মন মুনিয়া পর্ব-২৫

0
1554

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -২৫

মনি গম্ভীর কন্ঠে বললো
-ওই নিয়ানই আমার বাচ্চার বাবা আশাপু।

মনির কথায় চমকে উঠলো আশা, কথাটা কেন যেনো তার বোধগম্য হলোনা। সে আবারও মনিকে প্রশ্ন ছুড়লো।
-কি বললি তুই মনি?
মনি নরম গলায় মাথা নিচু করে বললো
-আমি ঠিকই বলছি আশাপু।
-তাহলে সেদিন যে বললি তুই ওকে চিনিস না।
-আর কিইবা বলতাম আমি?

মনির চোখে পানি, আশা নিজের হাত দিয়ে সেই পানি মুছতে মুছতে বললো
-একদম কাঁদবি না বলে দিলাম।।
-আমি কাঁদতে চাই না আশাপু, তবুও কেন জানি চলে আসে।

আশা কিছু বললোনা। সে শুধু অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো। মনি বিস্ময় নিয়ে কান্নারত অবস্থায় বললো
-তুমি এইখানে কি করো?
-আমি তোকে বলেছিলাম নিয়ান আমাকে ইনভাইট করেছে ওর বিয়েতে। ইনভাইটেই এসেছিলাম। কিন্তু এদিকটায় এসে দেখলাম তোকে। প্রথমে চিনি নি। তবে বোরকাটা দেখে সন্দেহ লাগছলো। যদিও এইরকম বোরকা রাস্তাঘাটে এভেইলেবল, তবুও নিজের জিনিসটা চিনতে কি কখনো ভুল হতে পারে?

মনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো
-তুমি যাও নাই কেন বরযাত্রী?
-তোকে চিনতে পেরে আমার মাথাটা হ্যাং হয়ে গেছিলো মনি বিশ্বাস কর। আমি নিজের মধ্যে ছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম তুই এখানে কি করছিস।
তবে এখানে থাকার পিছনে তোর যে এতোবড় কারণ থাকতে পারে সেটা কল্পনাও করিনি আমি।

মনি উদাশ দৃষ্টি মেলে আকাশের দিকে তাকালো। আশা বললো
-নিয়ান কি বললো তোকে?
-কি করবে জেনে? ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো মনি।
-জানতে চাই। বল কি বলেছে।
-আমি ওদের লেভেলের না, তাই আমাকে সে মেনে নিতে পারবেনা।
-আর কিছু বলেছে?
-ওদের নতুন জীবনে যেনো আমার কুনজর না লাগে তার জন্য সে আমার কাছে মিনতি করেছে।

আশার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। সে সামান্য ঝাঝালো গলায় বললো
-তুই কি বললি?
-আমার কথায় কি এসে যায়।
মনির চোখ বেয়ে আবারও পানি ঝরছে।

আশা ওকে সামান্য ধমকে বললো
-কান্না বন্ধ করতে বলেছি না?
মনির কান্না আরো বেড়ে গেলো কয়েকগুণ । আশা মনিকে আলতো হাতে জরিয়ে ধরে বললো
-এখানে কান্নাকাটি বন্ধ। বাড়ি চল।
-তুমি যাবে বাড়ি?
-এই অবস্থায় কি করে তোকে একা ছাড়ি বল।

_____
দুজনে বাড়ি পৌছুতে বিকেল হয়ে গেছে প্রায়। আশার পিছ পিছু বাড়ি ঢুকছে মনি। চোখদুটো ফুলে আছে, রক্তবর্ণে রঞ্জিত সে চোখদুটো দেখলে যে কেউই সহজে বুঝে যাবে সে কেঁদেছে। নিজেকে অনেক সামলাতে গিয়েও পারছেনা সে।

রুমের ভিতরে গিয়ে আশা আর মনি দুজনই হতবাক হয়ে গেলো। যেখানে আশাকে দেখে বাকিদের চমকানোর কথা ছিলো সেখানে আশা নিজেই চমকে গেলো চরমভাবে। ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে সুদর্শন এক ছেলে। মনি অবাক হলো তাকে দেখে।
এই ছেলেকে সে আগে দেখেনি। হাবভাবে মনে হচ্ছে অচিন দেশের কোনো এক সাহেব ভুল করে এই অজোপাড়া পায়ে চলে এসেছে।

আশা চোখ বড় বড় করে তাকালো ছেলেটির দিকে। ছেলেটি মিটমিট করে হাসছে আর আশার দিকে তাকিয়ে আছে।

আশা রেগে গেলো পরক্ষণে। চোখের পলকে সে ছেলেটির কাছে চলে গেলো, আক্রমণ করতে লাগলো ওর নরম হাত দিয়েই। ছেলেটি হাসছে আর হাত দিয়ে মার ঠেকানোর চেষ্টা করছে অনবরত। এক পর্যায়ে সে বললো
-আর কতো মারবি আশু। এবার তো থাম। এতোদিন পর তোদের বাড়ি এসেছি, খাতির যত্ন না করে মারছিস! এই দিনটা দেখতে হবে ভাবি নি।

-হ্যাঁ মারছি, আরো মারবো। তুই কাকে বলে এসেছিস এখানে?
আশা জোরে জোরে চিল্লিয়ে ডাকতে লাগলো ওর মাকে।
-মা, মা, ভাবী কোথায় তোমরা?
মনির বোধগম্য হচ্ছেনা কিছুই। সবকিছুই উলট পালট লাগছে তার কাছে। কে এই ছেলে? আশাপু এত ক্ষেপেই বা আছে কেন তার উপর?

রান্নাঘর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো হিমা আর রাবেয়া।
আশাকে দেখে অবাক হয়ে বললো
-তুই কখন এলি?
-মাত্রই এলাম। তোমরা আমাকে বলোনি কেন ভাইয়া এসেছে?
রাবেয়া হেসে বললো
-আমরাকও জানতাম না ও আসবে। হটাৎ করেই এসেছে।
পাশ থেকে হিমা বললো
-তোমার ভাই নাকি আমাদের সারপ্রাইজ দেবার জন্য এভাবে এসেছে।

আশা রেগেমেগে আবারও তাকালো নীলের দিকে, কিন্তু এবার আর কিছু বললনা। গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। নীল হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো আশার কাছে। আশার মাথায় টুকা দিয়ে বললো
-রাগ কি কমেছে আশু?
-নাহ। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো আশা।
-ওকেহ, তাহলে তোর জন্য আনা গিফটগুলো অন্য কাউকে দিয়ে দেই। কাকে দেওয়া যায় বলতো?
আশা মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো এবারও।

নীল হিমার দিকে তাকিয়ে বললো
-তাহলে ভাবী, আমি বরং চলেই যাই। আমার সামনে কেউ রেগে থাকলে আমার হেচকি উঠে।
হিমা হেসে বললো
-আরো কিছু?
নীল আবার সশব্দে হাসলো। আশার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে বললো
-ও হ্যাঁ, হেচকি ছাড়াও কেউ যদি আমার সামনে রেগে থাকে তখন আমারও খুব রাগ হয়, রাগের চোটে কান্নাও পায়। আর কান্না করতে করতে সর্দি লেগে যায় আমার। এটা আমার মোটেও ভালো লাগেনা। নাক লাল হয়ে অবস্থা নাজেহাল হয়ে যায়, সর্দির কারণে চোখ দিয়েও অনবরত পানি পরে, তখন লোকে ভাবে আমি হয়তো ছ্যাঁকা খেয়ে কান্না করছি।

আমি বাবা এতোদুর পর্যন্ত যেতে চাইনা। যেখানে আছি সেখানেই ফুলস্টপ দিয়ে চলে যাচ্ছি। টাটা…

আশার রাগ কমে গেলো এবার। সে ফিক করে হেসে ফেলতেই নীল দম ছেড়ে বললো
-যাক, বাবা। রাগ কমেছে তাহলে।
হিমা বললো
-তোমাদের ভাই বোনের রাগারাগি শেষ হলে এবার এসো খেতে। অনেকটা জার্নি করে এসেছো দুজনেই। আর মনি তুমিও এসো। সারাদিন হয়তো কিছু না খেয়েই ছিলে।

মনি মুচকি হাসলো। নিরব কন্ঠে বললো
-উনাদেরকে দিন ভাবী। আমার এখন খিদে নেই।
বাকিদের কিছু না বলার সুযোগ দিয়েই মনি রুমে চলে গেলো। মনটা তার বড্ড খারাপ। কি করে সে খাবে?

নীল কিছুক্ষণ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিলো মনির দিকে। ও চলে যাবার পরপরই সে আগ্রহ নিয়ে হিমাকে বলল
-মেয়েটা কে ভাবী?
-তোমার বোনের বান্ধবী।
-ওহ, কিন্তু এখানে কেন? না মানে বেড়াতে এসেছে নাকি?
-এসেছো যখন সবই জানতে পারবে। আগে খেয়ে নাও, তারপর না হয় সব শুনবে।
-ওকে।

খাওয়া দাওয়া করে প্রায় অনেক্ষণ বসে থেকে সকলের সাথে গল্পগুজব করেছে নীল। বিদেশে কিভাবে সে কি করে, কখন কোথায় যায়, ওখানকার পরিবেশ কেমন, মানুষজন কেমন সেসব নিয়েই ছিলো মূলত গল্পের আসরটা। গল্পগুজব সেড়ে ওর মনে হলো এবার একটু বিশ্রাম নেওয়া দরকার। এখানে আসার পর থেকে বিশ্রাম নেওয়া হয়নি একটুও। এতো বছর পর দেশে ফিরেছে সেই উত্তেজনায় বিশ্রামের চিন্তা ওর মাথাতেও ছিলোনা।।

গল্পের আসর সেড়ে উঠে পরে নীল। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। নীল চলে যারার পর হটাৎ আশার খেয়াল হয় ওর ঘরে তো মনি আছে। সে সাথেসাথেই হিমাকে জানায় ব্যাপারটা। হিমার হাসি পায় কথাটা শুনে। ওর খুব ইচ্ছে হয় নীল ঘরে গিয়ে মনিকে নিজের রুমে দেখে কেমন রিয়েক্ট করে। সে ফিসফিসিয়ে আশাকে বলে
-চল তো গিয়ে দেখি।
-হুম চলো।

আশা আর হিমা এগিয়ে যেতে থাকে নীলের রুমের দিকে।

প্রখর যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে মনি। এক রাশ যন্ত্রণা নিয়ে ছটফট করতে করতে বিছানায় শুয়ে আছে সে। ভালো লাগছেনা তার কিছুই। এ কি হয়ে গেলো তার সাথে। মনের ভিতর থাকা সুপ্ত বাসনাটাও আজ দুঃস্বপ্ন হয়ে গেলো। মনির চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে আসে।।

________
ঘরে ঢুকে মনিকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয় নীল। এটা তারই রুম তো? হয়তো না, ভুল করে সে হয়তো অন্য রুমে চলে এসেছে। নীল কোনো শব্দ না করে বেরিয়ে পরে রুম থেকে। পরক্ষণে মনে হয়, এটাইতো ওর রুম।। সে কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করে আবারও রুমে গিয়ে ঢুকে। ওর উপস্থিতি টের পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসে মনি। ভীত গলায় বলে
-আ আপনি?
-এটা কি আমার রুম?

মনির মনে হয়, আশাপু বলেছিলো এটা ওর ভাইয়ের রুম। কিন্তু এ কথাটা মাথায় ছিলোনা তার। মনে থাকলে নীল এসেছে দেখার পরেও এ রুমে সে কখনোই পা বাড়াতো না।

তবে নীলের প্রশ্নে কিছুটা অবাক হয় মনি। নিজের রুমের কথা কেউ কি করে ভুলে যেতে পারে? মনির ভাবনাচিন্তার মাঝে নীল আবারও বলে
– হুম, এটাই আমার রুম।। তার মানে আমার স্মৃতিশক্তি ড্যামেজ হয়নি।
মনি বিছানা ছেড়ে নেমে স্মিথ হেসে বললো
-জ্বি, এটাই আপনার রুম।
-কিন্তু আপনি?
-আমি এ রুমে কয়েকদিনের মুসাফির ছিলাম।

নীল হাসলো মনির কথায়। বলল
-বাহ, পুচকি মেয়ের মুখে অনেক মিষ্টি কথার ছড়াছড়ি। তা ম্যাডাম, আপনি আমার বোনের বান্ধবী হলেন কি করে? আমার বোনটার সময়মত বিয়ে হলে তো আপনার মতো কয়েক ডজন বাচ্চাকাচ্চা থাকতো।

দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো হিমা আর আশা। নীলের কথায় হিমা হেসে ফেললো শব্দ করে, কিন্তু ভীষণভাবে রেগে গেলো আশা। এ কি বলে তার ভাই? সে রেগেমেগে ভিতরে ঢুকে নীলের পিঠে শক্ত করে এক কিল বসিয়ে দেয়।

নীল শব্দ করে বলে উঠে
-আউচ…মারলি কেন আবার?
-আমি বুড়ি?
-আমি কখন বললাম তুই বুড়ি?
-তাহলে বললি কেন, সময়মত বিয়ে হলে মনির বয়সী আমার কয়েক ডজন বাচ্চাকাচ্চা থাকতো?
-এক মিনিট, তুই কি আড়ি পেতে ছিলি?
-আমি না, ভাবী ছিলো। আমিতো মনিকে নিতে এসেছিলাম। হয়তো এসে ভালোই করেছি, তা নাহলে তো জানতেই পারতাম না, তুই আমার সম্পর্কে এইসব ভাবিস।।
-ঠিকই ভেবেছি। তোর চেয়ে ছোট ছোট মেয়েগুলো গিয়ে দেখ বিয়ে করে সংসার করছে, আর তুই বসে বসে বুড়ি হচ্ছিস।

আশা রেগে বললো
-আমাকে এমন একজন দেখা, যে আমার ছোট আর সংসার করছে।
নীল হেসে বললো
-তোর সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে। বেচারি মনির আর কতোটুকুই বা বয়স, এই বয়সে দেখ, বিয়ে করে বাচ্চার মা ও হয়ে যাচ্ছে। কি ঠিক বললাম তো মনি?

নীলের কথায় আঁতকে উঠলো মনি। চোখদুটো আবারও ভিজে গেলো তার। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে সে ভেজা গলায় বললো
-আমি যাচ্ছি এখান থেকে।

মনি ছুটে চলে গেলো। নীল বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। অবাক হয়ে বললো
-এমন কি বললাম যে এভাবে মন খারাপ করে চলে গেলো?
-তুই ওর কলিজায় আঘাত করেছিস ভাইয়া।
কথাটা বলে আশাও ছুটলো মনির পিছু পিছু। নীলের মাথায় কিছুই ঢুকলোনা। সে আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে থেকে মাথা চুলকাতে লাগলো।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here