ছে। আমাকেই কেনো ঐ মেয়েটাকে বুঝতে হবে? আমাকেই কেনো ভালো ব্যবহার করতে হবে? মেয়েটা কি পারে না আমাকে বুঝতে? আমার সাথে ভালো ব্যবহার করতে? কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার। জীবনটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেলো।”

অন্যদিকে,,,,

মল্লিকা বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে কান্না করছে। কিছুতেই যেনো তার কান্না থামছে না। কিছুক্ষন পর মল্লিকা কান্না থামিয়ে শোয়া থেকে বসে চোখের জল গুলো মুচছে আর বলছে,,,,,,

—-“আমি খুব খারাপ এক্টা মেয়ে। যখন যা মন চায় তাই করে বসি। মাঝে মাঝে আমি নিজেকে ও বুঝতে পারি না। কোনো এক্টা মস্ত বড় ভুল করার পর রিয়েলাইজ করি যে ভুলটা আমি করেছি, শুধু ভুল না জঘন্য পাপ করেছি। কাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যা যা ঘটল সব আমার তৈরী। আমার একদম উচিত হয় নি উনার মাথা ফাটানো। আমি যদি উনাকে সবটা বুঝিয়ে বলতাম তাহলে হয়তো উনি বুঝত। না বুঝলে ও আমি জোর করে বুঝাতাম। আজ সকালে ও আমি উনাকে আটকাই নি। উল্টো যেতে দিয়েছি। একজনের বউ হওয়া সও্বে ও অন্যজনের কাছে ছুটে গেছি, তাকে দেখতে। বাড়িতে এসে আম্মুর মার খেয়েছি। সব কিছুতেই আমি দোষী। কি করব আমি? মাঝে মাঝে আমি নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি। উল্টো পাল্টা কাজ করে বসি। আমার কাজের জন্য সবাই খুব কষ্ট পায়। অথচ শেষে যে আমি ও কষ্ট পাই এই জিনিস টা কেউ বুঝে না। আমাকে সান্তনা দিতে ও আসে না। আব্বু ছাড়া এই পর্যন্ত আমাকে কেউ বুঝে নি। কেউ আমার প্রবলেম টা বুঝে না। আজ আব্বু ও আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। নিশ্চয়ই আমি খুব জঘন্য ভুল করেছি। আচ্ছা আমার জীবনে কি এমন কেউ আসবে না? যে আমাকে সম্পূর্ণ ভাবে বুঝবে? আমার ভুল গুলোকে বুঝে আমাকে বার বার আপন করে নেবে? হয়তো আসবে না! কজ আমি খুব খারাপ। কখন কি করি না করি কিছুর ঠিক থাকে না। আমি মনের দিক থেকে সবসময় একলা ই থেকে যাবো।”

মল্লিকা ওর চোখের জল গুলো মুছে বসা থেকে উঠে আবার বলল,,,,,,

—–“ভুল যেহেতু আমিই করেছি। তাহলে ভুলটা আমিই শুধরাবো। এখনি উনার নাম্বারে কল করে ক্ষমা চেয়ে নিব। আর উনাকে জলদি বাড়ি ফিরতে বলব।”

মল্লিকা আর এক মিনিট ও দেরি না করে সোজা হেঁটে বাড়ির ড্রইং রুমে চলে গেলো। মিঃ নাজিম আর মিসেস শিলা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। মল্লিকা মাথাটা নিচু করে উনাদের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মিসেস শিলা চোখ তুলে মল্লিকার দিকে তাকালো। মল্লিকা মিসেস শিলাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—–“উনাকে আমি ফিরিয়ে আনব আম্মু। তোমরা টেনশান করো না। আমার জন্য তোমাদের আর ফেইস লস হবে না। আমি খুব গুছিয়ে সংসার করব। সামনের দিকে কদম বাড়ানোর আগে ভেবে চিন্তে বাড়াবো। তোমরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারো।”

মিসেস শিলা মুখে হাসি ফুটিয়ে মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরে বলল,,,,,,

—-“এইতো আমার লক্ষী মেয়ে। আমি জানি তুমি ও আমার বড় মেয়ে মল্লরের মতো হবে। দেখছ তো, মল্লর কি সুন্দর গুছিয়ে সংসার করছে। শ্বশুড় বাড়ির সবাই ওর প্রতি বেশ খুশি। ওর স্বামী তো আরো বেশি খুশি। কিছুদিন পরে তুমি ও মল্লরের মতো সংসারী হয়ে যাবে। দোয়া করি মা। অন্তর ও তোমাকে খুব ভালোবাসবে। তোমাকে বুঝবে।”

মল্লিকা নরম স্বরে বলল,,,,,,

—-“আপু আসবে না আম্মু?”

—-“তোমার আপু তো সবে মাএ কাল তোমার বিয়ে খেয়ে গেলো। তোমার বউভাতের দিন আসবে। ওর পুচকি টা খুব জ্বালায় তো তাই।”

মিঃ নাজিম চুপচাপ হয়ে বসে আছে। মল্লিকা ওর আম্মুকে ছেড়ে মিঃ নাজিমের পাশে বসে বেশ নরম স্বরে বলল,,,,,,

—-“আব্বু আ’ম স্যরি। প্লিজ আমায় মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি আমার জন্য আর তোমাদের মান সম্মান হানি হবে না। আমি খুব মনযোগ দিয়ে সংসার করব। শ্বশুড় বাড়ির সবার সাথে ভালো ব্যবহার করব। মানিয়ে গুছিয়ে চলব। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। অন্তত তুমি তো আমাকে বুঝার চেষ্টা করো আব্বু। তুমি তো জানো তোমার এই ছোট মেয়েটা আধ পাগল। কি করে না করে কিছুর ঠিক থাকে না। তুমি আমাকে মারো, বকো যা ইচ্ছে তা করো এরপরে ও এভাবে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখো না। সবার অবহেলা সহ্য হলে ও তোমার অবহেলা আমার সহ্য হয় না।”

মিঃ নাজিম মেয়ের সাথে আর রাগ করে থাকতে পারল না। মল্লিকাকে জড়িয়ে ধরে মলিন কন্ঠে বলল,,,,,

—–“মা, তুমি এখন বিবাহিত। ছেলে মানুষি করলে এখন চলবে না। সবার মন বুঝে তোমাকে চলতে হবে। হুট হাট কোনো ডিসিশান নেওয়া যাবে না। তোমার এসব উটকো ব্যবহারের জন্য সারাফারাজের কাছে আমার অনেক ফেইস লস হয়েছে। প্লিজ তুমি বুঝার চেষ্টা করো মা। নিজেকে শোধরাও। দেখবে অন্তর ও তোমাকে ভালোবেসে কাছে টেনে নিবে। অন্তর যথেষ্ট ভালো এক্টা ছেলে। তোমাকে বুঝবে, সাপোর্ট করবে এবং অলওয়েজ তোমার পাশে থাকবে।”

মল্লিকা কান্না জড়িত কন্ঠে বলল,,,,,

—–“উনার ফোন নাম্বারটা দিবে আব্বু? উনার সাথে আমি কথা বলব!”

মিঃ নাজিম মলিন হেসে মল্লিকাকে ছেড়ে উনার ফোনটা মল্লিকার হাতে গুজে দিলো। মল্লিকা ফোনটা হাতে নিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো। রুমের দরজা আটকে মল্লিকা বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়ালো। অন্তরের নাম্বারটা সার্চ করে মল্লিকা চট জলদি অন্তরের নাম্বারে ডায়াল করল। অন্তর পকেট থেকে ফোনটা বের করে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখল মিঃ নাজিমের কল। অন্তর কিছুটা বিরক্তি নিয়ে কলটা রিসিভ করে বলল,,,,,

—–“আসসালামু আলাইকুম আংকেল!”

মল্লিকা গলাটা ঝাঁকিয়ে নরম স্বরে বলল,,,,,

—-“আমি মল্লিকা।”

অন্তর কপাল কুঁচকে বলল,,,,,,

—-“কেনো কল করেছেন? নিশ্চয়ই আমার মাথাটা নষ্ট করার জন্য।”

—-“কোথায় আপনি?”

—-“আপনাকে বলতে যাবো কেনো?”

—-“কারণ আমি আপনার ওয়াইফ।”

—-“আমি আপনাকে ওয়াইফ হিসেবে মানি না।”

—-“আমি তো মানি।”

—-“যদি মানতেন, তাহলে কাল এতোটা নির্মম ভাবে আমার মাথা ফাটাতে পারতেন না।”

—-“কালকের ঘটনার জন্য আ’ম স্যরি। মাফ করে দিন আমায়। আর কখনো এমন ভুল হবে না। আমি সত্যিই লজ্জিত। আর এবার কোনো নাটক করছি না।”

—-“আপনাকে বিশ্বাস করার রুচি নেই আমার।”

—-“আর একবার বিশ্বাস করে দেখুন। প্লিজ আপনি চলে আসুন। সবাই আপনার জন্য কষ্ট পাচ্ছে।”

—-“আই থিংক আপনি পাচ্ছেন না।”

মল্লিকা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,,,,,,

—-“আমি অনুশোচিত। কষ্টের চেয়ে অনুশোচনার দাগ বেশি।”

অন্তর ভ্রু কুঁচকে বলল,,,,,

—-“আপনি কি কান্না করেছেন?”

—-“আম্মু আমাকে চড় মেরেছে।”

—-“ওহ্ আচ্ছা। এই জন্যই আপনি আমাকে বাধ্য হয়ে কল করেছেন তাই না?”

—-“বাধ্য হয়ে কল করি নি। মন থেকেই কল করেছি। প্লিজ আপনি চলে আসুন। কথা দিচ্ছি আমি আপনার সাথে আর খারাপ ব্যবহার করব না।”

—-“ফুফু আম্মুদের নিয়ে আসছি আমি। ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। রাখছি এখন।”

মল্লিকা মলিন হেসে বলল,,,,,,,

—–“থ্যাংকস।”

মল্লিকা কলটা কেটে দৌঁড়ে বাড়ির ড্রইং রুমে গিয়ে মিঃ নাজিমকে জড়িয়ে ধরে অন্তরের ফেরার কথাটা বলল। মিসেস শিলা খুশি হয়ে মল্লিকার কপালে চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

—-“তুমি এখনই ঐ বাড়িতে ফিরে যাবে। অরুনীমার কাছে ক্ষমা চাইবে। অন্তর বাড়িতে ফিরলে অন্তরের কাছে ক্ষমা চাইবে। মনে থাকবে তো?”

—-“মনে থাকবে আম্মু।”

মিঃ নাজিম মল্লিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,,

—-“গাড়ি নিয়ে যাও। গার্ডেনে পার্ক করা আছে। জসীম তোমাকে ঐ বাড়িতে পৌঁছে দেবে।”

মল্লিকা মাথা নাঁড়িয়ে হ্যাঁ বুঝিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাড়ির গার্ডেনে গিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। মল্লিকা গাড়িতে উঠার সাথে সাথেই ড্রাইভার জসীম গাড়ি ছেড়ে দিলো।

রাস্তায় গাড়ি চলছে আপন গতিতে। মল্লিকা জানালার বাইরে মুখ দিয়ে রেখেছে। সে তার ভবিষ্যত নিয়ে খুব কনফিউজড। আপাতত সে নীলকে নিয়ে ভাবতে চাইছে না। সে এখন ভাবছে তার ফ্যামিলির সম্মান নিয়ে। হুট করেই সামনে অনেক জ্যাম বেঁধে গেলো। গাড়িটা নীলদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে থেমেছে। মল্লিকা বেশ আগ্রহ নিয়ে দশ তলা বিশাল ভবনের তিন তলায় চোখ রাখল। তিন তলার পুরো ফ্ল্যাটটা নীলদের। নীলের রুমের ব্যালকনির দিকে নজর দেওয়ার সাথে সাথে মল্লিকার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে চোখে জল জমে গেলো। নীল এক্টা মেয়েকে কোলে নিয়ে কফিতে চুমোক দিচ্ছে। মেয়েটা ও নীলের বুকের সাথে মিশে আছে। দুজনের ঠৌঁটেই হাসি।

মল্লিকা তাড়াতাড়ি চোখটা সরিয়ে সামনের দিকে তাকালো। মল্লিকার দু চোখ দিয়ে শ্রাবণের ধারা বইছে। এক্টু আগে যা দেখছে সবটা তার ধারনার বাহিরে। এর মাঝেই জ্যাম ছেড়ে দিলো। গাড়ি ছুটে চলল অন্তরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। মল্লিকা শাড়ীর আঁচল চেপে ধরে কাঁদছে আর বিড়বিড় করে বলছে,,,,,

—-“তার মানে রজনী ঠিক বলেছিলো। মুক্তার সাথে নীলের ভালোবাসার সম্পর্ক আছে? আমিই তাহলে ঐদিন রজনীকে ভুল বুঝেছিলাম? ইসসস কি বাজে ব্যবহার টাই না করেছিলাম রজনীর সাথে। রজনীর সাথে একদিন দেখা করে আমার পুরো সত্যিটা জানতে হবে। সত্যিটা জানার পর আমি নীলের মুখোমুখি হবো। আর ঐদিনই সব সম্পর্ক ছেদ করব।”

মল্লিকা কথা গুলো বলছে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। প্রায় পনেরো মিনিট পর গাড়ি এসে পৌঁছে গেলো অন্তরের বাড়ির গার্ডেনে। মল্লিকা চোখের জল গুলো মুছে গাড়ি থেকে নেমে সোজা বাড়ির ড্রইং রুমে ঢুকে গেলো। মিসেস অরুনীমা আর অনন্যা সোফায় বসেছিলো। মল্লিকাকে দেখা মাএই ওদের মুখে হাসি ফুটে উঠল। মল্লিকা মুচকি হেসে দ্রুত পায়ে হেঁটে মিসেস অরুনীমা আর অনন্যার মাঝখানে বসে ওদের দুইজনকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,,,,,,

—-“আমাকে মাফ করে দাও তোমরা। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমার একদম উচিত হয় নি তোমাদেরকে এভাবে একা রেখে চলে যাওয়া।”

মিসেস অরুনীমা মল্লিকার কপালে চুমো খেয়ে বলল,,,,,,

—-“যা হয়েছে ভুলে যাও মা। নেক্সট টাইম এই ভুল গুলো করো না। আমার ছেলের সাথে মানিয়ে গুছিয়ে নিও। আমার ছেলেটা কিন্তু ভীষণ ভালো।”

—-“আপনার ছেলে বিকেলের মধ্যেই ফিরছে আম্মু। আপনারা টেনশান করবেন না। আমি রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসছি। এরপর শ্বাশুড়ী আর বউমা মিলে রান্না করব।”

কথাগুলো বলেই মল্লিকা রুমে গিয়ে দরজা আটকে অঝড়ে কাঁদতে লাগল। দুইটা অভিনয় সে কনটিনিউ করতে পারছে না। একে তো নীলের দেওয়া ধোঁকা। দ্বিতীয়ত, ভালো বউ হওয়ার অভিনয়। কাঁদতে কাঁদতে সে কাবার্ড থেকে এক্টা নীল শাড়ী বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

প্রায় আধ ঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে মল্লিকা সোজা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। চোখ গুলো ফুলে টইটম্বুর হয়ে গেছে। মল্লিকা সেজে গুজে নিজের কষ্টটা আড়াল করতে চাইছে। মুখে স্নো, পাউডার লাগিয়ে, কপালের মাঝখানে নীল টিপ পড়ে, হাত ভর্তি নীল চুড়ি, কানে এক জোড়া নীল দুল, চোখে হালকা কাজল পড়ে নিজেকে আরেক দফা আয়নায় দেখে মল্লিকা সোজা কিচেন রুমে চলে গেলো।

ঘড়িতে বাজছে দুপুর দুইটা। কারোর মন মানসিকতা ভালো ছিলো না বলে এখনো রান্না করা হয় নি। মিসেস অরুনীমা কিচেনে ঢুকে অলরেডি কাটাকাটি শুরু করেছে। মল্লিকা কিচেনে ঢুকে মিসেস অরুনীমার কাজে হেল্প করছে। প্রায় দেড় ঘন্টা পর রান্না বান্না শেষ গেলো। অনন্যা আর মল্লিকা হাতে হাতে করে ডাইনিং টেবিলে খাবার গুলো সার্ভ করছে। এর মাঝেই বাড়ির গার্ডেনে গাড়ির হর্ণ বাজল। অনন্যা দৌঁড়ে গেলো সদর দরজার কাছে।

অন্তর, সাহেদ, মিসেস হৈমন্তী, সদ্য বিয়ে করা সাহেল আর ওর ওয়াইফ নুসাইবাকে দেখে অনন্যা খুশিতে চিল্লাচ্ছে আর বলছে,,,,,,

—-“আম্মু তাড়াতাড়ি এখানে আসো। ফুফু আম্মু, ভাইয়া, ভাবী সবাই চলে এসেছে।”

মিসেস অরুনীমা কিচেন রুম থেকে হন্ত দন্ত হয়ে বের হয়ে মল্লিকাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,,,

—-“মল্লিকা তোমার ফুফু শ্বাশুড়ী আর বড় ভাই, ভাবী এসেছে। মাথায় ঘোমটা দাও। প্রথমেই ওদের সালাম দিয়ে ওদের ভালো মন্দ জিগ্যেস করবে ওকে?”

মল্লিকা আঁচল টেনে মাথায় বড় এক্টা ঘোমটা টেনে বলল,,,,,

—-“ওকে আম্মু।”

মিসেস অরুনীমা দ্রুত পায়ে হেঁটে সদর দরজার সামনে দাঁড়ালো। ওরা সবাই এক এক করে বাড়ির ড্রইং রুমে ঢুকে গেলো। মিসেস অরুনীমা সবাইকে জড়িয়ে ধরে ভালো মন্দ জিগ্যেস করল। নুসবাইবা মিসেস অরুনীমাকে সালাম দিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরল। অন্তর সবার পিছনে। মিসেস অরুনীমা মল্লিকাকে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,,,,,,

—-“সি ইজ মল্লিকা। অন্তরের ওয়াইফ।”

মিসেস হৈমন্তী হেসে হেসে বলল,,,,,

—-“দেখি দেখি নতুন বউয়ের মুখটা দেখি। ঘোমটা দিয়ে তো পুরো মুখটা আড়াল করে রেখেছে।”

মল্লিকা আর দেরি না করে ঘোমটা টা মুখের উপর থেকে সরিয়ে এক গাল হেসে মিসেস হৈমন্তীর দিকে তাকালো। মিসেস হৈমন্তী আর নুসাইবা মুখটা হা করে মল্লিকার দিকে তাকিয়ে বলল,,,,,

—-“মাশাআল্লাহ্। আমাদের অন্তরের বউ তো খুব সুন্দুরী।”

অন্তর কিছুটা নড়েচড়ে দাঁড়ালো। সাহেদ কিছুটা থতমত খেয়ে অন্তরের কানে ফিসফিস করে বলল,,,,,,

—-“ভাবীর চোখ ও তো নীল। আমার তো মনে হচ্ছে ঐ মেয়েটাই ভাবী।”

অন্তর সাহেদের কানে ফিসফিসিয়ে বলর,,,,,

—-“কক্ষনো না। তোর ভাবী খুবই ঝগড়াটে আর অসভ্য। চোখ এক হলে ও দুটো মানুষ এক না। কয়েকদিন থাক বুঝতে পারবি।”

—-“যাই হোক। মানতে হবে তুই খুব লাকী। কারণ, ভাবী খুব সুন্দুরী।”

অন্তর এবার চোখ তুলে মল্লিকার দিকে তাকালো। হুট করেই অন্তরের হার্ট দ্রুত গতিতে বিট করতে লাগল। নীল চোখ, নীল শাড়ী, নীল দুল, কপালের মাঝখানে নীল টিপ, হাতে নীল কাঁচের চুড়ি, ছেড়ে দেওয়া ভেজা চুল সব মিলিয়ে মল্লিকাকে নীল পরী লাগছে। অন্তর বুকে হাত দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল,,,,,,

—-“আমার নীলান্জ্ঞনা!”

#চলবে,,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here