মন মুনিয়া পর্ব-২

0
2870

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -০২

মনির মনটা বেশ খারাপ থাকায় প্রাইভেটে কিছুতেই মন বসছিলোনা ওর। হামিদ স্যার কালো বোর্ডটাতে একটার পর একটা অংক করেই যাচ্ছেন। বাকিরা খুব মনোযোগ সহকারে সেগুলো খাতায় তুলছে। সবার মনোযোগ থাকলেও মনোযোগ নেই মনির। প্রিয় বান্ধবীর সাথে একসাথে আর পড়া হবেনা, স্কুলে আসা হবেনা ভেবেই কান্না পাচ্ছে ওর।

ব্যাপারটা হামিদ স্যারের নজরে এলো। তিনি সেটা লক্ষ্য করে বললেন
-কি ব্যাপার মনি, অংক খাতাতে তুলছোনা কেন?
স্যারের কথায় মনি হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইলো শুধু। কিন্তু কিছু বলতে পারলোনা।
স্যার কর্কশ গলায় চিল্লিয়ে উঠলেন হটাৎ। প্রচন্ড হুংকারে বললেন

-ফাইজলামি করস? আমার এখানে এইসব ফাইজলামি চলবেনা। পড়ার ইচ্ছে হইলে পড়, আর তা না হইলে বই খাতা নিয়ে বিদেয় হো। আমার এখানে কোনো অনিয়ম আমি মানবো না।
হামিদ স্যার কিছুক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকালেন। পরমুহূর্তে নিজেকে ধাতস্থ করে আবারও মনির দিকে তাকিয়ে বললেন
-নেহাত আজ আমার মন মেজাজ ভালো, নইলে অনিয়মের শাস্তি তুই পাইতি।

মনি চুপচাপ বসে আছে। চোখ দিয়ে পানি ঝরছে এক নাগারে। কোতুহলবসত সেখানে পড়তে আসা একটা মেয়ে হাসিমুখে বলে উঠলো
-আজকে কি কোনো বিশেষ দিন স্যার?
-কেন?
-অন্যদিনের চাইতে আজকে আপনাকে অনেক খুশি খুশি লাগতেছে।

মেয়েটির কথা শুনে স্যারের মুখের কালো আভা সরে গিয়ে সেখানে হাসির রেখা দেখা গেল। আনন্দচিত্তে তিনি বললেন
-আজ আমার ছেলে আসতেছে ঢাকা থেকে। ওইখানে বড় ভার্সিটিতে পড়ে সে। ঢাকা ভার্সিটির নাম শুনছিস তোরা?
স্যারের কথায় মনি ছাড়া বাকিরা উৎফুল্লচিত্তে বলে উঠলো
-জ্বি স্যার।
হামিদ স্যার গর্বের সঙ্গে বললেন
-সেখানেই পড়ে আমার ছেলে।

সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে বাড়ি আসলো মনি। ওর বাবা গাছের সাথে বেধে রাখা গরুটাকে খুব যত্ন সহকারে কি যেনো খাওয়াচ্ছে। মা ও একাজ ওকাজ করতে ব্যাস্ত। মনি নিশ্বব্দে ঘরে এসে ঢুকলো। উপরে টিনের চালা দেওয়া ঘরটার চারপাশে বাতার বেড়া দেওয়া। টিনের বেড়া দেওয়ার মতো সামর্থ্য ওদের নেই। রহিম মিয়া হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যা কামিয়েছিলো, তা দিয়ে এই গরুটা সে কিনেছে। এখন ওই একটা গরু নিয়েই পরে থাকে সারাদিন। ঘরে কি লাগলো না লাগলো সেসবের ধার ধারেন না উনি। মনির মা অনেক কষ্টে পরের বাড়িতে কাজ করে সবকিছু মিটাচ্ছেন।

আজ মনটা খারাপ থাকায় খাওয়া দাওয়ার কথা যেনো ভুলে গেছে মনি। সে ঘরে ঢুকে কোনোমতে বইগুলো বিছানাতে রেখেই উপর হয়ে শুয়ে পরলো। কিছুই ভালো লাগছেনা ওর।

কিছুটা সময় পর গরুটাকে রান্নাঘরের এক পাশে বেধে ঘরে এসে ঢুকে রহিম। মেয়েটাকে এভাবে এই অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা কপাল কুচকালেন তিনি। সামান্য রুক্ষ কন্ঠে বললেন
-এই বেলা শুইয়া রইছোস কেন শুনি?
বাবার কথায় সে কোনো নড়াচড়া না করে শুয়ে থেকেই বললো

-আজ ভালো লাগতাছেনা।
-ভালো লাগবো কেমনে। মা মাইয়া মিইলা আমারে ডুবাইয়া ফ্রাইবেড পড়াত যাইতাছোস। একবার ভাবোস নাই যেই টেকা দিয়া ফ্রাইবেড পড়বি সেই টেকা দিয়া আমাগো কয়েক দিনের বাজার চলতো। মার মতোন খালি নিজের স্বার্থডাই চিনলি। তোগো ভালো লাগবোও না।

একদমে কথাগুলো বলে হনহন করে রহিম মিয়া নিজের বিছানার দিকে গেলেন। সেখানে গিয়ে একটা বিড়ি ধরিয়ে সেটা টানতে টানতে তিনি সেখানেই বসে পরলেন।
মনির ভাবাবেগ হলোনা তাতে। সে আগের মতোই পরে রইলো বিছানায়।

রাতে অনেক জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারলোনা মনির মা। মেয়ের চিন্তায় তিনি অস্থির প্রায়। সকালে কয়েক লোকমা পান্তা ভাত খেয়ে বেরিয়েছিলো মেয়েটা। এই বেলা কিচ্ছুটি খাওয়া হয়নি। এখন রাতেও কিছু খেতে চাইছেনা। মেয়ে অসুখ বাধিয়েছে ভেবে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন উনি। কারণ অসুখ বাধলে ঔষধ খাওয়ানোর মতো যথেষ্ট টাকা উনার কাছে নেই।

তিনি মনির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন
-মা কি হইছে তোর? অসুখ করছে। আমারে বল মা।
-আমার কিচ্ছু হয় নাই মা।
-তাইলে খাস না কেন। সারাদিন না খাওয়া,অহনো যদি কিছু না খাস পরে অসুখ হইবো তো।
-হইলে হোক। আমি খামুনা কিছু।
মনির মা হতাশ গলায় বললো
-দেখ মা, তুই তো সব দেখোস সব জানোস৷ তবুও কেন এমন করতাছোস? যদি তোর কোনো অসুখ হয়, আমি কইত্তে তোর অসুধ খাওয়ামু? তোর বাপের চরিত্র তো জানোসই।

মায়ের কথার বিপরীতে মনি তখন আর কিছু না বলে উঠে বসলো। মায়ের ঠোঁটের কোনে তখন একটু হাসির আভা দেখা গেল। তিনি উঠে চলে গেলেন মেয়ের জন্য ভাত বেড়ে আনতে।

পরেরদিন সকাল সকাল আবারও স্কুলের দিকে ছুটলো মনি। যদিও একা একা যেতে ইচ্ছে করছিলো না ওর। কিন্তু যেতে তো হবেই। পুরো ছয়টা পিরিয়ড শেষ হবার পর ছুটির ঘন্টা বাজতেই যে যার মতো ছুটতে লাগলো বাড়ির দিকে। কিছু সংখ্যক ছাত্র ছাত্রী যারা হামিদ স্যারের কাছে পড়ে তারা নিজেদের মতো ওখানে যেতে লাগলো।

মনি ওদের পিছুপিছু একা একাই যেতে লাগলো স্যারের বাড়ির দিকে।। কিছুটা সময় পর স্যারের বাড়ির কাছাকাছি পৌছে গেলো ওরা। স্যারের বাড়ির বাইরের দিকে মনির সহপাঠীরা একটা জটলামতো বাধিয়েছে। মনি সেটা খেয়াল করে কিছুটা চিন্তিন মনে একা একা বিড়বিড় করে বললো

-এদের আবার কি হলো। এখানে কি করছে ওরা?
মনি সেখানে এগিয়ে গেলো আস্তে আস্তে। একটা বাশের তৈরি মাচার উপর সুদর্শন একটা ছেলে বসে গিটার বাজাচ্ছে। মনির সাথে পড়া বাকি মেয়েরা হা হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। সকলের চোখেমুখে খুশির ঝলক।
মনি ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে একটা মেয়েকে আস্তে আস্তে বললো
-এই ছেলেটা কে?
-হামিদ স্যারের ছেলে। সুন্দর না? ইশশ, ছেলেটা যদি একবার আমার দিকে তাকাতো নির্ঘাত প্রেমে পরে যেতো।

মনি আঁড়চোখে একবার মেয়েটার দিকে তাকালো। ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল সে। নাম ইতি। মনি ইতিকে লক্ষ্য করে বললো
-এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবা? পড়তে যাইবা না স্যারের কাছে?
-যাবো তো। এখন থেকে একবার নয়, বারবার পড়তে আসবো স্যারের কাছে। আমি আজই বাবাকে গিয়ে বলবো একবার পড়ে আমি এগোতে পারছিনা।
মনি ভ্রু বাকিয়ে বললো
-যা খুশি তা করো। আমি গেলাম।
মনি চলে আসার পর আরো কয়েকটা মেয়ে ওর পিছু পিছু স্যারের রুমে এসে বসলো। ছেলেগুলো আগেই চলে এসেছিলো।

হামিদ স্যার রুমে ঢুকে দেখলেন অন্যদিনের চাইতে আজ রুমটা বেশ কোলাহলময়। প্রায় সকলেই একে অন্যের সাথে কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে। উনি ঢোকাতেও কারো মাঝে কোনো পরিবর্তন এলোনা। তিনি সামান্য শব্দ করে কাশি দিলেন। এবার সকলে নড়েচড়ে বসলো। তিনি মৃদু হেসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-কি ব্যপার, আজ সবাই এতো অন্যমনস্ক কেন?

ইতি নামের মেয়েটা উৎসুক কন্ঠে বললো
-স্যার, বাইরে যে বসে আছে
কথাটা শেষ করার আগেই হামিদ স্যার বলে উঠলেন
-আমার ছেলে।
-জানি তো স্যার। আপনার ছেলের নাম কি?
-সেটা জেনে তুই কি করবি?
-নাহ, এমনিই জানতে চাইছিলাম আর কি।
-পড়তে আসছিস পড়, অন্যদিকে নজর দিসনা।
স্যারের কথায় কিছুটা বিপাকে পরে গেলো ইতি। সকলে কিছুটা শব্দ করে হেসে উঠলো তখন।।এতে কিছুটা বিচলিত বোধ করে বই খুলতে লাগলো সে।

প্রাইভেট পড়ার এক মুহূর্তে সেই ছেলেটা পড়ার রুমে এসে ঢুকলো। সকলেই একটু নড়েচড়ে বসলো এতে। ইতি চোখ বড় বড় করে তাকালো সেইদিকে, যেনো চোখ দিয়েই গিলে খাবে। ওর পাশেই বসা ছিলো মনি। ইতি অতিরিক্ত উত্তেজনায় মনিকে এক হাতে কিছুটা চেপে ধরে দাত চেপে হাসলো। মনি অদ্ভুতভাবে তাকালো ইতির দিকে। যে ইতি ওর দিকে ফিরেই তাকায় না, সে কিনা ওকেই চেপে ধরেছে। মনি ইতির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
-কি হইছে তোমার?
-ছেলেটা কতো সুন্দর না? ইশ, একদম আমার মতো সুন্দর।
-হো সুন্দর। আমি কি করমু তাতে?
ইতি মনিকে ছেড়ে দিয়ে বললো
-তোকে কিছু করতে হবেনা।

হামিদ স্যার খেয়াল করলেন উনার ছেলে কিছু একটা খুজে চলেছে পড়ার রুমে। উনি ছেলেকে লক্ষ্য করে হাসিমুখে বললেন
-কি খুজতাছো বাপ?
-আমার পাওয়ার ব্যাংক টা বোধহয় এই ঘরেই রেখেছিলাম রাতে। কোথায় রেখেছি বলো তো বাবা?
-আমি কেমনে জানমু বাপ। তুমি তো রাইতেই আইলা। কখন রাখলা এই ঘরে?
-আমি রাতে এখানে বসে ভার্সিটির কিছু কাজ করেছিলাম। তখন এখানেই ছিলো ওটা। এখন পাচ্ছিনা।
-ও, আচ্ছা আব্বা তুমি এখন একটু বাইরে যাও, ওগোরে ছুটি দিয়া আমি তোমার জিনিস তোমারে খুইজা বাইর কইরা দিমু।
-ঠিক আছে। কথাটা বলেই উনার ছেলে বাইরে চলে গেলো।

ইতি মন খারাপ করে মনিকে হাত দিয়ে একটা গুতো দিয়ে বললো
-দেখলি স্যারটা কতো খবিশ, একবারও ছেলের নামটা মুখে আনলো না আমাদের সামনে।
মনি শুধু কপাল বাকালো। এরপর আবার বই এর দিকে মনোযোগ দিলো সে।

প্রায় এক ঘন্টা পড়ার পর ওদের প্রাইভেট শেষ হলো। সকলে বইপত্র গুছিয়ে বাড়ির পথে রওনা করলো। শুধু ইতি আর মনি এখনো বের হতে পারেনি। ইতি এখনো গালে হাত দিয়ে বসে আছে বেঞ্চে। মনি কয়েকবার সেদিকে তাকিয়ে এড়িয়ে যেতে চাইলো ব্যাপারটা। সে নিজের মতো বইপত্র গুছিয়ে বের হবে, কিন্তু পরক্ষনে মনে হলো, ইতি হয়তো কোনো সমস্যায় পরেছে। সেই ভাবা থেকে সে আবারও উলটে গেলো ইতির কাছে। সে এখনো ভাবনায় মশগুল।

মনি ইতির কাধে স্পর্শ করতেই ওর দিকে হতভম্বের মতো তাকালো ইতি। মনি ইশারায় ওকে বললো
-কি হইছে, অসুখ করছে তোমার?
-হুম, প্রেমের অসুখ।
মনি এটার মানে বুঝতে না পেরে বললো
-কি কও, আমি বুঝতে পারি নাই।
-তোর বুঝে কাজ নাই।
কথাটা বলেই বই এর ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহন করে চলে গেলো ইতি। মনি বিস্ময় নিয়ে বিড়বিড় করে বললো
-আজব তো। ওর লাইগা আমি দাড়াইয়া রইলাম, আর ও আমারে থুইয়াই গেলো গা।

মনি আর বেশিক্ষণ চিন্তাভাবনা না করে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো। সে দরজার কাছাকাছি গিয়ে বাইরে বেরোবার জন্য এক পা বাড়াতেই কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পরে গেলো কিছুটা দূরে। সামান্য ব্যাথা পেয়ে উহ করে উঠতেই কারো কথায় সামনে তাকালো মনি। স্যারের সেই সুদর্শন ছেলেটি ওর সামনে উপুর হয়ে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে আছে আর বলছে
-এই মেয়ে, ব্যাথা পাও নি তো? হাতটা ধরে উঠে আসো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here