মন মুনিয়া পর্ব-৩১

0
1511

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৩১

সন্ধ্যার রান্নাবান্নার ধকল সামলিয়ে সবেমাত্র ফ্রি হয়েছে হিমা। আশাও আজ যথেষ্ট খাটুনি করেছে। খুব ক্লান্ত লাগছে, ঘুম চলে এসেছে তার চোখে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। মুনিয়া এখনো ঘুমাচ্ছে। ওর পাশেই শুয়ে পরেছে আশা।

মনি বারান্দায় বসা ছিলো, আশার উপস্থিতি টের পেয়ে সে চলে এলো সেখান থেকে। আশাকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে সে মুচকি হেসে বললো
-কষ্ট হয়েছে আপু?
-হুম রে। ক্লান্ত গলায় বললো আশা।
-না খেয়ে ঘুমিয়ে পরো না যেনো। শরীর খারাপ করবে।।

আশা এবার শোয়া থেকে উঠে বসলো। মনিকে বললো
-তুই খাবিনা?
-ইচ্ছে করছেনা।
-তুই না খেলে কিন্তু বাবুবিও খাবার পাবেনা কথাটা মনে রাখিস।।
-মনে আছে আশাপু।
-আয়, খেয়ে আসি।
-মুনিয়াকে একা রেখে যাবো?
-এক কাজ কর, তুই খেয়ে আয়। আমি বসছি বাবুর কাছে।

মনি বিছানার এক পাশে বসে বললো
-থাক আশাপু। তুমি খেয়ে আসো, আমার আজ সত্যিই খেতে ইচ্ছে করছেনা।

আশা বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো
-আচ্ছা, তুই বস বাবুনির কাছে। আমি আসছি।

মনি আর কিছু বললোনা। আশা চলে গেলো কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে।।
মনি বিছানাতে বসেই মুনিয়া মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো অপলকভাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্রেতে করে দুই প্লেট ভাত আর আর তরকারির বাটি নিয়ে রুমের দিকে রওনা করলো আশা। আরিশা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে টিভি দেখছিলো। আশাকে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে সে প্রশ্ন করলো
-খাবার নিয়ে কোথায় যাচ্ছো আশা?
-দেখতেই পাচ্ছো রুমে যাচ্ছি।
-তা দেখছি, কিন্তু রুমে নিয়ে যাচ্ছো কেন?
-খাবার নিয়ে যেহেতু যাচ্ছি, তা খাওয়ার জন্যই নিয়ে যাচ্ছি।

আরিশা মুখ বাকিয়ে বললো
-আমার সাথে তুমি সবসময় ত্যাড়া বাকা কথা বলো কেন?
-কোথায় ত্যাড়া বাকা কথা বললাম? আমার তো মনে হচ্ছে আমি ঠিক করেই কথা বলছি।

আরিশা হাসলো। সে হাসির কারণ আশার বোধগম্য হলোনা। তাই সেইসবকে উপেক্ষা করে খাবার হাতে নিয়ে রুমের ভিতর ঢুকে গেলো আশা।

দুইজন মিলে ভাত খাওয়ার এক পর্যায়ে আরিশা এসে রুমে ঢুকলো। আরিশাকে দেখে আশার মধ্যে কোনো পরিবর্তন এলোনা। সে দেখেও যেনো না দেখার মতো করে খেতে লাগলো। আরিশা কপাল কুচকালো আশার এমন বিহেভিয়ার এ। মনি হেসে বললো
-আরিশা আপু, বসুন এখানে।
-আমি বসতে আসিনি মনি, দেখতে এসেছি।

-কি দেখতে এসেছো আরিশা?
নীলের কথায় দরজার দিকে তাকালো আরিশা। নীল আবারও প্রশ্ন করলো
-বললেনা যে কি দেখতে এসেছো?
আরিশা কপাল কুচকে বললো
-আসলে নীল ভাইয়া, আমি দেখতে এসেছিলাম এখানে কি হচ্ছে, আশা কার জন্য আদিখ্যেতা করে খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমি হতবাক হয়ে গেছি জানো তো।
-কেন? ভ্রু বাকিয়ে বললো নীল।

আরিশা তাচ্ছিল্যের সাথে হেসে বললো
-আমি ভাবতেও পারছিনা তোমরা তোমাদেরই আশ্রিতা একটা মেয়েকে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা করছো।
-লিমিটের বাইরে যেওনা আরিশা। আমি আগেই বলেছি ও কোনো আশ্রিতা মেয়ে না।
আশার কথায় আরিশা হাসলো। বললো
-ওহ আচ্ছ, তাই নাকি? তো আশ্রিতা না হলে এখানে পরে আছে কেন? আমার জানামতে ও আমাদের কোনো আত্মীয় তো না। তাহলে কেন পরে আছে?

নীল খেয়াল করলো মনির চোখের পানি ছলছল করছে। কেন জানি খুব ব্যাথা অনুভব করলো সে। সহ্য হচ্ছেনা সে চোখের পানিধারা।

নীল রাগীচোখে আরিশার দিকে তাকালো। কিড়মিড় করে বললো
-আসার পর থেকেই দেখছি মনিকে হেনস্থা করার জন্য তুমি উঠেপড়ে লেগেছো। সমস্যা কি তোমার? কেন করছো এমন?
-অনেক সমস্যা। আমাকে তোমরা সমানভানে ইগ্নোর করে যাচ্ছো, কেন? ওর চাইতে আমি কি কোনো অংশে কম? বরং অনেক বেশি আছি। ওর কি আছে? না আছে মাথা গুজার ঠাই, আর না আছে লেখাপড়া। এক মুর্খ মেয়েকে নিয়ে কেন এতো আদিখ্যেতা করছো তোমরা?

মনির আর সহ্য হচ্ছেনা কথাগুলো। সে পানির গ্লাসটা নিয়ে ভাতসহ প্লেটের মধ্যেই হাত ধুয়ে ফেললো। এরপর আরিশার সামনে গিয়ে দাড়িয়ে ভেজা গলায় বললো
-দয়া করে আমার জন্য আপনারা নিজেদের মধ্যে অশান্তি করবেন না। আমি চলে যাবো।

মনি দম নিলো। এরপর আবার বললো
-আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আমি এ বাড়ির এক আশ্রিতা মেয়ে, তাই হাটুগেড়ে বসে আছি এখনো। যাওয়ার নামটা পর্যন্ত নিচ্ছিনা। আমার বুঝা উচিৎ ছিলো, এতো এতো শিক্ষিতের ভীরে আমার মতো অশিক্ষিত এক মেয়ে বড়ই বেমানান।
আরিশা রাগ দেখিয়ে বললো
-বুঝেছো যখন এক্ষুনি চলে যাও এখান থেকে। এই মুখটা যেনো আর না দেখি তোমার। নিজের ঠাই হয় না, আবার এক মেয়ে নিয়ে পরে আছো, অন্যের অন্ন ধ্বংস করছো।

মনি অসহায়ভাবে তাকালো আরিশার দিকে। আরিশা আবারও তাচ্ছিল্য করে মনিকে বললো
– আচ্ছা, এ মেয়ের কোনো পিতৃপরিচয় আছে তো? নাকি ওটা তোমার বিজনেসের ফল?

মনি আঁতকে উঠলো আরিশার কথায়। কথাটা একেবারেই সহ্য করতে পারলোনা সে। চোখের পানি ওড়না দিয়ে মুছে এক দৌড়ে সেই যায়গা ত্যাগ করলো মনি।

আশার রাগ এবার সপ্তম আসমানে। সে তেড়ে আসলো আরিশার দিকে দুটো কথা শুনানোর জন্য। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই আরিশার গালে ঠাস ঠাস করে দুটো চর বসিয়ে দিলো নীল। আশা সে যায়গাতেই থমকে গেলো। হটাৎ ই নীলের অন্য একটা রুপ দেখতে পেলো সে।

আরিশা গালে হাত দিয়ে বিস্মিত চোখে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোটগুলো তার রাগে কাপছে। কাপা কাপা ঠোঁটে অস্পষ্ট ভাষায় সে বললো
-একটা রাস্তার মেয়ের জন্য আমাকে তুমি মারলে?
-বেরিয়ে যা এই বাড়ি থেকে।

আরিশা অবাক হলো। নীল অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আরিশা বললো
-কি বললে, কি বললে তুমি?
-এই মুহূর্তে তোকে এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছি।
-ভুল করছো, বড় ভুল করছো।
নীল এবার চিৎকার করে উঠলো। বললো,
-তুই নিজে যাবি, নাকি আমি তোর ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়ে আসবো?

আরিশা হনহন করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আরশিয়ার কাছে গিয়ে সে কাঁদো কাঁদো গলায় শাক্তমতে বললো
–চলো মা।।
আরশিয়া অবাক হয়ে বললো
-কোথায়?
-বাড়ি যাবো।।
-এখন বাড়ি যাবি মানে? আজই তো আসলাম, তুই তো বলেছিলি কিছুদিন থাকবি।
-তুমি যাবে নাকি আমি একাই চলে যাবো?

আরিশা আর আরশিয়ার কথা শুনে রাবেয়া ছুটে এলো তখন। সে হন্তদন্ত হয়ে বললো
-কি হয়েছে তোদের?
-আমি চলে যাচ্ছি খালামনি?
-কেন? অবাক হয়ে বললো রাবেয়া।
আরিশা চোখমুখ শক্ত করে রাবেয়ার দিকে তাকালো। কড়া গলায় বললো
-কারণটা তোমার আদরের ছেলে মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো।
-কি করেছে ওরা?
– খাল খেটে কুমির এনেছো বাড়িতে। কি আর করবে, পরকে ঘরে রেখে ঘরের মানুষকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করছে।
-তুই কি করেছিলি?

রাবেয়ার কথায় চমকে তাকালো আরিশা। অবাক কন্ঠে বললো
-আমি কি করেছি মানে?
রাবেয়া বললো
-আমি আমার ছেলেমেয়েদের চিনি আরিশা। ওরা এমনি এমনি কিছু করেনা।
আরিশা রাগ দেখিয়ে বললো
-তবে থাকো তুমি তোমার ওই ছেলে মেয়ে আর আশ্রিতাকে নিয়ে। আমি আর আমার মা এখানে আর এক মুহুর্তও না।

আরিশা আর ওর মা চলে যাবার পর আশার কাছ থেকে সমস্ত ঘটনাটা শুনলো রাবেয়া। প্রচন্ড রাগ হলো তার আরিশার প্রতি। মেয়েটা এতোটা বেপরোয়া আর অবাধ্য যে রাবেয়াও ওকে পছন্দ করেনা। শুধুমাত্র বোনের মেয়ে বলে ওর করা সমস্ত বাড়াবাড়ি তিনি মুখ বুজে মেনে নেন।

_____
মন খারাপ হলে বারান্দাটা যেনো মনির পরম সঙ্গী হয়ে যায়। মন খারাপের সময় বারান্দার সঙ্গ তার পেতেই হবে। বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মনি ভাবে, “এ চাঁদের গায়েও তো অসংখ্য কলঙ্কের ছিটেফোঁটা আছে, কই তাকে তো কেউ কখনো অবহেলা করেনা, বরং এ চাঁদের আলো গায়ে মাখাতে সবাই উৎসুক, উদগ্রীব। তাহলে আমার এতোটুকু কলঙ্কের মাঝে সবাই কেন এতো দোষ খুজে বেড়ায়?

মনির ভাবনার জগৎ থেকে বিচরণ করার সময় ওর ভাবনায় বিচ্ছেদ করায় নীল। মনির পিছনে এসে দাড়িয়ে সে মনিকে প্রশ্ন করে,
-এখনো কাঁদছো?
-নাহ। চাঁদের পানে তাকিয়ে উত্তর দেয় মনি।
-একটা কথা বলবো?
-হুম।
-তুমি কি আর পড়ালেখা করতে চাও না?
-সাধ থাকলেও সাধ্য নেই।

নীল কিছু বললোনা। সে কিছু একটা ভেবে চলে গেলো সেখান থেকে।

পরেরদিন সকাল সকাল মনিকে রেডি হতে বলে বাইরে বেরিয়ে আসে নীল। মনি হতবাক হয়।

কিসের জন্য সে রেডি হবে, কোথায় যাবে?
এক সময় এইসব ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে মুনিয়াকে কোলে নিয়ে হাটতে থাকে সে। আশা এসে তাড়া দেয় মনিকে। বলে
-তুই এখনো রেডি হোস নি? ভাইয়া কখন বলে গেছে তোকে রেডি হওয়ার জন্য? তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। তা নাহলে ভাইয়া কিন্তু ক্ষেপে যাবে।
-আমি কোথায় যাবো আশাপু? বিস্ময় ভরা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে মনি।
-সেটা গেলেই দেখতে পাবি।
-আমি কোথাও যাবো না।।
-মার খাবি বলে দিলাম। যা রেডি হয়ে আয়।

মনি দোনোমোনো করে বলে
-আর মুনিয়া?
-ও আমার কাছে থাকবে।।
-মানে? অবাক হয় মনি।
-এতো অবাক হচ্ছিস কেন? আমার কাছে তোর মেয়ে থাকলে কিচ্ছু হবেনা। তুই রেডি হয়ে আয় তো।।
-ও কাঁদবে আশাপু।
-কাঁদবেনা। তুই যা।

মনি বিস্ময় নিয়ে রেডি হতে চলে যায়। কিছুক্ষন বাদে কোথা থেকে ফিরে এসে মনিকে নিয়ে বেরিয়ে পরে নীল। রাস্তায় বার বার প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পায়না মনি, ও কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে কোনো কিছুই বলেনা নীল।।শুধু বলে, “গেলেই দেখতে পাবে।।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ সিএনজি তে অতিক্রম করে একটা সময় গন্তব্যে এসে পৌঁছে ওরা।

গাড়ি থেকে নেমে মনি অবাক হয়। সে হতভম্ব হয়ে নীলের দিকে তাকায়। মনির তাকানো দেখে নীল হাসে। মনি বিস্ময়ে বলে
-এটাতো একটা কলেজ। আমরা এখানে কেন এসেছি?
নীল আবারও হাসে। অদ্ভুত সেই হাসি। মনি অবাক হয়, তবে ধরতে পারেনা সে হাসির কারণ।

চলবে……

তোমাদের উপর আমি খুব রেগে আছি😶
কারণ তোমাদের মধ্যে অনেকেই এখনো আমার এই ছোট্র পেইজটাতে লাইক দাও নি😪😪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here