#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -০১
উঠানের এক পাশের বড় গাছটায় সাদা গরুটা বাধতে বাধতে হাক ছাড়লেন রহিম মিয়া। পরণে ছেড়া একটা সাদা গেঞ্জি আর পুরনো একটা লুঙ্গি। শরীরে মাংস নেই বললেই চলে। হাড্ডিসার দেহখানা নিয়ে দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান তিনি। যার ফলে অধিকাংশ সময়েই মেজাজটা রুক্ষ আর কর্কশ হয়ে থাকে। এবারেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। আগের বার ডাক দেওয়ায় এখনো ঘর থেকে সাড়া না পাওয়ায় তিনি আবারও চেচিয়ে উঠলেন।
-কই গো মনির মা। কহন ডাকছি, মরলা নাকি ঘরে?
রহিমের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মনির মা। পরণে থাকা পুরোনো শাড়ির আচলে কপালে জমে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে স্বামীর সামনে এসে দাড়ালেন উনি। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল
-ডাকলেন কেন?
-তোর চেহারাখান দেহার লাইগা ডাকছি।
তিরিক্ষি কন্ঠে উত্তর করলো রহিম। এতে কপাল কুচকালো মনির মা। ঝাঝালো মেজাজে বললো
-সবসময় এতো ত্যাড়াবাকা কথা কন কেন। ডাকছেন কেন সেইডা বলেন।
-গড়ুর মাড় পানিডা তারাতাড়ি নিয়া আয়।
-আনতেছি।
কথাটা বলেই রান্নাঘরের দিকে ছুটলো মনির মা। রান্নাঘরের এক কোনায় একটা মাঝারি আকারের প্লাস্টিকের গামলায় চাল ধোয়া পানি আর ভাত থেকে নিংড়ানো মাড় রাখা আছে। সেটা দুহাতে ধরে তরিঘরি করে নিয়ে গেলো রহিম মিয়ার সামনে।
-এই লন।
রহিম মিয়া লুঙ্গির গিট থেকে একটা বিড়ি বের করে সেটাতে আগুন ধরাতে ধরাতে বললো
-গরুডার সামনে দে।
মনির মা তাই করলো। গামলাটা গরুর সামনে রেখে উনি আবার ঘরে চলে গেলো। আবারও রহিম মিয়া পেছন থেকে হাক ছেড়ে বললো
-মনি আহেনাই এহনো ইস্কুল থেইকা?
-না।
-কি কছ। বিকাল হইয়া গেছে অহনো আহেনাই? চিন্তার ভাজ পরল রহিমের কপালে।
ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে মনির মা বললো
-চিন্তা কইরেন নাতো। আজ থেইকা মনি ওর কোন স্যারের কাছে নাকি ফ্রাইভেড পড়বো কইছিলো। হের লাইগাই দেরি হইতাছে বোধহয়।
কথাখানা শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে গেলো রহিমের। মেজাজটা আবারও তীক্ত হয়ে গেলো তার। কর্কশ কন্ঠে বললো
-কিয়ের ফ্রাইভেড, টেকা কি গাছে ধরে? কার কাছে জিগাইয়া ফ্রাইভেডে গেছে?
-ওতো মেজাজ দেখাইয়েন না তো। সারাবছর একটা খাতা কলমের টেকাও দেন, কিন্তু মেজাজখানা এমন ধরেন যেন আপনেই সব দেন। সামনেই মাইয়াডার মেট্রিক পরীক্ষা। কোনোদিন তো ফ্রাইভেড কি জিনিস পড়াইতে পারি নাই। অহন দরকার দেইখাই তো মাইয়াডা পড়তে চাইছে।
মনির মায়ের কথা শুনে আবারও দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠলো রহিম। অত্যন্ত বিষাদ গলায় বললো
-আমি টেকা দেই না তই পাস কই টেকা, মাইনষের বাড়িত তোন কি চুরি কইরা আনোস?
-মাইনষের বাড়িত কাম কইরা টেকা আনি, চুরি কইরা আনুম কেন। বলেই ফুসতে ফুসতে ঘরে চলে গেলেন উনি।
কিন্তু রহিম এতেও দমলোনা। সে খিটখিটে গলায় আবারও বললো
-মাইয়ারে অতো লেহাপড়া কইরাইয়া কি বানাইবি শুনি, ম্যাজিস্ট্রেট বানাইবি?
-হো, তাই বানামু। ক্ষমতায় কুলাইলে তার চাইতেও বড় কিছু বানামু। দাওয়ায় দাড়িয়েই উত্তর দিলো মনির মা।
– যা খুশি তা কর, আমার কাছে জানি কোনো টেকার আবদার না আইয়ে কইলা দিলাম। কথাগুলো বলতে বলতে বাড়ির বাইরে চলে গেলেন উনি।
এদিকে সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বাড়ি এসে পৌছুলো মনি। ঘরে ঢুকে বইয়ের আধভাঙ্গা টেবিলটার উপরে বইখাতা গুলো রেখে দৌড়ে চলে গেলো কলপাড়ের দিকে। হাতমুখ ধুইয়ে ঘরে এসে একটা পুরোনো ওরনা দিয়ে ভালো করে মুছে নিয়ে ছুটে গেলো মায়ের কাছে। মাটির চুলাটা সামান্য ফেটে যাওয়ায় কাঁদা মাটি দিয়ে সেটা সারাবার চেষ্টা করছেন উনি। মাকে দেখে একটা মন খোলা হাসি দিয়ে মনি বলল
-ও মা ভাত দেও, খিদা লাগছে।
-ভাত লইয়া খা, কাম করতাছি দেখস না। চুলা লেপতে লেপতে বললো মনির মা।
একটু কাঁদো কাঁদো ভাব করে মনি আবারও বললো
-তুমি বাইড়া না দিলে কিন্তু আমি খামু না।
-না খাইলে না খা, আমারে জ্বালাইস না তো। যা এখান থেইকা।
মায়ের মুখে এমন উত্তর শোনার পর মনির মনটা সামান্য খারাপ হলেও সে বেশ বুঝতে পারলো, নিশ্চয়ই মায়ের মেজাজ ঠিক নেই। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ একটা বড় বাটিতে ভাত নিয়ে কাঠের একটা জলচৌকি নিয়ে মায়ের পাশেই বসে খেতে লাগলো সে।
লাল মরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত থেকে খেতে একসময় ঝালে ফুপাতে লাগলো মনি। ওর এমন অবস্থা দেখে ওর মা ওর দিকে তাকালো একবার। এরপর আবারও চুলা লেপতে লেপতে নরম গলায় বললো
-বেশি ঝাল লাগলে ভর্তা রাইখা দে মা। মাচার কাছে গিয়া দেখ মাটির কলসটার ভিতরে দুইডা কলা আছে। কলা দিয়া মাখাইয়া খা, ঝাল যাইবো গা।
মনি একটা হাসি দিয়ে ভাতের বাটিটা রেখে এক দৌড়ে মাচার কাছে গিয়ে কলাদুটো নিয়ে এলো। ভর্তাটা একটা বাটিতে রেখে লবন আর কলা দিয়ে ভাত কচলাতে কচলাতে বললো
-কলা কইত্তে আনলা মা?
-যে বাড়িতে কাম করি, সেখান থেইকা দিছিলো এক হালি কলা। তোর বাপ আর আমি দুইজনে দুইডা খাইছি, বাকি দুইডা তোর লাগি রাখছি।
মনি আর কথা বাড়ালো না। খুশিমনে খাওয়া শেষ করলো সে। রাতে পড়ার টেবিলে বসে পড়তে পড়তে একসময় খাতা কলম নিয়ে বসলো সে। আপন মনে অংক কষে যাচ্ছে একমনে । এক সময় একটা অংক করতে গিয়ে আটকে যায় মনি। একটা হিসাব সে কিছুতেই মিলাতে পারছেনা। বার বার মাথা চুলকাচ্ছে আর কলম মুখের ভিতরে পুরে দিচ্ছে। এরই মধ্যে মনির মা হাতের কাজকর্ম সেড়ে ভালোকরে হাতমুখ ধুয়ে এসে মেয়ের পাশে বসলেন। মেয়েকে লেখতে দেখে হাসিমুখে বললেন
-কি লেখিস রে মা?
-একটা অংক করতাছি।
কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পর উৎফুল্লভাবে আবারও বললো
-ও মা, একটা ক্যালকুলেটর কিইনা দিবা?
-এইডা আবার কি? মনির মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
মনি হেসে মাকে বললো
-এইটা হইলো অংকের হিসাব করার মেশিন। কিইনা দিবা মা। একটা ক্যালকুলেটর হইলে তারাতাড়ি অংক করতে পারতাম।
-কত লাগে?
-৩০০ টেকা।
মুহুর্তেই মনির মায়ের মুখের হাসিটা কোথায় যেনো উধাও হয়ে গেলো। চিন্তার স্বরে বললো
-এতো টেকা কইত্তে দিমু, আমার কি আর অতো টেকা দিয়া হিসাব করনের মেশিন কিনার সামর্থ আছে রে মা। তোর বাপেরে কইলেও উপায় নাই। কাইজ্জা শুরু কইরা দিবো লোকটা।
মনির মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেলো মায়ের কথা শুনে। মলিন মুখে সে আবারও বললো
-তাইলে একশ টেকাই দিও, একটা কমদামি দেইখা কিনমু নে।
মেয়ের কথার বিপরীতে আর কিছু বললেন না উনি। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তিনি মেয়েকে প্রশ্ন করলেন
-কোন স্যারের কাছে ফ্রাইভেড পড়স?
-ও মা ফ্রাইব্রেড না, প্রাইভেট।
-একটা হইলেই হইল। কার কাছে পড়স শুনি?
-হামিদ স্যারের কাছে পড়ি মা। আমাগো অংকের স্যার।
-ও, কত টেকা দেওন লাগবো মাসে?
-৩০০
মায়ের মুখ খানা আবারও চুপসে গেলো। কিন্তু কিছু বললোনা আর। কি যেনো ভাবতে থাকলো একমনে।
-আব্বা কই গেছে মা?
মেয়ের কথায় ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। শুকনো মুখে উত্তর দিলেন
-জানিনা।
পরের দিন সকালে পান্তা ভাত খেয়ে স্কুলের দিকে রওনা করলো মনি। যাবার পথে একটা রাস্তার পাশে বড় গাছের ছায়ার নিচে দাড়ালো প্রিয় বান্ধবীর অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা মেয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে এলো মনির দিকে। হন্তদন্ত হয়ে মনি বলল
-কিরে, এতো দেরি করলি কেন? আমি সেই কখন থেইকা তোর লাগি দাড়াইয়া আছি।
মেয়েটি মুখ কালো করে ক্ষীপ্ত কন্ঠে বললো
-জানিনা কেন দেরি হইছে। আয় তারাতাড়ি।
মনি কিছুক্ষন তাকিয়ে রইরো মেয়েটির দিকে। হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে মেয়েটির মনে কি চলছে। এক পর্যায়ে কিছু বুঝতে না পেরে বললো
-কিরে, তোর কি মন খারাপ? কি হইছে বল আমারে।
-জানিনা কি হইছে, আয় তো জলদি। কথাটা বলেই হনহন করে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলো মেয়েটি। ওর পিছনে পিছনে ছুটতে ছুটতে মনি বললো
-ওই রিতা, বল আমারে তোর কি হইছে? আমার কিন্তু ভালো লাগতাছেনা।
মনির কথায় রিতা আগের জায়গাতেই দাড়িয়ে গেলো। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বললোনা।
মনি এইবার ওর সামনে দাড়িয়ে আবেগি গলায় বললো
-কইবি না আমারে?
এবার মেয়েটি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। মনিকে জরিয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে কেঁদে ফেললো সে। মনি এবার কাঁদো কাঁদো গলায় বললো
-কান্দিস না রিতা। বল আমারে কি হইছে।
-আমি আর স্কুলে যামু না রে মনি। আইজকাই শেষ।
-মানে, ইস্কুলে যাইবি না কেন? কি পাগলের মতো কথা বলতাছোস।
-হো, আমি কালকা ঢাকা চইলা যামু। গার্মেন্টসে চাকরি করমু।
-কি কস, কার লগে যাবি? ভারী গলায় জিজ্ঞাসা করল মনি।
মেয়েটি মাথা নিচু করে কাঁদতে কাঁদতে বললো
-আমার এক খালাতো বোইন চাকরি করে, তার সাথেই যামু। আম্মা আব্বা আমারে আর পড়াইতে পারবোনা বইলা দিছে।
মেয়েটি আবারও আঝোরে কাদঁতে লাগলো। মনি এবার আর কিছু বলতে পারলোনা। কন্ঠ ভারী হয়ে এসেছে ওর, চোখদুটো ছলছল করছে। এই বুঝি ঠিকরে এক সমুদ্র পানি বেরিয়ে আসবে সেই চোখ থেকে।
_____
বিকেলে স্কুল ছুটির পর হামিদ স্যারের বাড়ি চলে আসলো মনি। রিতার সাথে স্কুল থেকেই বিদায় পর্ব শেষ করে এসেছে সে। সেই মুহূর্তে সময় দুইজন দুইজনকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষন কেঁদেছে। আসার আগে রিতা একটা কাগজে ওর খালাতো বোনের নাম্বারটা লিখে দিয়ে গেছে মনির হাতে। কখনো যদি কথা বলতে ইচ্ছে হয় তাহলে যেনো ওই নাম্বারে ফোন করে রিতার কথা বলে। তাহলেই সে রিতাকে পাবে। মনি সেই নাম্বারটা হাতে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছিলো শুধু।
চলবে….