মন মুনিয়া পর্ব-২৩

0
1607

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৩

দুদিন কেটে যাওয়ার পর আশার বাবার অনুমতিতে কোচিং এ জয়েন করলো মনি। দুটো শিফটের একটা সকাল ৭-৯ টা, আরেকটা বিকেল ৩:৩০-৫ টা।

মনি দুটো শিফটেই সময় দিবে, এতে করে সময়টাও কেটে যাবে সুন্দরভাবে।

প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকে সর্বপ্রথম বাচ্চাদের সাথে পরিচয় পর্ব সেড়ে নেয় মনি। এর মধ্যে মনির নামের ছেলেটা এসে প্রবেশ করে ক্লাসরুমে। আশার বাবা ফায়াজ সাহেব আগেই তাকে বলে রেখেছিলো আজ থেকে মনিও বাচ্চাদের পড়াবে৷

সে কারণে মনিকে দেখে বিন্দুমাত্র অবাক হলোনা মনির। উল্টে স্মিথ হেসে বললো
-কেমন আছেন মিস মনি?
-হুম ভালো।
কোনোমতে উত্তর দিয়ে সে আবারও বাচ্চাদের দিকে ঘুরে দাড়ালো। বাড়তি কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই তাই।

মনির ভ্রু বাকালো। মনে মনে ভাবলো
-এইটুকু একটা মেয়ের ভালোই তো দেমাক দেখছি, সবই কি রুপের কারণে?
মনির আবারও প্রশ্ন করলো মনিকে
-মন ভালো নেই নাকি?
-ভালো।

মনিরের কাছে কেমন যেনো অপমানজনক মনে হলো বিষয়টা। কিন্তু তিনি মনের মধ্যে সেটাকে পুষে রেখে ক্লাসরুম ত্যাগ করে অন্য ক্লাসে গেলেন। উনার চলে যাবার দিকে দৃষ্টি ফেলে স্বস্তির শ্বাস টানলো মনি। কেন জানি এই লোকটার দৃষ্টিভঙ্গি তার কাছে মোটেও সুবিধার লাগেনা।

প্রথম ক্লাসটা শেষ হলে মনি সেকেন্ড ক্লাস নেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তদমুহুর্তে মনির নামের ছেলেটা আবারও মনির ক্লাসে প্রবেশ করে। মনিরকে দেখে মনি ভ্রু বাকায়। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকানোর সাথে সাথে মনির বলে
-এখন আমার ক্লাস এখানে। আপনি ওই ক্লাসে যান।
মনি কথা বাড়ায় না। সে মনিরের নির্দেশ মতো ক্লাসরুম ত্যাগ করে।

পুরো দুটো ঘন্টা পার হয়ে গেলে কোচিং ছুটি দেওয়া হয়। মনি ঘরে যাবার জন্য পা বাড়ায়। পিছন থেকে মনির নামের ছেলেটি বলে উঠে
-মিস মনি।
মনি জায়গায় দাঁড়িয়ে পরে, তবে ফিরে তাকায় না।

মনির এগিয়ে এসে বলে
-বিকেলে আরেকটা শিফট আছে।
-আমি জানি।
-জানলে ভালো। আমি ভাবলাম, আমার আপনাকে জানানো উচিত।
-ধন্যবাদ।
মনি আর কথা বাড়ায় না। সে এগিয়ে যেতে থাকে ঘরমুখে।

পিছন থেকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে মনির। আবারও মনিকে ডাকতে গিয়ে কি যেনো ভেবে থেমে যায়। চলতে শুরু করে নিজের পথে।

________
বিকেলের শিফট শেষ করে যখন ঘরে আসে মনি তখন রাতের জন্য রান্নাবান্না চলছে। হিমা আর রাবেয়া মিলে পুরো দমে রান্নায় মনোনিবেশ করেছে। মনি রান্নাঘরে গিয়ে সামান্য উঁকি দেয়। ওর খুব ইচ্ছে করে ওদের সাথে গিয়ে কিছু করুক, ওদেরকে নিজের মানুষ ভেবে ওদের কাছেপিছেই থাকুক।

কি এক অজানা বাধা তাকে সামনে অগ্রসরের পথে যেনো বেড়াজাল দিয়ে রেখেছে। সেই বেড়াজাল পেরিয়ে সে ওদের কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করে।

মনি উল্টোদিকে ফিরে চলে আসতে নেয়। তখনই পিছন থেকে ডাক আসে তার।
-মনি, চলে যাচ্ছিস কেন। ভেতরে আয়।
রাবেয়ার কথা শুনে খুবই আনন্দিত হয় মনি। মনে হতে থাকে সামনে থাকা বেড়ার বাধটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।।

মনি সানন্দে রান্নাঘরে ঢুকে। হিমা হাসিমুখে বলে
-বসো মনি।
পাশ থেকে একটা ছোট্র টোল নিয়ে বসে পরে সে। রাবেয়া তরকারি কুটছে। মনি দ্বিধাদ্বন্দ্ব পেরিয়ে রাবেয়াকে বলে
-আমি কাটবো আন্টি?

রাবেয়া কিছুক্ষণ মনির দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। মনির কাছে মনে হয় সে হয়তো কোনো ভুল কিছু বলে ফেলেছে। মনি কথা ঘুরাতে বলে
-নাহ মানে,
ওর পুরো কথা বলার আগে বাধ সাধে রাবেয়া। ক্ষীণ কন্ঠে বলে
-তোকে বরং আমার দায়িত্ব টা দিয়েই দেই মনি। কি বলিস?

মনি অবাক হয় রাবেয়ার কথায়। বিস্ময়ে বিস্ফোরিত হয়ে আতংকে বলে
-মানে?
-তুই আর হিমা মিলে সবকিছু করবি, আমি শুধু তোদেরকে তদারকি করবো। ভাবছি, রান্নাবান্না থেকে আমি ছুটিই নেই। ওসব আর আমার দ্বারা হবেনা।
মনি অবাক হয়। কি বলবে সে ভেবে পায়না। হটাৎই আনন্দে হতবিহ্বল হয়ে পরে সে। চোখের কোনে পানি জমে যায় তার।

হিমা সেটা খেয়াল করে বলে
-কি হয়েছে মনি, তুমি কি কাঁদছো?
মনি হাসে। চোখের কোনে জমে থাকা পানি ওড়নার মাথা দিয়ে মুছতে মুছতে বলে
-কাঁদছি না আমি। আমি একটু ঘর থেকে আসতেছি ভাবি।

মনি ছুটে বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে। রান্নাঘরের দেয়ালের সাথে নিজেকে চেপে রেখে চোখ বন্ধ রাখে কিছুক্ষণ। এতোটাও পূণ্য সে কখনো করেনি যার কারণে এতো ভালো মানুষদের আশ্রিয়ে সে আশ্রিত হয়েছে।

হিমা রাবেয়াকে বলে
-তুমি কেন শুধু শুধু মেয়েটাকে দায়িত্ব নেবার কথা বললে মা, মেয়েটা হয়তো কষ্ট পেয়েছে।
রাবেয়া হাসলো। হিমাকে বুঝানোর মতো করে বললো
-তুই এইসব বুঝবিনা হিমা। মনি মোটেও কষ্ট পায়নি। আর আমি ওকে দায়িত্ব নেবার কথা বলেছি মানেই ওর মাথায় কাজের বুঝা চাপিয়ে দিচ্ছিনা। ওর মনটাকে ফ্রেশ করার জন্য আমি এই কথাটা বলেছি যাতে ওর মনে হয় আমরা ওকে পর ভাবছি না, আপন করে নিয়েছি।

যদি আমরা মেয়েটার সাথে সেই আচরণটা না করি তাহলে মেয়েটা ভেতর থেকে আরও ভেঙ্গে পরবে, মানুষিক ভাবে হয়তো অসুস্থও হয়ে পরবে, যেটা এই অবস্থায় একটা মেয়ের জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।

হিমা বললো
-সত্যিই তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয় মা। শিখে রাখলাম, যদি কখনো কেউ বিপদে পরে তখন যেনো আমিও তোমার মতো করে সাপোর্ট দিতে পারি।

মনি রান্নাঘরের অপর পাশে দাঁড়িয়ে থেকে এতোক্ষণ সব শুনছিলো। কথাগুলো শুনে মনের মধ্যে এক অজানা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেলো তার। চোখের কিনারা বেয়ে আবারও দুফোঁটা পানি বেরিয়ে এলো। সে আস্তে আস্তে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেল। চোখেমুখে ভালো করে পানি ছিটা দিয়ে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।

________
দিন গড়িয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক নিয়মে দিন যাবার সাথে সাথে পেটের ফোলাভাব টা একটু একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা বাঁকাভাবে ঠেকছে মনির নামের সেই ছেলেটার কাছে। একদিন কোচিং রুমে ক্লাস করানোর এক ফাঁকে মনির এসে মনিকে বলল
-ভালো আছো মনি?
মনি বইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো
-ভালো।
-তোমার সাথে একটু কথা বলা যাবে?
-কি বিষয়ে?
-এমনি একটু নিজেদের ব্যাপারে কিছু বলতাম আরকি।
-আমি ইচ্ছুক নয়।

আবারও অপমানিত হলো মনির। দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো
-তুমি কি প্রেগন্যান্ট?
মনি চমকে তাকালো মনিরের দিকে। অস্ফুটে বললো
-কেন?
-তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি প্রেগন্যান্ট।

মনি কয়েক সেকেন্ড দম নিয়ে বললো
-হুম।
-তোমার বিয়ে হয়েছে তো নাকি?
কথাটা খুব বাজেভাবে গিয়ে কানে ঠেকলো মনির। এই কথার উত্তর দেওয়াটা কি এতো সহজ?
মনির আবারও তাড়া দিয়ে বললো
-কি হলো, কথা বলছো না যে। তোমার হাজবেন্ড কি করে?
-আমার হাজবেন্ড নেই।

মনির নামের ছেলেটা ভ্রু বাকিয়ে বললো
-ওহ, এমনটাই ভেবেছিলাম। যেসব মেয়েরা অতিরিক্ত দেমাক দেখায় তাদের সাথে এমনই হয়।
কথাটা তীব্রভাবে আক্রমণ করলো মনিকে। সে কিছু বলে উঠতে পারলোনা। ছেলেটা আবারও বললো
-ঠিক বলেছি তো?
মনি চোখমুখ শক্ত করে তাকালো মনিরের দিকে। রাগে লাল হয়ে গেছে তার দুটো চোখ। মনির স্মিথ হেসে বললো
-আমার দিকে এভাবে রেগে তাকালেই কি সত্যটা মিথ্যা হয়ে যাবে মিস মনি?
-কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা সেটা বুঝতে হলে একটা মন লাগে, আপনার সেটা আছে?

মনির হাসলো। স্বাভাবিকভাবেই বললো
-এটলিস্ট আপনার চাইতে বহুগুণে বেশি আছে।
-আপনার কি ক্ষতি করেছি বলুন তো? কেন আমাকে এই ধরনের কথা বলে বিব্রত করছেন?
-প্রথম থেকেই তুমি আমাকে এভয়েড করছো। এইরকম চরিত্র নিয়ে তোমার কিন্তু এটা করা উচিত হয়নি।
-আমার চরিত্র নিয়ে আমাকেই ভাবতে দিন।

মনি দৌড়ে বেরিয়ে এলো ক্লাসরুম থেকে। আর সহ্য হচ্ছেনা তার। খুব কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করেও চোখের বাধ আটকিয়ে রাখতে পারছেনা সে।

বিছনায় উপুড় হয়ে শুয়ে নিরবে কাঁদতে লাগলো মনি। আর কতো অপমানিত হতে হবে তাকে? আর কতো ছোট নজরে মানুষ তাকে দেখবে?

মনি কাঁদছে। আজ খুব মায়ের কথা মনে পরছে তার। এই মুহূর্তে মা কাছে থাকলে নির্ঘাত মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলতো, “পাগলী মাইয়া, এইভাবে কান্তাছোস কেন? কাইন্দা কোনো কুল-কিনারা পাইবিনা। কান্দিস না, মনডারে শক্ত কর। যত নরম হইবি, মানুষ তোর লগে ততোই গরম দেখাইবো। নিজের দুর্বলতা মাইনষের সামনে বাইর না কইরা নিজেরে শক্ত কর, উচিত কথা মুখের উপরে শুনাইয়া দে, পরেরবার মাইনষে তোরে এক কইতে দুইবার ভাববো।”

সারাদিন এভাবে শুয়ে বসে দিন পার করলো মনি। দুপুরে অনেক জোরাজুরির পরেও কেউ ওকে দুমুঠো ভাত খাওয়াতে পারলোনা। বিকেলের শিফটেও আর কোচিং এ গেলোনা সে।

সন্ধ্যার পরপর হিমার মোবাইলে আশা কল করলো। বেশ কিছুক্ষণ মা আর হিমার সাথে কথা বলে সে মনির সাথে কথা বলতে চাইলো। হিমা ওকে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে বলে ফোনটা নিয়ে মনির রুমে এলো। মনি তখনও উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। হিমা মুচকি হেসে মনিকে ডাকলো।
-মনি।
হিমার এক ডাকেই মনি উঠে বসলো। সে যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে হিমাকে বলল
-জ্বি ভাবি।
-আশা কথা বলতে চায় তোমার সাথে।

আশার কথা শুনে খুশি হলো মনি। সে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে হিমার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কানে ঠেকালো।
-ভালো আছিস মনি?
-হুম৷ তুমি ভালো আছো? নির্জীব কন্ঠে বললো মনি।
-ভালো আছি। কিন্তু..
-কি?
-তোর গলা এমন শুনাচ্ছে। তুই কি অসুস্থ?
-না আশাপু। বাড়ির কথা মনে হচ্ছিলো তাই একটু খারাপ লাগছে।
-ওহ। বাড়ির কথা বলায় মনে হলো, আজ তোদের এলাকার এক জনের সাথে আমার কথা হয়েছে।

আশার কথায় উতলা হয়ে মনি বলল
-কার সাথে আশাপু?
-ওই যে তোর এক্সামের দিন একটা ছেলের সাথে কথা বলছিলাম মনে আছে? আমি বলেছিলাম ও আমার ভার্সিটির সিনিয়র।
মলিন কন্ঠে মনি বললো
-হুম মনে আছে।
-ওর সাথেই কথা হয়েছে। আজ ফোন করেছিলো, ইনভাইট করলো আমাকে।।

মনি অবাক হলো। বিস্ময়ে বললো
-কিসের জন্য?
-ওর বিয়ে কাল।
মনির মাথায় বাজ পরলো। এ কি বলছে আশাপু? মনের মধ্যে নানান অভিযোগ থাকলেও এতোদিন একটা সুপ্ত বাসনা ছিলো, বাচ্চাটা হয়ে গেলে হয়তো বাচ্চা দেখার পর নিয়ান ওকে মেনে নিবে। তাহলে কি এবার সব শেষ?

মনির কন্ঠ বসে গেছে। কিছু বলতে চেয়েও যেনো বলতে পারছেনা। অনেক চেষ্টার পর কাঁপা কাপা গলায় সে বলল
-কার সাথে?
-আমি চিনিনা। তবে বললো ওর হবু বউয়ের নাম নাকি ইতি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here