মন মুনিয়া পর্ব-১০

0
1655

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম-১০

সেদিনের তর্কাতর্কির পর একপর্যায়ে তুমুল ঝগড়ার সৃষ্টি হয়েছিলো। মনি মানতে পারছিলো না সেটা। খুব কষ্ট হচ্ছিলো তার। সে দুহাতে কান চেপে ধরে বসেছিলো তখন। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছিলো তার।

দিন চলে যাচ্ছিলো নিয়ম মাফিক। তবে মনির পরিবারের ঝগড়া যেনো শেষই হচ্ছিলোনা। প্রায় প্রতিদিনই ওর বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো, আর সেটার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতো মনি।

ইদানিং মনিকে আর স্কুলে যেতে হয়না। শুধু প্রাইভেটেই যায়। আর তাছাড়া সারাদিন বাড়িতেই থাকে। সারাদিন বাড়িতে থাকায় রহিমের চোখেও সেটা বেশি বেশি পরে। আর তাতে ঝগড়াও বাধে বেশি বেশি।

উনি এটা কিছুতেই মানতে পারেন না, জয়নালের সাথে মনির বিয়েটা হতে হতেও হলোনা। এই বিয়েটা হলে তার অনেক উপকার হতো। আয়েশে চলে যেতো বাকি দিনগুলো । জয়নাল তো বলেছিলোই যদি মনিকে বিয়ে করতে পারে তাহলে রহিম মিয়ার সকল খরচ সেই দিবে। এমনকি ওর পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বও সে নিবে।

কতো বড় একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে ভেবে সারাক্ষণই মেয়ে আর মেয়ের মায়ের উপর রেগে থাকেন তিনি।

সেদিন আবারও বেশ করে ঝগড়া লাগলো রহিম মিয়া আর মনির মায়ের মধ্যে। কারণটা হচ্ছে মনি আর ওর প্রাইভেটে যাওয়া। ঘরের এক কোনে বসে আছে মনে। বাইরে তুমুল বেগে ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়ার এক পর্যায়ে রহিম মিয়া মনির মাকে মারতে উদ্ধত হয়। মনি মানতে পারেনা সেটা।

এক পর্যায়ে সে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। দাওয়ায় বসে ঝগড়া করছেন উনারা। মনিকে বেরিয়ে আসতে দেখে চেচিয়ে উঠেন রহিম। অত্যন্ত বাজেভাবে বলেন
-তুই বাইরে আইলি কেন? আমাগো তামাশা দেখতে? মাইয়া হইয়া বাপের সাথে শত্রুতামি করছোস, এইরকম মাইয়া যানি শত্রুর ঘরেও না থাকে।

বাবার কথায় মনির চোখদুটো আবারও পানিতে ভরে গেলো। সে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো
-তুমি আর রাগারাগি কইরোনা আব্বা। আমি জয়নাল ভাইরেই বিয়া করমু।

মেয়ের কথা শুনে তেড়ে আসলেন মনির মা। হুংকারে বললেন
-কি কইলি মনি? আরেকবার যদি এই কথা মুখ দিয়া বাইর করোস, তুই মুখ ভাইংগা ফালামু আমি। বেশি বড় হইয়া গেছোস, যা ঘরে যা।

মনি কাঁদলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো
-তুমি আমারে মারো আর যাই করো, আমি জয়নাল ভাইরেই বিয়া করমু মা। প্রতিদিন আমারে নিয়া এতো অশান্তি আর ভাল লাগেনা।

রহিম মিয়ার চোখেমুখে খুশির ঝলক দেখা গেল। তিনি উঠে এসে মনির পাশে দাড়ালেন। উচ্ছ্বসিত গলায় বললেন
-তুই সত্যি সত্যি জয়নালরে বিয়া করবি মা?
মনি মাথা নিচু করলো। নিশ্বব্দে মাথা নাড়িয়ে বললো
-হু।

রহিম এবার মনির মায়ের দিকে তাকালো। বিজয়ীর হাসি হেসে মনির মাকে ব্যাঙ্গ করে বললো
-মনি আমারই মাইয়া। এতোদিন তোর পাল্লায় পইরা মাইয়াডা আমার এমন করছে।
মনির মা চোখ রাঙ্গালেন, তবে কিছু বললেন না। হনহন করে চলে গেলেন অন্যদিকে।

মনি তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। মা যখন মনির চোখের আড়ালে চলে গেলো তখন ধীর কন্ঠে মনি বললো
-একটা কথা কমু আব্বা?
-কো মা, আইজ তোর যত খুশি ততো কথা কো।
-আর দেড় মাস পরে আমার মেট্রিক পরীক্ষা। আগে পরীক্ষাডা দেওনের লাইগা দেও, তার পর আমারে বিয়া দিও।

রহিম কিছুক্ষণ কি যেনো ভাবলো। এরপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বললো
-আমি জয়নালরে কইয়া দিমু নে। হেই তোরে পরীক্ষা দেওনের ব্যবস্থা কইরা দিবো।

মনি নিশ্বব্দে কাদলো। তবে বাবার মুখের উপর আরেকটা কথা বলার মতো সাহস হয়ে উঠলোনা তার।

রহিম সেটা খেয়াল করে বললো
-আইচ্ছা ঠিক আছে। তয় রেডি থাকিস। তোর যেদিন শেষ পরীক্ষা হইবো তার পরেরদিন তোর বিয়ার দিন রাখমু।
রহিম মিয়ার কথায় শুকনো হাসলো মনি। তবে ভেতর থেকে সে পুরোপুরি শেষ হয়ে যাচ্ছে।

এক মাস পর—-
পরীক্ষার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুতি নিচ্ছে মনি। আর মাত্র পনেরো দিন বাকি, তারপরই সেই অতিপ্রত্যাশিত পরীক্ষা। তবে পরীক্ষার পরের পরিণতি মনে হলেই মনের ভিতর অজানা এক আতংক কাজ করে তার।

মনি প্রাইভেটে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রাইভেটও এখন শেষের পথে। আর দুই এক দিন পড়িয়ে আর পড়াবে না স্যার। বইপত্র গুছিয়ে বের হয়ে গেলো মনি।

উঠোনের এক কোনায় বসে বিড়ি টানছিলেন রহিম। মনিকে যেতে দেখে তিনি বিড়ি টানতে টানতে বললেন
-ফ্রাইভেডে যাস মা?
-হু। ছোট করে একটা উত্তর দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো মনি। এখন বাবা আর আগের মতো রাগারাগি করেনা, বকেওনা। আদর করে কথা বলে। ককয়েকদিন পর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠিয়ে দিবে কিনা।

তবে মা খুব রেগে থাকে মনির উপর। মনি সেসব আর গায়ে মাখেনা। একবার বিয়েটা হোক, এ বাড়িতে আর পা রাখবেনা সে।

মনের মধ্যে জমিয়ে রাখা অসংখ্য অভিমান আর অভিযোগ নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে মনি। আজ আকাশটায় খুব মেঘ করেছে। এই শীতের দিনে মেঘ করার মানেটা মনির বুঝে আসছেনা কিছুতেই। আকাশের যা অবস্থা যেখে মনে হচ্ছে এখনই ঝমঝম করে আকাশের বুক চিড়ে বৃষ্টি পড়বে।

কিছুক্ষণ হাটার পর একপর্যায়ে স্যারের বাড়ি গিয়ে পৌছুলো মনি। এরই মধ্যে গুড়ুগুড়ি বৃষ্টি পরতে শুরু করে দিয়েছে। পড়ার রুমের সামনে গিয়ে দেখলো কেউই আসেনি। মনি অবাক হলো, আজ কেউ আসেনি কেন? বৃষ্টির কারণে?

স্যারকেও খুজে পাচ্ছেনা সে। এদিকে বৃষ্টির বেগও বেড়ে চলেছে। স্যারের বাড়ির কাজের মহিলা সমস্ত কাজ কর্ম শেষ করে স্যারের থাকার ঘরটা বন্ধ করে চলে যেতে লাগলো। মনি উনাকে ডেকে স্যারের কথা জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাও স্যার বাড়ি নেই, উনার স্ত্রিকে নিয়ে কোথায় যেনো গিয়েছে। বলতে বলতে উনিও বৃষ্টির মধ্যেই দৌড়ে চলে গেলেন।

মনি বিপাকে পরলো এবার, স্যার আজ পড়াবেনা সেটা তো ওকে বলেনি। নাকি বলেছিলো, কিন্তু সে শোনেনি? না বললে বাকিরা ঠিকই আসতো। নিজের এমন অদ্ভুত ভুলের কারণে নিজের উপর বেশ রাগ হলো তার। এদিকে বৃষ্টি বেড়েই যাচ্ছে। এইভাবে বৃষ্টি হবে জানলে সে আজ কিছুতেই আসতোনা।

কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার পর ফিরে যাবার কোনো উপায় না পেয়ে পড়ার রুমে গিয়ে ঢুকলো মনি। একটা বেঞ্চে বসে সামনের বেঞ্চটায় মাথাটা ঠেকালো সে।

এরই মধ্যে কেমন ভয়ংকর একটা শব্দ কানে এলো মনির। শব্দটা কারো গোঙ্গানির মতো। মনি চারপাশটায় চোখ বুলাতে লাগলো। কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছেনা সে। গোঙ্গানির শব্দটা এখনো আসছে, তবে খুবই অল্প পরিমানে। মনি এবার ভয় পেতে লাগলো। একেতো সে একলা, তার উপর ভয়ংকর রকমের বৃষ্টি, এখন আবার এই অদ্ভুত শব্দ।

মনি খেয়াল করলো শব্দটা এক ঘরেরই এক কোনে রাখা একটা টেবিলের অপর পাশ থেকে আসছে। মনি মনে কিছুটা সাহস যুগিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো সেদিকে।

সামনেই কয়েকটা মদের বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, আর একটা বোতল থেকে ঢকঢক করে মুখে পুরে নিচ্ছে নিয়ান। মনি অবাক হল, এ আবার কখন এলো? এই এইসবই বা কেন খাচ্ছে?

মনি ধীরে ধীরে নিয়ানের পাশে বসলো, আস্তে করে ওর ঘারে হাত রাখতেই পাশ ফিরে তাকালো নিয়ানা। মনিকে দেখে সবকটা দাঁত বের করে হাসলো সে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
-বান্ধবী, এসেছো তুমি? আমি অপেক্ষা করছিলাম তো।।
-আপনে কখন আইলেন? আর এইসব ছাইপাঁশ খাইতাছেন কেন?

নিয়ান মদের বোতলটা মনির চোখের সামনে ধরে নেশাতুর গলায় বললো
-এটাকে একদমই ছাইপাঁশ বলোনা বান্ধবী, এটা আমার প্রেমিকা।
মনি ভ্রু বাকালো। অবাক হয়ে বললো
-কি কন এইসব?
-হুম, আমার প্রেমিকা। আমার আগের প্রেমিকা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, তাই এটাকে নতুন প্রেমিকা বানিয়েছি। ভালো হয়েছে না বলো? এ আমাকে ছেড়ে যাবেনা কোথাও।।

কথাটা বলে আবার ঢকঢক করে খেতে লাগলো নিয়ান। মনি কপাল কুচকালো, চলে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হলো। এখানে সে আর থাকবেনা। এমনিতেই সে নেশায় বুদ হয়ে আছে। তার উপর প্রচন্ড রকমের বিশ্রী গন্ধ, বমি পাচ্ছে খুব সাথে মাথাও ঘুরছে।

এইসব আর সহ্য করতে পারছেনা মনি। সে উঠতে যাবে তখনই ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেললো নিয়ান। মনি সামান্য রাগ দেখিয়ে বললো
-আপনে আমার হাত ধরলেন কেন? আমার হাত ছাড়েন।
-তুমি চলে যাচ্ছো কেন বান্ধবী?
-আপনে নেশা করছেন, আমি থাকমুনা এইখানে।
নিয়ান মদের বোতলের দিকে তাকালো একবার। এরপর হেসে বললো

-নেশা!! হুম নেশা। আমি নেশা করেছি বান্ধবী। শুনো বান্ধবী, এই নেশা আমাকে কিছু করতে বাধ্য করছে।
-কি করতে বাধ্য করছে? আমতা আমতা করে বললো মনি।।

নিয়ান মাতলামো করতে করতে বলল
-প্রেম করতে।
-মানে?
-হুম বান্ধবী। এই বৃষ্টিতে আমার প্রেমের নেশা হয়েছে। আমি তোমার সাথে প্রেম করবো বান্ধবী।
মনি আবারও রেগে গেলো। সে কিছুটা চেচিয়ে বললো
-আপনে যা খুশি তা করেন, আমারে ছাড়েন। আমি বাড়ি যামু। মনি নিজের হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে কথাটা বললো।

নিয়ান ছাড়লোনা সে হাত, আগের তুলনায় আরো শক্ত করে ধরলো। এরপর অদ্ভুত এক হাসি হেসে আবারও মাতাল গলায় বললো
-আমি তোমায় ছাড়ছিনা বান্ধবী। আমি আজ প্রেম করবোই। খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে আমার।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here