মন মুনিয়া পর্ব-৪১

0
1565

#মন_মুনিয়া
তন্বী ইসলাম -৪১

কলেজের গেইটের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে আছে আশা। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাক, আবার ইচ্ছে করছে ছেলেটার মুখের উপর কয়েকটা চটাং চটাং জবাব দিয়ে তার পর যাক। সারা শরীরে জ্বালা ধরে আছে আশার। মাঝে মাঝে হতাশ হচ্ছে এটা ভেবে যে, ওরই সামনে থেকে একটা ছেলে কিভাবে ওকে এভাবে বুড়ি বলে চলে যেতে পারলো? আর সেও এটা কিভাবে হজম করলো?

আশা কয়েক মিনিট এক নাগাড়ে গেইটের সামনে পায়চারি করতে লাগলো। গেইটের দারোয়ান চাচাটা বেশ খানিক্ষন ধরেই এটা খেয়াল করে যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি আশাকে জিজ্ঞাস করলেন
-মা, কি হইছে আপনের?
-কিছু হয় নাই চাচা।
-তাইলে এমন করতাছেন কেন?

আশা কি বলবে কিছু বুঝতে না পেরে বললো
-জানিনা চাচা, ভালো লাগতেছে না।
দারোয়ান টি আর কোনো কথা বাড়ালো না। আশা এবার ডিসিশন নিলো, আর দাঁড়িয়ে থাকবেনা এখানে। এবার চলে যাওয়াটাই উত্তম হবে। আশা গেইটের বাইরে বেরোবার জন্য পা বাড়ালো। এর মধ্যে আরো একবার কি যেনো মনে করে পিছন ফিরে তাকালো সে। তক্ষুনি চোখ ছানাবড়া তার। সে গেইটের বাইরে পা দিতে গিয়েও দিলো না। বরং আরও দু কদম এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।

ছেলেটি আরো কয়েকজনের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছে। লোকগুলো থাকায় সৌজন্য বশত আশা কিছু বললোনা। কয়েক মুহূর্ত বাদে বাকিরা চলে গেলে আশা নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিছুটা জোরে ডাক দিলো
-এই মিস্টার খাম্বা।
আশার কন্ঠস্বরে ছেলেটি আশার দিকে আড়চোখে তাকালো। এরপর আবার দৃষ্টি সরিয়ে নিলো ঝটপট। আশার ডাকে কোনো পাত্তা না দিয়ে সে ডিপার্টমেন্টের দিকে হাটা ধরলো। আশা কিছুটা রাগ দেখিয়ে এগিয়ে গেলো তার কাছে।

লোকটার কাছাকাছি গিয়ে আশা বললো
-আপনার নামে আমি পুলিশে কমপ্লেইন করবো।
ছেলেটি সামনের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল
-ওকে।
আশার রাগ হলো। সে বললো
-আপনার নামে আমি মানহানির অভিযোগ করবো।
-সেটা আপনার পার্সোনাল ম্যাটার। করতেই পারেন, তবে আমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করছেন কেন।
-আমি আপনাকে বিরক্ত করছি?
-অবশ্যই।
-দেখুন..

লোকটি এতোক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলেও এবার আশার দিকে ফিরলো। চোখের চশমাটা খুলে সেটা মুছে আবারও চোখে লাগিয়ে বললো
-আপনার বাচ্চার সাথে দেখা হয়েছে? কখন থেকে ঘুরঘুর করছেন, দেখা না হলে বলুন, আমি আপনাকে সাহায্য করবো।
-এই মিস্টার খাম্বা, বার বার আমাকে এইসব কেন বলছেন? আমার কিন্তু এখন আর সহ্য হচ্ছেনা।
-এই যে মিসেস গার্জিয়ান, সেই তখন থেকে আমার পিছনে কেন লেগে আছেন?
-আমি আপনার পিছনে লেগে আছি?
-আমার তো তাই মনে হচ্ছে। ভালো লেগেছে আমাকে? পটাতে চান? কোনো লাভ নেই, আমি পটবো না।

আশা অপমানিত বোধ করলো প্রচন্ড। সে দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে কিছু বলতে গিয়ে বললোনা। লোকটি ঠোঁটের কোনে এক চলতে হাসি টেনে বললো
-স্বামী সন্তান নিয়ে সুখে টানুন। টাটা..

ছেলেটি চলে গেলেও আশা নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। কান্না করতে ইচ্ছে করছে খুব। জীবনের প্রথমবার কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলেছে। আশা এবার আর সেখানে দাড়ালোনা, হাটা শুরু করলো নিজ গন্তব্যে।

দুপুরে টিফিন পিরিয়ডের সময় মনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলো। এ পর্যন্ত চারটে ক্লাস হয়েছে, টিফিন পিরিয়ডের পর আর দুটো হবে। তবে আর একটা ক্লাসও করা যাবেনা। মুনিয়াও বোধহয় এতক্ষণে কান্না করছে। মেয়েকে কাঁদিয়ে নিজের স্বার্থ খুজা বেশ অস্বস্তিকর লাগছে মনির কাছে। সে বইয়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে লাগলো। আশাপু তো নেই।

মনি বেশ চিন্তায় পরলো এবার। আশাপু যদি এখনো না এসে থাকে, তাহলে কিভাবে সে বাড়ি যাবে? পথ ঘাট তো তার অচেনা। মনির কপালে ভাজ এলো।
তার চোখগুলো এলোপাতাড়ি ভাবে আশাকে এখনো খুজে যাচ্ছে।

অনেক্ষন কেটে যাবার পরেও আশাকে দেখতে না পেয়ে নিরাশ হলো মনি। ভেবে নিলো, একেবারে ছুটির বেলাতেই মনে হয় সে আসবে। আশা হতাশ হয়ে ঘুরে দাড়ালো। বাকি ক্লাসগুলোও করতে হবে বিধায় সে ক্লাসরুমের দিকে পা বাড়ালো। ঠিক তখনই ওর পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেলো মনি।

আচমকা কেউ ওর পিঠে হাত রাখায় চমকে উঠলো সে। ভয়ার্থ গলায় বললো
-কেহ।
মনি ফিরে তাকালো। নীল ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। মনির ধরে প্রাণ এলো। সে বললো
-আপনি? আমিতো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম। ভাবলাম কে না কে।
-এখন স্বস্তি?
-হুম।
-তাহলে ধরে নিই, আমাকে তুমি মেনেই নিয়েছো?

মনি কিছু বললোনা নীলের কথায় পিঠে। তবে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো
-আশাপু আসেনি?
-নাহ, আমাকে পাঠিয়েছে।
-ওহ।

কলেজ গেইটের সামনে থেকেই একটা রিক্সা নিলো নীল। মনিকে হাতের ইশারায় উঠতে বলে নিজেও উঠে গেলো। মনি বেশ ইতস্তত বোধ করতে লাগলো, নীলের পাশে বসাটা বেশ অস্বস্তিকর তার লাছে। মনির এমন অস্বস্তি দেখে নীল মুচকি হেসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো
-স্বামীর কাছে এতো কিসের লজ্জা। একটু স্বাভাবিক হও। তাহলে তো লোকজন ভাববে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করছি।

মনি চোখ বড় করে তাকালো নীলের দিকে হাসলো। রিক্সাওয়ালাকে এগুতে বলে নীল মনিকে বললো
-এভাবে তাকিও না বউ, ভয় লাগে।
-আপনি মুখটা বন্ধ করবেন?
নীল হেসে বললো
-আপনার হুকুম আমি মাথা পেতে নিলাম ম্যাডাম।

মনি একভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। রিক্সা চলেছে অবিরামভাবে। একটা সময় মনির মনে হল, তারা অন্য রাস্তায় যাচ্ছে। আসার সময় রাস্তাটা এমন ছিলোনা তো। মনি বিস্ময়ে নীলের দিকে তাকিয়ে বললো
-আমরা কি অন্য কোনো রাস্তায় যাচ্ছি?
-আমরা ঠিক পথেই যাচ্ছি।
-আসার সময় তো এমন ছিলোনা রাস্তাটা। কোথায় যাচ্ছি আমরা? বাড়ি যাচ্ছি তো?
-গেলেই দেখতে পাবে।

মনির কিছুটা সন্দেহ হলো। সে কিছুটা রাগ দেখিয়ে বললো
-সত্যি করে বলুন আমরা কোথায় যাচ্ছি। তা নাহলে কিন্তু আমি রিক্সা থেকে নেমে পরবো।
-নামবে?
-হুম।
-নেমে দেখাও দেখি।

চলন্ত রিক্সা থেকে নামার মতো সাহস মনির নেই।।রিক্সাওয়ালাকে বললেও থামবেনা সে জানে। মনি বললো
-আমি চিৎকার করবো।
-করো।
মনি হতাশ হলো। বললো
-আমি বাড়ি যাবো, মুনিয়া কাঁদছে হয়তো।
-মুনিয়া ঠিক আছে, আমি দেখে এসেছি। সবার সাথে আনন্দ ফুর্তিতেই আছে মামনিটা।

মনি বুঝতে পারলো, এখন সে যতো যাই বলুক, কোনো লাভ হবেনা। তাই সে নিরবে বসে রইলো চুপ করে।
একটা সময় রিক্সা এসে দাড়ালো নিজ গন্তব্যে। নীলের কথামতো সে রিক্সা ছেড়ে নামলো। ভাড়া মিটিয়ে নীল মনিকে ইশারা করলো সামনের দিকে হাটার। মনি হাটলো না। সে মুখভার করে নিজ যায়গাতে দাঁড়িয়ে রইলো। নীল মুচকি হেসে বললো
-আমি বুঝতে পেরেছি।
-কিহ? অবাক হয়ে বললো মনি।

নীল মুখে কিছু না বলে চট করে মনিকে পাজাকোলে নিয়ে নিলো। মনি হতবাক। এটা কি হয়ে গেলো? সে হাত পা ছুড়াছুড়ি করছে তাকে নামানোর জন্য। নীল ফিসফিস করে বললো
-এতো লাফালাফি করোনা তো। হাটতে সমস্যা হয়।
-আমাকে নামান বলছি।।
-নামাবোনা।
-নামান প্লজ।
-ঠিক আছে, তবে একটা শর্ত আছে।
-কি শর্ত।
-আমার হাত ধরে তোমাকে হাটতে হবে। রাজি?
-পারবো না।
-আমিও নামাবোনা।

মনি হতাশ হলো। এক পর্যায়ে সে বললো
-ঠিক আছে। তবুও কোল থেকে নামান।
-দ্যাটস গুড।
মনিকে নামিয়ে দিলে মনি গা ঝাড়া দিলো। রাগীচোখে তাকালো সে নীলের দিকে। নীল হেসে হাতটা মনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
-হোল্ড মাই হ্যান্ড।
মনি রেগেমেগে খামছে ধরলো নীলের হাত। চোখেমুখে তার প্রচন্ড ক্ষোভ। নীল হেসে বললো
-তাতেই আমার চলবে, তোমার তিক্ত আক্রমণ আমার কাছে বরাবরই মিষ্টি মনে হয়। মনি ফোস করে কিছু বলতে গিয়েও বললোনা।

একটা বিশাল বিস্তৃত লেক। তার পাশদিয়ে অনেক মানু্ষের সমাগম। গাছগুলো সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে। লোকজন সৌন্দর্য উপভোগ করায় ব্যস্ত। মনি এতোক্ষণ রেগে থাকলেও এতো সৌন্দর্য দেখে রাগ তার নিমিষেই মিলিয়ে গেলো। সে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো চারপাশটা। আর নীলের নজর তখন তার মায়াবতীর দিকে। মনির এ মায়াভরা মুখটার দিকে সে সারাজীবন তাকিয়ে থাকতে পারবে।

মনির হটাৎ খেয়াল হলো নীল ওর দিকে তাকিয়ে আছে। এতোক্ষণ রাগ করলেও এবার তার মধ্যে লজ্জার উদয় হলো। না পারছে নীলের দিকে তাকাতে আর না পারছে ওর তাকানোকে ইগ্নোর করতে। প্রচন্ড দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে সে নীলের দিকে তাকালো। নীলের হুশ এলোনা। সে এখনো তাকিয়ে আছে মনির দিকে। নীলের চোখ বরাবর তাকালো মনি। সে চোখের গভীরতা অনেক, নিমিষেই তলিয়ে যাওয়া যায়।

মনি মুহুর্তেই ভুলে গেলো তার নিজ সত্তা। পিছনের সবকিছু ভুলে সে নীলের মুগ্ধতার মাঝে হারিয়ে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। নীল একহাতে আরেকটু কাছে টেনে নিলো মনিকে। মনির হুশ নেই, সেও নীলের অতল গভীরে যেনো হারিয়ে যাচ্ছে। নীল মনিতে মগ্ন হয়ে বললো

“মায়াবতী, এ কোন জাদুতে মজিয়েছো আমায়। আমি আমারো অস্তিত্বে মিশিয়েছি তোমায়।

আমি বিলীনও হয়ে তোমারি মাঝে, মিশে যেতে চাইছি বারে বারে। তোমাতে মজে আমি, হারিয়েছি পথ। শেষ প্রান্তে গিয়েও বলতে চাই, আমার এ ধারায়, আমার সমস্ত কল্পনায়, তুমিই আমার সব।””

মনি ডুবে আছে নীলের মায়ায়। নীলও আজ মনিতে মগ্ন। আকস্মিক নীলের কি হলো, সে কোনো কিছু না ভেবে হটাৎ মনির কপালে আলতো করে এক চুমু দিয়ে বসলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here