১
বাসর ঘরের দরজার সামনে মোটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। গায়ে ভারী লাল রং এর লেহেঙ্গা আর ভুড়ি ভুড়ি গহনার ভাড়ে বার বার নিচে নুইয়ে পড়ছি। এরপরে ও হাতের লাঠি ছাড়ছিনা। কিছুতেই ঐ অচেনা, অজানা ছেলের সাথে সংসার করা যাবে না। বলা নেই, কওয়া নেই হুট করে ফ্যামিলি নিয়ে মেয়ে দেখতে চলে আসবে আর কোনো রকম পছন্দ হয়ে গেলেই জোর করে তিন কবুল পড়িয়ে বাসর ঘর অব্দি টেনে আনবে। এর কোনো মানে হয়? না এসব উটকো নিয়ম আমি মানি না। জীবন দিবো তবু ইজ্জত দিবো না। কিছুতেই আমি ঐ লোকটার সাথে ফুৃলসজ্জা করতে পারব না।
আমি “আয়ানা হায়াত মল্লিকা”। মল্লিকা নামটা কিউট না? নামটা রেখেছে আমার আব্বু। আমার আব্বুর পছন্দ বরাবরই বেস্ট। আমি আমার আম্মু, আব্বুর আদরের ছোটো মেয়ে। সবে মাএ অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পা দিয়েছি। পড়াশুনায় বেশ ভালো আমি। এমনটা আমার আব্বু বলে। তবে আমার মতে আমি খুব পঁচা ছাএী। পড়াশুনায় গোল্লা। অবশ্য পড়াশুনায় মেধাবী ছাএী না হলে ও লিখালিখি করতে বেশ পছন্দ করি। অবসর সময় পেলেই লিখতে বসি। সোশ্যাল মিডিয়াতে লেখিকা হিসেবে আমার খানিক নাম ডাক ও আছে। গল্প পড়তে এবং লিখতে প্রচন্ড ভালোবাসি। ইচ্ছে আছে লিখালিখিটাকে প্রফেশনালী রূপ দেওয়ার। ইনশাআল্লাহ্ চেষ্টা করলে হয়তো পারব। আমার আব্বুর ফুল সাপোর্ট আছে লিখালিখিতে। বাকিটা উপর ওয়ালা ভালো জানে।
এবার আসি বিয়ের প্রসঙ্গে। বিয়েটা করেছি কেবল মাএ আব্বুর সম্মানের কথা ভেবে। আব্বুর বেস্ট ফ্রেন্ডের ছেলের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। ছেলেটাকে ঠিকঠাক চিনি না আমি। কেবল সারফারাজ আঙ্কেলকেই চিনি। বিজনেসের ব্যাপারে আব্বুর সাথে আলোচনা করতে উনি প্রায় আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করত। ঐখান থেকেই আমাকে উনার ছেলের বউ হিসেবে ভালো লাগা। উনার ছেলে নাকি প্রায় কিছুদিন হলো জার্মান থেকে ফিরেছে। আপাতত সারফারাজ আঙ্কেলের সাথে অফিসের কাজে জয়েন করেছে। ছেলেটাকে চোখের দেখা ও দেখতে পারলাম না। দেখতে ভালো না খারাপ তাও পরখ করতে পারলাম না। হুট করে কাজী সাহেব ডেকে এনে তিন কবুল পড়িয়ে নিলো! ছেলেটাও কেমন মাথা মোটা। আমার সাথে আলাদা করে কথা বলতে ও চাইল না! কি আজব। এর কি নিজস্ব কোনো মতামত নেই? নিশ্চয়ই সে ও আমার মতো চাপে পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। পৃথিবীর সব বাবা-মা রাই এক্কারে সেইম।
ধুর বাবা আর পারছি না ভারী লেহেঙ্গা সামলাতে। হতচ্ছেড়া বরটা ও তো আসছে না। আসলে না হয় মাথাটা ফাটিয়ে ফ্লোরে চিৎ করে শুইয়ে রাখতাম। এর পর বেশ নিশ্চিন্তে লেহেঙ্গা আর গহনা গুলো খুলে শান্তির এক্টা ঘুম দিতাম। আজ সকাল থেকেই বেশ ধকল যাচ্ছে আমার উপর। ভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরেই সেজে গুজে ছেলে পক্ষের সামনে বসতে হলো। দেখাদেখি সেরে, বিয়ে করে, কান্না কাটির পর্ব শেষ করে, বাপের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে,চলে এলাম শ্বশুড় বাড়িতে। এখন আবার ছোট ননদিনী আমাকে সং সাজিয়ে বাসর ঘরে বসিয়ে দিয়ে গেলো। ঢং করে আবার দুধের গ্লাস ও দিয়ে গেছে। বরকে খাওযাবো বলে। আদেক্ষেতা দেখে বাঁচি না বাপু। বাসর রাতে দুধ খাওয়ার কি আছে? ছেলে কি ছোট বেলায় দুধ খেয়ে মানুষ হয় নি? ধুর বাবা এসবের চাপে পড়ে নীলের সাথে কথা বলতে ও ভুলে গেছি। ইসসসস, নীল নিশ্চয়ই খুব রাগ করে আছে আমার উপর। কি করব বিয়ে করতে করতে সময় ই পাই নি নীলকে কল করার। আচ্ছা ব্যাপার না, ঐ হতচ্ছেরা বরের মাথা ফাটিয়ে না হয় নীলের সাথে একবার কথা বলে নিবো। আমি জানি আমার ক্রাশ বয়টা বেশ রাগ করে আছে আমার উপর। কলটা রিসিভ করেই তেজী কন্ঠে কথা বলবে আর ঝাঁঝালো গলায় বলবে,,,,,,,
—–“সারাদিন কি এমন কাজে ব্যস্ত ছিলে তুমি? যার কারণে আমাকে এক্টা বার ও কল দেওয়ার সময় পাও নি?”
তখন আমি ও মুখটা ফুলিয়ে আমার বিয়ের কথাটা বলে দিবো। নিশ্চয়ই নীল আমার ব্যস্ততার কারণটা বুঝবে।
পরক্ষনেই মল্লিকা লাঠিটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে জিভ কেটে মাথায় হাত দিয়ে বলল,,,,,,
—-“ওহ সিট। বিয়ের কথা বললে তো নীল আরো ক্ষেপে যাবে। বলা যায় না, হয়তো আমাকে এই বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। নয়তো আমাকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। না না, কিছুতেই নীলকে বিয়ের কথাটা জানানো যাবে না। এতে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।”
এর মাঝেই দরজায় কয়েকটা টোকা পড়ল। মল্লিকা তাড়াহুড়ো করে লাঠিটা হাতে নিয়ে মনে মনে অজস্র সাহস সঞ্চার করে দরজার খিলটা খুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে যেই না লাঠিটা উপরে তুলে সামনের ব্যক্তির মাথায় আঘাত করতে যাবে এর আগেই মিসেস অরুনিমা চেঁচিয়ে বলল,,,,,,,
—-“এই এই মল্লিকা কি করছ কি? এভাবে লাঠি নিয়ে তেড়ে এলে কেনো? মেরে ফেলবে নাকি আমায়?”
মল্লিকা চোখ জোড়া খুলে লাঠিটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে ঢুলুঢুলু কন্ঠে বলল,,,,,,
—–“না শ্বাশুড়ী মা। আমি আপনাকে মারতে যাবো কেনো? আমি তো ঘুমোচ্ছিলাম। ঘুমের মধ্যে কেউ আমাকে বলছিলো,,,,,,
—-“মল্লিকা তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে হাতে এক্টা লাঠি নিয়ে দরজার খিলটা খুলে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির মাথাটা ফাটিয়ে দিবি। আমি ও তাই করছিলাম।”
কথাগুলো বলেই মল্লিকা বড় এক্টা হাই তুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায়া চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। পিছন থেকে মিসেস অরুনিমা শুকনো ঢোক গিলছে আর বিড়বিড় করে বলছে,,,,,,,
—-“নিশ্চয়ই মল্লিকার সাথে কোনো এক্টা আলগা জিনিস আছে। না হয় কেউ আবার ঘুমে এসব উটকো কথা শুনে নাকি। তাহলে কি আমার একমাএ ছেলেটার কপাল পুড়ল। না না এসব আমি কি ভাবছি। মল্লিকা খুব ভদ্র আর শান্ত সভ্য এক্টা মেয়ে। নিশ্চয়ই উল্টো পাল্টা স্বপ্ন দেখে এসব বলছে আর করেছে।”
পর মুহূর্তে মিসেস অরুনিমা এক্টা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,,,,,,,
—-“ছেলেটা এখনো রুমে এলো না। নিশ্চয়ই অফিসের কাজে ব্যস্ত আছে। ফুলসজ্জার রাতে ও কি এতো ব্যস্ততা দেখাতে হবে? মল্লিকা নিশ্চয়ই রাগ করে ঘুমিয়ে গেছে। যাই “অন্তরকে” ডেকে এনে রুমে দিয়ে যাই। ছেলেটাকে রুমে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজায় খিল দিয়ে এরপর আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোতে যাবো।”
কথাগুলো বলেই মিসেস অরুনীমা রুম থেকে বের হয়ে স্টাডি রুমের দিকে চলে গেলো। মিসেস অরুনীমা রুম থেকে যাওয়ার সাথে সাথেই মল্লিকা শোয়া থেকে উঠে পা টিপে টিপে দরজার সামনে দাঁড়ালো। দরজার বাইরে কিছুক্ষন উঁকি চুকি মেরে অরুনিমা ঠাস করে দরজাটা লাগিয়ে দরজায় ঠ্যাস দিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে আর বলছে,,,,,,,,
—–“উফফফফ বাবা জোর বাঁচা গেলাম। ভাগ্যিস শ্বাশুড়ী মা মুখ খুলেছে না হয় লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিতাম। বড় সড় এক্টা কেলেংকারি বেঁধে যেতো। ভাগ্য ভালো বলে আল্লাহ্ আমাকে হাতে ধরে বাঁচিয়ে দিলো। আর ঠিক টাইমে দুর্দান্ত এক্টা আইডিয়া মাথায় এসেছে বলেই ব্যাপারটাকে ধামা চাঁপা দিতে পারলাম। না হয় ভালোভাবেই ফেঁসে যেতাম।”
মল্লিকা কথাগুলো বলছে আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে।
অন্যদিকে,,,,,,,,
মিসেস অরুনিমা স্টাডি রুমে ঢুকেই কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। পুরো স্টাডি রুম ফাঁকা। কোথাও অন্তরকে দেখা যাচ্ছে না। তবে টেবিলের এক পাশে অন্তরের ল্যাপটপ টা পড়ে আছে। মিসেস অরুনিমা আর দেরি না করে দৌঁড়ে ছাদে চলে গেলো।
ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে অন্তর। পরনে তার লাল পান্জাবী। দৃষ্টি তার নিচের দিকে। মিসেস অরুনীমা ধীর পায়ে হেঁটে অন্তরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অন্তর এখনো ওর পাশে দ্বিতীয় কারো অস্তিত্ব টের পায় নি। মিসেস অরুনীমা শান্ত কন্ঠে অন্তরের হাতে হাত রেখে বলল,,,,,,,
—–“আজকের দিনে ও মন খারাপ করে রাখবে অন্তর? এতোটা স্বার্থপরতা তোমাকে মানায় না!”
অন্তর নিচের দিকে তাকিয়ে গলা জড়ানো কন্ঠে বলল,,,,,,,
—–“আমি এখনো তাকেই ভালোবাসি আম্মু। যাকে আমি প্রথম দেখাতেই মন দিয়ে ফেলেছি। তার চোখের প্রেমে পড়েছি। তাকে নিয়ে অনন্ত কাল বাঁচার স্বপ্ন দেখেছি। তাকে নিয়ে কল্পনার জগতে হাজার বার পাঁড়ি দিয়েছি। তাকে আমি এখনো খুঁজি আম্মু। হয়তো একদিন পেয়ে ও যাবো।”
মিসেস অরুনীমা বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল,,,,,,
—-“এসব ভাবা পাপ অন্তর। তুমি এখন বিবাহিত। বউ আছে তোমার। সে তোমার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে ফুলসজ্জার খাটে বসে আছে। আর তুমি কিনা অন্য নারীর কল্পনায় ব্যস্ত।”
—-“আমি তো বিয়ে করতে চাই নি আম্মু। তোমরা আমাকে বাধ্য করেছ। বাধ্যতার যাতাকলে পড়ে আমি বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। তোমরা হাতে ধরে মেয়েটার জীবন নষ্ট করলে।”
মিসেস অরুনীমা বেশ রেগে কড়্ড়া কন্ঠে বলল,,,,,,,
—–“আমি অতো শতো বুঝি না অন্তর। তোমাকে এক্ষনি তোমার রুমে যেতে হবে। আমি তোমাকে আদেশ করছি। আমার আদেশ তোমাকে মানতেই হবে।”
—–“এই আদেশটা মানতে পারব না আম্মু। ক্ষমা করো আমায়।”
#চলবে,,,,,,,,
#মন_চায়_তোকে
#সূচনা_পর্ব
#নিশাত_জাহান_নিশি
(নতুন গল্প নিয়ে চলে এলাম। ভালো রেসপন্স পেলে গল্পটা এগিয়ে নিয়ে যাবো। প্রথম পর্ব বলে ছোট করে দিয়েছি।)
খুব সুন্দর গল্প